শতবর্ষে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়

কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথের গানে সুচিত্রা মিত্রের মতই এক সাধিকা। নিজেকে নিভৃতে রেখে রবীন্দ্রনাথে আত্মনিবেদন - এটাই ছিল কণিকার যাপনচিত্রের সবথেকে বড় বৈশিষ্ট্য। এমনভাবেই এক আত্মমগ্নতার জগত তিনি তৈরি করেছিলেন-
 
 
 
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়,রবীন্দ্রনাথের গানের এক নক্ষত্র। আজ তাঁর জন্মশতবর্ষ পূর্তির মুখে একটাই প্রশ্ন মনে জাগে, শেষ জীবনে কেন কণিকা এন জি ও র সঙ্গে নিজেকে এভাবে সম্পৃক্ত করলেন? এই সংযোগ কি তাঁর স্ব-ইচ্ছায় হয়েছিল? না কি কোনও চাপের কাছে শেষ পর্যন্ত তাঁকে হার মানতে হয়েছিল? 
 
 
 
অনেকটা সেই রবীন্দ্রনাথের গানের মত, 'হার মানালে গো, ভাঙিলে অভিমান।' 
কণিকাকে যাঁরা চিনতেন, জানতেন যাঁরা, সকলেই একবাক্যে বলবেন, গানের বাইরে কণিকার ব্যক্তিজীবন ছিল খুব সীমায়িত। আত্মজন আর সেই পরিমন্ডলে ঢুকে পড়া গোরা সর্বাধিকারীর মত লোক ছাড়া কণিকা বৃত্তে অন্যের প্রবেশাধিকার ছিল নৈব নৈব চ। কণিকা কি নিজেকে খুব গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন? 
 
 
 
যাঁরা তাঁকে খুব কাছ থেকে জেনেছেন, দেখেছেন, চিনেওছেন- তাঁরা কখনও এই কথার সঙ্গে একটিবারের জন্যেও একমত হবেন না।জীবনের একটা পর্যায় পর্যন্ত তিনি ছিলেন খুব ই বহিঃর্মুখ আর অন্তর্মুখের আশ্চর্য এক মিশেল। ইচ্ছে করেই 'সমন্বয়' শব্দটা লিখলাম না।কারন, 'সমন্বয়' আর 'মিশেল' শব্দদুটি সমার্থক মনে হলেও প্রকৃতিগতভাবে দুটো শব্দের উপস্থাপনের ভিতরে বেশ ফারাক আছে।
কণিকা রবীন্দ্রনাথে আত্মস্থিত ছিলেন। গানের ভিতর দিয়েই ভুবনখানিকে দেখতে তিনি অভ্যস্থ ছিলেন। গানের দুনিয়ার বাইরে অন্য কোনও অনুসঙ্গের প্রতি তেমন আকর্ষণ তিনি অনুভব করেছেন কখনও, তাঁর বৃত্তে কিছুটা থেকে, তেমনটা কখনও মনে হয়নি। এতখানি মগ্নতা গান ঘিরে, রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে, এটা তাঁর সময়ে খুব কম শিল্পীকেই দেখা গিয়েছে।   
 
 
 
তাঁর শিক্ষক শৈলজারঞ্জনের এই বৈশিষ্ট্যের ছাপ কণিকার উপরে খুব বেশিই পড়েছিল বললে মনে হয় না ভুল হবে। আত্মমগ্নতায় রবীন্দ্রনাথের গানের বিস্তারে এক অসাধারণ প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছিলেন শৈলজারঞ্জন। সেই আঙ্গিকের ছায়া শৈলজারঞ্জনের অন্যতম প্রিয় এবং অন্যতম সেরা ছাত্রী কণিকার উপরে খুব বেশিরকম পড়েছিল। কণিকা ছিলেন স্বল্পবাক মানুষ। কি নিজের সঙ্গীত জীবনে, কি ছাত্রছাত্রীদের গান শেখাতে, এমন কি বাড়ির ডাইনিং টেবিলে পারিবারিক আড্ডায় বলার থেকে, শুনতেই বেশি ভালোবাসতেন তিনি। জীবনের শেষ দিকে, যখন বাড়ির বাইরে খুব একটা বেরোতেন না চিকিৎসা ইত্যাদি বিশেষ কারন ছাড়া, তখনও পরিবারের মানুষদের সঙ্গে বা তাঁর খুব কাছের মানুষ যাঁরা আসতেন দেখা করতে, তাঁদের কথা শুনতেই ছিল কণিকার বেশি আগ্রহ। নিজে একটা দুটো কথা যে বলতেন না, তা নয়। কিন্তু নীরব শ্রোতা- এটাই যেন ছিল তাঁর একটা স্বভাব বৈশিষ্ট্য। তা বলে কেউ যদি ভুল কিছু বলতেন, অন্যায় কিছু বলতেন- সে ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করতে কখনও পিছপা হতেন না। তবে তাঁর প্রতিবাদের মধ্যে দৃঢ়তা আর নম্যতার এক অদ্ভুত সমন্বয় ছিল। এই সমন্বয়ী মানসিকতাই ছিল কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যক্তিজীবনের অন্যতম সেরা বৈশিষ্ট্য।
 
 
 
এই বৈশিষ্ট্য কণিকা পেয়েছিলেন তাঁর গোটা জীবনের সাধনক্ষেত্র শান্তিনিকেতনের জল, মাটি, বাতাস, আগুন থেকে। কণিকা ম্যাট্রিক পাশ করে গুরুদেবকে প্রণাম করতে গিয়েছেন। প্রণাম করলেন। গুরুদেবের প্রশ্ন, হঠাৎ প্রণাম করলি কেন? তাঁর মোহরের সলজ্জ উত্তর, গুরুদেব, আমি ম্যাট্রিক পাশ করেছি। সকৌতুকে রবীন্দ্রনাথ বললেন, সে কি রে! তুই তো আমার থেকেও শিক্ষিত হয়ে গেলি। আমি তো ম্যাট্রিক পাশও না। এই কৌতুকাশ্রিত সারল্য পারিবারিক পরিমন্ডল আর রবীন্দ্রনাথ, তাঁর মধ্যে গেঁথে দিয়েছিলেন। এই সারল্য ছিল কণিকার শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ছাপিয়ে ব্যক্তি বৈশিষ্ট্যের এক অনন্য উদাহরণ। তাঁর শেষ অসুস্থতার সময়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ উদ্যোগে উন্নত চিকিৎসার জন্যে কণিকাকে আনা হচ্ছে কলকাতায়। সড়ক পথে আনলে তাঁর কষ্ট বেশি হবে। তাই চিকিৎসকদের পরামর্শ রেলপথে আনাই ভালো। রেল দপ্তরের আন্তরিক সহযোগিতায় সমস্তরকমের আপৎকালীন চিকিৎসা ব্যবস্থা, চিকিৎসক সহ তাঁকে আনা হচ্ছে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে করে।
 
 
 
কণিকার চিন্তা, কী করে তিনি এসএসকেএম হাসপাতালে যাবেন! উদ্বিগ্ন কণিকা জিজ্ঞাসা করলেন গোরা সর্বাধিকারীকে, আমরা কী করে পিজি হাসপাতালে যাব গোরা? সকৌতুকে গোরা সর্বাধিকারী বললেন, তোমাকে সাইকেলে বসিয়ে নিয়ে যাব। যানবাহন ঘিরে শান্তিনিকেতনের পরিমন্ডলে সাইকেল, রিক্সা- এসবের সঙ্গেই মানসিক সম্পৃক্ততা ছিল কণিকার। ট্রেন এসে থেমেছে হাওড়া স্টেশনে। কণিকা অনুরাগীকে স্টেশন চত্ত্বর থিক থিক করছে। আবার তাঁর প্রশ্ন গোরা সর্বাধিকারীকে, এত লোক কেন? আসলে কণিকা যে শিক্ষার ধারাবাহিকতা আত্মস্থ করেছিলেন, সেটা ছিল সার্বিকভাবে আত্মমুখী। সেই আত্মমুখীনতার আত্মস্থতায় এতটাই স্থিত ছিলেন শিল্পী যে তিনি ভাবতেই পারতেন না, তাঁকে ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে কতটা আবেগ কাজ করে। কতটা ভালোবাসা কাজ করে।
 
 
 
তবে এই আবেগ তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে কণিকার নিজের জীবনের শেষকালের বেশ কয়েকটা বছরের নিভৃত যাপনচিত্রেরও একটা বড় ভূমিকা আছে। বয়সের ঘড়ি যত এগিয়েছে, কণিকা তত তাঁর গুরুদেবের গানের নিজেকে একদম সঁপে দিয়েছিলেন। আর বিশুদ্ধ রবীন্দ্রসঙ্গীতের ধারার প্রবাহমানতা বজায় রাখতে মনপ্রাণ দিয়ে নিজেকে উজার করে দিয়েছিলেন তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। এই সময়ের কণিকাকে দেখলে, প্রাচীন তপোবনের সাধিকাদের যে ছবি ভারতীয় বৈদিক সাহিত্যে, বেদ- উপনিষদে অঙ্কিত রয়েছে, ঠিক তেমনটাই মনে হত। বাইরের দুনিয়ার কোনও স্পন্দনই তাঁকে যেন তখন আর স্পন্দিত করত না। দিনান্তবেলার শেষের ফসল যে তরীতে তুলবার সময় হয়েছে, সেটা হয়তো কণিকা তাঁর নিজের আধ্যাত্মিক অনুভূতি তাঁর ধর্মীয় দীক্ষাগুরু 'সাধুবাবা'র কৃপায় অনুভব করতে পারতেন। তাই হয়তো আত্মস্থতার এক অনির্বচনীয় পরিমন্ডল তিনি, 'আপনারে দিয়ে রচিলিরে কি এ আপনারই আবরণ' তৈরি করেছিলেন। কিন্তু শূন্যতাকেও তিনি কখনওই স্থান দিতে প্রস্তুত ছিলেন না।
 
 
 
এমন মানুষ, যখন নশ্বর শরীর ত্যাগ করবার পর, মরদেহকে ওই ভাবে প্রদর্শিত করা হল, কেবল দুঃখ নয়। প্রচন্ড রেগে গিয়েছিলেন তাঁর পরম সুহৃদ সুচিত্রা মিত্র। সুচিত্রার অভিব্যক্তি ছিল; মোহর ছিল কোমলতার এক প্রতিমূর্তি। নিজেকে অহেতুক বিজ্ঞাপিত করতে একদম ভালোবাসত না। নিভৃতে নিজেকে নিজের মত রাখতে সব সময়েই চাইত। সেইভাবেই গোটা জীবনটা, বিশেষ করে শেষ পনের বছর কাটিয়েছে। সেই মানুষটার মৃতদেহ এভাবে প্রদর্শিত করা? এটা তো মোহরের গোটা জীবন ধরে বয়ে চলা যে ভাবনা, তার ঠিক উল্টো।
আজ সুচিত্রা বেঁচে থাকলে, তাঁর মোহরের স্মৃতিরক্ষার নামে যে কার্যত তাঁর স্মৃতিকে ঘিরে এমন কিছু করছে তাঁরই প্রিয়জনেরা, সেটা আর যাই হোক কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোটা জীবনের যে বোধ, তার সঙ্গে একেবারেই যায় না। সেসব দেখে কী বলতেন, আজ সুচিত্রা মিত্র বেঁচে থাকলে, কে জানে!
 
 
 
একজন মানুষের, শিল্পীর, স্রষ্ঠার স্মৃতির প্রতি সম্মান প্রদর্শনের শ্রেষ্ঠ পন্থা হল, তাঁর জীবনবোধ, জীবনবেদের চর্চা এবং প্রসারে সচেষ্ট হওয়া। সেই দায়িত্ব পালনে যেমন তাঁর অনুরাগী, অনুগামীদের ভূমিকা রয়েছে, ঠিক ভাবেই ভূমিকা রয়েছে আত্মজনেদেরও। সেই ভূমিকা পালনের মধ্যে দিয়েই সবথেকে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে শিল্পীর জন্মদিন পালন। আরও বেশি করে দীপ্তমান হয় শতবর্ষে শিল্পীকে স্মরণ করবার প্রাসঙ্গিকতার বিষয়টি। জন্মদিন পালন কেবল উচ্ছ্বাস নয়। শতবর্ষ পালন তো নয়ই। শিল্পীর আদর্শকে কতখানি সময়ের প্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক রাখা যায়, যৌক্তিকভাবে উপস্থাপিত করতে পারা যায়, একজন স্রষ্ঠার তা নিয়ে সাহিত্যিক হোন বা গায়ক বা চিত্রশিল্পী, শিল্পের আঙ্গিকে দিপ্যমান ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সেটাই সবথেকে শ্রেষ্ঠ পন্থা। ভালোবাসা জানানোর সেটাই সেরা পথ।

  • গৌতম রায়