ঊনিশ শতকের রেনার জাতি ঘিরে আবেগঘন সজ্ঞায়ন। সেই সজ্ঞা কি আমাদের চিন্তার আরোহিনীকে আন্দোলিত করেছিল? জাতি গঠনে রোমান্টিক অভিযাত্রা কি দূর থেকে পিয়াসী হয়েছিল সুদূরের?প্রশ্ন আর উত্তরের অনুসন্ধানের প্রয়াস--
জাতি রাষ্ট্র আধুনিক পুঁজিবাদী বিশ্বের সৃষ্টি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে রেনার জাতি নিয়ে আবেগ প্রবন সংজ্ঞায়িত করা এবং জার্মান লেখকদের যানটি গঠনের একটি রোমান্টিক ব্যাখ্যা দেওয়া নিয়ে জাতিগঠনে ইউরোপ কেন্দ্রিক ধারণ তৈরী হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে নেশন শব্দটার কোনো বাংলা প্রতিশব্দ সেই অর্থে নেই। হালফিল বেনেডিক্ট অ্যান্ডার্সন বলেছেন যে জাতি একটি কল্পিতসমাজ যা এম্পটি হোমজেনাস টাইম এর উপরে অবস্থিত। কিন্তু জাতি রাষ্ট্র বাদ দিয়ে কল্পনা করা যায় না। জাতি রাষ্ট্রর মূল ভিত্তি স্থানিক। জাতি রাষ্ট্রর নির্দিষ্ট ভূখণ্ড থাকতে হবে যা আবার ইউরোপীয় মানচিত্রের ধারণা থেকে গৃহীত হয়েছে। ইউরোপের মানচিত্রে জাতি রাষ্ট্র গঠনের ধারণা এসেছে ওয়েস্টফালিয়ার চুক্তির ধারণা থেকে। থাই ঐতিহাসিক থংচাই উইনীচকূল দেখিয়েছেন ঊনবিশ শতাব্দীতে মানচিত্র কি ভাবে জাতি রাষ্ট্রর ধারণা কে এশিয়া তে প্রভাবিত করেছে। আর এই মানচিত্র কোনো একক ধারণার উপর নির্ভরশীল নয়। কেউ জাতি গঠনের মানচিত্র কে কোনো সম্প্রসারিত ফ্রন্টিয়ার এর ধারণা দিয়ে চিহ্নিত করেন। এন্থনি স্মিথ জাতি গঠনের ক্ষেত্রে এথনিসিটি র ধারণার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর ঔপনিবেশিক তাত্ত্বিকরা যেমন পার্থ চট্টোপাধ্যায় বা হোমি ভাবা জাতি গঠনের ক্ষেত্রে উল্লেখ করেছেন অন্দর মহল এবং বাহির মহলের তত্ত্ব। পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন যে ভারতের ক্ষেত্রে অন্দর মহল হলো অধ্যাত্বিকতা সেখানে দক্ষিণ এশীয়রা নিজেদের কে ইউরোপীয়দের থেকে উচ্চমার্গের বলে মনে করেন আর বাহির মহল হলো বস্তুজগতের উন্নতি মানে বিজ্ঞান অর্থনীতি প্রযুক্তি এক্ষেত্রে তাঁর ইউরোপীয়দের উচ্চতর জায়গায় স্থান দেন। এই দুইয়ের মধ্যে ghat প্রতিঘাতে জাতির ধারণা তৈরী হয়েছে। আবার হোমি ভাবা জাতি গঠনের পক্রিয়া কে narration বা কাহিনী বিধৃত করার পক্রিয়া বলেছেন। সম্প্রতিকালে মনু গোস্বামী দক্ষিণ এশিয়াতে জাতি গঠনের পক্রিয়াতে কিভাবে স্পেস বা পরিসর তৈরির গল্প রয়েছে তার কথা উল্লেখ করেছেন আঁড়ি লেফেব্রে কে কেন্দ্র করে। সুমথি রামস্বামী তাতে যোগ করেছেন মানচিত্রের গল্প। প্রকৃত পক্ষে ভারতে বারানসিতে ১৯৩৬ সালে ভারতমাতা মন্দির স্থাপিত হয় তাতে কোনো বিগ্রহের পরিবর্তে সেকালের ব্রিটিশ ভারতের মানচিত্রকে বিগ্রহ করে দেখানো হয়।
কেউ কেউ আমাকে প্রশ্ন করেছেন ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক জাতিগঠনের পক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে ব্যাখ্যা করতে। আসলে আমরা যখন ভারত বাংলাদেশ সম্পর্ক ব্যাখায় করি তখন ১৯৭১ সালের পরে ভূখণ্ড হিসাবে ব্যাখ্যা করি। কিন্তু ১৯৭১ সল্ বাংলাদেশের কল্পিত সমাজের ভিত্তি নয় বিভিন্ন ঘাট প্রতিঘাতে জাতিসত্ত্বার বিবর্তনের একটি অংশ মাত্র। আমরা যদি এন্থনি স্মিথ এবং বেনেডিক্ট এন্ডারসনের মধ্যে একটি কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে বাংলদেশের ধারণার উৎস খুঁজি তাহলে তার উৎস দুটি। একটি হলো ব্রিটিশ ভারতের ১৮৭২ সালের জনগণনা যাতে বাংলাভাষী জনগণের মধ্যে যে মুসলমান সমাজকে সংখ্যা গরিষ্ঠ বলে চিহ্নত করে হয়েছে। আর তার সঙ্গে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে একটি মজার ঘটনা রয়েছে সেটি হলো বঙ্কিম ছিলেন একেবারে বাঙালি জাতিয়তাবাদী। তিনি বন্দে মাতরম গানে je জাতি সত্ত্বার কল্পনা করেন তা হলো সার্বিকভাবে একটি বাঙালি হিন্দু জাতিস্বত্ত্বার কল্পনা। সেখানে বাংলার জনসংখ্যার ভিত্তিতে বাঙালি রাষ্ট্রর কল্পনা রয়েছে। কিন্তু বঙ্কিম সবার চাইতে ভালো ভাবে জানতেন যে বাংলাভাষীর মধ্যে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেইকাৰণে তাঁর আনন্দমঠে তিনি ব্রিটিশ শাসনের স্থায়িত্ব চেয়েছিলেন। তার পরবর্তীকালে বাঙালি হিন্দুরা বাঙালি মুসলমানদের বাঙালি ভাবতেন না। শরৎচন্দ্র যিনি মহেশের মতো সংবেদনশীল গল্প লিখেছেন তিনিও মনে করতেন বাঙালি আর মুসলমান দুটি আলাদা সত্ত্বা।
বাংলায় মুসলমানদের মধ্যে উদীয়মান মধ্যবিত্তরা তাঁদের সংখ্যা গরিষ্ঠতার কথা জানতেন। এঁদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের বাঙালি বলে পরিচয় দিতেন। আবু হোসেন সিরাজীর লেখা পড়ুন , আবুল মনসুর আহমদের লেখা পড়ুন বা একবারে ধর্ম নিরপেক্ষ আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ এর লেখা পড়ুন বা কামরুদ্দিন আহমদের লেখা পড়ুন সবাই নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দিয়েছেন। ১৯১৮ সালে শহীদুল্লাহ সাহেব শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে একটি সভাতে বাংলাকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘোষণা করেন।
আসলে মূল বিষয়টা হলো মানচিত্র আর জাতিসত্ত্বা। যা নিয়ে তর্ক তা হলো বাঙালি হলো আলাদা জাতিসত্ত্বা না ভারতীয় সভ্যতার একটি জাতিসত্ত্বা। ১৯৪০ সালে বাংলায় মুসলমান মধ্যবিত্তরা সবাই মনে করতেন ভারতে বাঙালি মুসলমান একটি আলাদা জাতি সত্ত্বা। ভারত কোনো জাতি হতে পারে না। তার ভিত্তি ছিল ১৮৭২ সালের জনগণনা। ১৯৪৭ সালের অখণ্ড বাংলা আন্দোলনের পুরোধা আবুল হাশিম সেই একই কথা বলেছিলেন। ফলে ১৯৭০ সালে শেখ মুজিবর রহমান যখন বাঙালি জাতিয়তাবাদের নাম ভোট চেয়েছিলেন তখন মানচিত্রে বাংলাদেশ কিন্তু একটি বাঙালি মুসলমান অধ্যুষিত রাষ্ট্র হবে লেবাননের মতো তা দুই ধর্মের রাষ্ট্র হবে না তা তিনি জানতেন। সেই জন্যে তিনি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান এবং অখণ্ড বাংলা চেয়েছিলেন আর ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭১ সালের পরে যে ভূ খন্ড বাংলাদেশ বলে পরিচিত হয় পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রহিত করে তা তিন দিকে ভারত বেষ্টিত। ফলে ভারত তাদের উপর আধিপত্য করবে কি না সেই নিয়ে তাঁদের গভীর সন্দেহ থেকে যায়। তাঁরা অনেকেই ভারত কে বহুজাতিক কৃত্রিম রাষ্ট্র হিসাবে ভাবেন যা পরা শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়ে বাংলাদেশ কে গিলে খাবে। এখন সেই চিন্তাই প্রবল। কারণ পাকিস্তান ১৯৭১ সালের পর বহু দূরের রাষ্ট্র। ভারত বাংলাদেশের প্রতিবেশী। জাতিসত্ত্বার কল্পনার ভিত্তিতে কিন্তু ১৮৭২ এর লোক গণনা ১৯৪৭ এর রাডক্লিফ লাইন ১৯৭১ এর থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ একটি অন্যরেখা। কল্পিতজাতি সমাজের পরিসরে বাঙালি জাতীয়তাবাদ খুব সহজেই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে পরিণত হয়। ফলে অধিকাংশ বাংলাদেশী মনে করেন তাঁরা বাঙালি জাতি কিন্তু তাদের জাতীয় পরিচয় বাংলাদেশী। উর্দু বাংলার মধ্যে যে সংঘর্ষ তা শ্রেণী সংঘর্ষ। পাকিস্তানেও উর্দু সংখ্যালঘুদের ভাষা কিন্তু অষ্টাদশ শতকে উর্দুর সঙ্গে আশরাফ পরিচিতিবোধের সম্পর্কের জন্যে তা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। পাঞ্জাবি ,পুস্তু বা সিন্ধি বা বালুচ বলেন সে দেশের কৃষক, কিন্তু মধ্যবিত্তরা উর্দু বলেন।
আমার জাতীয়তাবাদের তত্ত্ব পরে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের সম্পর্কে এটি হলো ধারণা। ভারতের বিভিন্ন অংশে জাতীয়তাবাদের বিকাশের থেকে এই ধারণা ভিন্ন। কাজেই ভারত বাংলা সম্পর্কের মূল ধারা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বুঝতে গেলে এই ধারণা বুঝতে হবে। তাহলে প্রশ্ন থাকতেই পারে পশ্চিমবাংলা বা আসামে যে বিশাল বাংলা ভাষী মুসলমান রয়েছে বা বাংলাদশে হিন্দু সমাজ রয়েছে তাদের কি হবে। উত্তরটা জাতীয়তাবাদের মধ্যে রয়েছে জাতীয়তাবাদ সংখ্যলঘুৰ কথা ভাবে না। সিভিক বা নাগরিক জাতীয়তাবাদ এখনো দক্ষিণ এশিয়াতে স্বপ্ন মাত্র। তামিল সিংহল সম্পর্ক , বা পাকিস্তান পাঞ্জাবিদের সঙ্গে বালুচ , পাখতুনদের সম্পর্ক নেপালে ম-দেশিদের সঙ্গে পাহাড়িদের, আফগানিস্তানে পাখতুনদের সঙ্গে তাজিক, Hazara দের সম্পর্ক দেখুন তাহলে আমার বক্তব্য বুঝতে পারবেন। ভারতের কথা আমার নিজের লেখা The Dialectics of Resistance: Colonial Geography, Bengali Literati and the Racial Mapping of Indian Identity কষ্ট করে পরে নিন।