'তোমায় নতুন করে পাব বলে'

রবীন্দ্রভাবনার এক ব্যতিক্রমী বিশ্লেষণ। প্রথাগত রবীন্দ্র আলোচনার বাইরে, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির ভিতর দিয়ে তাঁর প্রতিবাদী সত্ত্বার অন্বেষণ। এই খোঁজ রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে চেনায় আমাদের- 

 

 

আত্মপক্ষ ঘিরে যখন অভীক মজুমদার লেখেন; 'রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আবার একটা বই?' প্রবীণ এক অধ্যাপকের আর্তনাদের একটা অভিব্যক্তি মিশিয়ে তার সাময়িক জমে থাকা কথা, তখন আমাদের প্রত্যাশা জেগে ওঠে, নিশ্চিত আমরা রবীন্দ্র অন্বেষণের একটা নতুন ধারার চিন্তা চেতনা পেতে চলেছিঅভীকবাবুর সোনায় মোড়ানো কলম থেকে। এখানে সত্যিই আমাদের কৃতজ্ঞতা শেষ নেই অভীক বাবুর প্রতি, যেখানে তিনি লেখেন; 'অহরহ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, তাঁর সাহিত্য তো বটেই, এমনকি ব্যক্তির জীবন নিয়ে' কল্পিতকথাসাহিত্যও মুদ্রিত, প্রকাশিত হয়ে চলেছে। বিক্রিও ভালো। পাশাপাশি, সারস্বত সমাজে 'রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ' আজ আর শুধু শব্দ নয়তার 'অর্থ' আছে! পদোন্নতির জন্য 'বলি' চড়ানো সেইসব সমকালীন বেতনবাদীগ্রন্থাবলি প্রবীণ অধ্যাপককে সম্ভবত ওই অকরুণ খেদোক্তি করতে প্রবৃত্ত করেছিল।" এই কথা অভীক মজুমদারের পক্ষেই বলা সম্ভব। রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবন ঘিরে কাল্পনিক কাহিনী তৈরি করেতার থেকে বাজার তৈরি করা -এ প্রতিবাদ করবার হিম্মত একমাত্র ছিল অন্নদাশঙ্করহীন দুনিয়ায়শঙ্খ ঘোষের আর এখন আছে অভীক মজুমদারের।

 

 

 

অভীকবাবুর এই প্রতিবাদ মনে করিয়ে দেয় ন্যুনতম সরগম না জেনেও, টাকার জোরে ওয়েলিংটন স্কোয়ার থেকে পুরনো রেকর্ড কিনে সঙ্গীত বিশেষ 'অঙ্গ' হয়ে অতিবামেদের চটুল পত্রিকায় পর পর দুবার প্রবন্ধ লিখে নিজের বেতন বৃদ্ধির সুপারিশকারী কৃষ্ণদেশীয় অধ্যাপকের কথা। শাবাশ অভীকবাবু, এ তূণীরে এইসব ভন্ডদের মুখোশ উন্মোচনের জন্যে। রবীন্দ্রনাথকে যিনি কখনও নিজের কেরিয়ার তৈরির উপকরণ বলে মনে করেননি। অভীকবাবুর মতো মানুষ রবীন্দ্রনাথে অবগাহন করেছেন। রবীন্দ্রনাথের দ্বারা স্থিত হয়েছেন এবং সঠিক রবীন্দ্রনাথকে সমকাল এবং ভাবিকালের কাছে উপস্থাপিত করবার জন্য শঙ্খ ঘোষের যে প্রয়াস ছিল, সেই প্রয়াসের উত্তরাধিকার যাঁরা এখন বহন করছেনতাঁদের মধ্যে তিনি এক প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। ১৯০৫ সালে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি, এই আত্মকথাতেই, আত্মপক্ষ পর্যায়ের অভীক লিখছেন 'আমি তাই ঠিক করিয়াছি যে অগ্নিকাণ্ডের আয়োজনে উন্মুক্ত না হইয়া যতদিন আয়ু আছে, আমার এই প্রদীপটি জালিয়া পথের ধারে বসিয়া থাকিব।' এটি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে। উপলক্ষ ছিল বঙ্গভঙ্গ জনিত সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেক্ষিত। কিন্তু সেই প্রেক্ষিতকেই বর্তমানের আঙ্গিকে উপস্থাপনার ক্ষেত্রে অভীক লিখছেন, সারা জীবন ধরেই নানা সংঘাতমুখর মুহূর্তে, দেশকালের নানা সংকটে, রবীন্দ্রনাথ "প্রদীপখানি জালিয়া পথের ধারে বসিয়া থাকিব" সংকল্পে নিয়োজিত রয়ে গেছেন।

 

 

 

রবীন্দ্রনাথের এই নিয়োজনের সঙ্গে আমরা যেন অদ্ভুতভাবে অভিক বাবুর সংকল্পের একটা সাদৃশ্য খুঁজে পাই। অভীকবাবু কিন্তু কখনও কোনও অবস্থাতেই সত্য কথা বলতে দ্বিধা করেন না। সত্য, তা সে যত নির্মমই হোক, যত কঠিনই হোক এবং সেই সত্য প্রকাশ তাঁর জীবনে যত সংকটই ডেকে আনুক তাকে ফুটিয়ে তুলবার ক্ষেত্রে, উপস্থাপিত করবার ক্ষেত্রে, তিনি কখনও কোনওরকম ভয়ের কাছে, চাপের কাছে, আবেদন নিবেদনের কাছে, চোখরাঙানির কাছে -এতটুকু আত্মসমর্পণ করেনি। তাই এই ছোট গ্রন্থটির মধ্যে প্রাণের ঠাকুরতৃতীয় নেত্রদুই আমি শিশু:ভোলানাথ, বাঁশিসহজপাঠের ম্যাজিক, প্রণতি ইত্যাদি এই সমস্ত লেখাগুলো আমাদের কাছে রবীন্দ্রনাথকে কেবল আরও প্রাসঙ্গিক, আরও আরও আপনার জন করে তুলে ধরছে না। আমরা আমাদের সমসাময়িকতার সঙ্গে, বর্তমান সময়ে মানবতার যে সংকট, যে দীনতার আবর্তন, মানবসমাজকে ঘিরে কেবল বাংলায় নয়, কেবল ভারতে নয়, গোটা বিশ্বজুড়ে ঘটে চলেছে- তার সঙ্গে একটা অদ্ভুত যোগসূত্র রচনা করতে পারি। তাই যেন 'তৃতীয় নেত্রপ্রবন্ধের শুরুতে ১৩১১ সালের শ্রাবণ মাসের রবীন্দ্রনাথ লেখাপাগল, তোমার এই রুদ্র আনন্দে যোগ দিতে আমার ভীত হৃদয় পরাঙ্ মুখ না হয়। সংহারের রক্ত- আকাশের মাঝখানে তোমার রবিকরোদ্দীপ্ত তৃতীয় নেত্র যেন ধ্রুবজ্যোতিতে আমার অন্তরের অন্তরকে উদ্ভাসিত করিয়া তোলে। নৃত্য করো হে উন্মাদনৃত্য করো।যেন সেই নৃত্যের এই আহ্বান জানাচ্ছেন কবি। ১৯৩২ সালের ১০ জানুয়ারি হিজলি জেলে আটক রাজবন্দীরা রবীন্দ্রনাথের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে শ্রদ্ধা জানিয়ে চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে লেখা প্রথম পংক্তিটি ছিল; 'বাংলার একতারায় বিশ্ববাণীর ঝঙ্কার তুলিয়াছ তুমিহে বাউল কবি, তোমার জন্মদিনে আজ তোমাকে প্রণাম করি।হিজলি গেলে আটক থাকা রাজবন্দীদের এই যে রবীন্দ্রনাথকে সম্মোধন 'বাউল কবি' বলেএই শব্দটি এত প্রাসঙ্গিকভাবে কোনওরকম বাহুল্যের ধারপাশ দিয়ে না হেঁটেঅভীকবাবু তাঁর এই প্রবন্ধে আলোচনা করেছেন, যা আমাদের কাছে, একদিকে বাউল সত্ত্বা, আরেকদিকে রবীন্দ্রনাথের বাউল সত্ত্বা- দুটোকেই যেন নতুন করে মেলে ধরছে। অভীক মজুমদার লিখছেন, 'বাউল' শব্দটি লোকজীবনের অভিজ্ঞতা স্বতন্ত্র্যচিহ্নিতশব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে গতে-বাঁধা জীবনচর্যা বহির্ভূত আনন্দময় অথচ ঋজু কঠোর দার্শনিকের ছবি উঠে আসে (পৃষ্ঠা-২০)।"

 

 

 

আর এই অনির্বাচনীয় উক্তির পরই লোকধর্ম এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের এক অনবদ্য আলোচনা লেখক উপস্থাপিত করছেন। বাউলদের সার্বিক যাপনচিত্রের মধ্যে যে সাবলীল প্রতিবাদ লুকিয়ে আছে, তার অনুসন্ধানে অভীকবাবু যেভাবে এখানে নিজের বোধ এবং মেধাকে পরিচালিত করেছেন, অতীতের উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বা সমকালের ডক্টর আবুল আহসান চৌধুরীকে এই উপমার ভেতর দিয়েই অভীকবাবুর প্রতি শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা আমাদের উত্থাপিত করতে হয়। লোকজীবন ঘিরে, লোকধর্ম ঘিরে, বাউল ফকিরদের ঘিরে, আরও লেখা আমরা তাঁর কাছে প্রত্যাশা করি। বাউল ফকির তরিকা, যাকে থার্ড কমিউনিটির সাধন পদ্ধতি বলা হয়, সেই বেশরাদের নিয়ে অভীক বাবুর যে অবস্থান আমরা এই 'তৃতীয় নেত্র' নামক ছোট প্রবন্ধটির মধ্যে পেলাম আলোচ্য গ্রন্থটিতে, তা থেকে যেন প্রতিবাদের সংজ্ঞাও নতুনভাবে উদ্ভাসিত হয়ে পড়ছে। তাই অভীক লিখছেন, এক প্রতিবাদী কবির কাছে রাজবন্দীরা শুনতে চাইছিলেন ওই বিশ্বাসকে, সেটা আমরা খুব বেশি আলোচনা করিনি। ১৯৩২ সালের ১০ জানুয়ারি হিজলী জেলে আটক থাকা রাজবন্দীদের লেখা রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের শুভেচ্ছাবাহী এই চিঠিটিকে ঘিরেও আলোচনা বেশি একটা হয়নি। অভীকবাবু সেই চিঠি প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরে, প্রতিবাদের সংজ্ঞাকে রবীন্দ্রআলোকে যে গভীর ব্যঞ্জনার মধ্যে দিয়ে মেলে ধরতে পারলেন এখানে, তেমনটা সমসাময়িককালে খুব বেশি আমরা দেখতে পাই না। রবীন্দ্রনাথকে 'বাউল কবি' বলে সম্বোধন করার মধ্যে দিয়ে হিজলি জেলে রাজবন্দীরা সমসাময়িকতা, অর্থাৎ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সশস্ত্র বিপ্লববাদী চিন্তাভাবনা, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার অধিকার ঘিরে, সমসাময়িক জনহিল্লোল। বিশেষ করে কল্পনা দত্ত কে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি, যেগুলি পরবর্তীকালে রবীন্দ্র রচনাবলীর নানা সংস্করণে সংযোজিত হয়েছে। সেই সমস্ত কিছুই যেন আমাদের কাছে একটা নতুন অর্থ নিয়ে, নতুন ভাবনার জগতকে উন্মোচিত করবার লক্ষণীয় উপস্থাপিত হচ্ছে। অভীক বাবু, বাউল জীবনে গুরুর ভূমিকা ঘিরে ওয়াকিল আহমেদের অনুধ্যান উপস্থাপিত করেছেন।

 

 

 

শক্তিনাথ ঝায়ের কথাও বলেছেন। তাঁকে উদ্ধৃত করেছেন। সেই পরম্পরায় আমাদের প্রত্যাশা ছিল, আবুল আহসান চৌধুরীর ভাবনাচিন্তা ঘিরেও তিনি তাঁর এই অনবদ্য রচনায় কিছু বলবেন। সেই প্রত্যাশা আমাদের থেকে গেল। আমাদের বিশ্বাস পরবর্তী কোনও প্রবন্ধে, নিশ্চয়ই এই বিষয়গুলির অবতারণা তিনি করবেন। রবীন্দ্রনাথের নাটককে এই 'বাউল' যার তিনি এক অর্থে প্রচলিত প্রতিশব্দ করছেন 'প্রতিবাদ', সেই আঙ্গিকে যে অনবদ্য একটি ভাবনার মধ্যে দিয়ে দেখেছেন অভীকবাবু, বিশেষ করে রক্তকরবীর 'গোঁসাই', যাকে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অনুচরের অবস্থান আর তার বিপরীতে বিশু পাগলের যে অবস্থান, যে বিশু পাগল মতে, 'শেষে সে বিপ্লবীদের পথিকৃৎ' (পৃ২৪)। আবার উঠে আসছে 'প্রায়শ্চিত্তনাটকের কথা। মুক্তধারার কথা উঠে আসছে। প্রায়শ্চিত্ত নাটকের ধনঞ্জয় বৈরাগী চরিত্রটির কথা। যেখানে, 'রাজার তথা জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকসমাজকে উসকে তোলা তথা সংগটিত করাই তার কাজ।' (পৃ-২৪)। সেখানে ধনঞ্জয় বৈরাগীর লোকায়ত গুরুর মতো আচার-আচরণের মধ্যে দিয়ে, উদার মানবতাবাদী আহ্বান। আনন্দময় গতিমুখর উচ্ছ্বাস - একইসঙ্গে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। এ যেন এক সুদূরের পিয়াসি করে তোলে পাঠক চিত্তকে। পাঠকের কাছে বারবার মনে হয়, বাউল তত্ত্বের গুরুবাদের সঙ্গে রবীন্দ্র সৃষ্টির বাউলদের যে প্রতিবাদী ধারাসেই ধারার যে ফারাকটি, এখানে তাঁর অনবদ্য কলমে, অনন্য সাধারণ মেধায় এখানে প্রতিষ্ঠিত করেছেন লেখক, তেমনটা বোধহয় রবীন্দ্রনাথের এই নাটকের প্রতিবাদী চরিত্রগুলি ঘিরে খুব বেশি আলোচনা আমরা আগে পড়িনি।

 

 

 

রক্তমাখা চরণতল

অভীক মজুমদার

লালমাটি

১০০ টাকা

 

  • শঙ্খদীপ্ত ভট্টাচার্য