ভিয়েতনাম। বাঙালির মনে শিহরণ জাগানো এক নাম। একটা সময়ে এখানকার অলিগলি মুখরিত হতো, ‘তোমার নাম, আমার নাম – ভিয়েতনাম - ভিয়েতনাম’ শ্লোগানে। সেই দেশের অন্দরের সুলুক সন্ধান-
#নানধান সাইগন
একটা শহর সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণা গড়ে দেয় সেই শহরের ট্যাক্সিচালক। হোচিমিন এয়ারপোর্টে নেমে হান নামে যে গাড়ি চালক হোটেল নিয়ে এল, মাঝরাতে সে হাতজোড় করে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলল, “ওয়েলকাম, আমার নাম হান। আমার দেশে স্বাগতম।”
হোটেলে মাঝ রাতে রিসেপশনে জেগে থাকা লুই একইরকম হেসে বলল, “আসতে কষ্ট হয়নি তো? আপনাদের ঘর সব তৈরি আছে। সকালে কী খাবেন এখন বলে দিতে পারেন, সবকিছু সময়মত রেডি করে রাখব।”
প্রথমে সাজানো ভদ্রতা মনে হলেও পরে বারবার কথা বলে দেখেছি, এটা স্বাভাবিক আচরণ। এইভাবেই ওরা হাসিমুখে অতিথিকে কাছে ডেকে নেয়।
হোচিমিন সিটি ঘুরে দেখার ট্যুরগাইড সন বলল একইভঙ্গিতে, “আমাদের দেশে স্বাগত।”
“কত বয়স তোমার সন?“
ঝকঝকে বেতের মত চেহারা, মিষ্টি হেসে সে বলল, “তুয়েন্তিফোর। আমার জন্ম দু’হাজার সালে।”
“তাহলে তো তুমি নিউ জেনারেশন। যুদ্ধ দেখনি, কষ্ট দেখনি।”
“না দেখিনি। কিন্তু সব জানি। আমরা চীনকে হারিয়েছি, জাপানকে হারিয়েছি, ফরাসিদের বাধ্য করেছি আমাদের দেশ ছেড়ে যেতে, আমেরিকাকে উচিত শিক্ষা দিয়েছি।”
দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের ক্ষত এখনও কি ভিয়েতনামের মনের ভেতরে আছে? প্রাকৃতিক সম্পদ প্রচুর, দেশটাও বেশ লম্বা। আধুনিক ভিয়েতনাম ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে উত্তর থেকে দক্ষিণে। দক্ষিণের সবথেকে পুরনো বড় শহর সাইগন এখন নাম পাল্টে হয়েছে হোচিমিন সিটি। যদিও স্থানীয়রা দুটো নামই ব্যবহার করে। সাইগন নামের নদী শহরটার বুকচিরে চলে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সাইগন ছিল সাবেক ইন্দো-চায়নার রাজধানী। ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের প্রধান কেন্দ্র হোচিমিনসিটি। দক্ষিনপূর্ব এশিয়ার ব্যস্ততম শহরের একটা। ফরাসীরা খুব যত্ন করে বানিয়েছিল শহরটা। এখনও সেই যত্নের চিহ্নগুলো রয়ে গেছে। অপরূপ কিছু ফরাসী স্থাপত্যের নিদর্শন রয়েছে অপেরা হাউস, সিটি হল, সাইগন পোস্টঅফিস, নোতর দাম ক্যাথিড্রাল … হ্যাঁ সেই প্যারিসের ক্যাথিড্রালের ভিয়েতনামের সংস্করণ। রাস্তাঘাট, পরিচ্ছন্নতা, সৌন্দর্যবোধ দেখলে তাক লেগে যাবে। এতসুন্দর সাজানো গোছানো শহর, দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের দগদগে ঘা কী করে সারিয়ে ফেলল এত তাড়াতাড়ি! এই প্রশ্নই রেখেছিলাম সন’কে। ভিয়েতনামের স্থুলকায় নারীপুরুষ বিরল। ঠিক তেমনই বিরল গোমড়ামুখো মানুষ। এই সনের সঙ্গে হোচিমিনের ওয়াকিং ট্যুর করতে করতে সেই হাসিমুখের সঙ্গে আরও অভ্যস্ত হয়ে গেছি। হাসতে হাসতেই সন উত্তর দিল, “ভিয়েতনাম হল শান্তির দেশ। এখানে আমরা কারো সঙ্গে ভেদাভেদ রাখি না।”
টুরিস্টদের মন রাখার জন্য বলছে? এমন সবাই বলে।
“তোমরা ধর্ম মানো? বৌদ্ধ, ইসলাম, খ্রীষ্ট, হিন্দু ..এইসব।”
“আমাদের সরকার মানে না। জানোই তো এটা কমিউনিস্ট দেশ। কিন্তু কাউকে বাধা দেয় না।”
“কিন্তু এই ধর্ম নিয়েই তো যত হানাহানি।”
“আমাদের এখানে নেই। আমাদের ৩০% নতুন প্রজন্ম কোনও ধর্মই মানে না।”
“তুমি?”
“আমার মা খ্রিস্টান, বাবা বৌদ্ধ। আমায় দুজনের কেউই কোনও কিছু মানতে বলেনি। আমি জল, বায়ু আর আগুনকে মানি, প্রকৃতি উপাসনা বলতে পার।”
“এটাও তো একটা ধর্ম।”
“হতে পারে। তোমরা যেগুলোকে ধর্ম বলে জেনে এসেছ, সেই টেম্পল, প্যাগোডা, চার্চ এইসব গিয়ে আমি উপাসনা করি না।”
তথ্য বলছে ভিয়েতনামে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীর সংখ্যা প্রচুর। কিন্তু তাঁরা অধিকাংশই বয়স্ক মানুষ। নতুন প্রজন্ম এখানে কোনও ধর্মের অনুশাসনে নিজেকে বেঁধে ফেলতে চায় না। এমনিতে ভিয়েতনামে একটা আপাত খোলামেলা সমাজব্যবস্থা আছে। ধর্ম আর জাতপাতের বিচারে বিবাহ হয় না। সংখ্যাগুরু ভিয়েত ছাড়াও বেশ কিছু সংখ্যালঘু উপজাতিও আছে। সেখানে সবকিছুই যে শান্তির আবহে চলছে তাও নয়। তবে অনেক দ্রুতহারে সবাই নিজেদের মধ্যে মিলেমিশে যাচ্ছে।
“আমাদের চীনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলবে না। আমাদের পূর্বপুরুষ হয়ত চীন থেকেই এসেছিল, কিন্তু আমাদের ভাষা, স্ক্রিপ্ট সব আলাদা।” সনের মত একই কথা পরেও শুনেছি। ভিয়েতনামি স্ক্রিপ্ট তৈরিতে মূল প্রভাব ছিল ফরাসী ভাষার। ফরাসীরা নিজেদের প্রয়োজনেই স্কুল কলেজ খুলেছিল, শহর সাজিয়েছিল। ঔপনিবেশিকতার সব ভাল খারাপ নিয়েই গড়ে উঠেছিল দেশটা। সাইগনে ফরাসী প্রভাব সবথেকে বেশি।
“ফরাসীরা আমাদের স্ক্রিপ্ট তৈরিতে সাহায্য করেছে। চীনের স্ক্রিপ্ট আমরা বুঝি না। ওদের ভাষাও সব বুঝি না।”
হোচিমিন সিটির রাস্তায় হাঁটতে বেশ ভাল লাগে। বামপন্থীরাষ্ট্র কিন্তু গাড়ি এখানে সব রাস্তার ডানদিক দিয়ে চলে। অধিকাংশ জাপানি আর কোরিয়ান মডেল, তারমধ্যেই ভিয়েতনামের নিজস্ব গাড়ি ভিন ফাস্টতাল দিয়ে চলছে। চারচাকার থেকে অবশ্য দুইচাকার স্কুটি সংখ্যায় অনেক বেশী। শুধু হোচিমিনসিটিতেই নাকি পঁয়ত্রিশ লক্ষ স্কুটি চলে! সংখ্যাটা শুনে প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু এটাই সত্যি। সাধারণ মানুষ স্কুটি চাপতে খুব পছন্দ করে। এত গাড়ি রাস্তায় চলছে কিন্তু অহেতুক হর্ন বাজাচ্ছে না কেউ। ফুটপাত বেশ চওড়া, ফুলের বাগান দিয়ে সাজানো। ভিয়েতনামিরা রাস্তার ধারে ছোট ছোট টুল পেতে খাওয়া দাওয়া করতে ভালবাসে। খাওয়া-দাওয়ার এত আয়োজন, তার মধ্যে ভিয়েতনামের স্প্রিং রোল, ফা (মোটানুডুলস), স্টিকি রাইস, এগ কফি, জাপানি আর কোরিয়ান খাবারও প্রচুর। পর্ক, বিফ, চিকেন, মাছ, চিংড়ি, ঝিনুক, শামুক, গুগলি, তার সঙ্গে সবুজ পাতার বিচিত্র সব শাক.. খাওয়ার কোনও কমতি নেই।
“ভিয়েতনামিরা যা পায় তাই খায়। তার কারণ একসময় অনেক খাদ্য সংকট ছিল এখানে। আমরা বেঁচে থাকার জন্য সব কিছুই খেতে শিখেছি।”
“আমরাও মাছ খেতে ভালবাসি। ভাত আর মাছ আমাদের রোজকার খাদ্য।“
সন অবাক হয়ে বলল, “তুমি নন-ভেজ খাও? ভারতীয়রা সব দেখি এখানে এসে ইন্ডিয়ান ভেজ রেস্টুরেন্ট খুঁজে বেড়ায়।”
“ভারতে অনেকে নন-ভেজ খায় সন।আমাদের উত্তরপূর্বের মানুষদের সঙ্গে তোমাদের খাবারে অনেক মিল।”
“আমি দিল্লী, বোম্বে আর ব্যাঙ্গালোর শুনেছি। ক্যালকাটা নামটা জানা ছিল না।”
শুনে খুব দুঃখ পেলাম। ওকে ম্যাপ খুলে পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলদেশ বোঝালাম। কলকাতায় একটা রাস্তার নাম হোচিমিনের নামে আর সেই রাস্তাতেই আমেরিকান কনস্যুলেট শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ভাবলাম ওকে শেখাই “তোমার নাম আমার নাম ..ভিয়েতনাম”, তারপর ক্ষান্ত দিলাম। বেচারা ট্যুরগাইড, বাংলাকে চেনে না জানে না, সেটা ওর দোষ নয়।
আমেরিকা ভিয়েতনামের সঙ্গে যে অহেতুক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল, তার প্রায়শ্চিত্ত আজও করে যাচ্ছে। এখন বাজারধরার জন্য আর দক্ষিন চীনসাগরের দখল নেওয়ার জন্য ভিয়েতনামের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক সবযুগেই অনেকরকম পরতে চলে, সব কিছু বন্ধুতা আর শত্রুতা দিয়ে বিচার হয় না।
হোচিমিনের ওয়ার রেমিন্যান্ট মিউজিয়াম দেখতে গিয়ে সেটা আরও বুঝলাম। এই মিউজিয়ামের ছবি আর ডিসপ্লেগুলো কিছুক্ষণ দেখার পর সংবেদনশীল মানুষের শরীর অসুস্থ লাগতে পারে। এতটাই অসহনীয় কিছু ছবি। রাসায়নিক যুদ্ধ, না পামবোমা, এজেন্ট অরেঞ্জ এর প্রভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে যাওয়া শিশু, গর্ভবতী মায়ের বিকলাঙ্গ ভ্রূণ, পরবর্তী প্রজন্মকে একইরকম বিকলাঙ্গ বানিয়েছে এই রাসায়নিক। সাধারণ মানুষের উপর যুদ্ধের ভয়ঙ্কর প্রভাবের সমস্ত কিছু সাজিয়ে রাখা রয়েছে সব গ্যালারিতে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় প্রচুর সাংবাদিক, চিত্রসাংবাদিক নিখোঁজ হয়েছিলেন। তাঁদের তালিকা আর ছবিও চমকে দেওয়ার মত। বিশ্বজুড়ে যত প্রতিবাদ হয়েছিল, সেই ডিসপ্লের মধ্যে একমাত্র ভারতীয় পোস্টারটি দেখলাম ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির তৈরি বাংলায় লেখা।
“এই দেখ, এটা আমাদের কলকাতার পোস্টার।”
“ওহ তাই! এখানে এর আগে কোনও ভারতীয় এটা আমায় নোটিশ করায় নিতো।” সন দেখলাম ছবি তুলে নিল, অন্য ভারতীয় ট্যুরিস্টকে এবার থেকে দেখাবে।
মিউজিয়ামের বাইরে আমেরিকার ব্যবহার করা বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র, চিনুককপ্টার, কামান, মিসাইল, বোমা, রকেট লঞ্চার সার দিয়ে সাজানো। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে বহু চেষ্টা করেও বাগে আনতে পারেনি আমেরিকা। সতেরো বছর ধরে প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ মানুষকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিল। একশো তেতাল্লিশ লক্ষ টন বোমা ফেলা হয়েছিল পুরো ভিয়েতনামজুড়ে। সাইগন একসময় হয়ে গেছিল গরীব ভিখিরি, ড্রাগমাফিয়া আর বড়লোক আমেরিকানদের শহর। দক্ষিণ ভিয়েতনামের পুতুল সরকারকে সরিয়ে উত্তর আর দক্ষিণ এক হয়ে গেল যেদিন, “ফল অব সাইগনের” সেই বিখ্যাত হলুদ বাড়িটার ছাদটা এখনও দেখা যায় সাইগন স্কোয়ার থেকে। মিউজিয়াম থেকে সোজা ওখানেই এলাম। একপাশে সাইগন পোস্টঅফিস, অন্যদিকে অপেরা হাউসের রাস্তা। সন ওর মোবাইল থেকে ১৯৭৫ এর ছবিটা দেখিয়ে আঙুল তুলে দেখাল, “ওই দেখ, আমেরিকানরা সবাই ওই ছাদ থেকে হেলিকপ্টার করে পালিয়ে গেছিল।”
ছবিটার সঙ্গে বিল্ডিংয়ের এখনও অনেকটাই মিল। প্রায় পঞ্চাশ বছরে পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক কিছু ঘটে গেছে। যুদ্ধ এখনও হয়, হয়েই চলেছে কোথাও না কোথাও। ভিয়েতনাম কিন্তু নিজেদের সামলে নিয়েছে। সুন্দর সাজানো গোছানো আধুনিক শহর হোচিমিনসিটিতে এখন যুদ্ধের ক্ষত কিছুই আর বাইরে থেকে চোখে না পড়লেও, ওরা মনে করিয়ে দেবে বারবার, এই দেশ আর শহর একসময় কী ভয়ঙ্কর সময়ের মধ্যে দিয়ে গেছে।
“আমরা যুদ্ধকে অতিক্রম করে এসেছি। এখন ওগুলো সব সাজানো রয়েছে খালি। ভিয়েতনাম এখন শান্তির দেশ। সাইগন এখন আমাদের সবথেকে ঝকমকে শহর।” সন হাসিমুখে বলে যাচ্ছিল।
“ নানধানসাইগন। মানে ভাইব্র্যান্ট সাইগন – এটাই এখন স্লোগান এই শহরের। সাইগন আনন্দের শহর। তুমি ভাল করে তাকিয়ে দেখ, বুঝতে পারবে।”
সিটি হলের সামনে হোচিমিনের বিশাল মূর্তি। চারপাশের রাস্তা সুন্দর বাগান দিয়ে সাজানো। একটু দূরে অপেরা হাউসের সামনে দেখি একটা হুডখোলা আমেরিকান গাড়িতে ওয়েডিং ফটোসুটহচ্ছে। ফরাসী বেশকিছু ক্যাফে আছে এই চত্বরে, একটার সামনে মার্সিডিজ ভিন্টেজ মডেল দাঁড় করানো। সুন্দরী যুবক যুবতীরা হাত ধরে হেঁটে যাচ্ছে। পরিবার নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে, কারো কোলে পোষ্য। দূরে বিশাল এক পার্ক, সেখানে ইচ্ছামত খেলছে বাচ্চারা। রাস্তায় অত্যাধুনিক গাড়ি, সুশৃঙ্খলভাবে চলেছে, নিয়ন্ত্রিত গতিবেগে। হোচিমিনসিটি আধুনিক হলেও সবাই যে খুব ব্যস্ত এইভাবটা যেন নেই।
“গেরিলাদের ক্যাম্প আর যুদ্ধের আসল স্বাদ নিতে চুচি টানেল যেতে হবে।” সন বলল।
“ চল, ওখানেই যাচ্ছি। মাটির তলায় বুকে হেঁটে যেতে পারবে তো? জঙ্গলের মধ্যে একদম আসল সব টানেল! ইচ্ছা হলে সত্যি স্টেনগান দিয়ে শুটিং প্র্যাকটিসও করতে পারো।”
“বল কি! পারব পারব।” উৎসাহে টগবগ করে উঠলাম।
“চল তাহলে বসে উঠে পড়। আজ তোমার ফিটনেস চেক হবে।” ঝকঝকে হেসে সন নিয়ে চলল চুচি টানেল দেখাতে।
……