শারদ অর্ঘ্যঃ বাঙালির ‘পুজোর গান’

পুজো গানের নস্টালজিয়া এখন টিকে আছে কেবল মুদ্রিত অক্ষরে আজকের প্রজন্মের কাছে পুজোর গান ঘিরে মন উচাটনের কোনও ব্যাপারই নেই পুজো-শারদীয়া পালনে এখন হাজার উপকরণ কিন্তু সেদিনের পুজোর গান? সেই যেদিনগুলি, বাঁশি বাজানো দিনগুলি, আগমনীর দিনগুলি….পিছু কি তারা ডাকছে?

 

 

বাঙালির কাছে আগমনী গানের জনপ্রিয়তা অমোঘ-- সেই রামপ্রসাদের সময় থেকেই। আগমনী গান, অর্থাৎ; শারদ উৎসবের আগেঘরের মেয়ে উমার আবাহনের গান। বাঙালির পুজোকেন্দ্রিক গানের প্রথম বীজ লুকিয়ে ছিল সেই আগমনী গানেই। কিন্তু সে গান সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থা ছিল না। বিশ শতকের প্রথম দিকে এল গ্রামোফোন কোম্পানি। ১৯১৪ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হল প্রথম পুজোর গান’-এর ১৪টি রেকর্ড— ‘শারদাবলীদাম ৩ টাকা ১২ আনা। প্রথমবারের সেই পুজোর রেকর্ডে গেয়েছিলেন সেকালের খ্যাতনামা শিল্পীরাকে মল্লিক, মানদাসুন্দরী দাসী, সরলা বাঈ এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতে অমলা দাশ (দেশবন্ধুরভগিনী) সেই শুরু। ঢাকের শব্দ, কাশের বন, শারদ-সাজ ও পূজাবার্ষিকীর সঙ্গে-সঙ্গেই পুজোর গান’-ও বাঙালি জীবনে বিনোদনের অঙ্গ হয়ে উঠেছিল ১৯২০-র দশক থেকে। ধীরে ধীরে এলেন পঙ্কজ কুমার মল্লিক, দিলীপকুমার রায় ও কমলা ঝরিয়াদের মতো বিখ্যাত শিল্পী। পুজোর গানের প্রথম যুগে মাতৃবন্দনা বা আগমনী গানের প্রচলন ছিল বেশি১৯৩১ সালের পুজোর গানের রেকর্ডে প্রকাশিত হয়েছিল ধীরেন্দ্রনাথ দাসের কণ্ঠেআজি শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও জননী এসেছে দ্বারেএত বছর পার করে আজও অনেক শারদ-বিজ্ঞাপনে ক্যাচলাইন হিসেবে সগৌরবে বিরাজ করে— ‘জননী এসেছে দ্বারেপুজোর গান’-এর রেকর্ডে আগমনী ও ভক্তিমূলক গান গেয়ে একসময় বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। অনেক বছর রেকর্ড করা থেকে বিরত থাকার পর সাতের দশকে পুজোর রেকর্ডে তিনি গেয়েছিলেন একটি আগমনী গান— ‘এলো গিরি-নন্দিনী, য়ে সুমঙ্গল ধ্বনি

 

 

দি গ্রামোফোন কোম্পানি অব ইন্ডিয়া (HMV), কলম্বিয়া, হিন্দুস্তান রেকর্ডস ইত্যাদি রেকর্ড কোম্পানি পুজোর সময় মুক্তি পাওয়া নতুন গানগুলির লিরিক্স সহ বই প্রকাশ করতেন। তাতে থাকত গানের কথা ছাড়াও শিল্পীদের ছবি, গীতিকার-সুরকারের নাম, রেকর্ড নম্বর ছাপা হতো। কোনও কোনও ক্ষেত্রে শিল্পী সম্পর্কে কিছু পরিচয়ও দেওয়া হত। কারও ক্ষেত্রে শিল্পীর শিক্ষাগুরুর নামও উল্লেখ থাকত। ১৯৫৩ সালে এইচএমভি কর্তৃপক্ষ এই বইয়ের নাম দিলেন পূজার গান ১৯৫৪ এক টালমাটাল বছর- বিশ্বযুদ্ধের সময়ও যে বই প্রকাশে ছেদ পড়েনি, তা থেমে গিয়েছিল যায় ১৯৫৪তে। শ্রমিক-কর্মচারীরা দীর্ঘ বঞ্চনার প্রতিবাদে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেনঅবশ্য পরের বছর আবার বেরোল বই, নতুন নামে। ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত নাম ছিল পূজার ডালি১৯৫৫-র পূজার ডালিতে সম্পূর্ণ গান ছাপা হয়নি। গানের  অংশবিশেষ, সেই সঙ্গে গানের বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু শ্রোতাদের তা পছন্দ হয়নি। তাই ১৯৫৬ থেকে আবার পুরো গানের কথা ছাপা হতে থাকে।

 

 

শারদ অর্ঘ্যনাম দেওয়া হয় ১৯৬০ সালে তারপর আর নামের পরিবর্তন ঘটেনি। আর এই ষাটের দশক জুড়ে বাংলা গানের শারদ সম্ভার যে উৎকর্ষ আর জনপ্রিয়তার শিখরে উঠেছিল, তার তুলনা পাওয়া ভার। ১৯৪৯-এ পুজোর গান হিসেবে গাঁয়ের বধূদিয়ে হেমন্ত-সলিল জুটির জয়যাত্রার সূচনা-- পুরো পঞ্চাশ ও ষাটের দশক জুড়ে তাঁরা শ্রোতাদের মন মাতিয়েছেন একের পর এক কালজয়ী সৃষ্টিতে—‘রানার’, ‘পাল্কির গান’, ‘অবাক পৃথিবীথেকে দুরন্ত ঘূর্ণি’, ‘মনের জানালা ধরে’, ‘শোনো, কোনো এক দিনপাশাপাশি অবশ্য অন্য গীতিকারদের কলমে, নিজের সুরেও জনপ্রিয় পুজোর গান উপহার দিয়ে গেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ১৯৫৭তে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায়, হেমন্তর নিজের সুরে ও কণ্ঠে অবিস্মরণীয় দুটি গান— ‘ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো নাআর কত রাগিণীর ভুল ভাঙ্গাতে  গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখায়, নিজের সুরে ১৯৬০ সালের পুজোয় গেয়েছেনঅলির কথা শুনে বকুল হাসে আরআমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি নচিকেতা ঘোষের সুরেও রয়েছে তাঁর একাধিক জনপ্রিয় পুজোর গান- ‘একগোছা রজনীগন্ধা’, ‘মেঘ কালো আঁধার কালোএবং সর্বোপরি, যে গান হতে পারে তাঁরই এক ও অদ্বিতীয় এপিটাফ’—‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে।   

 

 

১৯৬২তে বেরিয়েছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের মায়াবতী মেঘে এল তন্দ্রা’, শ্যামল মিত্রের আহা ওই আঁকা-বাঁকা যে পথ মান্না দে-আবার হবে তো দেখাআর সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের আজ মনে হয় এই নিরালায়’-- দুটি কালজয়ী গানই প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৪তে। আরতি মুখোপাধ্যায়ের না বলে এসেছিআর যদি আকাশ হত আঁখিবেজেছিল ১৯৬৭-র পুজোর গান হিসেবে। ওই বছরই প্রকাশ পেয়েছিল শ্যামল মিত্রের কী নামে ডেকে বলব তোমাকে১৯৬৮ তে পেলাম পিন্টু ভট্টাচার্যের বিখ্যাত গান, ‘চলো না দিঘার সৈকত পেরিয়ে’, আর ওই বছরই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে অসামান্য, মর্মস্পর্শী এক গান প্রকাশ পেল প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে— ‘আঁধার আমার ভাল লাগেঝুমঝুম ময়নাআর মন মাতাল সাঁঝ সকালগান দুটি মুকেশের কণ্ঠে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ১৯৬৮ তেই। লতা মঙ্গেশকরের না মন লাগে না‘, মান্না দে-ললিতা আজ ওকে চলে যেতে বল না’, আর ভূপেন হাজারিকার একখানা মেঘ ভেসে এল আকাশেপ্রকাশ পেয়েছিল ১৯৬৯-এর শারদ-সম্ভার রূপে। আবার সলিল চৌধুরীর সুরে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারার মত চিরকালীন সৃষ্টি আত্মপ্রকাশ করেছিল ওই বছরেই।

 

 

১৯৬৫ সাল নাগাদ গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুরোধে রাহুল দেববর্মন প্রথম বার সুরারোপ করলেন পুজোর গানে। আমি বলি তোমায় দূরে থাকো তুমি কথা রাখো নাএবং আমার মালতীলতা কি আবেশে দোলেগান দুটি গাইলেন লতা মঙ্গেশকর। এরপর রাহুলদেব বর্মনের কাছ থেকে পাওয়া গেল একের পর এক পুজোর গান। প্রায় প্রতি বছর রাহুল-আশা জুটি পুজোর গানে রীতিমত সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ১৯৬৭ সাল নাগাদ প্রথম কিশোর কুমারকে দিয়ে পুজোর বাংলা গান গাওয়ালেন রাহুল দেববর্মণগীতিকার মুকুল দত্তের কথায় তিনি গাইলেন একদিন পাখি উড়ে যাবে যে আকাশেআর এর হিন্দি রূপান্তরও কিশোর কুমার গেয়েছিলেন অনামিকা’(১৯৭৩) ছবির জন্য। পুজোর গানের নেপথ্যকাহিনির আকর্ষণও কম নয়, চালু আছে হরেক গল্পও। ১৯৬৯-এর পুজোর গানে প্রথম নিজের সুরে কণ্ঠ দিলেন রাহুলদেব বর্মন। প্রথমে কিশোরকুমার গাইবেন বলে ঠিক হয়েছিল। কিশোর শুনলেন সুরটা, কিন্তু পছন্দ হল না তাঁরতখন সুরকার ঠিক করলেন, গানটি নিজেই গাইবেন। গান লেখার জন্য ধরে বসলেন বন্ধু শচীন ভৌমিককে। সেই সময় শচীনবাবু বম্বের বেশ কয়েকটি ছবিতে চিত্রনাট্য লেখার কাজে ব্যস্ত। এদিকে রাহুল নাছোড়বান্দা, যেমন করেই হোক গানের কথা তাঁর চাই-ই চাই। অগত্যা শচীনবাবু তাঁর স্কুলজীবনের বান্ধবী ছবি রায়ের কথা স্মরণ করে লিখে ফেললেন মনে পড়ে রুবি রায় সেই স্কুল-কলেজবেলার কৈশোরগন্ধী প্রেমের গানসুপারহিটহল- আধুনিক বাংলা গানের জগতে এনে দিল এক নতুন অধ্যায়।

 

 

১৯৭২ সালে সুরকার শৈলেন মুখোপাধ্যায় প্রথম হৈমন্তী শুক্লাকে দিয়ে গাওয়ালেন এত কান্না নয় আমারএবং ময়ূর নাচে দেখবি আয়হিন্দুস্থান কোম্পানি থেকে রেকর্ড বেরনোর কিছুদিন পরেই ডাক এল এইচ এম ভি থেকে। এরপর হৈমন্তী গাইলেন তাঁর বিখ্যাত গান আমার বলার কিছু ছিল না’, ‘নয়নে আবির ছড়ালে’— পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ও মান্না দে-র সুরে এবং ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো নাগাইলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে। সেই সময় বম্বে ও বাংলার কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রীর গাওয়া বাংলা গান ও কৌতুকনকশাও পুজোয় প্রকাশ করেছিল এইচ এম ভিঅভিনেতা বিশ্বজিৎ গাইলেন তোমার চোখের কাজলে’, হেমা মালিনী গাইলেন কাঁদে মন পিয়াসি’, ‘গুনগুনগুন করে যে মন’, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় গাইলেন এই আশা-নদীর কূলে’, ‘সেই পলাতক পাখি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৌতুকনকশা তো সর্বজনবিদিত। অন্যদিকে ছিল লোকসংগীতের  রেকর্ডনির্মলেন্দু চৌধুরীর কণ্ঠেসুজন রে, জীবনের আর হদিস পাইলাম নাএবং একদিন তোর হইবে রে মরণ হাসন রাজা এর পাশাপাশি ১৯৭৬ সালে সোনি মিউজিক একটি ই.পি রেকর্ডে প্রকাশ করল স্বপ্না চক্রবর্তী নামে এক নতুন শিল্পীর দুটি গান বড়োলোকের বিটি লো’, এবং বলি ও ননদি’—যা রাতারাতি খ্যাতি এনে দেয় শিল্পীকে। ১৯৭৬ সালে এইচ এম ভি-এর আর একটি কালজয়ী শারদ অর্ঘ্য আয় খুকু আয়’, পুলক বন্দোপাধ্যায়ের লেখনী ও ভি বালসারার সুরসৃষ্টিতে এই গানটির সার্থক রূপদান করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তী মজুমদার- যা আজও আম-বাঙালির হৃদয় ছুঁয়ে যায়। গানটা অনেকখানি হয়ে যাচ্ছিল বলে একটি স্তবক বাদ দেওয়ার চিন্তা করছিলেন গীতিকার-সুরকার মিলে, বাদ সাধলেন গানের বাবাহেমন্তদরকার হলে প্রিলিউড-ইন্টার লিউড কমুক, এ গানের কথা ছাঁটা যাবে না। সত্যিই, যায়নি। ছোটবেলার সেই মায়াবী পিছুডাক শোনার জন্য এ গানের প্রতিটি শব্দের উচ্চারণ অপরিহার্যএমনকি হামিংটুকুও।    

 

     

৮০ এর দশকের শুরু সময় থেকে রেকর্ডের জায়গা দখল করে বসল ক্যাসেট। অলিতে-গলিতে বিভিন্ন ক্যাসেট কোম্পানি গজিয়ে উঠতে লাগল। রেকর্ড ব্যবসা একটা বড়ো রকমের ধাক্কা খেল। অনেক কোম্পানি আবার পুরোনো প্রকাশিত রেকর্ড থেকে গান ক্যাসেটে তুলে নিয়ে বাজারে রিলিজ করতে লাগল এইচ এম ভি-র কোনও অনুমতি না নিয়েই। মিউজিক পাইরেসি শব্দটা অবশ্য তখনও জনসমক্ষে আসেনি। তখন বলা হত নকল ক্যাসেট। তখন এইচ এম ভি ও মেগাফোন -এর মত নামী কোম্পানিও বাধ্য হল নিজেদের ক্যাসেট প্রকাশেশুরু হল ক্যাসেটের যুগ কিন্তু মূল রেকর্ডের সাউন্ড কোয়ালিটি কোথায়? সংগীত-রসিকরা পুরোনো রেকর্ড কেনার জন্য তারা ছুটতে লাগলেন ধর্মতলায় ফ্রি স্কুল স্ট্রীট অথবা ওয়েলিংটন রোডে। এর মধ্যে একের পর এক বিশিষ্ট শিল্পীর প্রয়াণ; বয়সের ভারে ক্লান্ত অনেকে গানের জগত থেকে অবসর নিলেন যার ফলে অনেকখানি  শূন্যতার সৃষ্টি হল। ১৯৮৮ সাল নাগাদ এইচ এম ভি তাদের শেষ শারদ অর্ঘ্যপত্রিকা প্রকাশ করে। সেখানে ব্যাক-কভারে লেখা ছিল সংগীত বাঁচান, নকল হটান কিন্তু সেই নকলের হাত থেকে শেষপর্যন্ত মুক্তি মেলেনি। নকলবা প্রতিলিপিকরণহয়ে উঠল উত্তর-আধুনিকতার ধর্ম, সাহিত্য হোক বা সংগীততাকে এড়িয়ে টিকে থাকার উপায় বোধহয় সত্যি ছিল না। তাতে ভাল হয়েছে কি মন্দ সে তর্ক থাক। বরং পাড়ার মণ্ডপ থেকে ভেসে আসা গানটাই শোনা যাককোনওদিন বলাকারা অত দূরে যেত কি, ওই আকাশ না ডাকলে

  • পৃথা কুণ্ডু