সেকালের গ্রাম আর মানুষ

সময় বদলায়।বদলে যায় অর্থনীতির আঙ্গিক। সেই তালেই বদল হয় আমাদের সামাজিক জীবনের নানা চালচিত্র। অতীত মানেই সব ভালো।আর বর্তমানেই সব খারাপ -এই কূপমুন্ডকতার বাইরে মানুষ এবং সমাজকে দেখতে গেলে, সেকালের সমাজটাকেও একটু জানা দরকার- 
 
 
ভাবতে বেশি অবাক লাগে এমন একটা সময় আমাদের এই বাংলার গ্রামীণ পটভূমিকায় ছিল যখন চা বিড়ি সিগারেট -এসবের নাম গ্রামের সাধারণ মানুষদের কাছে প্রায় অজানা ছিল। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি তাঁর জীবনের যে স্মৃতিচারণ করেছেন, তাতে আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে, হুগলি জেলার আরামবাগ সন্নিহিত এলাকার গ্রামের ছবিটা এরকমই তিনি এঁকেছেন। তামাকের ব্যবহার এটা বাংলার বহু কালের একটা প্রচলিত প্রথা। হাট থেকে কিনে আনা হত ভালো তামাক পাতা। তামাকের মসলা এনে চিটে গুড়ের সঙ্গে ঢেঁকিতে কুটে তামাক তৈরি হত। তেমন ব্যবস্থা আজও হয়ত গ্রামাঞ্চলে কোনও কোনও ধূমপায়ীদের মধ্যে প্রচলিত আছে। আমরাও ছোটকালে, আজ থেকে ৭০-৭৫  বছর আগে, 'গুড়ের নাদা' শব্দটা সঙ্গে খুব পরিচিত ছিলাম। আবার 'গুড়ের নাগরী' ও বলা হত। ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের শীতকালে চাদর দিয়ে মাথামুড়িয়ে, গোটা শরীরটাকে মুড়িয়ে দিলে, কেউ কেউ মজা করে বলত, কীরে? কেমন গুড়ের নাগরীর মত তোকে সাজিয়ে দিয়েছে।
গুড়ের পুরো কলসি ভর্তি করে তার মধ্যে হাট থেকে কিনে আনা তামাক রেখে দেওয়া হত। প্রায় ২০-২৫ দিন ধরে তেমন অবস্থাতেই থাকত সেসব। তারপর সেই তামাক থেকে ধূমপায়ীদের উপযোগী সুগন্ধ নির্গত হত। তাঁরা সেটা সুগন্ধ বললেও, মেয়েদের কাছে সেটা আদৌ সুগন্ধ বলে মনে হত না।
 
 
সেই সময়কালের যে সমস্ত সাহিত্যিক উপাদান পাওয়া যায়, সেখানে এই তামাকের কটু গন্ধকে অনেকেই, বিশেষ করে, হাতেগোনা দু একজন মহিলা সাহিত্যিক তখন যে সমাজচিত্র রেখে গিয়েছেন, সেখানে এই গন্ধকে কটু গন্ধ বলেই উল্লেখ করা হয়েছে। নূরুন্নেছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনীর (মুর্শিদাবাদের মানুষ ছিলেন) লেখায় তামাকের এই গুড়ের নাদায় রাখার পরের গন্ধ ঘিরে মেয়েদের বিরক্তির কথা আছে।
তামাকের অপকারিতা, তামাক কীভাবে ফুসফুসের ক্ষতি করে এসব ঘিরে তো আজ থেকে ৭০-৮০ বছর আগেও সেভাবে সাধারণ মানুষের মনে সচেতনতা ছিল না। আর মফস্বলে এবং গ্রামে তখন অতিথি আপ্যায়নের ক্ষেত্রে তামাকের একটা বিশেষ রকমের গুরুত্ব ছিল। একটু সমৃদ্ধশালী  পরিবারগুলিতে সব সময় মালসায় করে আগুন থাকতো। নানান কারণে যাঁরা আসছেন বাড়িতে, তা তিনি কাজের জন্যই আসুন, আর সাধারণ গল্পগাছা করতেই আসুন ,তামাক না খেয়ে, তামাক না পুড়িয়ে, বাড়ি থেকে তিনি যেতেন না। আবার এই তামাকের ক্ষেত্রেও একটা অদ্ভুত জাত্যাভিমানের পরিকাঠামো ছিল সেই যুগে। ব্রাহ্মণেরা অ ব্রাহ্মণের হুঁকোতে  খেতেন। আবার অব্রাহ্মণদের মধ্যেও নানা ধরনের জাত পাতের বেড়াজল ছিল। একে অপরের হুকোয়ে তামাক না খাওয়ার ব্যাপারটা ছিল বেশ প্রচলিত। বিভূতিভূষণের সৃষ্টিতে এই ধরণের বহু ঘটনা পাওয়া যায়। আর মহিলা অতিথি এলে পান দোক্তার ব্যাপারটা ছিল সাধারণ স্বাভাবিক ব্যাপার। আজকাল যেমন আতিথ্যের ক্ষেত্রে চা ব্যাপারটা একটা প্রাথমিক বিষয়, ঠিক তেমনভাবেই, সেকালে তামাকের ব্যবহারটা ছিল আতিথ্যের একটা বড় অঙ্গ।
 
 
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উনিশ শতককে ঘিরে অসামান্য উপন্যাস 'সেই সময়'তেও আমরা দেখেছি, কলকাতার নবোত্থিতবাবু সমাজ, তাঁদের মধ্যে অতিথি সৎকারের প্রাথমিক জায়গাটাই ছিল এই তামাক। মফস্বলের পরিবারগুলিতে এই প্রথার চল সারা বছর থাকলেও, গ্রামে কিন্তু সেটা বেশি দেখতে পাওয়া যেত দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে। তখন ধীরে ধীরে গ্রামের বিত্তবানেরা গ্রাম থেকে শহরমুখো হওয়ার চেষ্টায় রত রয়েছেন। প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ নিয়ে যাঁরা শহুরে চাকরি-বাকরি পাচ্ছেন, তাঁরা ধীরে ধীরে গ্রাম থেকে শহরমুখো হচ্ছেন। তাঁরা বাইরে নানা ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য করে যাঁরা বিত্তবান হয়ে উঠছেন, তাঁদেরও নাড়ীর টানটা কমতে শুরু করেছে, তাঁরাও বাস্তব প্রয়োজনে এবং সামাজিক কৌলিন্যের তাগিদে শহরমুখো হচ্ছেন। কিন্তু শারদোৎসবকে কেন্দ্র করে তাঁদের মধ্যে গ্রামে যাওয়া, গ্রামের পৈতৃক দুর্গাপুজোর ব্যাপারটি তদারকি করা -এ সমস্ত প্রতি একটা বিশেষ রকমের মানসিক আকর্ষণ ছিল।
 
 
 
দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে এই বঙ্গেই হোক বা সেকালের পূর্ববঙ্গই হোক, এই যে মানুষের দেশের বাড়িতে ফেরার একটা টান সেটা ছিল একটা সামাজিকতার বিশেষ পর্যায়ে, শঙ্খ ঘোষের 'সুপারিবনের সারি' ছোটদের জন্য লেখা এই অসাধারণ স্মৃতিকথার মধ্যেও আমরা দেখতে পাই।দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে সেকালে কলকাতা শহরে কর্মরত মানুষজনদের দেশের বাড়িতে ফেরবার জন্য কী ধরনের আকুলতা কাজ করত শঙ্খবাবু তা অসাধারণ স্বাদু গদ্যে লিখেছেন। আসলে ধর্মীয় অনুসঙ্গের সঙ্গে সঙ্গেই সামাজিক অনুষঙ্গে জাতপাতের বেড়া ভেঙে এক অসাধারণ মিলন উৎসব হিসেবে দুর্গাপুজো সদর মফসলে একটা বিশেষ পর্যায়ে হয়ে দাঁড়াত। যখন স্বাধীনতা প্রায় আমাদের দোরগোড়ায়, নানা ধরনের রাজনৈতিক চাপানউতর ধরে হিন্দু মুসলমানের সম্পর্ক বিভিন্ন প্রকারের দোলাচালের ভেতরে যাচ্ছে, সেই সময়ও কিন্তু হিন্দু বাঙালির দুর্গোৎসবকে,বাঙালি মুসলমান, উৎসবের আঙ্গিকে দেখবার জায়গা থেকে কোনও অবস্থাতেই নিজেদের সরিয়ে নেয়নি। বিশেষ করে শারদ উৎসবকে কেন্দ্র করে সেকালে যে ধরনের বিনোদন, অর্থাৎ, খাওয়া দাওয়া, যাত্রা-থিয়েটার বহু ক্ষেত্রে কলকাতা থেকে নামিদামি যাত্রার দল পূর্ববঙ্গের গ্রামগুলিতে কল শোতে আসতেন, আবার গ্রামের মানুষেরা শখের থিয়েটার করতেন এই দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে।এমনকি সেই সব থিয়েটারে অভিনয়ের ক্ষেত্রে অনেক জায়গাতে হিন্দু-মুসলমানের কোনও বিভাজন থাকত না।
 
 
 
একটা সময় ছিল, যখন শারদোৎসবকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ শিল্পকে আলাদা করে প্রমোট করতে হত না। শারদ উৎসবের নানা ধরনের অনুসঙ্গ ,তার মধ্যে ধর্মীয় অনুষঙ্গ আছে সামাজিক অনুসঙ্গ আছে। সবকিছু সঙ্গেই গ্রামীণ শিল্পগুলির একটা অদ্ভুত সংযোগ ছিল। সেকালের গ্রামে বা মফস্বলেও বাড়ির পুজোতে মাটির তৈরি বাসনপত্রের একটা বড় রকমের গুরুত্ব ছিল। একেবারে পূজার্চনার জন্য কাঁসা-পিতল, তামা ইত্যাদি দামি ধাতুর বাসনপত্র ব্যবহৃত হলেও, পুজোর নানান আচারের সঙ্গে এবং পুজোকে ঘিরে যে সামাজিক সম্পর্কের একটা আদান-প্রদানের বিষয় ছিল, সেখানে মাটির বাসন, বেতের নানা ধরনের সামগ্রী, বাঁশের নাম নানা ধরনের সামগ্রী, সেগুলো ছিল একটা বিশেষ রকমের গুরুত্ব। আজ যদি একজন সাধারণ গ্রামের মানুষকে জিজ্ঞেস করা হয়,  তিজেল কাকে বলে? মুড়িভাজা খাপরি কাকে বলে? হাতসরা, বুটিসরা, কলিকা, টাঁটি, ধুনাচুর, ভাতের ফ্যানঝড়া ডাবা, ডাল রাখার ডাবা- এসব কী জিনিস? বেশিরভাগ মানুষই উত্তর দিতে পারবেন না। শারদোৎসবকে কেন্দ্র করে রান্নাবান্নার যে আয়োজন হত, সেখানে এই ধরনের নানারকম মাটির তৈরি জিনিসপত্রের খুব চাহিদা ছিল এবং প্রয়োজনীয়তাও ছিল।
 
 
প্রকৃতিবান্ধব এই সমস্ত জিনিসগুলো ধীরে ধীরে আমাদের সমাজ জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। একটা সময় যে কোনও ভোজ বাড়িতেই কলাপাতা, মাটির গেলাস -এগুলো ছিল খাওয়া-দাওয়ার সঙ্গেই একেবারে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত একটা বিষয়। আজ পরিবেশ বিজ্ঞান ঘিরে যে নিত্যনতুন গবেষণা হচ্ছে, পরিবেশবিদেরা যে সমস্ত ভাবনাচিন্তা আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করছেন, সেখানে দেখতে পাওয়া যায়, পরিবেশ বান্ধব জিনিসপত্রের উপরেই তাঁরা সব থেকে বেশি গুরুত্ব আরোপ করছেন। এছাড়া স্বাস্থ্যবিধির ক্ষেত্রেও এই ধরনের পরিবেশ বান্ধব জিনিসপত্রের একটা বিশেষ ধরনের উপকারিতা আছে। 
 
 
আজকাল দুর্গাপুজো থেকে শুরু করে যে কোনও পারিবারিক, সামাজিক, এমনকী রাজনৈতিক দলগুলি আয়োজিত নানা ধরনের ভোজে এই ধরনের পরিবেশবান্ধব বাসনপত্র ব্যবহারটা কমে গিয়েছে। নেই বললেই চলে। থার্মোকলের থালা, সেখান থেকে কিছু রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া মানুষের শরীরে হতে পারে কিনা বা কাগজের গেলাস, সেখান থেকে কোনও রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া মানুষের শরীরে হতে পারে কিনা, তা নিয়ে আমরা আলাপ আলোচনা করি। গবেষণা করি। সেমিনারে বক্তব্য রাখি। খবরের কাগজে লিখি। কিন্তু ব্যবহারিক জীবনে সেই সচেতনতার পরিচয় কিন্তু আমরা রাখি না। এমনকী যে সমস্ত জায়গায় খুব নামি দামি ক্যাটারার ব্যবহার করা হয়, ক্ষেত্রে সেই সব জায়গাতেও, ওইসব কাঁচের, পোর্সিলিনের থালা ইত্যাদি ব্যবহৃত বাসনপত্র, পরিষ্কার করবার ক্ষেত্রে কতটা হাইজিন মেনে কাজ করা হয়, তা নিয়েও কিন্তু পরিবেশবিদরা, পুষ্টিবিদেরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম ভাবনাচিন্তা এবং সংশয়ের কথা বলেছেন।

  • কুহু বাগচি