মাগরিবের ছায়া

গৌরীপুরে চটকল তৈরি করে ইংরেজ তখন লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছে। তাই গঙ্গার ধার ঘেসে জমিগুলোর উপর তাদের তখন ধীরে ধীরে নজর পড়তে শুরু করেছে। শীতল মুখার্জীর বাপ কর্তব্যনারায়ণ তখন নৈহাটি কাঁঠালপাড়া ধার ঘেসে গঙ্গা বরাবর একদম মুক্তোপুর শ্মশান পর্যন্ত জায়গার মালিক। ওদিকে মুক্তুপুর শ্মশান লাগোয়া কবরস্থান মাঠ জুড়ে বাংলা মসজিদের গা ঘেষে মুসলমান পাড়া। মুক্তোপুর শ্মশানের মাঝ বরাবর খানিকটা কুমোর, মালাদের বসবাস আছে। নৌকো লুঠের ভাড়াটে লুঠেরা হয়ে কর্তব্যনারায়ণ থেকে শুরু করে তার ছেলে শীতল মুখার্জীর শাগরেদ গিরি এই মালোদের ভিতরেই অনেকেই করে। তবে সেই শাগরেদির সর্দারি নিয়ে উধোম মালো আর নিতাই মালোর ভিতরে বেশ একটা গা খামচাখামচি ব্যাপার আছে। ষড়ানন তর্করত্নের ছোট ছেলে বিশ্বসুন্দরের নারী কল্যাণের ব্যবসার দেখভাল নিতাই মালো করে বলে সপ্তগ্রাম, গুপ্তিপাড়ার পড়ন্ত যৌবনেও যেসব মালপত্তর বোঝাই নৌকো যায়, মুখার্জীদের হয়ে সেসব লুঠতরাজের কাজে নিতাইয়ের একটু বেশি খায় খাতির আছে।
          

 

ষড়ানন তর্করত্ন তর্কশাস্ত্রের চর্চার দিকে এখন আর খুব একটা সময় দেন না। গুপ্তিপাড়া, বেউলে - পরপর দুজায়গায় শাস্ত্রবিচার সভায় হালিসহরের বারিন্দি বামুনদের কাছে বেশ কয়েকবার জব্দ হয়েছেন একদা কলির শঙ্করাচার্য বলে হাড়ের গরমে পৃথিবী অন্ধকার দেখা ষড়ানন। তারপর তারকেশ্বরের মোহন্তকে নিয়ে গোলমালের সময় ষড়াননের চালচলন ঘিরে নবদ্বীপ, গুপ্তিপাড়ার বামুনেরা এমন সব কথাবার্তা বলে বেরিয়েছে যে অমন দপদপানি করা ভাটপাড়ার বশিষ্ঠ গোত্রের দেমাকে ভুবন অন্ধকার দেখা পন্ডিত ও ভিজে বেড়ালের মতো মুখ নিয়ে ফিরে এসেছে সার্বভৌমতলায় নিজের বাড়িতে। বাড়ির পাশ দিয়ে তখন রেল লাইন পাতা শেষ হয়ে গিয়েছে।পরীক্ষার জন্যে একটা আধটা ট্রেন ঘসঘস আওয়াজ তুলে যাচ্ছে বইকি। সেই ট্রেনের আওয়াজকেই যেন যত নষ্টের গোড়া ধরে নিয়ে ছোট ছেলে বিশ্বসুন্দরের খোঁজ করলেন তর্করত্ন। ওদিকে বিশ্ব যে সেইদিনই তিলক গোস্বামীর তের বছরের বিধবা মেয়ে মানদা আর সুরেশ ঘোষালের ষোল বছরের বিধবা বোন  হরিপ্রিয়ার বৈধর্ব্য জীবনের সবটুকু ক্লেশ নিবারণের জন্যে তাদের নিয়ে নৌকা যোগে কাশীযাত্রা করেছে। সঙ্গে আর সব বিশ্বস্ত লোকেদের সাথেই মুক্তোপুর শ্মশানপাড়ের নিতাই মালো অবশ্যই রয়েছে। কাশীর বাঙালিটোলার সোনারপুরায় ষড়ানন তর্করত্নের বিশাল বাড়ি। কোচবিহার মহারাজার ঘনিষ্ট বৃত্তের  মানুষ ছিলেন ব্রজসুন্দর দেববর্মা। ব্রজসুন্দরের উপর তখন মহারাজার এডি কোং এর শণির দশা চলছে।কোচবিহারে প্রায় ঢুকতেই পারে না ব্রজ। গোসানীমারীর দিকে যে বিস্তর জমি জিরেত মহারাজকে ঘড়া ঘড়া তেল ঢেলে নিজের কব্জায় আনতে পেরেছিল ব্রজ,  মহারাজের ই এ ডি কোং এর শণির নজরে সে সব তখন প্রায় বেহাত হয়ে যায় আর কি।

 

কীভাবে না কীভাবে ব্রজসুন্দরের সঙ্গে হঠাৎ করেই যোগাযোগ হয়ে যায় ষড়াননের। ভাটপাড়ার এই তাবড় পন্ডিতকে পেয়ে যেন হাতে চাঁদ পেল ব্রজসুন্দর। একদম পেড়ে ধরল তর্করত্নকে। যে করেই হোক এই বিপদ থেকে আমাকে উদ্ধার করে দিতে হবে ঠাকুর - ষড়াননকে বলে ব্রজসুন্দর। ভাটপাড়ার বামুন মানেই তখন 'ঠাকুর' !  পেটে বোমা মারলেও নর শব্দে ষষ্ঠী মনে করে বলতে পারবে কি না সন্দেহ, কেবল পেটে আসছে, মুখে আসছে না বলে বিড়বিড় করবে- তবুও বশিষ্ট গোত্রের জোড়ে তারা 'ঠাকুর' ! ষড়ানন অনেক ছক কষলেন ব্রজসুন্দরকে ঘিরে। মক্কেলকে খেলিয়ে তুলতে কখনও মুখ গম্ভীর করলেন। দুপাশে বেজায় মাথা নাড়লেন। মুখ দিয়ে 'চুক চুক' আওয়ান। চোখ মটকালেন। পিটপিটও করলেন। তারপর বেশ ধ্যানস্থ থাকলেন মিনিট কয়েক। অবশেষে মুখ খুললেন, ওই রাজকর্মচারী তোমার সঙ্গে চরম শত্রুতা করে চলেছে। দশমহাবিদ্যা দিয়েই তাকে শায়েস্তা করতে হবে। ব্রজসুন্দরের কোচবিহারে শাক্ত ধারার চর্চা নেই বললেই চলে। আছেন রাজপরিবারের কুলদেবতা মদনমোহন। তাঁকে একটু আধটু আপদে বিপদে মানেন ব্রজসুন্দর। বৈরাগীদীঘির জলে হাত ধুয়ে পদ্মপাতায় মুড়ে সন্দেশ নিয়ে মদনমোহনের পুরুত ঠাকুরের হাতে দিয়েই খালাস ব্রজ। কিন্তু কখনওই ভুল করেও মদনমোহন লাগোয়া দুর্গাবাড়ির চাতালে ওঠেন না। কারণ, উঠলেই প্রথা মতো দশ পাক চক্কোর খেতে হবে। অতো চক্কোর খাবে কে? তাই ষড়ানন তর্করত্নের কথা শুনে একটু ভয়ার্ত গলায় বললেন; তাহলে উপায় ঠাকুর? ষড়ানন বুঝলেন ফাৎনা ডুবেছে। এবার একটানে মাছ তুলতে গেলে বড়শি ছিঁড়ে পালাতে পারে মাছ। একটু ভাবে ষড়ানন, বড়শির মুখে চাড়টা ঠিক মতো দেওয়া হয়েছিল তো? এই ভাবনাটাকে আরো একটা গদগদে হয়ে উঠতে দেওয়ার তাগিদেই তখন সে বলে, উপায় তো আছে।কিন্তু আমি এখন আঠরো খন্ড পুরাণের বাংলা অনুবাদেই নিজেকে ব্রতী রেখেছি। পুরাণের আদিরসের চুটকি চাটকা যে রাজ দরবারের খাস লোক ব্রজসুন্দর জানে না, তা তো আর নয়। কিন্তু রাজ অনুগ্রহ ফিরিয়ে আনতে এই ভাটপাড়ার বামুনকে তেল তামাক করতে গেলে তো আর আঠারো খন্ডের আঠালো রস নিয়ে আর এখন ভাবলে চলবে না। পুরাণের অনুবাদের নাম শুনে একটু অন্যমনষ্ক হয়ে গিয়েছিল বই কি ব্রজকিশোর। তার মনস্চক্ষে তখন ভেসে উঠেছিল বাংলা ভাষায় নিজে নিজে সেই পুরাণের টইটম্বুর রস নেওয়ার মৌতাত। কিন্তু এইসবই সামলে নিতে হল ব্রজকে। বেশ একটু গদগদে স্বরে আবারও বলল, আপনাকে যখন পেয়েছি, ছাড়ছি নেকো। আমারে অমন যে ঠকাইতেছে,  তার বিহিত করত্যাই হবে আপনেরে।

 

কোচ বংশদ্ভূত হলেও কোচবিহারের অন্য দশটা অভিজাত মানুষদের মতোই একটু ভাটির দেশের টান কথায় ব্রজের। খোদ মহারাজের ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় এই ভাটির দেশের টান সব সময় গোপন থাকে না। আর মহারাজ নিজেও সেই টান গোপন রাখার জন্যে কোনও সযত্ন প্রয়াসই জারি রাখেন না। গাঁথা মাছ আর ফসকানোর লক্ষণ নেই বুঝে ষড়ানন বলে 'মহানির্বাণ তন্ত্রে'  অবশ্য এই জায়গা থেকে উত্তরণের কিছু বিধি বিধান আছে। কিন্তু সে বড়ো কঠিন। আর সেই যাজনযোজন জানা মানুষেরও আজকাল বড়ো অভাব। পারবে কি তুমি সেসব করতে? - একটু বেশি গম্ভীর আর পাংশুটে মার্কা মুখ করে কথাগুলো ব্রজের উদ্দেশে বলে সে কি বলে, কেমন আচরণ করে -এইসব বোঝবার জন্যে উদাস চোখে বাইরের দিকে চেয়ে রইলেন ষড়ানন। ব্রজকিশোর যেন ষড়াননের নিশ্বাসের প্রতি শব্দের খন্ড বিখন্ড প্রহরগুলো শুনতে পাচ্ছে। অত্যন্ত উত্তেজিত গলায় ব্রজ বললে, আপনি একবার বলেই দেখুন না ঠাকুর। দেখুন না কি করতে পারে এই ব্রজসুন্দর। ষড়ানন বুঝলেন, মাছ কে আর জলের ভিতরে খেলানোর দরকার নেই। কি জানি! বেশি খেলালে যদি আবার শেষমেষ হিতে বিপরীতই শুধু না, হাড়ে সব্বোনাশ হয়ে যায়?  তাই মাছকে এখন পাড়ের জল থেকে একটু ঝটকিটে পটকিয়ে ডাঙাতে তুলে ফেলাটাই সবথেকে উচিত কাজ বলে ঠিক করে নিলেন ষড়ানন। উপায় হলো, মহানির্বাণ তন্ত্র যে দশমহাবিদ্যাকে তুষ্ট করবার পথ নির্দেশিকা দিয়েছেন, সেই নির্দেশিকার অনুসরণ।

 

ব্রজ জানতে চায় কী সেই নির্দেশিকা? একটু বিরক্ত ভাবই দেখালেন ব্রজ। সারা জীবন সাধনা করে যে তন্ত্রের কুলকিনারা মেলে না, তার সারৎসার কি তুমি এক লহমায় জেনে নিতে চাও? ব্রজ বাবাজীবন, তোমার রাজকার্যের মতো কোনও রাজনীতির কুশলী চাল দিয়ে বজ্র কঠিন পথকে সহজ করে নেওয়ার মতো কোনও রাস্তা যে এই তন্ত্রে নেই। একটু যেন বেশি রকমের কাঁচুমাচু হয়ে গেল ব্রজকিশোরের মুখ। কে বলবে এই ব্রজকিশোরই গোসানীমারীতে,  রাজাভাতখাওয়াতে কোচবিহার রাজের কোচদের দেওয়া খাস জমি কায়দা কানুন করে নিজের,  মেয়ের,  বৌয়ের নামে বিঘের পর বিঘে নিজের নামে করে নিয়েছে। এমনকী খোদ কোচবিহার শহরে তোর্ষার নতুন করে জেগে ওটা দুটো চর নিজের নামে করে নিয়েছে। ঢানঢিঙগুড়িতে গদাধরের ধার ঘেষে সেই নৈহাটির শীতল মুখার্জী যেমন গঙ্গার ধার ঘেঁসে জমি বাগিয়েছে, তেমনটাই গদাধরের ধারে করেছে এই ব্রজকিশোরই।(ক্রমশঃ)

  • গৌতম রায়
  • সপ্তম
img
আগের পাতা
সাঁকোপথ