অজানা একজন জাতির কথা। ‘রাভা’–এঁদের জীবনের বারমাস্যা। ভারতের এক অচেনা দুনিয়ার উন্মোচন এই রাভা জীবনকথা-
উত্তরবঙ্গের রাভা জনজাতির পরিধেয় পোশাক মেখলা। হাতে বোনা এই চাদর শরীরের নিচের অংশে জড়িয়ে পড়তে হয়। উপরে থাকে আরেকটি অংশ। রাভা জনজাতির মধ্যে (রাভা ভাষায়) একটা কথার খুব প্রচলন আছে—
‘তাঙিরামিকাপচা
বিয়ৌগাসায়নাপচা’
— অর্থাৎ যে যুবতী কাপড় বুনতে পারে না, তাকে বিয়ের জন্য কেউ পছন্দ করে না।
উত্তরবঙ্গের আদিবাসী জনজাতির একটি হল রাভা জনজাতি। চাষবাস, সুপারি বিক্রি, শূকরপালন— এসব কাজের সঙ্গে সঙ্গে বয়নশিল্প রাভা রমণীকুলের আরেকটি বিশেষ দিক। আলিপুরদুয়ারের উত্তর মেন্দাবাড়ি, ফালাকাটা, পোরো এলাকায় রাভাদের বসবাস। উত্তর মেন্দাবাড়ির রাভাবস্তি একটি মনোরম জায়গা। পুরো বস্তিটাই রাভাদের। গ্রাম ঢুকতেই রাস্তার ধারে ছোট ছোট গাছের বেড়া। কাঠের বাটিনের তৈরি রাভাদের বিশেষ বাড়ি। চারিদিকে সারি সারি সুপারি গাছ। সুপারির বন। ছায়াশীতল, নিবিড়, শান্ত এই রাভাবস্তি অতি মনোরম। প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে সময় যাপনের উৎকৃষ্ট স্থান। রাভা জনজাতির চলাচলে এখনও আছে প্রাচীনতার ছাপ। আধুনিক সমাজ ওদের এখনও অতটা ছুঁতে পারেনি। সুদৃশ্য কাঠের বাড়ি, পাথুরে পথ, ফার্ণের ঝাড়, বনফুলের ঝোঁপ নিয়ে যেন কোনও শিল্পীর আঁকা ছবি এই বস্তি। এখানে প্রতিটি বাড়িতে আছে হস্তচালিত তাঁত। তাঁতে জড়ানো আছে লাল কালো সবুজ হলুদ রঙের সুতো। কেউ কেউ অর্ধেক হয়ে আসা কাপড়ে মন দিয়ে সুতোর নকশা তুলছে। রাভা মহিলারা সবাই তাঁতের কাজে বিশেষ পারদর্শী। মন থেকে নকশা তোলার ক্ষেত্রে প্রত্যেকে এক একটা দক্ষ বয়নশিল্পী। রাভা জনজাতির ঐতিহ্যবাহী পোশাক হল মেখলা। এটা মেয়েদের পোশাক। মেখলার দুটি ভাগ। নিচের ভাগকে বলা হয় লুফন বা কেমব্লেট। উপরের অংশকে বলা হয় কাম্বান। লুফন ও কাম্বান নিয়েই হয় মেখলা। পুরুষদের পোশাক কালাইপাকার বা কালাইপাকোর। কালাইপাকারকে গামছাও বলে ওরা। এছাড়া আছে কাম্বাংসা বা মাফলার। বিচিল বা কুর্তা। মেখলা কালাইপাকার কাম্বাংসা ওরা হাতেই বোনে। বাড়ির তাঁতে। বিচিল বা কুর্তা বাজার থেকে কিনে এনে ঘরে সেলাই করে। উর্মিলারাভা, মেনন্তীরাভা, রণিকারাভা, দিপালী রাভা নামের মহিলারা বাড়িতে বসে কাজের অবসরে ওসব পোশাক বানায়৷ এটাই ওদের প্রধান জীবিকা। যদিও চাষবাস সুপারি বিক্রির কাজ করে মাঝে মাঝে। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করা মেনন্তীরাভার কাছে জেনে নিচ্ছিলাম মেখলা তৈরির নানা কথা। সেরা ভা ডেভলপমেন্ট কাউন্সিল এর সদস্যা। এসব রাভা মহিলারা তাদের মা ঠাকুমা দিদি-কাকিমার কাছ থেকে ছোট থেকে এই কাজের হাতে খড়ি নেয়। গ্রামের প্রতিটি মহিলা এই কাজটি দিনরাত করে চলে। ওরা তাঁত চালাতে পারে একপ্রকার চোখ বুজে। তাঁতের সঙ্গে যুক্ত নানা লোকযন্ত্র/যন্ত্রাংশ যেমন— ছানা, বুয়া, বুবিন, নুলি, কাঁইট্যা প্রভৃতির কাজটিও নিঁখুতভাবে করতে পারে। মাঝবয়সী উর্মিলা রাভা কানতেলপুষুক (এক ইঞ্চি প্রস্থ বিশিষ্ঠ, আড়াই ফুট দৈর্ঘ্য বিশিষ্ঠ কাঠের টুকরো) দিয়ে একটি সুতোকে আরেকটি সুতো থেকে পৃথক করছিল। সুতোর ভিতরে কানতেলপুষুক চালিয়ে। তারপর যে রঙের সুতো দিয়ে নকশা তোলা হবে সেই সুতোকে মুগড -ঐ নামের একটি ক্রুশকাঁটার মতো ছোট্ট বস্তু দিয়ে মেখলার প্রধান রঙবিশিষ্ট সুতোর ভিতর ঢুকিয়ে দেয়। কাজটি বেশ ধৈর্যের। প্রতিটি সুতো গুনে গুনে ঢোকাতে হয়। অঙ্কের হিসাবে। যা ওদের কাছে জলভাত। এবং অতি দ্রুততা করতে পারে ওরা। এভাবেই সুতোর খেলায় ও রাতোলে নানা ফুলের নকশা। যেমন—বেগুনফুল, উনিকনফুল, বেয়ারজুমিতফুল। ডিজাইনে যে ফুল তোলা হয় তাকে মুগ বলা হয়। মুগড -ঐ শব্দের অর্থ হল ফুল তোলার ছোট্টকাঁটা। মুগ অর্থে ফুল। ড –ঐ অর্থে ছোট্ট লাঠি বা কাঁটা (অনেক টাউল বোনার কাঁটার মতো)। রাভা ভাষায় নকশার নানা নাম আছে। যেমন—বান্টোইপার, দুংচুংমুগ, দিমচিমুগ, জেবমুগ। লুফন ওকাম্বানে এসব নকশা ওরা তুলে ধরে। মেখলাবোনা, ডিজাইন করা নিজেদের মন থেকেও করে থাকে ওরা। তবে ওদের কাজে আধুনিকতার ছাপ এখনও পরেনি। প্রাচীনকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে যোগ করেছে শুধু আপন খেয়ালের নানা উদ্ভাবন। সেখানে মূলত দুটি রঙের প্রাধান্য বেশি। লাল বা পিষাক এবং কালো বা পেনেক। লাল ওদের কাছে বীর্যের প্রতীক। আবার পূর্বজরা অন্ধকার অরণ্যে থাকার কারণে দেখা যায় কালো রঙের অধিক প্রয়োগ। এছাড়াও আছে সবুজ বা পিকতিং, হলুদ বা হলদি রঙের ব্যবহার।ঝুন্টিরাভা, ফুলমনিরাভা, ঝুম্পারাভা অন্যত্র বাস করলেও (কালচিনি ব্লক) ওদের কাজেও সেই একই ধারা বয়ে চলেছে। নিজেদের প্রয়োজনে, নিজেদের ব্যবহারে বয়নশিল্পের এক অনন্য ঘরানাকে বয়ে চলেছে রাভা মহিলারা। কোচবিহারের জয়গাঁও থেকে ওরা আনে সুতো। তা দিয়ে বোনে আদিবাসী ঘরানার এই বিশেষ বস্ত্র। মূলত নিজেদের ব্যবহারের জন্য। দু-তিন পুরুষ আগে অবধি এদের পূর্বপুরুষরা জঙ্গলের গাছগাছড়া মাটি এনে প্রাকৃতিক রঙ বানাত। কিন্তু একালের রাভা জনজাতি সে সব গাছকে আর সনাক্ত করতে পারে না। ওরা হারিয়ে ফেলেছে প্রাকৃতিক রঙ তৈরির লোকপদ্ধতি। যাইহোক, দুই থেকে সাত দিনে ওরা বুনে দিতে পারে একটা মেখলা। যার মূল্য রাখে ছ’শো থেকে তিন চারহাজার পর্যন্ত। আবার কালাইপাকার বুনতে সময় নেয় এক থেকে খুব বেশি হলে দুদিন। যার দাম ১৫০ থেকে শুরু। কাম্বাংসা বা মাফলারে সময় লাগে এক বা দুদিন। দাম রাখা হয় আড়াই থেকে তিনশো টাকা। কিন্তু এসব শিল্পীদের মূল সমস্যা হচ্ছে বিপণন। বিক্রির বাজার নেই। তাই গ্রামে মেখলা ফেরি করে রাভা রমণীরা। সেরকম এক রাভা আর্টিস্ট উর্মিলারাভা। তার নিজস্ব শিল্পীকার্ড আছে। Ministry of Textile থেকে ওদের দেওয়া হয়েছে Weavers Photo Identity Card বা Pehchan Card. কিন্তু ওটুকুই! এসব শিল্পীদের দুরাবস্থা আজও এক।সরকারের নানাবিধ উদ্যোগে এরাও সচেতন নয়। আবার সরকারের তরফে লোন দেওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবায়িত খুব একটা হয় না। কাগজেকলমে বহু রাভাশিল্পীর নাম সরকারের কাছে থাকলেও শিল্পীদের মাসিক আয় মেরেকেটে পাঁচ থেকে ছয় হাজার। অর্থনৈতিক সমস্যা ছাড়া আছে রাভা মহিলাদের অনীহা। ওরা খুব একটা সরকারি অফিসের দিকে পা বাড়াতে চায় না। কথাটি বলছিলেন আলিপুদুয়ারের ডুয়ার্সকন্যা অফিসের এক কর্মকর্তা।
নানা সমস্যা থাকলেও এখনও তাঁতে হাত রাখছে সুপারির দেশের রাভামহিলাকুল। বর্ষীয়ান শিল্পীদের সঙ্গে হাইস্কুল পড়ুয়া মেয়েরাও (নিশনীরাভা, স্নেহারাভা) শিখে নিচ্ছে কাজ। বছরে একদুবার অংশ নিচ্ছে জেলামেলায়। রাভা ডেভলপমেন্ট কাউন্সিল রাভাদের নৃত্যগান সংস্কৃতিকে তুলে ধরার কাজটি করছে পুরোদমে। ওদের মাছধরা বা আলুতোলার নৃত্যপরিবেশন করছে নানা স্থানে। এসবের সাথে সাথে রাভা কাউন্সিল বয়নশিল্পের দিকে একটু বেশি নজর না দিলে কতদিন তাঁত-হাত চলবে তা বলা খুব মুশকিল। ওসব সহজ সরল মহিলা বয়নশিল্পীকে প্রাচীনতার সঙ্গে সঙ্গে নতুন যুগের চাহিদাসম্পন্ন ডিজাইনের শিক্ষা দেওয়া দরকার। দরকার সচেতনতা বৃদ্ধি ও বয়ন প্রশিক্ষণের। নইলে বয়নিকারা শুধু ঐতিহ্যই ধরে রাখবে, উত্তরণ ঘটাতে পারবে না শিল্প তথা শিল্পীদের।