মাগরিবের ছায়া

তারামনের ছেলে হাফিজুল এখন ফাস্ট ইয়ারের ছাত্র। অনেক ঝড়ের পর, ঝড় থামা দমকা আবহাওয়ার ভিতর দিয়েই ঋষি বঙ্কিম কলেজে ছেলে ভর্তি করাতে পেরেছে তারা। ভোলা মিঞার বেওড়া থেকে ষড়ানন তর্করত্নের এক ছেলে চিরঞ্জীবের ছোট ছেলে বিশ্বজীবনের বাড়িতে বাসনমাজার বৌ ভারতী হতে অনেক অনেক পথ পেরোতে হয়েছে তারামনকে।স্বাধীন ভারতের নাগরিক এক বিধবা নারীকে পরের বাড়িতে ঝি গিরি করতেও নিজের বাপ- দাদা- পরদাদার পরিচয়বাহী নামকে গোপন করে হিন্দু নাম নিতে হয়েছে, হিন্দু পরবে র,' দোল পূর্ণিমার নিশি নির্মল গগণ, মন্দ মন্দ বহিতেছে মলয় পবন' মুখস্ত করতে হয়েছে। পেটের দায়ে আপন ধর্মের নিয়মকানুন যে সব সময় পালন করতে পারে তারা , তা না হলেও নামাজ, রোজার দিকে ছোটবেলাকার ঝোঁক আজ ও তার ভিতর বেশ জোরদার ভাবেই আছে। খোদাতালা  এই অনিমিত নামাজ আদায়ে তার নছিবে গুনাহ লেখেন কি না এ নিয়ে একটু আধটু সংশয় থাকলেও এশার নামাজ নিয়মিত আদায় করে তারা।

 

 

 ভোলা মিঞার ইন্তেকালের পর পাশের ঘরের দেওসুন্দরীর জ্বালায় রামনরেশ মাঝির বাড়ি ছাড়তে হয়েছে তারার। এখন এই মালাপাড়ায় আশুবাবুর লাইনে উঠে আসার পর পাশের বাংলা মসজিদে সুবে সাদিকে মোয়াজ্জিনের আজানে ঘুম ভেঙে গেলেই ওজু সেরে ফজরের নামাজ আদায় করে তারা।নামাজ সেরে জায়নামাজে বসে সেজদা দিতে গিয়ে তার মনে পড়ে যায়, বিশ্বজীবন মাস্টারের বাড়ি হিন্দুর বিধবা সেজে ঝি গিরি করার দায়ে রোজ কেয়ামতে  জবাবদিহির কথা।এসব।ভাবতে ভাবতেই চৌকির উপর ঘুমন্ত হাফি আর মেয়ে রোহিমার দিকে চোখ যায় তারার। অনেক কষ্টে তিল তিল করে জমানো টাকায় গত মাসে এই সস্তার চৌকি টা কিনেছে সে।রাতে লম্ফোর আলোয় রামনরেশের বাড়িতে থাকতে কাঁথা সেলাই করতো তারা।

 

 

একটা জনকে কাঁথা সেলাই করে পেতো তখন পনের টাকা। ঝিয়ের কাজ করে সাকুল্যে হাতে আসে তারার পঞ্চাশ টাকা মাসে। কাঁথা সেলাইয়ের কাজ তারামনকে প্রথম জুটিয়ে দিয়েছিল তারার বাড়ির ভাড়াটে রেণু। তারা। তারকদাসী। কেউ কেউ বলে মালা, কিন্তু সে নিজে বলে পাল। রাণী মালার নাতবৌ যে কি করে পাল হয়, তা একমাত্র তারকদাসীর জীবনবৃত্তান্তের আনাচে কানাচেই হয়তো লুকিয়ে আছে। গরিবগুর্বো পাড়ার হতদরিদ্র পরিবারের গরীব থেকে গরীবতর , তার থেকে গরীবতম হওয়ার খবর কে রাখে?  ভোলা মিঞার বৌ তারামনকে মোটেই সহ্য করতে পারে না রাণী মালার সাত কাঠা জমির উপর একটামাত্র পাকা ঘর আর গোটা ছয় সাতেক টিনের ঘর, যেগুলির ভাড়াটেদের মাসিক ভাড়ায় তারকদাসীর সংসার চলে, দুগ্গির মায়ের। দুগ্গির মা, তারকদাসীর ভাড়াটে মুখ ব্যাঁকা সমরের বৌ রেণুকে নাম ধরে এই কুমোরপাড়াতে কেউ ই প্রায় আর  ডাকে না।এয়োতি বা বিধবা নারী, একবার বিয়োতে পারলেই খুব সহজেই হয়ে ওঠে অমুকের মা, কিংবা তমুকের ঠাঙ্মা। রেণু আমাদের তেমন ই হয়েছে কচিমণির মা।রেণুর মেয়ে কচিমণি , ছেলে বিশ্বদেব, দেবেশ্বর আর ছোটটার নাম থেকে গেছে ,' ফুচকা' ' পুঁচকে' র অপভ্রংশ আর কী।রেণুর ছোট ছেলে অনেকটা এই নদিয়া জুটমিল লাগোয়া শ্রমিক লাইনগুলোর দেহাতি পরিবারের লাইন দেওয়া অ্যান্ডা গ্যান্ডার মুনুয়া, মুনিয়া নামকরণের মতোই ' পুঁচকে' বলে বিবেচিত হয়েছিল। তা সেই ' পুঁচকে' অনেককাল নিজের নাম ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারতো না। 'পুঁচকে' তার উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যে হয়ে গিয়েছিল ' ফুচকে' ' ' আর কখনো সংশোচিত হয়ে ' ' হলো না কিন্তু 'পুঁচকে' র আকার টা জিভে জল আনা খাবারের মর্যাদা রাখতে সহজেই ' 'কার সংযুক্ত হয়ে গেল।

 

 

চটকলিয়া বোলচালের সঙ্গে বিয়ের আগে কখনো এতোটুকু পরিচয় ছিল না তারামনের।সে চিনতো মাটির মেহনতী এবাদতকে।চিনত জমি।জানতো ফসল ওঠার পর বা বীজ বোনার একটু আগে র সময়ে বাপের সঙ্গে জমি নিড়েন দিতে।বাপের হাতের গতির সঙ্গে নিজের হাতের গতি মেলাবার বৃথা চেষ্টার কথা এখনো মনে হঠাৎ হঠাৎ ভিড় করে আসে তারামনের।বাপ তো ঝড়ের বেগে চালাচ্ছে হাত।খুড়পি দিয়ে মাটি চ্যাঁচছে দুরন্ত গতিতে।একটু বড়ো আগাছা, যেগুলো খুড়পির ধারে গোড়া থেকে কেটে যায়, কিন্তু শেকড়টা সেই থেকে যায়।ফসলের চাড়া উঠলে পরে বড়ো জ্বালাতন এইসব ফেকুড় থেকে ওঠা আগাছা নিয়ে।ধান চাষের জমিতে এমন আগাছা থাকলে ধানের চাড়া বাড়লে সব সময় যে খুব বড়ো রকমের সমস্যা হয় , তা নয়।কিন্তু আলু , পিঁয়াজকলি, পালং শাক- যেসব ফসল টুকটাক রুইতে চায় তারার বাপ, সেসব গাছের চাড়া একটু বড়ো হলেই এইসব ফেকুড়ে আগাছা নিয়ে হয় মুশকিল। আলুর চাড়া একটু মাথা তুললেই ফেকুড়ে আগাছা থেকে ফাকুন্দা ধরে আলু গাছে।আস্তে আস্তে ছেয়ে যায় ফাকুন্দা একটা আলুর চাড়া থেকে আর একটায়।গোটা জমির আলুর চাড়াই তখন ফাকুন্দার সাদাটে আস্তারণে আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে যেতে শুরু করে।শেষে শুকিয়ে যায় একটু একটু করে।

 


আগাছার চরিত্র বোঝে না তারামন।জংলি ঘাস চ্যাঁছে যে ভাবে , ঠিক সেভাবেই জল বিচুটি, ঘাস বিচুটি, ফাকান্দা পাতা ও চ্যাঁচতে থাকে সে।এইসব মাঠ জ্বালানো আগাছা গুলোর কোনো সর্বজনগ্রাহ্য নাম নেই।এই ছেরামপুরে এক নাম তো হুগলীর সবলসিংহিপুরে আর এক নাম।এমন কি পাশের নৈহাটির রামচন্দ্রপুরে মাঠের লোক যে নামে ডাকে , ছেরামপুরের মানুষ সেই নামে ডাকে না। ফেকুড়ে আগাছাগুলো ও খুড়পি দিয়ে কেবল চ্যেছে দিচ্ছে তারা। মেয়ের কাজে একটু বিরক্ত হয় তার বাপ।খুড়পির মাথায় এইসব আগাছার উপরের অংশ টা কাটা হয়ে গেলেও শেকড়টা থেকেই যায়।তারপর একটা বৃষ্টির জল কি সেচের জল পেলে আবার সেইসব আগাছা পত পথ করে বেড়ে ওঠে।তখন ই হয়ে যায় সমস্যে। এদিকে আলুর চাড়া বা টমেটো গাছ মাথা তুলেছে। আর তার সঙ্গে এখানে সেখানে মিলে মিশে আছে এই ফেকুনে আগাছা। ফসলের চাড়াতে ফাকুন্দা ধরানো এই সব আগাছাগুলো কে তখন আলাদা করে উঠড়ানো মহা মুশকিলের কাজ।তাই আলচষার আগে বা সময় সময়ে এইসব আগাছা না তুলতে পারলে ফসল ভালো হয় না। মেয়েকে একটু রেগেই বলে তার বাপ; তোরে কইছি না, টান দিয়া একসব ফেকুনে আগাছারে এইক্কেবারে উপড়াই দিবি- তয় একখান কথাডাও মনে রাখতে পারস না। তার স্মৃতিশক্তি ঘিরে বাপ সন্দেহ প্রকাশ করছে- বেশ একটু রাগই হয় তারামনের। একটু ঝনঝনে গলায় বলে ;আসমানি পানির লাইগ্যা বইছি রে বাপ। বৃষ্টি পানিতে জমিন ভিজলেই তোর আবাদের কাল আওনের আগেই যতো কালশেওড়া, ফাকুন্দার চাড়ার দাদা-পরদাদা আছে, সকলরেই কবরে পাঠাব। হেসে ফেলে তারামনের বাপ। অতিরিক্ত পরিশ্রমের জেরে তার বলিষ্ঠ শরীরও ঘামে ভিজে উঠেছে। মেয়ের মিঠা মিঠা পাকা বুড়ির লাওস কথা শুনে পরানটা যেন পরিশ্রমের ধকলই ভুলে যায়। বদনা থেকে গলায় পানি ঢালে ঢকঢক করে। তারপর হাসতে হাসতে বলে; আমার পরদাদী আলিন আর কি!

 

তারামন লজ্জা পেয়ে যায় বাপের কথায়। উঠে গিয়ে দুহাত তফাতে বাপের পিঠে দুমদাম করে কিল মারতে থাকে। মেয়ের এই মারের আদরে প্রখর ধূপের ভিতরেও সব পরিশ্রম ভুলে খিল খিল করে হেসে ওঠে তারামনের বাপ। (ক্রমশঃ)

  • গৌতম রায়
  • অষ্টম