যে প্রতিমার ভাসান নাই

যে প্রতিমার ভাসান নাই- প্রতিমা বড়ুয়া সম্পর্কে এখন এই বাক্যটা যেন একটা প্রবাদবাক্যে পরিণত হয়েছে। লোকায়ত সংস্কৃতির এক আত্মনিবেদিত প্রাণ। 'আপোষ' গোয়ালপাড়ার গানের ক্ষেত্রে এই শব্দটি যাঁর অভিধানে ছিল না-

 

 

প্রতিমাদির জন্মদিন। ৩ অক্টোবর এই পৃথিবীর আলো প্রথম দেখেছিলেন প্রতিমা বড়ুয়া। সাল? কী দরকার সাল, তিথি, নক্ষত্র ঘিরে আলোচনা প্রতিমা বড়ুয়ার জন্যে? প্রতিমা বড়ুয়া, ভারতের বব ডিলান। প্রতিমা বড়ুয়া ভারতের মাটির ভাষার এক বিস্ময়। প্রতিমার কন্ঠ মুহূর্তের জন্যে উদাস করে দেয়নি, তাঁর গানের শ্রোতাদের মধ্যে এমন মানুষ খুব কমই আছে। কী ছিল প্রতিমা বড়ুয়ার কন্ঠে? গদাধরের পারে পারে রে- শুনতে শুনতে যে মানুষটি কখনও গদাধরকে দেখেনি, তাঁরও মন কেন উদাস হয়ে যায়? গদাধরকে আমি কিন্তু প্রথম গোয়ালপাড়াতে দেখিনি। দেখেছিলাম, কোচবিহারে। শহর থেকে কিছুটা দূরে ঢানঢিংগুড়ি নামের একটা গাঁয়ে। সেটা ছিল আটের দশকের একদম শুরুর দিক। কোচবিহার শহর থেকে খুব বেশি দূরে নয় ওই গ্রামটি। তবে তখনও সে গ্রামের সবকিছু নগর সভ্যতা গ্রাস করে নেয়নি। গোটা উত্তরবঙ্গটাই তখন অন্যরকম। অতীতের ধারাবাহিকতার মধ্যেই পথচলা শুরু হয়েছে আধুনিকতার। কিন্তু সেই আধুনিকতার অন্বেষণে নেই প্রচারসর্বস্বতা। নেই জাহির করবার মত মানসিকতা। যথেষ্ট বিত্তবানেদরাও তখন আগের কালের আবহাওয়া, বিশেষ করে সেখানকার বৃষ্টির বহরকে মনে রেখে ঢালাই ছাদ প্রায় দেয়ইনি। কোচবিহার, জলপাইগুড়িতে তখন ঢালাই ছাদের বাড়ি ছিল প্রায় হাতে গোনা। বৃষ্টির এমনই দাপট ছিল আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে পর্যন্ত যে, কোচবিহার বা তার আশেপাশের এলাকায় পাকা বাড়ি রক্ষা করাই যেত না। বৃষ্টির কারনে ছাদ নষ্ট হয়ে যেত।

 

 

গদাধরের তীরে, সেটা ঢাপডিংগুড়ি গাঁয়ে দাঁড়িয়ে আমার প্রথম মনে পড়েছিল, প্রতিমা বড়ুয়ার সেই গান, গদাধরের পারে পারে রে। আসলে লোকজীবনকে আত্মস্থ করতে যাপনচিত্রের যে ভূমিকা, সেটা যখন প্রতিমাদিকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করবার পর দেখলাম, তখন বুঝলাম লোকজীবন-লোকসংস্কৃতির আত্মস্থতা আর ফরমাইশিপনার মধ্যে ফারাকটা কোথায়। আসামের গোয়ালপাড়ার নিজস্ব আঙ্গীকে লোকসঙ্গীতের যে সম্পদ, তাকে বিশুদ্ধতার সঙ্গে মানুষের দরবারে তুলে ধরাটাই ছিল প্রতিমার জীবনের ব্রত। গোয়ালপাড়া অঞ্চলের কার্তিক পুজোর যথেষ্ট খ্যাতি আছে। কার্তিক পুজোকে কেন্দ্র করে গোয়ালপাড়ার নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ভরা বিনোদন, এখানকার একটা প্রচলিত রেওয়াজ। কার্তিক পুজোর কালে গোয়াপাড়িয়া সঙ্গীতের পরিবেশন, 'সোহাগ চাঁদ বদনী ধ্বনি নাচো তো দেখি' গানটির তুমুল জনপ্রিয়তা।

 

 

কার্তিককে প্রজননের অন্যতম দেবতা হিসেবে উপাসনার একটা প্রচলন আছে। এই প্রচলন দুই বঙ্গেই হিন্দু সমাজে যথেষ্ট সমাদৃত। আবার বাংলা লাগোয়া আসামের নিম্নাঞ্চল, অর্থাৎ গোয়ালপাড়া, যেখানে আসামের মানুষেরা থাকলেও বাংলা এবং বাঙালি সংস্কৃতির একটা বড় প্রভাব আছে, সেই গোয়ালপাড়াতে কার্তিক পুজো যথেষ্ট হইচইয়ের মধ্যে দিয়ে উদযাপিত হয়। গোয়ালপাড়া জেলা জুড়ে কার্তিক পুজোর আড়ম্বরে কেবলমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ঘিরে ব্যস্ততা থাকে না। আঞ্চলিক সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে এই কার্তিক পুজো হয়ে উঠেছে বিশেষ রকমের একটা অন্তরঙ্গ বিষয়। প্রতিমাদির কাছেই প্রথম শুনি, সোহাগ চাঁদ বদনী, গানটি হল গোয়ালপাড়ার কার্তিক পুজোকে ঘিরে বহুল চর্চিত একটা গান। পরবর্তীতে এই গানটি জনপ্রিয় শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরী গেয়েছিলেন। লোকায়ত সংস্কৃতিকে বাজারজাত জনপ্রিয়তায় পরিণত করা, যন্ত্রানুসঙ্গে স্থানীয় আঙ্গিককে বাদ দিয়ে অন্য আঙ্গিক, বিশেষ করে বিদেশি যন্ত্রানসঙ্গ - এগুলি কেবল প্রতিমা বড়ুয়ার অপছন্দের বিষয় ছিল, তাইই নয়। এই ধরণের অভ্যাস তাঁকে খুব ব্যথিত করত। লোকায়ত ধারার বিশুদ্ধতার প্রশ্নে প্রতিমা বড়ুয়া ছিলেন আপোষহীন। এই আপোষহীনতাকে অনেকে তাঁর গোঁড়ামি বলেও ঠাওড়াতেন। লোকজ বিষয়কে বিনোদনের দুনিয়াতে যারা কমোডিটি হিসেবে তুলে ধরতে আত্মনিবেদিত, তাদের কাছে লোকজ যে কোনও বিষয়, তা গান হোক, নাচ হোক, চিত্রকলা হোক, পোষাক- যাই হোক না কেন -এই বিষয়গুলিকে শহুরে বাজারের চাহিদার সঙ্গে সম্পৃক্ত করবার একটা ঝোঁক থাকে।

 

 

এই ঝোঁকের কারন হল বাণিজ্যিক। ঝোঁকটিকে একেবারে অপ্রাসঙ্গিক ও আমরা বলতে পারি না। কারন, বাণিজ্যিক আদান প্রদানের ফলে লোকজ শিল্পীদের অর্থনৈতিক দিকটির যদি উন্নতি না ঘটে, তাদের আর্থ-সামাজিক পরিমন্ডলে যদি ইতিবাচক পরিবর্তন না আসে, শিল্পীদের জীবনযাত্রার মানের যদি অদলবদল না ঘটে, তবে লোকজ শিল্পকেই বাঁচিয়ে রাখাটা একটা বড় রকমের সঙ্কট। বিশেষ করে লোকজ শিল্পীদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটানো একটা বড় বিষয়। তাঁদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষা, স্বাস্থ্যের প্রসার -এসবের জন্যে তাঁদের অর্থনৈতিক জীবনের মানোন্নয়ণ একটা বড় বিষয়। প্রতিমা বড়ুয়া লোকায়ত শিল্পের যে ধ্রুপদীয়ানায় বিশ্বাস করতেন, বাজার অর্থনীতির যুগে তাকে একেবারে সেই আঙ্গিকে টিকিয়ে রাখবার মধ্যে অনেক বাস্তব সমস্যা আছে। ধ্রুপদীয়ানার সেই আঙ্গিক শিল্পীর পেটে ভাতের যোগানের ক্ষেত্রে কতখানি ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারবে, তা ঘিরেও অনেক রকমের সংশয় থেকে যায়। দ্বিধা তৈরি হয়। সঙ্কটের আবর্তে ফলে নিমজ্জিত করে শিল্পীর জীবন। তার ফলশ্রুতি হিসেবে লোকজ শিল্পীদের পরবর্তী প্রজন্ম আর সেই শৈল্পিক ধারা বয়ে নিয়ে চলবার ক্ষেত্রে বিশেষ একটা আগ্রহী হয় না। বাস্তব কারণেই অর্থনৈতিক বিষয়টা তাঁদের কাছে বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।

 

 

প্রতিমা বড়ুয়া গোয়ালপাড়ার লোকজ গানের পরিবেশনের ক্ষেত্রে যে শুদ্ধাচারে বিশ্বাস করতেন এবং সেই বিশ্বাসকে অন্তরে ধারণ করে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন- তেমন জেদ, খুব কম শিল্পীর মধ্যেই দেখতে পাওয়া যায়। শিল্পের বিশুদ্ধতা রক্ষায় কখনও আপোষ করবার কথা না ভাবতে পারা শিল্পীদের জীবনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেমে আসে একটা অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা। সেটা নেমে এসেছিল প্রতিমা বড়ুয়ার জীবনেও। সামন্ততান্ত্রিক পারিবারিক কাঠামো কালের নিয়মে তাঁর দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আর্থিক সঙ্কট শেষের বহুকাল তাঁর নিত্যসঙ্গী না হলেও সঙ্গী ছিল। তা স্বত্ত্বেও শহুরে বিনোদনে গোয়ালপাড়ার গানকে তিনি কখনওই পর্যবসিত হতে দেননি। নিজের অঞ্চলের সংস্কৃতির প্রতি টান, ভালোবাসা, প্রেমটা তাঁর ছিল এমনই। এই টানে কখনও এতটুকু হেরফের হয়নি। টানাপোড়েনও চলেনি গোয়ালপাড়ার নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি প্রতিমা বড়ুয়া অন্তরের আকর্ষণে। ভূপেন হাজারিকা থেকে নির্মলেন্দু চৌধুরী, অমর পাল - লোকসঙ্গীতের পেশাদার দুনিয়ার মানুষজনেরা, তাঁরা লোকায়ত ভুবনের প্রসার এবং কিছুটা বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তাকে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করেছেন। বহু ক্ষেত্রেই সফল হয়েছেন তাঁরা। ভূপেন হাজারিকার সুরারোপিত কল্পনা লাজমীর ছবি, 'রূদালী' সেখানে তো ভূপেনবাবু লোকায়তের সুরের মুর্ছনায় গোটা ভারতকে মাতিয়েছিলেন। কিন্তু সেই মুর্ছনাকে আধুনিক যন্ত্রানুসঙ্গের অনুসঙ্গে সিক্ত করে পরিবেশন করেছেন। জাতীয় স্তরে পুরস্কারও পেয়েছে এই ফিল্ম। যন্ত্রণানুসঙ্গের বিষয়েও কখনও আপোষ করেননি প্রতিমা বড়ুয়া। লোকসঙ্গীতের মর্মবাণী হিসেবে আঞ্চলিক শ্রম সংস্কৃতির যে প্রভাব থাকে, গোয়ালপাড়ার গানে নদী এবং মাহুত আর হাতী -এই তিনটি বৈশিষ্ট্য, যা প্রবাহমান কাল ধরে ওই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক জীবনকে যেভাবে বয়ে নিয়ে চলেছে, তাকেই সংস্কৃতির আঙিনায় উপস্থাপিত করবার সাধনা নিজের গোটা জীবন ধরে প্রতিমা বড়ুয়া করে গেছেন।

 

 

আব্বাসউদ্দিনের গানে যে মাটির গন্ধ, নদীর স্পর্শ আমরা পাই যন্ত্রাণুসঙ্গের বনেদিয়ানায়, সেটাই গোয়ালপাড়ার গানের দুনিয়াতে পরম্পরাগত ভাবে বয়ে নিয়ে চলেছিলেন প্রতিমা বড়ুয়া। আব্বাসউদ্দিনের জীবনের শেষ পর্বে সঙ্গীতের দুনিয়ায় দেশজ যন্ত্রণানুসঙ্গের সাথেই যুক্ত হতে শুরু করেছিল পশ্চিমী দুনিয়ার নানা যন্ত্রাদি। কিন্তু আব্বাসউদ্দিনের শৈল্পিক সত্তায় সেটা তেমন ভাবে সাড়া দেয়নি। লোকায়তধারার অনুসারী, অনুগামী মানুষ ছিলেন কুমার শচীনদেব বর্মণ। তিনি তাঁর প্রথম জীবনের গানগুলিতে দেশজ যন্ত্রানুসঙ্গের যে ব্যবহার ঘটিয়েছিলেন, শেষজীবনে বলিউডের সুরসংযোগই হোক আর নিজের গাওয়া বেসিক বাংলা গানই হোক- যন্ত্রানুসঙ্গের ক্ষেত্রে একগুঁয়ে মানসিকতা নিয়ে কখনও চলেননি। তবে তাঁর বাদ্যযন্ত্রের সহশিল্পীদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ব্রজেন বিশ্বাসের কথা এক্ষেত্রে বলা খুব জরুরি। বহু পশ্চিমী যন্ত্রের আমেজ ব্রজেন বিশ্বাস একেবারে দেশীয় এমনকী আঞ্চলিক যন্ত্রপাতি দিয়ে শচীনদেবের বহু গানে এনে দিয়েছিলেন।

  • গৌতম রায়