ভগিনী নিবেদিতা ও বিপ্লবী আন্দোলনের প্রথম যুগ

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নানা ধারার মধ্যে সশস্ত্র বিপ্লববাদী ধারা ছিল একটা আন্দোলনের একটা বিশেষ প্রবাহ। ব্রিটিশের বুকে হৃৎকম্পন তুলতে ভগিনী নিবেদিতাও রেখেছিলেন বিশেষ অবদান। জ্বলন্ত অগ্নি, স্বামী বিবেকানন্দের ভাবাদর্শ প্রচারে নিবেদিতার সংযোজন ঐতিহাসিক-

 

 

ভগিনী নিবেদিতা ভারতবর্ষে আসবার আগেই তাঁর নিজের দেশে একটা রাজনৈতিক পরিমন্ডলের ভিতরে বেড়ে উঠেছিলেন। নিবেদিতার  পরিবারের একটা বিপ্লবী ঐতিহ্য ছিল। আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর পিতামহ জন নোবেলের ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। নিবেদিতার পিতা স্যামুয়েল নোবেলের আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি বিশেষরকমের সহানুভূতি ছিল। নিবেদিতা প্রথম জীবনে আইরিশ হোমরুলের জন্যে লড়াই করেছিলেন "দি আয়ারল্যান্ড" দলে যোগ দিয়ে।

 

স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে নিবিদিতার যখন প্রথম যোগাযোগ হয়, তখনই বিবেকানন্দর ভিতরে তীব্রভাবে ব্রিটিশ শাসন বিরোধী মনোভাব তৈরি হয়ে গিয়েছে। যদিও বিবেকানন্দের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎতের এই পর্বে, ইংরেজদের ব্যক্তি চরিত্র নিয়ে একটা মুগ্ধতা নিবেদিতার ভিতরে ছিল। প্রথম অবস্থায় তাঁর এই ধারণাও ছিল যে, ইংরেজদের সঙ্গে একটা সম্মানজনক মীমাংসার চেষ্টা করলেও করা যেতে পারে। ইংরেজদের ব্যক্তিচরিত্র নিয়ে নিবেদিতার মুগ্ধতা প্রথম থমকে গেল বিবেকানন্দের পিছনে ব্রিটিশের গোয়েন্দা লেগেছে -এই খবরটা জানবার পরে। ১৮৯৮ সালের ২২ মে একটি চিঠিতে নিবেদিতা লিখছেন, "নির্ঘাত মাথায় গোলমাল হয়ে গিয়েছে। যদি স্বামীজীকে কোনওভাবে বাঁধা দেওয়া হয় তাহলে সত্যিই সরকার প্রমাণ করে দেবে যে তাঁদের মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে। এর ফলে যে আগুন জ্বলবে অচিরেই তার তাপে গোটা দেশ জ্বলবে। আমি? এই দেশের মাটিতে নিঃশ্বাস নিয়েছে এমন একজন সবথেকে বেশি রাজানুগত্যসম্পন্ন রমণী হিসেবেও যদি আমাকে দেখা হয়, তাহলে বলব, ভারতবর্ষে আসবার আগে আমি সত্যিই হয়তো বুঝিনি রাজানুগত্যের গভীরতা। সেই আমিই প্রথম জ্বলে উঠব।"

 


সেই চিঠিতেই এই পরিচিত মানুষকে নিবেদিতা লিখছেন, "ইংল্যান্ডে থেকে তুমি বুঝতেই পারবে না যে, জাতিবিদ্বেষ কাকে বলে। তিনজন শ্বেতাঙ্গিনীর সঙ্গে স্বামীজী ও অন্য নেটিভরা যখন কোথাও যান, তখন তাঁদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা হয়, কেমন অপমান তাঁদের সহ্য করতে হয় -তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না।" অল্প সময়ের ভিতরেই নিবেদিতার উপলব্ধি হয় যে, সন্ন্যাসীর অহিংসাকে একজন গৃহস্থের জীবনে স্থাপন করাকে বিবেকানন্দ কোনও অবস্থাতেই অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বলে মনে করেননি। বৌদ্ধদের অহিংসা নিয়ে বেশি রকমের মাতামাতিই ভারতবর্ষের পরবর্তীকালের ভীরুতার উৎস ভূমি - নিবেদিতার বোধে এটাই ছিল স্বামীজীর অভিমত (স্বামীজীকে যেরূপ দেখিয়াছি-ভগিনী নিবেদিতা। উদ্বোধন।পৃ-২৪)।

 

নিবেদিতা ভারতে আসার অল্প কিছুদিনের মাথায় কলকাতায় ভয়াবহ প্লেগ হয়। প্লেগের টিকা নিয়ে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কলকাতার মানুষদের ভিতরে প্রবলভাবে সরকার বিরোধী মনোভাব জেগে ওঠে। পরিস্থিতি এতোই জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, ইংরেজদের বিমাতৃ সুলভ আচরণে কলকাতার মানুষদের ক্রোধ একটা সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। ইংরেজরা সেই সময়ে কলকাতার প্রকাশ্য রাজপথে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে পর্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। নিবেদিতা এই সময়ে "অ্যান ইংলিস লেডি" ছদ্মনামে প্রত্যক্ষদর্শীর একটি বিবরণ পর্যন্ত একটি বিদেশি কাগজে পাঠিয়েছিলেন ১৮৯৮ সালের ৪ মে। এই পর্যায়ে স্বামীজীর কথার ভিতর থেকেই নিবেদিতার চেতনা ঋদ্ধ হয়েছিল এই ভাবনায় যে, ঈশ্বর শুভের মতোই অশুভের ভিতরেও বিকশিত হন। হিন্দুরাই কেবলমাত্র তাঁকে অশুভ রূপে উপাসনা করতে সাহস পায় না (স্বামীজীর সহিত হিমালয়ে-ভগিনী নিবেদিতা-পৃ২৯৩)। এই সময়কালেই ইংরেজ সম্পর্কে নিবেদিতার মনে খুব তাড়াতাড়ি অদল বদল হতে শুরু করেছিল। বিশ শতকের শুরুতেই প্রিন্স ক্রপটকিনের ভাবনা নিবেদিতাকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করে। তাঁকে তিনি ব্যক্তিগত ভাবেও জানতেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পরবর্তীকালে মহাত্মা গান্ধীর চিন্তাধারাতেও ক্রপটকিন একটা বড়ো রকমের প্রভাব ফেলেছিলেন। ভূপেন্দ্রনাথ দত্তের মতে, ১৯০০ খৃষ্টাব্দের মাঝামাঝি ক্রকটকিনের সঙ্গে নিবেদিতার প্রথম পরিচয় হয়(পেট্রিয়ট প্রফেট-ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, পৃ-৩৩৯)। প্যারিস ইন্টারন্যাশানাল এগজিবিশনে বিবেকানন্দের সঙ্গেও ক্রপটকিনের দেখা ও দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিল। তবে ক্রপটকিনের দ্বারা স্বামীজী কখনওই প্রভাবিত হননি বলে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত অভিমত প্রকাশ করেছেন।

 


অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসুর মতে, "অ্যানার্কিস্ট ক্রপটকিনের মতবাদকে ভারতীয় পটভূমিকায় প্রয়োগের ইচ্ছা করে নিবেদিতা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন, ভারতীয় রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে তার বিশেষ মূল্য আছে"।(নিবেদিতা লোকমাতা -শঙ্করীপ্রসাদ বসু। দ্বিতীয় খন্ড। পৃ-৫৭)
একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে ইংরেজদের অধীনস্ত হয়ে থাকা ভারতের মানুষদের কোন পর্যায়ে আত্মশক্তির উপর ভর করে সেই ইংরেজদেরই বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে তার পরিকল্পনা রচনায় নিবেদিতার জীবনে ক্রপটকিনের ভাবনা অনেকখানি প্রভাব ফেলেছিল। সেই সময়কালটা ছিল লড়াইয়ের প্রাথমিক স্তর। তাই সেই অবস্থায় ভারতের সামাজিক সংগঠনগুলির শক্তিবৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে মনে করেছিলেন নিবেদিতা। কারণ, যে শাসন কাঠামো ইংরেজ উপর থেকে ভারতের মানুষদের সামনে চাপিয়ে দিয়েছে তাতে দেশের সামাজিক সংগঠনগুলোই পারবে অকেজো করতে -এটাই ছিল নিবেদিতার বিশ্বাস। তাঁর বিশ শতকের সূচনা পর্বের ও চার বছর পরে রবীন্দ্রনাথ এভাবেই স্বদেশি সমাজের ভাবনা ভেবেছিলেন। সেদিক থেকে স্বদেশি সমাজ ভাবনায় নিবেদিতাকে রবীন্দ্র ভাবনার পূর্বসূরী বলা যেতে পারে। এমনকী অরবিন্দ ঘোষ, বিপিনচন্দ্র পাল বা পরবর্তীকালে মহাত্মা গান্ধীও নিবেদিতার স্বদেশি সমাজ ভাবনার মূল নির্যাস টুকু নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের স্বদেশি সমাজের চিন্তায় রাজনীতির কোনও ঠাঁই ছিল না। রাজনীতি ব্যাতিরেকে নিরুপদ্রব সামাজিক চিন্তা সম্ভব কিনা -সমাজবিজ্ঞানের একটি গুরুতর প্রশ্ন। নিবেদিতার স্বদেশি সমাজের ভাবনা রাজনীতি বাদ দিয়ে ছিল না।

 


১৯০০ খৃষ্টাব্দের এক নভেম্বর নিবেদিতা লিখছেন, "ভারতের ভরসা ভারতেরই হাতে-ইংল্যান্ডের হাতে নয়"। ইংরেজদের সম্পর্কে ১৯০১ সালের ১১ জানুয়ারি লিখছেন, "আমার সম্পূর্ণ আশাভঙ্গ হয়েছে, মন চিরতরে তিক্ত হয়ে গেছে।" সাম্রাজ্যকে অভিশাপ হিসেবে বর্ণনা করলেন ২৯ মার্চে লেখা চিঠিতে। স্ত্রীশিক্ষা বিস্তারের প্রসঙ্গে লিখলেন, "আমি কিন্তু একই সঙ্গে রাজনৈতিক প্রয়োজনকেও অত্যন্ত স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি"।(১০ জুনের চিঠি)
সেই বছরেরই ১৯ জুলাই মিস ম্যাকলাউডকে একটি দীর্ঘ চিঠি লেখেন নিবেদিতা। সেখানেই তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা খুব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। আমাদের জাতীয় আন্দোলনের এই পর্যায়ে নিবেদিতা সংশ্লিষ্ট চিঠিতে যে কঠোর মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন, তেমন কথা প্রকাশ্যে সমসাময়িক রাজনৈতিক নেতারাও বলতে পারেননি। বিবেকানন্দ এই সময়েই মেরী হেলকে লেখা একটি চিঠিতে এ সম্পর্কে তাঁর অভিমত জানিয়েছিলেন।
নিবেদিতা লিখছেন, "বুয়োর যুদ্ধ ইংরেজদের ব্যক্তিগত ও জাতিগত অধঃপতন সূচিত করেছে।.......ইংল্যান্ডের মধ্যে যা কিছু মহৎ ছিল সবই যেন মরে গেছে।"

 

বিশ শতকের সূচনাপর্বে ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারতবর্ষের পরিস্থিতি নিয়ে নিবেদিতা বেশ কয়েকটি বক্তৃতা করেন। ব্রিটিশ শাসনের মঙ্গলকর বিষয়গুলি নিয়ে যে প্রচার করা হয় তা অন্তঃসারশূণ্যতা -ইংল্যান্ডের মাটিতে দাঁড়িয়ে একথা নিবেদিতা প্রকাশ্যে বলেন(১৯০১ সালের ১৫ নভেম্বর এই বক্তৃতাটির প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।)১৯০২ সালের মার্চ মাসে নিবেদিতার সঙ্গে ওকাকুরার প্রথম সাক্ষাৎ হয়। কলকাতার রাজনৈতিক মহলের সঙ্গে ওকাকুরার যোগাযোগ তৈরি হয় নিবেদিতার মাধ্যমে। সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই পর্বের একটি মূল্যবান স্মৃতিচারণ করে গিয়েছেন (বিশ্বভারতী পত্রিকা, আগষ্ট, ১৯৩৬)। বাংলায় বিপ্লব প্রচেষ্টার সম্পর্কে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখছেন, "মৃত্যুর এক বৎসর পূর্বে তাঁর (বিবেকানন্দ)দুজন বিদেশি অনুরাগী (তন্মধ্যে একজন ছিলেন তাঁর শিষ্যা)কলকাতায় কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিকের সহায়তায় একটি জাতীয়তাবাদী দল গঠন করেন। এই দলটিই পরে বিপ্লববাদী আন্দোলনের সৃষ্টি করেছিল।"(স্বামী বিবেকানন্দ-ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, পৃ-২,৩)

 


বিবেকানন্দের শরীরত্যাগ নিবেদিতার কাছে ছিল তাঁর গুরুর চিরবিদায় নয়, ছিল "বিজয়ীর প্রত্যাবর্তন"(১৯০২ সালের ২১ জুলাইয়ের চিঠি)। নিবেদিতার সংস্পর্শে আসা বিপ্লবীরা সারদামণি দেবীর পদস্পর্শ করে বিপ্লবী আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করতেন। ব্রক্ষবান্ধব উপাধ্যায় "স্বরাজ" পত্রিকাতে লিখেছেন, "যদি তোমার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হইয়া থাকে তো একদিন সেই রামকৃষ্ণ পূজিত লক্ষ্মীর চরণপ্রান্তে গিয়া বসিও আর তাঁহার প্রসাদ-কৌমুদিতে বিধৌত হইয়া রামকৃষ্ণ শশীসুধা পান করিও -তোমার সকল পিপাসা মিটিয়া যাইবে।"(উদ্ধৃতিটি সঙ্কলিত হয়েছে শঙ্করীপ্রসাদ বসুর বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষের ১ম খন্ড। পৃ-৩৪৯)সারদা দেবীর চরণস্পর্শ করে বিপ্লবী কাজে আত্মনিয়োগের কাছটি যে সমসাময়িক বহু বিপ্লবীই করতেন তা নিবেদিতার একাধিক চিঠি থেকে জানা যায়(০৫-৮-১৯০৯)
সেই সময়ে রামকৃষ্ণ মিশন যে ব্রিটিশের গোয়েন্দা দৃষ্টিতে রয়েছে তা টেগার্টের রিপোর্ট থেকে জানা যায়। তা স্বত্বেও সারদা দেবীর তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা স্বামী সারদানন্দ বিপ্লবীদের কোনও বাঁধা দেননি।

 


সারদা দেবী একবার স্বামীজীর দেহাবসানের পর বলেছিলেন, আমার নরেন বেঁচে থাকলে ইংরেজ কি আর ওকে বাইরে রাখত? ফটকে পুরে রাখত। এটি শ্রীশ্রী মায়ের নিছক সন্তানপ্রতিম নরেনের প্রতি স্নেহ সম্ভাষণ ছিল না। স্বামীজী যেভাবে বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ হয়ে উঠছিলেন সারদা দেবী নিশ্চয়ই তার আঁচ পেয়েছিলেন। তাই তাঁর ওই ঐতিহাসিক উক্তি। গুরুর লীলাবসানের পর শ্রীগুরু মহারাজের সেবার উপকরণ হিসেবে শ্রীশ্রী মায়ের স্নেহের খুকি তাই একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন দেশের মানুষের সঙ্গে। এভাবেই ভারতের জাতীয় আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়লেন ভগিনী নিবেদিতা।

  • কুহু বাগচি