বুকে বেজে থাকা শূন্যতা

শঙ্খ ঘোষের কবিতার মত আমাদের বুকে এখনও কি গভীর নিস্তবদ্ধতার ভিতর আত্মজনের সংলগ্ন না হওয়ার ব্যথা বাজে? বেহাগ তো বড় প্রিয় রাগ ছিল রবীন্দ্রনাথের। সেই সুর বাজে এখনও?

 

 

প্রবীণ দিবস। হ্যাঁ, প্রবীনদের নিয়ে সমাজমাধ্যমে অনেকে অনেক কথা লেখেন। প্রবীনদের প্রতি একেবারে বিগলিত করুণা, জাহ্নবী যমুনা, সেসব লেখা। এই সমাজমাধ্যমের যুগে আমরা হওয়ার প্রকৃতি দেখতে পাই! যে একটু মৃদুমন্দ বাতাস বইতে শুরু করে, তখনই হয়তো, 'হাওয়া হাওয়া, এ হাওয়া'- চটুল গানের সুর আমাদের মনকে হাওয়ার তালে ভাসাবার চেষ্টা করে। সে চেষ্টা কখনও সফল হয়। কখনও বা হয় না। আসলে 'সমাজমাধ্যম', এই মাধ্যমটির ব্যবহার গত এক যুগ ধরে আমাদের সামাজিক জীবনে খুব প্রকট হয়ে উঠবার পর, সবকিছু কেমন যেন একটা ছাঁচে ঢালা ব্যবস্থার মধ্যে এসে পড়েছে। আচ্ছা, পাঠক। আপনারা তো 'ছাঁচে ঢালা', এই শব্দটার সঙ্গে অনেকটা পরিচিত। রবীন্দ্রনাথের 'রাশিয়ার চিঠি' মনে পড়ে? তিনি সেখানে তিনি যে সময়কালের ভ্রমণ করেছিলেন, সেই সময়কালের ছবিটি সোভিয়েট ইউনিয়ন ঘিরে তুলে ধরেছিলেন। সোভিয়েট আমলের শিক্ষা ব্যবস্থাকে 'ছাঁচে ঢালা' শিক্ষাব্যবস্থা বলে বর্ণনা করেছিলেন। আচ্ছা, ছাঁচে ঢেলে কেউ মূর্তি গড়েছেন। কেমন হচ্ছে এ মূর্তি? কেষ্টর জামাই, কল্লার বর, আমরা ছোটবেলা শুনলাম, সে কৃষ্ণনগর থেকে আসা এক মস্ত বড় শিল্পী। যখন সে বিভু পাল আর দুর্গা পালের, দুর্গা পালের নামটা ভুল করলাম করলেও করতে পারি। কিন্তু ভুল যদি করি, সুচিত্রা মিত্রের ভাষায়, কচু পোড়া খেলো যা, কেউ ভুলের মাশুল না হয়, রোজ কেয়ামতে দেওয়া যাবে। তবু মনে পড়ে কল্লার বর যখন দুর্গা প্রতিমার চোখ আঁকছে, কেষ্টোর বউ, আমাদের কল্লার মা, যার ঘাড়টা সবসময়ে দুলত, আমাদের সাবধান করে দিয়েছিল; 

 

 

ওরে তোরা এত চেল্লাসনি কো। চোখ আঁকতে গেলে ইদার উদার কথা বললে চোকের নজর খান ঘুড়্যে যাবে কোন। কল্লার বর যখন হঠাৎ মরে গেল, আমরা বেবাক হয়ে গেছিলুম। সে প্রতিমা কোন্ মন্ডপে গেছিল তা এখন আর মনে নাই কো। তবে আমাদের ধারণা হয়েছিল, কুমোরপাড়ায় কেন, আমাদের এ তল্লাটে আর কেউ নেই কো, যে কল্লার বরের মত প্রতিমা গড়তে পারে। কল্লার বর মরে যাওয়ার পরে আমরা হাপুস নয়নে কেঁদেছিলাম এই কারণে যে, এমন চোখ চেয়ে থাকা পির্তিমে আর আমরা দেখতে পাব না কো। আসলে ভাবনা যখন মনের কোণে বাসা বাঁধব বাঁধব করছে, তখন সে ভাব নাকি আমরা তাড়াতে পারি না। ভাবনা আমাদের মনের অন্দরে সিঁদ কেটে ঢুকে পড়ে। এ কালের মানুষজন অবশ্য সিঁদ কাটার ব্যাপারটিকে বাস্তব জীবনে কখনও জানে না। সকলেরই প্রায় কোটা দালান বাড়ি। মাটির বাড়ি নেইই বললেই চলে। গ্রামেও মাটির বাড়ি ক্রমশ মিউজিয়ামের ঠাঁই পেটে চলেছে। তাই মাটির বাড়ির অভাবে কোটা বাড়িতে তো আর সিঁদ কাটতে পারে নাকো সিঁদেল চোর! এ যুগের তারা চোর চোট্টারা তাই নিয়ে নিয়েছে অন্য পন্থা। তাই সে যুগের কথাসাহিত্যের অঙ্গনের সিঁদ কাটার ব্যাপারটাতে এ যুগের মানুষ একটু ঠাউরে নিতে চেষ্টা করে। এই যে আমি প্রাচীন কলকাতার ঘঁটি লব্জ বারবার উচ্চারণ করছি, তার জন্য কি আমার পাঠকরা আমার উপরে খুব রাগ করে বসে আচেন? রাগ করেই থাকচেন তাঁরা?

 

 

আসলে ভাষা শব্দ কথ্যরীতি, মানে বলবার ধরন আর কী, এসবের মধ্যে সেকাল আর একালের 'মেলাবেন তিনি মেলাবেন' যদি আমরা না বলতে পারি, না সইতে পারি, তবে কাকস্য পরিবেদনা। অমন অবস্থায় এলে আমরা কী করব? কাঁদতে কাঁদতে বলব, "ওঁ কৃৎত স্মর। জ্বালানি কাঠ জ্বলো, জ্বলতে জ্বলতে জ্বলতে বলো, আকাশ তলে এসে, অঙ্গার হল আলো। অঙ্গার হলো আলো।"

 

 

আচ্ছা, অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা এখন কি কেউ পড়েন? সিরিয়াসলি, সিরিয়াস প্রবন্ধ, সিরিয়াস কবিতা, গল্প, উপন্যাস, এসব পড়ে না এখন কমার্শিয়াল পত্রিকাগুলো তো সেই পাঁচের দশকের উত্তম সুচিত্রার প্রেমের আদল নিয়ে, যে আদলে, নায়কের সঙ্গে দেখা হল নায়িকার, তাকে অবশ্যই সময়ের প্রেক্ষিতে দাঁড় করিয়ে দেয়। দেখা হলো কোনও শপিংমলে। নায়ক হয়ত ভয়ানক উচ্চবিত্তের মানুষ। প্রচুর টাকা। কোটির কম সেসব টাকার মালিক হন না নায়কেরা। কিছু উদভুতুরে নামের নায়িকা। সে ভীষণ গরীব। অনেকটা সেই উত্তম-সুচিত্রার 'হারানো সুর' বা নাম মনে না করা অনেক রকমের মিষ্টি মিষ্টি প্রেমের সিনেমার মতো। তেমন ভাবেই চলছে আর কী এই সময়ের সাহিত্যের একটা দিক। এই সাহিত্যকে যদি হজম করতে পারো তবে তুমি সময়ের উপযোগী। আর যদি হজম করতে না পারো, তবে তুমি ব্যাকডেটেড। অর্থাৎ, সময়ের থেকে তুমি পিছিয়ে আছো। সমকালীনতা থেকেও তুমি পিছিয়ে আছো।

        

 

আসলে সমকালই ধরতে পারে তার মধ্যেই তুমি সময়ের সঙ্গে আছো কি না আছো? এইসবের একটা অদ্ভুত প্রতিযোগিতা চলে। এই প্রতিযোগিতায় যদি তুমি জিততে পারো, তবে তুমি নামীদামী স্মারক অর্থাৎ যাকে তুমি আজকের ভাষায় অ্যাচিভমেন্ট বলো, সেটার তুমি অধিকারী হবে। নচেৎ, তুমি হেরো, গো হেরো। ও হো হো, হেরে গেছো। হেরে গেছো -এমন কথা শুনতে শুনতে তুমি হেরে যাওয়ার মালা নিয়ে আস্তে আস্তে প্যাভেলিয়ানে ফিরে যাবে। আচ্ছা, একবার কি জিজ্ঞেস করবে না, কী ফুলের সেই মালাটা ছিল? যে মালটা গলায় দেওয়ার ইচ্ছে নিয়ে তুমি ধীরে ধীরে প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দুতে পা বাড়াতে চেয়েছিলে? প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলে? কিন্তু দিনের শেষে, সেই প্রতিযোগিতার সবগুলোতে না এঁটে উঠতে পেরে, ওই মালটা তোমার তোমার আর গলায় দেওয়া হল না। তোমার কি অধিকার নেই, এক বারও  জিজ্ঞাসা করবার যে মালার ফুলটাতে কী ফুল ছিল?

 

 

রবীন্দ্রনাথ  কি এই জন্যেই  এটা লিখেছিলে না;  মেলা হতে খসে পড়া ফুলের ফুলের একটি দল--সুচিত্রা মিত্র গাইতেন। সেই গান শুনে আমরা খুব আহ্লাদে আটখানা হতাম। আচ্ছা, সুচিত্রা মিত্রর গান শুনে কেন আমাদের এমন একটা অনুভূতি হত? মালা হতে খসে পড়া ফুলের একটি দল - সেই খসে পড়া ফুলটি কেমন ছিল? কী ছিল তার রং? কোন ও কি গন্ধ ছিল সে ফুলের? সে ফুলের আমোদে আমরা কি আমোদিত হতাম? আমরা কি মনের মধ্যে একটিবারের জন্যেও মনে করতাম, মালার থেকে খসে পড়া একটি কুসুম, আমার মনের গহীনে একটা সুর তুলবে? একটা তালকে হিন্দোলিত করবে? আচ্ছা, এই যে 'হিন্দোলিত' শব্দটা এখানে ব্যবহার করলাম, এটা কে কি আপনারা গুরুচণ্ডালি দোষে অভিষিক্ত করবেন? সাধু আর চলিতে মেশামিশি ঘিরে এমন একটা সংকট তৈরি করলাম যে, আপনাদের কাছে শব্দটিকে ঠিকমতন বোধগম্যই করে উঠতে পারলাম না।

 

 

এমন যদি হয় তবে তো মহাবিপদ। সে বিপদ থেকে কে আমাকে উদ্ধার করবে? অর্থাৎ, সে বিপদ থেকে 'উদ্ধার' আমাকে কে করবে, উচ্চারিত এই শব্দটাও কি খুব একটা কঠিন শব্দ ব্যবহার করে ফেললাম?এখন তো আধুনিক ভাষার যুগ। প্রমথ চৌধুরীর যুগ থেকে উত্তোরিত হয়ে, আমরা মানে, আমাদের সময়ের থেকে এগিয়ে এসে আরও কি অনেকটা আধুনিক হয়ে উঠেছি? আচ্ছা এই আধুনিকতার মানে কি? রকের ভাষা, রকে কোথাকার লোকের ভাষা? আমাদের উত্তর কলকাতার ভাষা? নাকি সদর লাগবে লাগুয়া মফস্বলের ভাষা? 'মন'কে আরও গহীনে আমাদের হৃদয়ে স্থান দিয়ে ব্যবহার করে ফেলছি কি খুব একটা খটো মটো ভাষায়? আবার কি পত্রিকার সম্পাদক আমাকে গুরুচণ্ডালি দোষে অভিষুক্ত করবেন? না, না গুরুচণ্ডালি এখন একটা খুব চটপটে শব্দবন্ধ। এই শব্দের আঁকড়ে পা ডুবিয়ে অলস জলে এখন আমি সাঁতার কাটতে পারি। সাঁতার কাটতে কাটতে বারবার শঙ্খ ঘোষের মতো বলতেও পারি, পা ডোবানো অলস জল এখন আমার মনে পড়ে? সব শেষে কেবল বলব, 'তোমায় আমি বুকের ভিতর নিইনি কেন রাত্রিবেলা।'

  • গৌতম রায়