প্রহেলিকা

"এটা কি ঠিক হল?"

বিশ্বরূপ ইজিচেয়ারে একটু ঝিমুচ্ছিলেন। সামনে চিকু দাঁড়িয়ে, কোমরে দু'হাত, গলায় আবদারের সুর। ঠিক পেছনেই পিকু। 

"কেন দাদুভাই, আমি আবার কী অপরাধ করলাম!" বিশ্বরূপ এবার একটু এগিয়ে বসলেন। 

চিকু ওঁর মেজদার নাতি আর পিকু বড়দার। চিকু দশ আর পিকু আট। উত্তর কলকাতার বনেদি চৌধুরিবাড়ির বিশাল চৌহদ্দিতে বাসিন্দার থেকে এখন ঘর বেশি। বিশ্বরূপ অবিবাহিত, সদ্য রিটায়ার্ড। বড়দা-বৌদি দুর্ঘটনায় গত হয়েছেন। 

"তুমি বলেছিলে গল্প বলবে!" চিকুর ফর্সা মুখ উত্তেজনায় লাল। 

"নিশ্চয়ই বলব। চিকেন রোস্ট আসুক...খেতে খেতে শুনবে'খন।"

"কচি, তোমার রেসিপি নিয়ে মা, জেম্মা আর রীতা পিসির মধ্যে এখন ঝামেলা চলছে। ডায়নাও রান্নাঘরের সামনে ওয়েট করতে করতে রেস্টলেস হয়ে গেছে।" পিকু এক নিঃশ্বাসে বলে থামল। 

বলা হয়নি, ডায়না, দু'বছরের আমেরিকান স্পিৎজ্, 'বাড়ির সক্কলের বড়ো আদরের। ওর জন‍্যেই পাড়ার ছোটরা চৌধুরিবাড়িকে "ডায়নার বাড়ি" বলে।

মনীশ, চিকুর বাবা, এবার বৈঠকখানায় ঢুকল। "কচি কি তোদের গপ্প শোনাচ্ছে? জানিস, আমরা দু'ভাইও ছোটবেলায় কচির কাছে গপ্প শুনতাম।"

"আয় বোস।" বিশ্বরূপ একটু হেসে বললেন। অনেকটা ছোট বলে ওঁর দু'দাদা ওঁকে "কচি" বলে ডাকতেন। সেই নামেই ডাকে দু'জন ভাইপো, এমনকী পিকুও। চিকু অবশ্য "কচিদাদু" বলে।

বিশ্বরূপ এবার নাতিদের হাত ধরে দু'পাশে বসিয়ে দিলেন।

"তাহলে তো গল্পটা শুরু করতেই হয়।"

"হ‍্যাঁ হ‍্যাঁ, শিগ্গির বলো", চিকু ও পিকু আরও গা ঘেঁষে বসল।

 

 

"সেদিন সন্ধ্যেবেলা বারান্দায় বসে আছি। আমাদের আস্তানা জঙ্গলের ভেতর নদীর ধারে আদ্যিকালের এক পোড়ো বাংলো। সামনে এক গভীর জঙ্গল, কুয়াশাঘেরা‌, অমাবস্যায় ঘোর অন্ধকারের চাদরে মোড়া। কানে আসছে অদূরে থাকা ঝোরার জলের কুলকুল আওয়াজ… আর ভেসে আসছে একটা বাচ্চার কান্নার শব্দ। উঁ-উঁ-উঁ-উঁ… একঘেয়ে সুর, কোনও ওঠানামা নেই। বিগত এক ঘণ্টায় এই নিয়ে চার চারবার। এবারের কিস্তি চার-পাঁচ মিনিট ধরে চলছে, একনাগাড়ে। পিনাকী উঠে দাঁড়াল। আমার ছেলেবেলার বন্ধু; অ্যাডভেঞ্চারের মারাত্মক নেশা! ওর পাল্লায় পড়েই এই জঙ্গলে আসা। এর আগে কোনওদিন ট্রেকিং করিনি। তাই একটু ইতস্তত করছিলাম। কিন্তু পিনাকী নাছোড়বান্দা। ওর সঙ্গে আলাপ প্রেসিডেন্সি কলেজে। আমার ফিজিক্সে অনার্স আর ওর কেমিস্ট্রিতে। ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা শেষ হতেই আমার পেছনে উঠেপড়ে লেগেছিল এই বেরিয়ে পড়ার জন্যে। 

সেই বেড়ানো এখন শেষের দিকে; আগামীকাল কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার কথা আমাদের।

'এটা কীসের আওয়াজ বল তো?' পিনাকী উঠে দাঁড়াল। 

আমি হাত ধরে জোর করে টেনে বসালাম ওকে। সেটা ওর পছন্দ হল না। 

'আওয়াজটা খুব দূরের নয় রে; ঐ ঝোরাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে, মনে হচ্ছে সেখান থেকেই আসছে।' ওর কথা শুনে মনে হল এক্ষুনি গিয়ে দেখতে চায় ওটা কীসের শব্দ। কী মুশকিল রে বাবা!

'আরে, ওদিক দিয়েই তো এলাম। পুরো ঘন জঙ্গল।' কান্নার ধ্বনি যেন আরেকটু জোরালো হল। আমার গায়ে একটা শিরশিরানি জাগল। এমনিতে আমারও ভয়ডর কম, লোকে আমাকে সাহসী বলে; কিন্তু গতকাল মাঝরাতে হঠাৎই ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কাল তাঁবু খাটিয়ে ক্যাম্প করেছিলাম এখান থেকে বাইশ কিলোমিটার দূরে। ওখানে এরকম জঙ্গল নেই, কিন্তু পুরো জায়গাটা শাল আর মহুয়া গাছে ভর্তি। একটা মুরগি কিনে এনেছিলাম সামনের গ্রাম থেকে। পিনাকী ওটার ছালসুদ্ধু পালক ছাড়িয়ে ফেলল। আমি তেলমশলা মাখিয়ে কাঠ-পাতার আগুনে ভালোই রোস্ট করলাম। তারপর গল্প করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি! হঠাৎ কিচ-কিচ আওয়াজে ঘুম ভাঙতে দেখি পিনাকী নেই – তাঁবুতে আমি একা। বাইরে মুখ বাড়ালাম; অন্ধকারটা যেন গিলে খেতে এল। ডাকলাম ওকে বার কয়েক, কোনও সাড়া নেই। টর্চ নিয়ে বেরিয়ে দেখি তাঁবুর একটু দূরে খোলা আকাশের তলায় চিৎপাত হয়ে ঘুমোচ্ছে। অনেক ঠ্যালা গোঁত্তা দেওয়ার পর চোখ মেলল। কিছুতেই ভেতরে শুতে যাবে না। এ'ধরনের ট্রেকিং-এর আসল মজাই নাকি তাঁবুর বাইরে ঘুমোনো! অনেক সাধ্যসাধনা করে প্রায় হাতে-পায়ে ধরে ওকে ভেতরে নিয়ে এলাম। আনার কারণও ছিল। এ অঞ্চলের স্থানীয় লোকজনের মুখে শুনেছি এদিকে আগে চিতাবাঘের খুব উপদ্রব ছিল, এখনও রাতে তারা শিকারের সন্ধানে মাঝেমধ্যে হানা দেয়। 

 

 

ওইই...কান্নাটা আবার শুরু। এবার পিনাকী টর্চ আর ওর ধারালো ভোজালিটা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। এই ঘরের কোণে আজ একটা বড় লোহার রড পেয়েছি, মুখটা ভাঙা আর ছুঁচলো। আমি সেটাই তুলে নিলাম। টর্চ আমার সঙ্গেই আছে। কান্নাটা নদীর স্রোতের মতোই বয়ে চলেছে, একটানা…

 

 

ঘরের দরজা খুলে বেরোলাম। বাংলোর বাকি তিনটে ঘর ফাঁকা। অবশ্য এখানে কেউ চট করে আসে বলে মনে হয় না। ঘরগুলো বেশ বড়, আসবাব বলতে ভেতরে একটা কাঠের তৈরি ভাঙা আলমারি, দুটো বড় কাঠের চৌকি, ওপরে নারকেল ছোবড়া দিয়ে তৈরি তোশক। জমে থাকা ধুলো প্রমাণ করে বহুদিন এখানে কেউ আসেনি। একটাই বাথরুম, তাতে সারি দেওয়া বালতিতে জল ভরা আছে। রান্নাঘরও আছে কিন্তু দেখলেই বোঝা যায় সেটার ব্যবহার হয়নি অনেকদিন। কেই বা আসবে আমাদের মতো দু'চারটে পাগলা অ্যাডভেঞ্চারার ছাড়া! বাংলোটা বলতে গেলে পরিত্যক্তই!

 

 

আজ বিকেলে দূর থেকে এই বাংলোটা দেখতে পেয়ে এখানেই রাত কাটাতে আসি। মেন গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই যেন ঝুপ করে আঁধার নেমে এল। বুড়ো চৌকিদারটা তখন বাংলোর একধারে থাকা কুয়ো থেকে জল তুলছে। আমাদের দেখে একটু থমকে দাঁড়াল। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে এসে আমাদের মুখোমুখি। অবাক লাগল যখন আমাদের নাম, পরিচয়, কোত্থেকে আসছি কিছুই জিজ্ঞেস করল না। এক রাত থাকা খাওয়ার জন্যে কত টাকা দিতে হবে জিজ্ঞেস করাতে বলল, আমরা যা বিবেচনা করে ঠিক করব, তাতেই চলবে। আড়াই ঘণ্টার মধ্যে আমাদের জন‍্যে রুটি, বেগুনভাজা আর চিকেন কারি রান্না করে নিয়ে এল ওর বাড়ি থেকে।  

 

 

বাংলোতে কেউ না থাকলে ও কাজ সেরে রাত্তিরে কাছের গ্রামে চলে যায়। আমরা বললাম আমাদের জন্যে ওকে রাতে থাকতে হবে না। বাড়ি চলে গেল রাত সাড়ে আটটা নাগাদ। বলল, মেন গেটে বাইরে থেকে শেকল তুলে দেবে। আমরা বারণ করলাম; বললাম ভাল করে পাল্লা টেনে দিতে ... আমরা ভেতর থেকে ছিটকিনি দিয়ে দেব। কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে কোনও প্রাণীর পক্ষে ওই ভারী দরজা ভেঙে ঢোকা অসম্ভব, একমাত্র হাতি ছাড়া। 

 

 

কান্নাটা এতক্ষণে থেমেছে। আমি মেন গেটের বাঁ-পাল্লা টেনে ধরে ডানদিকেরটা একটু জোরে ঠেলতেই বাইরের কুয়াশা, অমাবস্যা হুমড়ি খেয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। পিনাকীর টর্চের আলো সোজা গিয়ে পড়ল সামনের বড় সেগুন গাছটার গায়ে। দেখলাম কেউ একজন গুঁড়ির পেছনে সট করে লুকিয়ে পড়ল। 

'কে ওখানে?'

'আমি রতন, আলো সরাও...চোখে নাগে।'

বাচ্চা ছেলের গলা! টর্চ নামাল পিনাকী। কুয়াশা ফুঁড়ে বেরিয়ে এল একটা বছর দশেকের ছেলে, হাতে একটা ছোট কঞ্চি আর দড়ি – যার অন্য প্রান্তে একটা ছাগলছানা – রং ধবধবে সাদা। এই অন্ধকারেও দিব্যি দেখা যাচ্ছে।

'এত রাতে তুই এখানে কী করছিস?'

'ইটা পাইলে গেছিল। তুমরা কই যাও এত রাতে?'

'একটা বাচ্চা কাঁদছে মনে হয়!'

'উটা তো শিয়ালের ডাক! তুমরা জলদি ঘরে যাও। ইখানে চিতাবাঘ আছে...'

'তোর বাড়ি কোথায়?'

ও হাত তুলে গ্রামের দিকটা দেখাল।

'এই বাংলোর চৌকিদারকে তুই চিনিস?'

'সি তো আমার বাবা – সুখরাম মাহাতো।'

রতন ছাগলটাকে নিয়ে আস্তে আস্তে চলে গেল।"

 

 

"কচি, তারপর কি তোমরা রুমে চলে গেলে?" পিকু একটু নড়েচড়ে বসল

হ্যাঁ সোনা।”

শুনে একটু হতাশ হল ও।

শেষটা শোনাই?”

বল...”

পরদিন সকালে পিনাকী ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজছে, আমি তখনও বিছানায়; মনে হল কেউ খুব জোরে মেন গেটে ধাক্কা দিচ্ছে। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে খুললাম। বছর পঁয়তাল্লিশের এক মহিলা, মনে হয় চৌকিদারের বৌ। আমাদের দেখে সে যেন চমকে উঠল। 

'তুমরা!'

'আমরা কাল সন্ধ্যেয় এখানে এসেছি। কেন সুখরাম কিছু বলেনি?' আমি শুধোলাম। 

ওর চোখে কেমন যেন একটা অদ্ভুত চাউনি!

'তোমার ছেলে আছে?'

'না বাবু; আমার ইকটাই ছেলে ছিল...মরেচে দু বচ্ছর হল।'

'এ বাবা, কী করে?'

'চিতেবাঘের পেটে, বাবু। রাতে ছাগলছানা পাইলে গেছল বলে আনতি গেল...'

ওর গলা ধরে এল!

'পা টেনে টেনে হাঁটত, জোরে ছুটতি পারত না! ডাগদার বলেছেল উর কি ইকটা রোগ, পুলিও না কি ...'

'নাম কী ছিল?' ছোপধরা আবছা আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কামাতে কামাতে পিনাকী জিজ্ঞেস করল।

'রতন।'

কালকে রাতে দেখা ছেলেটাও তো পা টেনে টেনে হাঁটছিল! পিনাকীর দিকে তাকালাম; ওর চোখেমুখে ভয় নয়, কেমন যেন একটা অস্বস্তির ভাব দেখলাম – এই প্রথম! একটু সামলে নিয়ে ও বলল,

'যাকগে, এবার বলো তোমার মরদ কখন আসবে? আমাদের তো একটু পথ দেখাতে হবে। আজকেই আমরা ফিরব।'

'সেও ত আর লাই, বাবু…'

'মানে!'

'রতন চলি গেলে মরদের মাতাটা পুরোপুরি খারাব হইয়ে গেল। ইদিক সিদিক মহুয়া গিলে যিখানে-সিখানে পড়ি থাকত। তারেও একদিন চিতেবাঘ সাবড়ে দেল...'

ওর কথা শেষ হতে না হতেই একটা ছাগলছানা মেন গেট পেরিয়ে সিধে ভেতরে ঢুকে পড়ল – রঙ সাদা ধবধবে।"

 

 

মণীশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বৈঠকখানার আবছা আলোয় বিশ্বরূপ দেখলেন চিকু আর পিকুর মুখ শুকনো, চোখ দরজার দিকে। একটা ধবধবে সাদা কিছু দাঁড়িয়ে...

"ভৌ ভৌ..."

ডায়না মনে হয় বলছে, খাওয়ার ঘরে চল, চিকেন রোস্ট রেডি।

 

  • প্রান্তিক বিশ্বাস