মাগরিবের ছায়া

ভাটপাড়ার ষড়ানন এখন কাশীতে ব্রজসুন্দরের দৌলতে বাগিয়ে নেওয়া সোনারপুরার বাড়িতে কলির শঙ্করাচার্য হওয়ার মকশো আপাতত মুলতুবিই রেখেছে। বড়ছেলে শ্রীসুন্দরকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে ষড়াননের তাগিদ ভাটপাড়ার বুকে একটা আধটু ঘোর তৈরি করতে পারলেও কুমারহট্টের পন্ডিতসমাজ, বিশেষ করে বাঙাল পন্ডিতগুলোর বাড়বাড়ন্তের জল একদম পুকুর থেকে ছেঁচে বের করে দেওয়ার সবরকম চেষ্টা করেও ঠিক সফল হচ্ছে না ষড়ানন থেকে শ্রীসুন্দর। কুলিন বামুনদের দাপটের সে যুগ কি তবে শেষ হতে চলেছে?

 

 

'কাপের মেয়ে সাপে ছোঁয় না' - সেই প্রবাদ বাক্যি কি ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে যেতে বসেছে? শেতল মুখুর্জের দাপট কি শীতল হয়ে যাবে?   ' মাল ঠাকুর'  প্রশ্নটা প্রথম করেছিল ষড়াননের বড়ছেলে শ্রীসুন্দরকে। জনমালীর যে নাম এই ভাটপাড়া,  মুক্তোপুর,  নৈহাটি,  কাঁঠালপাড়া থেকে শুরু করে আতপুরের গলিঘুঁজিতেও কখন মাল ঠাকুর হয়ে গেছে সেটা যেমন শীতল মুখুজ্জেরা জানতে পারেনি,  তেমনিই পারেনি ষড়ানন থেকে শ্রীসুন্দরের মতো দাপুটে লোকজনেরাও। বল্লাল সেনের কৌলিন্য প্রথার রেশ বশিষ্ট গোত্রীয় ব্রাহ্মণদের গায়ে বিশেষ লাগেনি। তাই কুলিন বামুনদের সঙ্কট বা কাপ,  ছুরিত্তিরদের সমস্যাগুলোর সঙ্গে কখনোই যুঝতে হয়নি। আদতে খোট্টাইয়া সংস্কৃতির ধারা বহন করতে করতে হঠাৎই , বাঙালি হয়ে ওঠা , ষড়ানন- শ্রীসুন্দর , মাল ঠাকুরদের এই না যোজবার সমস্যাটা বাঙালরা পাত্তাই দিল না বলে বশিষ্টগোত্রীয়দের বেশ দুক্কু আছে মনে। কিন্তু এই বশিষ্ঠ গোত্রীয় বামুনদের , কুলিন বামুনদের বাড়ির মেয়েদের হঠাৎ হঠাৎ, ' এই কদিন আগে রেতের বেলা স্বামী এয়েচিল'  বলে সবদিক সামাল দেওয়ার ব্যাপার-স্যাপারগুলো একটু ভিন্ন বুদ্ধিতেই সামাল দিতে হত। কুলিন ঘরে সধবারা হঠাৎ হঠাৎ সন্তানসম্ভবা হলে যা হোক একটু মুখ লুকোবার উপায় ছিল। কাপ,  ছুরিত্তিরের ঘরে এসব সমস্যা বড়ো একটা দেখা যেত কি?  সাপই যে মেয়েদের ছোঁয় না,  তেমন দজ্জালদের বাইরের গোষ্ঠীর পুরুষেরা ছুইয়ে ফেলতে দেবে নারীরা -এটা কি কখনো বিশ্বাস করতে পারা যায়?

 

 

কিন্তু বশিষ্টগোত্রীয়দের ব্যাপার স্যাপারই ছিল আলাদা রকমের। ষড়াননের বড়ছেলে শ্রীসুন্দরকে ঘিরে পন্ডিত বাপের যতোটা আশা ভরসা ছিল,  ছোট ছেলে বিশ্বকে ঘিরে তার আশা ভরসা এখন ক্রমশঃ কেমন যেন সন্দেহের ঘোরপাশে ঘোরাফেরা করছে। তিলক গোস্বামীর তের বছরের বিধবা মেয়ে মানদা আর আর সুরেশ ঘোষালের ষোল বছরের বিধবা বোন হরিপ্রিয়াকে নিয়ে শেতল মুখুজ্জের বাড়ির সামনের ঘাট থেকে  বিশ্ব যখন নৌকো ছেড়েছিল তখন কনে দেখা গোধুলিতে নৈহাটি শহরটাকে দুই বালিকাই উদাস ভাবে দেখছিল। পার ঘেঁসে চলছিল নৌকাটা।বেশ বড় পাল তোলা নৌকা। স্রোতের উজানে চলেছে নৌকো। হাওয়া বইছে চারিদিকে তিরতির করে। ছইয়ের বাইরে বিশ্ব ঠাকুর বসে বসে হুঁকো টানছে। হুঁকোর দিকে তার মনে আছে কিনা কেমন একটা সন্দেহ মাঝিদের কারো কারো মধ্যে হচ্ছে।

 

বিশ্ব জোড়ে হাঁক পাড়লো; বলি ও নগেন,  কখন বেন বেলায় নৌকো ছেড়েচো। বাচ্চা মেয়ে দুটোর গলা যে এক্কেবারে শুকিয়ে কাট হয়ে গেছে। একটু শরবত বানিয়ে তাদের দিতে তোমায় সেই কখন বলেচি। তোমার হাতে কি বাতে ধরেছে? যাদের উদ্দেশ্যে এই কথাগুলো বললো বিশ্ব,  নৌকার সেই রাধুনী বামুন অনেক আগেই দুখানা শ্বেতপাথরের গেলাসে শরবত বানিয়ে রেখে দিয়েছে। কিন্তু যাদের খাওয়ার জন্য বিশ্ব ঠাকুর এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, সেই মানদা আর হরিপ্রিয়া শরবত খাওয়ার কথা শুনে আঁতকে উঠল। আজকে একাদশীর নির্জলা উপোস। এখনো সন্ধ্যা হয়নি। এই রাত পেরোলে তবেই সকালবেলায় ,চান করে সন্ধ্যান্নিকর পর, তবে পারন করে জল গ্রহণ। মানদা চুপি চুপি বলে হরিপ্রিয়া কে;

           

 

বিশ্ব ঠাকুর যে কোয়েচে শরবত খেতে। ঠাকুর কি ভুলে গেচে,  আজ একাদশী? এটা  ভাটপাড়াতে যদি একবারও কেউ শোনে, একাদশীর মদ্দ্যে ঠাকুরের আদেশে আমরা সরবত খেয়েচি,  তা মোদের বিশ্ব ঠাকুর, যত বড় ঠাকুরই হোক না কেন,  ন্যাড়া করে,  প্রাচিত্তির করে,  গোবর খাইয়ে ছাড়বে মোদের। হরিপ্রিয়া কথাগুলো শোনে। কথাগুলো তার কানে ঢুকছে কি না, ঠিক বুঝতে পারা যায় না। কারণ,  কোনও প্রত্যুত্তর করে না হরিপ্রিয়া। কথাগুলো কি হাওয়ায় ভেসে উজান স্রোতে কোন দূর অজানায় হারিয়ে গেল ? মানদা কেমন একটা চুপসে যায়। ভাবে চুপিসারে এসব বলা কি তার উচিত হল হরিপ্রিয়া কে?  কথাসব  ঠাকুরের যদি কানে যায়, তবে তো অনত্ত ঘটে বসতে পারে। যতক্ষণ না কাশীতে গিয়ে পা ফেলতে পারছে,  ততক্ষন তো ঠাকুরের অবাধ্য হলে চলে না। হরিপ্রিয়া চোখের সামনে ভাসতে থাকে নিজের শৈশবকাল। শৈশব কাটিয়ে কৈশোরে এখনো সে প্রবেশ করেছে এটা জোর দিয়ে বলতে পারা যায় না। স্বামীসঙ্গ?  হ্যাঁ, তা সে  করেছে বটে। কিন্তু সেটা সঙ্গ, মানে সোহাগ, না অত্যাচার, তা বুঝে ওঠার আগেই শাঁখা-সিঁদুর খোয়াতে হয়েছে হরিপ্রিয়াকে।

            

 

হরিনাথ তর্কভূষণের ছেলে রামনাথের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল হরিপ্রিয়ার আসলে বিয়ে না হয়ে উপায় ছিল না। বামুন ঠাকুরুণ রাধারানীর মেয়ে হরিপ্রিয়ার গর্ভবতী হওয়ার খবরটা তর্কভূষণ বাড়ির আর সবাই ঠিক মতো বুঝে না উঠলেও,  তর্কভূষণ ঘরণীর চোখ এতোটুকু এড়াতে পারল না। এই কাজটা যে কার ,তা বুঝতেও তর্কভূষণ ঘরণীর এতটুকু দেরি হয়নি। তাই রাতারাতি প্রায় পঙ্গু, শয্যাশায়ী ছেলের সঙ্গে বামুন ঠাকুরণের মেয়ের খুব ঘটা করেই বিয়ে দিয়েছিলেন হরিনাথ তর্কভূষণ। হারকিপটে হরিনাথ রাধুনী বামুনের মেয়ের বিয়ে,  এত ঘটা করে কেন দিচ্ছে, এই প্রশ্নটা অবশ্য ভাটপাড়ার সমাজে খুব একটা ওঠেনি। না ওঠার কারণ যে হরিপ্রিয়া অচঞ্চল কুমারীত্ব,  তা আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। তর্কভূষণ গিন্নির মাধ্যমে ভাটপাড়ার গণ্যমান্য সমাজপতিদের অন্দরমহলে তখন খবর পৌঁছে গেছে;  তর্কভূষণের গৌরীদানের বড় শখের কথা। সবাই তখন ধ্বন্নি,  ধ্বন্নি করছে তর্কভূষণের। সেদিন শীতলা মন্দিরের সামনে ভজা চাটুজ্জের মা তো বেশ নাটুকেপনা করেই আর দশজন গিন্নিকে বলে দিল;

       

 

আহা দেখেছ আমাদের পণ্ডিতের মনটা?  মেয়ে নেই, তাই গৌরিদান করতে পারলে না। সেই মনের দুক্কে এই পরের মেয়েকে গৌরী দান করে পুন্নি অর্জন করলে -এই বলে ভজা চ্যাটুজ্জের মা দুহাত তুলে জোরে পেন্নাম ঢুকে বসল। দেখাদেখি আর সব গিন্নিবান্নীরা পেন্নাম ঠুকলো, তবে তা কার উদ্দেশ্যে,  তা ঠিক বোঝা গেল না। রাধারানী কবে থেকে যে তর্কভূষণের হেঁশেলের দায়দায়িত্ব নিয়েছে, সেটা এখন আর বিশেষ কারো মনে নেই। কেউ কেউ বলে যে,  তর্কভূষণের মায়ের যখন অন্তর্জলী যাত্রা হল,  হরিনাথ তর্কভূষণের তখনও বে থা হয়নি। সংসার একেবারে ভেসে যায় আরকি। তখনই নাকি,  সেই সুন্দরবনের দিকের বোড়াল থেকে রাধারানী,  তর্কভূষণের হেঁশেলের দায়দায়িত্ব নিয়েছিল। পাঁচ মন্দিরের গায়ে শেতলা মন্দিরের রোয়াকে বসে যখন পাড়া কুঁদুলি গিন্নিরা,  শেতলা মায়ের পুজো দেওয়ার ফাঁকে, এসব নিয়ে তর্ক করে, তখন আর এ প্রশ্নটা উঠে আসে না যে, বিধবা রাধারাণী প্রথম থেকেই এই কোন্নেটি ছিল?  নাকি তর্কভূষণেল বাড়িতে সধবার একাদশীর মতো, বিধবার সন্তান প্রাপ্তি ঘটল।

            

 

কেউ কেউ আবার কূটতর্ক জুড়ে দেয়; আরে তিনদিন বললাম সরকারের ঘাটে থেকেও আবার তো মাকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনল হরিনাথ। তারপরে ছেলের বিয়ের সব। জোগারযন্তর করে,  টুকটুকে বউয়ের রাঙ্গা মুখখানা দেখে,  হঠাৎ একদিন ধড়ফড়িয়ে সন্ন্যাস রোগে মরে গেল সে বুড়ি। তারপল এল তর্কভূষণের বাড়িতে বামৌন ঠাকুরোন। -এই তর্ক চলতেই থাকে,  চলতেই থাকে,  চলতেই থাকে। কিন্তু সেই তর্কের অন্ধিসন্ধির ভেতরে চাপা পড়ে যায় তর্কভূষণের বাড়িতে আসার কল্যাণেই বিধবা রাধারানীর গর্ভবতী হওয়ার কথা। তবে রাধারানী যে তর্কভূষণের বাড়িতে এসেই গর্ভবতী হয়েছিল,  এই সত্যটা বোধহয় তর্কভূষণ ঘরণী জানেনা। আর জানে না বলেই, রাধারানীর কন্নে হরিপ্রিয়া মাত্র দশ বয়সে যখন কুমারী অবস্থায় গর্ভবতী হয়ে উঠলো, তখন কুলের মান রাখতে, নিজের রুগ্ন শয্যাশায়ী ছেলের সঙ্গে রাঁধুনির মেয়ের বিয়ে দিয়ে, নিন্দে মান্নির পরিবর্তে, সমাজের কাছ থেকে বেশ সম্মানের অধিকারীই হয়ে উঠলো।

               

 

হুঁকোর আগুন যে নিভে গেছে, সে দিকে খেয়াল নেই বিশ্বের। মনের আগুন,  শরীরের তাপ কমাতে বিশ্ব তখন জোরে জোরে হুঁকো টেনে চলেছে। টেনেই চলেছে। ভুটভুট করে হুঁকো টানলেও একটুও ধুঁয়ো সেখান থেকে বেরোচ্ছে না। এটা অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ্য করছিল নৌকার মাঝিরা। টিকে ধরিয়ে একজন এগিয়ে দিল বিশ্ব ঠাকুরের সামনে। বিশ্ব টিকেটাকে নিয়ে হুঁকোর মধ্যে ফেলে দিল আগুনটা। আগুন আগুনের মত জ্বলতে থাকলো। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় টান দিতে থাকল বিশ্ব। আবার ভুরভুর করে তামাকের ধোঁয়া বেরোচ্ছে। হুঁকোর বুড়বুড়ির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এই গুড়গুড় আওয়াজ ক্রমাগত ঘুন পোকার মতো সেই তখন থেকে বিশ্বের নানা চিন্তা-ভাবনার অদল বদল ঘটাতে থাকে। বিশ্বের ভিতর তখন উথালপাতাল হতে থাকে,  এই যে ছোট ছোট দুটো মেয়েকে ,কাশী বাস করাতে নিয়ে যাচ্ছে নৌকোয় করে, এই খবরটা তো এখন আর ভাটপাড়ার বুকে চাপা নেই। আর ভাটপাড়ার লোকেরাও মাঝেমধ্যেই তীর্থ ভ্রমণ করতে কাশীতে আসে। তাদের পরিবারের কারোর না কারোর সঙ্গে কখনও না কখনও মানদা, সৌদামিনীর দেখাও হয়ে যাবে। কেমন যেন একটা অসুস্থতা বোধ করতে থাকে বিশ্ব মুহুর্তের জন্যে। ওর পেটটা কেমন যেন গুড়গুড় করতে থাকে। এপাশ-ওপাশ করে, বেশ সশব্দে বাতকর্ম সারে।

         

 

বিশ্বের সশাব্দিক বাতকর্মের বিস্ফোরণে মানুদা আর হরিপ্রিয়া হঠাৎ পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। আর বেশ অনেকক্ষণ পর, চাপা হাসিতে ফেটে পড়ে। সেই হাসিটা চোখ এড়িয়ে যায় না বিশ্বে। হাসি দেখে দেখে বেশ খুশি হয়েছে সে। কারণ, এতক্ষণ ভয় ভক্তিসব দিয়েই মেয়েদুটোর মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করে সে সফল হয়নি। মেয়ে দুটোর মুখে হাসি ফোটানোর অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু সব চেষ্টাই জলে ভেসে গেছে, হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। সাথে বিশ্বর চিন্তা বেড়েছে। তাই তার সামান্য শারীরিক ভঙ্গিমায় মেয়েদুটোর মুখে হাসি আসার সুযোগটাকে কাজে লাগাতে দেরি করল না বিশ্ব ঠাকুর। এদিকে তর্কভূষণের বাড়িতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত এগোতে শুরু করলেও সব ঘরে ঘরে বাতি দেওয়া হয়নি। এই কাজটা ইদানীং হরিপ্রিয়াই করত। আজকে বাড়িতে সে না থাকায় ,এইবার কাজটা কে করবে, তা নির্দিষ্ট করে দেননি তর্কভূষণের অর্ধাঙ্গিনী। সেই কারণে বাড়ির ঠাকুর-চাকরেরা প্রথমটায় বুঝে উঠতে পারেনি কী করা উচিত।

                

 

ঠাকুরদালানে রাধারানী সন্ধে দেখিয়েছে। প্রদীপ হাতে করে ভেতরের দিকে দেখিয়ে, প্রদীপটা আবার ঠাকুরদালানে রেখে দিয়ে, শাঁখে তিনবার ফুঁ দিয়ে যখন ধীরে ধীরে ভেতর বাড়িতে ঢুকলো রাধারানী, তখনই হঠাৎ মনে পড়ে গেল তার মেয়েটার কথা। হু হু করে উঠলো বুকের ভেতরটা। এতক্ষণ কাজের ভিতর থাকার দরুন,  নিজের মেয়েকে নিয়ে ভাববার তেমন একটা অবসর পায়নি বেচারী। এই সন্ধে দেওয়ার কালে এই ছোট্ট একখানা সাদা থানকাপড় পড়ে ঘরে ঘরে সেজের বাটি, কোথাও হেরিকেন পৌঁছে দেওয়ার জন্য ছোটাছুটি করতো মেয়েটা। এই দৃশ্যটা আর কারুর কাছে ভালো লাগুক আর না লাগুক,  রাধারানীর মনের ভেতরে একেবারে গেঁথে গিয়েছিল। তাই হঠাৎ যখন মনে পরল মেয়েটা তার কোন ঘাট আঘাটা পেড়িয়ে বিশ্বনাথের চরণে ঠাঁই পেতে চলেছে, চোখের জল আর ধরে রাখতে পারল না রাধারাণী। মাঝে মাঝে দাদা সুরেশের উপর খুব রাগ হয় রাধারাণীর। দাদা যখন কড়ে রাঢ়ী রাধাকে এই তর্কভূষণের বাড়িতে রেখে দিয়ে গেল,  তখনও বোধহয় রাধার সিঁথির কোলে সিঁদুরের আভা ছিল। আজ রাধা ভাবে, সে কি সত্যিই এতোটা ভার হয়ে উঠেছিল দাদার?  এই হরিনাথের বাড়ির জোয়াল যেভাবে ঠেলছে সে গত বিশ বচ্ছর ধরে,  তেমনই না হয় ঠেলতো দাদার সংসারেরও জোয়াল। তা বলে তো আর দাদার সংসারে কড়ে রাঢ়ীর পেট হওয়ার দায় বইতে হত না তাকে।

                         

 

এলোমেলো ভাবতে ভাবতে একটা বড় সেজের বাতি নিয়ে হরিনাথের ঘরের দিকে যায় রাধা। চৌকাঠ পেরিয়ে ডুকতেই অভ্যর্থনা পায় বাড়ির গিন্নির; তোমাকে আগেই বলেচি, এইসব মাগীদের বেশি জো দিয়োনা কো।তা শুনলে তুমি আমার কথা? মাগীর মেয়ে বাইরের নোকের হাতে পেট করে,  পেট খসিয়ে,  স্বোয়ামীকে খেয়ে কাশীবাস করতে চললেন আর সেই দুক্কে মাগীর মা, ভাতারখাকী এই ভরসন্ধেতেও ঘরে একটু বাতি দেকালোনি কো। গিন্নির কথা ভালো লাগছে না তর্কভূষণের।পৈতে দিয়ে পিঠ চুলচোচ্ছে আর এলোমেলো ভাবে হাতের কাছে পড়ে থাকা তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া খাচ্ছে। এমন সময়েই সেজের আলো নিয়ে রাধারাণীকে ঘরে ঢুকতে দেখে তর্কভূষণ একটু অপ্রস্তুত ই হয়ে গেল। হরিনাথ মনে মনে ভাবল, গিন্নীর কথাগুলো কি রাধারাণীর কানে গেল?  আসলে রাধা যে কি মনের কষ্টে আছে সেটা আর কেউ বুঝুক আর নাই বুঝুক হরিনাথ খুব ভালো করে বোঝে। এখন পারতপক্ষে রাধার সাথে সরাসরি কথা বলে না সে। ভাটপাড়ার গন্নিমান্নি পন্ডিত হিসেবে হরিনাথের নাম এখন এলাকার ভূগোল ছাপিয়ে গোটা বাংলায় ছড়িয়েছে। রাজা রাধাকান্ত দেবের পরামর্শদাতা হিসেবেও তর্কভূষণের খ্যাতি ছড়িয়েছে।

 

 

খ্যাতির শীর্ষে উঠতে গেলে যে রাজারাজরাদের অনুগ্রহ চাই, এটা হরিনাথ প্রথম জীবনেই বুঝেছিল। আর বুঝেছিল তর্কের বিপরীতে রাখতে হবে এমন মানুষজনদের,  যাদের সঙ্গে তর্কে জেতা-হারাটা বিষয় নয়, তর্ক যে করেছিল, সেটাই খ্যাতি এনে দেবে। তাই শোভাবাজারের রাজার লোক হয়ে বিধবা বিবাহ ঘিরে বিদ্যাসাগরের নামে কুৎসা করে হরিনাথের খ্যাতি এখন একটু আধটু ফোর্ট উইলিয়ামের ভিতরেও ছড়িয়েছে।হরিনাথ বুঝেছে,  সাহেব সুবোদের বিদ্যেসাগর কব্জা করতে পারলেও, তাদের সব্বাইকে যে কব্জা করতে পেরেছে, তেমনটা ভাববার কোনো কারণ নেই। পল্টনের যুদ্ধে সাহেবদের জন্যে রাধাকান্ত দেব যে সেবাটা দিয়েছে, তার জেরে সাহেবসুবোদেরও একটা বড় অংশ রাজাবাহাদুরের দিকেই যে আছে, সেটার প্রমাণ হরিনাথ হাতেনাতে পেয়েছে। তবু বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তক্ক জুড়বার আগে হরিনাথ একটু ভয়ে ভয়েই ছিল। কারণ, বিশ্বস্ত সূত্রে তার কানে গিয়েছিল, রাধারাণীর সাথে তার সম্পর্কের কথা ভাটপাড়া থেকেই তার বিপক্ষ গোষ্ঠীর কোনো পন্ডিত তুলে দিয়েছিল বিদ্যাসাগরের কানে।

 

 

হরিনাথের বিপক্ষ গোষ্ঠীর পন্ডিত মানেই যে সে বিদ্যাসাগরের সমর্থক, বিধবা বে মেনে নিচ্ছে, তা কিন্তু নয়। বেধবার বে নিয়ে বিদ্যেসাগরের বাড়াবাড়ি ঘিরে ভাটপাড়ার বহুধা বিভক্ত পন্ডিত সমাজ কিন্তু ভীষণ রকম ঐক্যবদ্ধ। ভাটপাড়ার পাশ্চাত্য আর দাক্ষিণাত্য বৈদিক সমাজের একজন ও প্রতিনিধি চান না বিধবা বিয়ে। দুই একজনের বিষয়টা ঘিরে একটু ভিন্ন মত আছে এটা বুঝতে পেরেই হরিনাথ তর্কভূষণ আসরে নেমে পড়েছিল। কারণ, হরিনাথের কানে চারপাশের খবর ততোদিনে পৌঁছে গেছে। চুঁচড়োর সাহেব সুবোদের হাওয়া হালিশহরের ম্লেচ্ছ পন্ডিতদের ভিতরে পড়তে শুরু করেছে -এটা ভালোভাবেই বুঝেছে হরিনাথ। নবদ্বীপের পন্ডিত সমাজের একটা বড় অংশও এই বিধবা বিয়ের প্রশ্নে বিদ্যাসাগরের দিকেই কিছুটা ঢলে আছে। বারেন্দ্র আর রাঢ়ী বামুনরা এই ছলছুতো করেই ব্রাহ্মণ্য সমাজের মাথা হয়ে উঠতে চায়। আর এই রাঢ়ী,বারিন্দিররা যদি একবার ব্রাহ্মণ সমাজে বেশি কল্কে পায়, তাহলে পাশ্চাত্য আর দাক্ষিণাত্য -দুই বৈদিক সমাজকেই বাংলা থেকে পাততাড়ি গোটাতে হবে।

 

 

এই ভয়টাই ভাটপাড়ার পরস্পর বিবাদমান পন্ডিত সমাজের ভিতরে বেশ ভালো ভাবেই প্রবেশ করিয়ে দিতে পেরেছে হরিনাথ। আর তাতেই যা কাজ হওয়ার হয়েছে। বিদ্যেসাগর ঠিক না বেঠিক, সেই বিতন্ডায় না গিয়ে নিজেদের সমাজপতির আসন টলে যেতে পারে, এই ভয়ে ভাটপাড়ার পন্ডিতসমাজ বিদ্যাসাগরের বিরোধিতায় প্রচন্ড ঐক্যবদ্ধ। তবু তো ঘন দুধে এক ফোঁটা কেরোসিন তেল গোপনে মিশিয়ে দেওয়ার লোকের অভাব থাকে না। ভাটপাড়ার এই পন্ডিত সমাজের ভিতরেই কেউ একজন বিদ্যাসাগরের কানে রাধারাণীর কথাটা তুলে দিয়েছে -এটা জেনেও বিদ্যাসাগরের সাথে বিধবা বিয়ে নিয়ে তর্কযুদ্ধে নেমেছিল হরিনাথ। কিন্তু ব্যক্তি আক্রমণের ধারপাশ দিয়ে গেলেন না বিদ্যাসাগর। হরিনাথ সত্যিই অবাক হয়ে গেছিলেন সেদিন।

(ক্রমশঃ)

  • গৌতম রায়
  • নবম