সকলেই কবি নয়…

জীবনানন্দ একটা নামএকটা অনুভূতি বললেও মনে হয় না তাঁর সম্পর্কে ভুল কিছু মূল্যায়ণ করা হবেকবিতার অনুভূতিতে যেন গড়া এক কবি মানসসেই কবি সত্ত্বায় আছে এক চরম বিশুদ্ধতাআছে এক নিবিড় অনুভূতি-

 

 

সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি’ —এ কথা তিনিই বলতে পারেন যিনি কবিতার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করেছেনএই উক্তির কথক জীবনানন্দের (১৮৯৯-১৯৫৪) ক্ষেত্রে এটা শুধুকবিতানয়, কবিতা অর্থে ভাষা-রচিত তাঁর অন্যান্য সমস্ত সৃষ্টি প্রক্রিয়া যেমন উপন্যাস আর ছোটগল্পগুলিকেও এর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে তবে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ইচ্ছেই তাঁর ছিল উপন্যাস-গল্প তাঁর ট্রাঙ্কেই থেকেছে বহুদিন পর্যন্ত সাধারণ দিনযাপনের জরুরি কাজকর্মটুকুর তুলনায় দুটো ভালো কবিতা লিখতে পারলে তৃপ্ত হওয়ার ব্যাকুলতা তাঁকে আজীবন ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়িয়েছেউনিশ শতকে নবচেতনার আলোকে ভাস্বরযুবা-কন্ঠের প্রতিধ্বনি হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্র যখন এই প্রশ্ন তুলেছিলেনএই জীবন লইয়া কী করিবতখন এই প্রশ্নের সামনে ছিল ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের পদানত যুবা সম্প্রদায় বিশ-শতকে দুই বিশ্বযুদ্ধ দেখে নেওয়া পৃথিবী যখন আরও জটিলতর জিজ্ঞাসার মুখে দাঁড়িয়েছে তখন জীবনানন্দ নিজের সংক্ষিপ্ত জীবনপঞ্জী দিয়ে সেই উত্তর খানিকটা দিয়েছেন, যদিও তাঁর জীবৎকালে তাঁকে খুব একটা কেউ বোঝেননি

 

 

কবিকে’ —এই সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তর যদি জীবনানন্দের নিজের ভাষ্য থেকে খুঁজে নিতে হয় তাহলে সেখানে দেখা যাবে সমাজের প্রতি একরাশ ক্ষোভ, হতাশা আর বিরক্তি জমে আছে ‘He has to resort to crafts other than the poet’s own -usually jobs petty and insecure-to make a living.’ (‘The Poet’s Plight in Bengal Today’ জীবনানন্দ দাশ প্রবন্ধ সমগ্র) এই প্রবন্ধেই তিনি উল্লেখ করছেন বঙ্গদেশের কবিদের কথা যাদের জীবন চালাতে গেলে থালা-বাসন বেচাকেনার মতো কোনো সাধারণ জীবিকা আশ্রয় করতে হয় জীবনানন্দের স্মৃতিকথার কথকদের বয়ান থেকে উঠে আসে এরকমই তথ্য যেখানে তিনি কোনো জীবিকায় সুস্থিত হতে না পেরে ছাতার বাঁটের বিক্রিবাটা, জীবনবীমার দালালি অথবা খবরের কাগজের হকার সবকিছুই করতে চেয়েছেন অথচ এটা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে কবিকেকবিহতে গেলে বিষয়ের প্রতি নতুন মনোভঙ্গি আর নিজস্ব ভাষা, কলাকৌশল সমেত হাজির করতে হয় নচেৎ কবি হওয়া যায় না ‘Poetry and other arts, however, frequently mean fresh approach in complete new language and technique in so much as what old authors have accomplished at one time or other is understood and treatment made in other way.’(‘The Poet’s Plight in Bengal Today’ জীবনানন্দ দাশ প্রবন্ধ সমগ্র) সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণায় উঠে আসে জীবনানন্দের কবিতা সম্পর্কে অপার মুগ্ধতার প্রসঙ্গ যেখানে জীবনানন্দের এই অনাস্বাদিত ও অননুকরণীয় ভাষা কৌশলের কথাটাই সর্বাগ্রে গুরুত্ব পায়তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী সাপ্তাহিক রেশন দোকানের লাইনে দাঁড়িয়ে একবার শোনা গানের কলি বারবার মনে আসার মতো করে ফিরে আসে সদ্য পড়ে ফেলা সাতটি তারার তিমির -এর (১৯৪৮) কয়েকটা পঙক্তি – ‘বিকেলের থেকে আলো ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে নিভে যায় -তবু/ ঢের স্মরণীয় কাজ শেষ হয়ে গেছে/ হরিণ খেয়েছে তার আমিশাষী শিকারির হৃদয়কে ছিঁড়ে;/ সম্রাটের ইশারায় কঙ্কালের পাশাগুলো একবার সৈনিক হয়েছে’ (‘সৃষ্টির তীরে’) নিজের অজান্তেই সুনীলের স্মৃতিতে ঠাঁই করে নিয়েছে জীবনানন্দের কবিতা কিন্তু কেন? এর কারণ অনুসন্ধানে দেখা গেল বেশ কিছু অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে যেমনঅনেকবোঝাতেঢের’, বিকেলের আলোপড়েযাওয়ার বদলেনিস্তেজহওয়া ইত্যাদি কিন্তু শুধু এটুকুই এই কবিতাকে মনে রেখে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট কারণ নয় পঙক্তি আর শব্দের পারম্পর্যের অর্থ নয়, বিষয়কে অন্যভাবে দেখা আর পূর্বজদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন কৃৎকৌশলে তাকে প্রকাশ করতে সমর্থ হওয়া, যা পাঠকের মনে শুধু কবিতার অর্থবোধ নয়, সুনীলের মতে তার অনুরণন জাগিয়ে তোলে 

 

 

বিষয়কে অন্যভাবে দেখা এবং দেখানোর ক্ষমতাই যেআধুনিককবিতার বীজমন্ত্র হতে চলেছে, অন্তত জীবনানন্দ যেভাবে দেখাতে চেয়েছিলেন, সেটা সেই সময়ে অনেকের কাছেই একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল তাই সবসময়ে স্বীকৃত হননি কারণ তৎকালে প্রচলিত সুগঠিত মূল্যবোধের বাইরে ছিল সেসব উপরন্তু অর্থসঙ্কটে বিপর্যস্তকবিদেশ পত্রিকার দপ্তরে ৮টি বা মতান্তরে ১০ টি কবিতা রেখে আগাম টাকা ধার চাইতে গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে আসেনবেশ কিছু কবিতা বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকার দপ্তর থেকেও বাতিল হয়ে ডাকযোগে ফেরত আসে যদিও তাঁর কাব্যগ্রন্থ বনলতা সেন বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ভবন থেকেই এক পয়সায় একটি সিরিজে ১২ টি কবিতার সংকলন হিসেবে কাব্যগ্রন্থ হিসেবে ছাপা হয় কিন্তু পরের দিকের কাব্যগ্রন্থ যেমন মহাপৃথিবী সমাদৃত হয়নিতাঁর জীবৎকালে সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পাদিত পূর্বাশা বা সঞ্জয় ভট্টাচার্য ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের যুগ্মভাবে সম্পাদিত নিরুক্ত পত্রিকা তাঁর কবিতার ভবিষ্যত সম্ভাবনা মূল্যায়ন করতে পেরেছিলেন কিন্তু সামগ্রিক স্বীকৃতি আর বোঝাপড়া তৈরি হতে হতে তাঁর জীবন চলে গেছে সময়ের পার অথচ তাঁর খুব সাধারণ বিষয় সংক্রান্ত লেখা যেমন, কলকাতা নিয়ে, সেখানেও দেখা যাবে এই কবির দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থিত, অন্তত তিনি যাকে কবিবলে মনে করেন ‘Calcutta is not a very clean city, nor is it, compared with London, Paris or New York, in any sense, very much captivating…The city, however, is overlaid with a crust of poverty, … Poor, ignorant and diseased people who unconsciously add to the city’s difficulties are, however, themselves probably the worst sufferers and not only physically. Their sufferings have frequently a deep psychological basis.’ (‘This City’, জীবনানন্দ দাশ প্রবন্ধ সমগ্র) এই বর্ণনায় প্রথমেই যেটা চোখে পড়ার মতো সেটা হল নিজের শহর সম্পর্কে কোনো উচ্ছ্বাসের পরিবর্তে এটা ধরিয়ে দেওয়া যে এটা লন্ডন, প্যারিস কিম্বা নিউইয়র্কের মতো পরিচ্ছন্ন শহর নয় এই পঙক্তি দিয়েই প্রবন্ধ শুরু হয়েছে এরপর আসছে তাদের কথা যাদের জন্য শহর অপরিচ্ছন্ন এবং অসুবিধার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে সমস্ত দরিদ্র, অজ্ঞ, অসুস্থ মানুষ যারা শুধু শারীরিকভাবে নয়, ‘মানসিকভাবেও সম্পূর্ণ ভগ্ন, অসুস্থ এই বর্ণনা সেই সময়ের যখন কলকাতা সাতচল্লিশের দেশভাগের চিহ্ন বহন করছে এই শহরে জীবনানন্দও নিজের পঞ্চান্ন বছরের জীবনের শেষ কুড়ি বছর কাটিয়েছেন ফলে এই দেশ-ভাগাভাগির মানসিক ভগ্নতা খানিকটা নিজেও বহন করছেন অথচ সেই যন্ত্রণাকে কোনো তথ্যে প্রকাশকরা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার অন্তত প্রবন্ধের ভাষায় তো নয়ই তবুও তথ্যের মধ্যে ছোট্ট করে ঊঁকি দিয়ে যায় সেই কথাটা যে এই অসুস্থ মানুষগুলোর যন্ত্রণাভোগের ভিত্তিতে আছে ‘a deep psychological basis’এই প্রসঙ্গটা গোটা প্রবন্ধে আর কোথাও উল্লিখিত হয় না কবিতায় দেখা যাবে এই কথাটাই ফিরে এসেছে অনন্য প্রকাশ কৌশল নিয়ে, অথচ বিষয়ের দর্শন একেবারেই নির্মোহ, উচ্ছ্বাসমুক্ত যেমনটা প্রবন্ধে দেখা গেছিলহাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল/ অথবা সে-হাইড্র্যান্ট হয়তো বাগিয়েছিল ফেঁসে/ এখন দুপুর রাতনগরীতে দল বেঁধে নামে/ একটি মোটরকার গাড়লের মতো গেল কেশে’ (‘রাত্রি’, সাতটি তারার তিমির), এখানে এই নগরী তো সেই ভাঙনের কলকাতাইবিষয় হিসেবে আছে নগর কলকাতার অসুস্থ, আশ্রয়হীন মানুষের উপায় না পেয়ে হাইড্র্যান্টের জল খেয়ে থাকার কথা কিন্তু শুধু তথ্য নয়, জীবনের কড়াবাস্তব আরও হাজারগুণেঅনুরণিতহতে থাকে যখন মোটরকার কাশতে কাশতেগাড়লেরমতো চলে যায়, মধ্যরাতদল বেঁধে নগরীতেনামে অথবা হাইড্র্যান্ট উপচে না গিয়েফেঁসেযায় নগর কলকাতা জীবন্ত হয়ে ওঠে আর কবিতায় ফুটে ওঠে সময় যে ভাষা তাঁর আগে কেউ ব্যবহার করতে পারেননি

 

 

জীবনানন্দের সঙ্গে প্রায়ই রবীন্দ্রনাথের তুলনা চলে আসে খুব সঙ্গত কারণেই আসে কবিতার ভাষাকে যুগের প্রয়োজন অনুযায়ী নির্মাণ করার দরকার হয় অনেকক্ষেত্রেই সময়ের থেকে এগিয়ে থেকে করতে হয় রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দ নিজ নিজ সময়ে দাঁড়িয়ে কবিতা এবং আরও স্পষ্ট করে বাংলা সাহিত্যের ভাষার নতুন প্রকাশ ক্ষমতা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের পরে জীবনানন্দের এই অবস্থান খুব স্পষ্ট কিন্তু জীবনানন্দের পর? সে উত্তরের জন্য হয়তো অপেক্ষা করতে হবে আরও কোনো যুগান্তের

  • ব্রতী গায়েন