নন্দনতত্ত্বের একটি মত বলে, স্রষ্টা আর রসের উপভোক্তা যদি এক হয়ে যান, তাহলে শিল্পের অপমৃত্যু ঘটে। সৃষ্টি করেই শিল্পীর কাজ শেষ, নিজের নান্দনিক ভাবনা বা জীবনবোধের ব্যাখ্যা শ্রোতা-দর্শক-পাঠকের কাছে খুলে বলার দায় তাঁর থাকে না। কথাটা সম্পূর্ণ ভুল নয়, আবার এই মত যদি পুরোপুরি মেনে নিতে হয়, তাহলে আত্মকথা বা আত্মজীবনীকে সাহিত্যের পদবাচ্য বলে ধরাই চলে না। কোলরিজের ‘বায়োগ্রাফিয়া লিটারেরিয়া’, তলস্তয়-এর আত্মজীবনী থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’— এ জাতীয় সব কিছুকেই বাদ দিতে হয় মানুষজাতির সাংস্কৃতিক ইতিহাসের মহাফেজখানা থেকে। ব্যক্তি-‘আমি’ বা ‘Individual self’ -এর ধারণা পাশ্চাত্যের উনিশ শতকীয় রোমান্টিক ভাব-আন্দোলনের ফসল, আবার এই ‘আমি’ যে সমাজ-বহির্ভূত কোনও সত্ত্বা নয়, সে কথা বলে যাবার দায় অস্বীকার করতে পারেননি উত্তরসূরি শিল্পী-সাহিত্যিকরা। ব্যক্তি-সাহিত্যিক বা ব্যক্তি-শিল্পীর সঙ্গে সমাজের এই যোগসূত্রটুকু তুলে ধরার প্রয়োজনেই আত্মজীবনী-মূলক সাহিত্যের শৈল্পিক, বৌদ্ধিক এবং সামাজিক গুরুত্ববুঝে নিতে হয় আমাদের।
বাংলার সঙ্গীত-সংস্কৃতির ইতিহাসে চণ্ডীদাস, রামপ্রসাদ, এমনকি নিধুবাবুর আমলেও আত্মজীবনী লেখার চল ছিল না, কিন্তু সুযোগ বা ইচ্ছে থাকলে হয়তো পদ্য-আকারেই তাঁরা রেখে যেতে পারতেন নিজেদের কথা, আর তা হতে পারত বাংলা সঙ্গীত-সাহিত্যের সম্পদ। বাংলা গানে কথা আর সুরের অর্ধনারীশ্বর রূপ; বাণীকে বাদ দিয়ে বাংলা গানে প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনাই করা যায় না। একথা ‘সংগীত চিন্তা’য় নানাভাবে বলে গেছেন যিনি, সেই রবীন্দ্রনাথ নিজেই নিজের সাঙ্গীতিক ভাবনা ও সৃষ্টিকর্মের এক আদর্শ ভাষ্যকার—তাঁর সঙ্গীতময় আত্মকথন নিয়ে আলোচনাও হয়েছে বিস্তর।
অতুলপ্রসাদ সেন রেখে যান নি কোন আত্মজীবনী— তবে কয়েকটি ভাষণে, চিঠিপত্রে বা ঘনিষ্ঠজনের স্মৃতিচারণায় তাঁর সঙ্গীতভাবনা সম্পর্কে টুকরো টুকরো কথা জানা যায়। মামাতো বোন সাহানা দেবীর ‘স্মৃতির খেয়া’ থেকে তাঁর সঙ্গীত মননের কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ‘আমার জীবনের আরম্ভ’ নামে একটি অসমাপ্ত স্মৃতিকথা লিখে গিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গীত-জীবন অবশ্য রীতিমত উজ্জ্বল তাঁর সুযোগ্য পুত্রের স্মৃতিকথায়-- দিলীপকুমারের ‘স্মৃতিচারণ’, ‘স্মৃতির শেষ পাতায়’, ‘সাঙ্গীতিকী’-র মত গ্রন্থের বেশিরভাগ জুড়েই বিরাজমান তাঁর পূজনীয় পিতৃদেব। কবি রজনীকান্ত সেন শেষ জীবনে রোগশয্যায় বসে লিখে রেখেছিলেন তাঁর ডায়রি—সে এক মর্মান্তিক কষ্টের দিনলিপি। আত্মীয়-বন্ধুদের পীড়াপীড়িতে আত্মজীবনী লেখা শুরু করেছিলেন, কিন্তু জন্ম ও বংশপরিচয়টুকু লিখেই তাঁকে চলে যেতে হয়েছিল ‘ঐ বধির যবনিকা’র ওপারে, নিজের কথা সেভাবে বলে যাওয়ার মত পরিস্থিতি বা মানসিকতা তাঁর ছিল না।
নজরুলও সে-অর্থে আত্মকথনে নিজের গানের ভাষ্য রেখে যান নি, তবে তাঁর কিছু কিছু অভিভাষণ বা চিঠিপত্রে, গীতি-সংকলনের ভূমিকায় বিক্ষিপ্তভাবে গান সম্বন্ধে ব্যক্তিগত অনুভবের কথা কিছুটা পাওয়া যায়।১৯২৭ সালে ‘নওরোজ’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “জীবন আমার যত দুঃখময়ই হোক, আনন্দের গান, বেদনার গান গেয়ে যাব আমি।দিয়ে যাব নিজেকে নিঃশেষ করে সকলের মাঝে বিলিয়ে।সকলের বাঁচার মাঝে থাকবো আমি বেঁচে।এই আমার ব্রত, এই আমার সাধনা, এই আমার তপস্যা।”(নজরুল রচনা সম্ভার, প্রথম খণ্ড, ৩২৩)।১৯৩১-এ জনসাহিত্য সংসদের এক অধিবেশনে তাঁর ভাষণে নজরুল আত্মপ্রত্যয়-সহ বলেছিলেন, “সাহিত্যে দান আমার কতটুকু তা আমার জানা নেই, তবে এটুকু মনে আছে, সংগীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি।সংগীতে যা দিয়েছি সে সম্বন্ধে আজ কোন আলোচনা না হলেও ভবিষ্যতে যখন আলোচনা হবে তখন আমার কথা সবাই মনে করবেন– এ বিশ্বাস আমার আছে” (তদেব, ২০৭)।
পঞ্চকবির আমল পেরিয়ে, আধুনিক গানের জনপ্রিয়তা ক্রমে বাড়ার সময় থেকে খানিকটা বাণিজ্যিক, খানিকটা পেশাদারিত্বের দাবি, আর খানিকটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক পট-পরিবর্তনের কারণে গীতিকার, সুরকার আর শিল্পী আলাদা ব্যক্তি হয়ে দেখা দিলেন। সেক্ষেত্রেও বলতে হবে, বাংলা গানের বিভিন্ন শাখায় যুগধারক শিল্পীর মর্যাদা যাঁরা পেয়ে থাকেন, তাঁরা ‘সাহিত্যিক’ না হলেও সাহিত্যের বোধ, গানের কথা আর সুরের গভীর বন্ধনকে আত্মস্থ করে পরিবেশন করার ক্ষমতাটুকু অবশ্যই তাঁদের ছিল। তাঁরা যদি নিজেদের অনুভবের কথা লিখে যান, অথবা তাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়ে, তাঁদের আলাপচারিতার আঙ্গিকে বলা কথার ‘অনুলিখন’ করেন কোনও অভিজ্ঞ, পেশাদার জীবনীলেখক-সাংবাদিক, তাহলেও সাংবাদিকতা-সাহিত্যের (Journalistic literature) বিচারে তার মূল্য ফেলে দেবার মত নয়। এ ধরনের কাজ আমরা পেলাম গত শতাব্দীর পাঁচ-ছয়ের দশক থেকে। ‘মাসিক বসুমতী’র পাতায় এই সময় প্রকাশ পেয়েছিল ‘আমার কথা’ শিরোনামে বেশ কয়েকজন সঙ্গীতগুণীর জীবনকথা—কখনও তা সাক্ষাৎকার-ভিত্তিক, কখনও বা তাঁদের জবানিতেই লেখা। তবে গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, দক্ষিণামোহন ঠাকুর, রাধিকামোহন মৈত্র প্রমুখের নামে যে সব সংক্ষিপ্ত ‘আত্মকথা’ প্রকাশ পেয়েছিল, সেগুলিতে সাধারণ কিছু জীবনীমূলক তথ্যের বাইরে, তাঁদের নিজস্ব সঙ্গীত-দর্শন বা সঙ্গীতের ব্যবহারিক বোধ নিয়ে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল না।
বর্ষীয়সী সাহানা দেবীর ‘স্মৃতির খেয়া’ প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৬০ সালের মাসে। তবে ততদিনে তিনি বাংলার সঙ্গীত-জগৎ থেকে অনেক দূরে, পণ্ডিচেরির আশ্রমে নিভৃতে সাধিকার জীবনযাপন করছেন। দিলীপকুমার রায়ের ‘স্মৃতিচারণ’-এর প্রথম খণ্ড প্রকাশের আলো দেখে ১৮৮২ শকের আশ্বিনে, অর্থাৎ ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে।পরবর্তী যুগে গণমাধ্যমে(বেতার ও চলচ্চিত্র-সূত্রে) জনপ্রিয় সঙ্গীতগুণীদের মধ্যে এ ধরনের স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থপ্রকাশে পঙ্কজ কুমার মল্লিক-ই সম্ভবত অগ্রগণ্য।‘আমার যুগ আমার গান’ নামে সেই আত্মকথনের অনুলিখন করলেন অরুণাভ সেনগুপ্ত। ‘দিনের শেষে’তে সুরারোপ প্রসঙ্গ, কৃষ্ণচন্দ্র দে-র মত অগ্রজ সঙ্গীতগুণীদের স্মৃতিচারণা, বেতার-খ্যাত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও সুররচনার মত অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে তাঁর বয়ানে। ত্রিশ-চল্লিশের দশকের জনপ্রিয় শিল্পী কে মল্লিক-এর অসম্পূর্ণ আত্মকথা অপ্রকাশিত ছিল দীর্ঘদিন। সম্প্রতি প্রতিভাস থেকে তা প্রকাশ পেয়েছে।
সাতের দশকে ‘অমৃত’, ‘দেশ’-এর মত পত্রিকা উদ্যোগী হল বিশিষ্ট শিল্পীদের আত্মজীবনী-প্রকাশে। ১৯৬৯-৭০ সালে শচীন দেববর্মণের আত্মকথা ‘সরগমের নিখাদ’ ধারাবাহিক ভাবে বেরিয়েছিল ‘দেশ’ পত্রিকায়। কানন দেবীর ‘সবারে আমি নমি’ প্রভূত সমাদর পেয়েছিল ‘অমৃত’ পত্রিকার পাতায় (১৯৭৩-৭৪), সন্ধ্যা সেনের ধারাবাহিক অনুলিখনে। এগুলি বই হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে আরও পরে। ১৯৭৬ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশ পেল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের আত্মজীবনী ‘আনন্দধারা’— সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব কথনেই। প্রথম যৌবনে সাহিত্যিক-হতে চাওয়া এই মহাশিল্পী প্রাঞ্জল গদ্যে, গল্প বলার অকৃত্রিম ভঙ্গিতে শুধুমাত্র নিজের জীবনকথা ব্যক্ত করেন নি, নিজের অভিজ্ঞতার নিরিখে অনেকটাই আভাস দিয়ে গেছেন আধুনিক বাংলা গানের একটি সম্পূর্ণ যুগ-ইতিহাসের— কতখানি সচেতনভাবে, তা অবশ্য বোঝার উপায় নেই। আটের দশকে তাঁর দ্বিতীয় আত্মজীবনীমূলক বইটি প্রকাশ পায় ‘আমার গানের স্বরলিপি’ নামে, সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুলিখনে এ কাজটি সম্পূর্ণ করেছিলেন শঙ্করলাল ভট্টাচার্য, যিনি পণ্ডিত রবিশঙ্করের ‘রাগ-অনুরাগ’ শীর্ষক আত্মকথারও অনুলেখক।
বিগত শতাব্দীর সাতের দশকের শেষ দিক থেকে এমন উদাহরণ আরও অনেক মিলে যায়। দেবব্রত বিশ্বাসের অভিমানাহত, বিতর্ক-জাগানিয়া আত্মজীবনী ‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত’ প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৭৯ সালে। পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের আত্মজীবনী ‘তহজীব-ই-মৌসিকী’ বেরিয়েছিল ১৯৮৪তে, ‘দেশ’ পত্রিকায়, শৈলজারঞ্জন মজুমদারের ‘যাত্রাপথের আনন্দগান’ প্রকাশিত হল ১৯৮৫ সালে। এসব গ্রন্থ মুষ্টিমেয় কিছু সঙ্গীত-অনুরাগী ভালোবেসে কেনেন, পড়েন, সংগ্রহে রাখেন। কিন্তু বাংলা গানের ইতিহাস বা সঙ্গীত-তত্ত্বের আলোচনায়, সঙ্গীতগুণীদের আত্মজীবনী-সাহিত্য আলাদাভাবে স্থান পায় না আজও। নামী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সঙ্গীত বিভাগের পাঠক্রমেও এগুলির অন্তর্ভুক্তি সেভাবে চোখে পড়ে না—দু-চারজন গবেষক হয়ত ব্যক্তিগত আগ্রহে ভাবনাচিন্তা করেন এই দিকটি নিয়ে।
সঙ্গীতকে শ্রোতার কাছে পৌঁছে দেওয়া শিল্পীর ‘কাজ’ অবশ্যই, কিন্তু সেই ‘কাজ’ সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য শিল্পীর ব্যক্তিসত্তাকে তাঁর সমসাময়িক সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে যে ভাবনা, যে বৌদ্ধিক, মানবিক ও আত্মিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার স্তরগুলো পেরিয়ে আসতে হয়, তার অংশীদার হওয়ার চেষ্টাটুকু কি মনোযোগী শ্রোতার, সঙ্গীতপ্রেমীর ‘কাজ’-এর মধ্যে পড়ে না? আত্মজীবনীকি শুধুই শিল্পীর‘আমি’ত্বের উচ্চারণ?না কি এর মধ্যে রয়েছেসমষ্টি-অস্তিত্ব, সামাজিকঅস্তিত্ব, বিশ্ব-আমির মনের কথা? আত্মকথনের সূত্রে যদি ধরা দেয় বাংলার এক-এক জন স্মরণীয়, বরণীয় সঙ্গীতব্যক্তিত্বের অন্তর-জীবনের খানিক আভাস, আর তার আলোয় নতুন করে দেখা যায় বাংলা গানের ধারায় নানা পরিবর্তনের দিকচিহ্নগুলিকে, তবে তা কোনও এক দিন উত্তীর্ণ হলেও হতে পারে সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ভিন্নতর ভাষ্য রচনার প্রয়াসে।