জীবনের দিনলিপির ছেঁড়া পাতা 

এক ভয়াল সুন্দর রাত ছিল সেদিন। শিকাগো থেকে নরমালি ফিরছি রাত ৮ :৩০ র সময়ে গাড়ি চালিয়ে। ডিসেম্বর মাসের ২৩ তারিখ। চারিদিকে নিশুতি আধার। হালকা কুয়াশার আস্তরণ। হঠাৎ শুরু হল তুষার ঝড়। সুতীক্ষ্ণ ঠান্ডা হওয়ার চাবুকে শ্বেত শ্রুভ্র তুষার কণাগুলো দৃষ্টিপথ ঝাপসা করে দিচ্ছে। আমি তখন মরিয়া হয়ে এক গ্রামের পথ ধরলাম।  হাইওয়ে থেকে নেমে সেই কুয়াশার মধ্যে দেখি খ্রিস্তৎসবের বাতি উজ্জ্বল এক গির্জা। মনে হলে এতো রাতে ভিতরে লোক আছে। আমি গির্জার দরজা ধাক্কালাম। আবার ধাক্কালাম। ভিতর থেকে আওয়াজ এল, কে আগাথা ?

 

 

আমি বললাম, না, আমি এক পথিক। রাতের তুষার ঝড়ে পথে গাড়ি চালাতে না পেরে কিছু সময়ের জন্যে আশ্র্রয় খুঁজছি। ভিতরে একটু আওয়াজ হল। এক কৃষ্ণাঙ্গ বৃদ্ধ ভদ্রলোক এবং দুজন শ্বেতাঙ্গ মহিলা আর এক যুবক দেখতে ভারতীয়দের মতো বাদামি রঙের দরজার সামনে ভিড় করে দাঁড়ালেন। তারপর আমায় দেখে তাঁদের মায়া হল। ভদ্রমহিলা বললেন, এসো, ভিতরে এসো। তুমি কোথা থেকে আসছো? আমি বললাম, ওহেয়ার বিমানবন্দর থেকে।আমার স্ত্রী নিউইয়র্কে পড়াশোনা করেন। সেখানে থেকে এসে উড়োজাহাজে শিকাগো নামি। বাড়ি ফিরছিলাম। কিন্তু পথে তুষার ঝড়ে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তাই গ্রামের পথে নেমে তোমাদের গির্জার আলো দেখে এসেছি। সঙ্গে সঙ্গে সবাই একসঙ্গে বলে উঠলেন, Hallelujah! Lord has guided you to us! এরপর কৃষ্ণাঙ্গ ভদ্রলোক মুখ খুললেন। আমি এই গির্জার pastor। এটা একটি ব্যাপটিস্ট গির্জা। তুমি সঠিক জায়গায় এসে পড়েছো। আমরা আগামীকাল খিস্তৎসবের আগের রাতের প্রার্থনা আর তারপরে খ্রিস্তৎসবের প্রার্থনার জন্যে খাবার গোছাচ্ছি আর গির্জাটা সাজাচ্ছি। তুমিও কিছু খাও আর আমাদের সঙ্গে হাত লাগাও। প্রয়োজনে রাতটা আমাদের সঙ্গে থেকে যাও।   

 

 

আমি তাদের সঙ্গে গল্প করতে লাগলাম। গির্জার কোনায় ভ্যাকুয়াম ক্লিনার নিয়ে বয়স্ক মহিলার নির্দেশ মতো পরিষ্কার করলাম। তারপরে পিৎজা আর আর একটু স্যালাড খেতে বসলাম ওনাদের সঙ্গে। প্যাস্টর এর নাম ক্রিস্টোফার সলোমন, তিনি আর তাঁর স্ত্রী মেরি গির্জার সঙ্গেই থাকেন।  বাকিরা গ্রামের অধিবাসী। তাঁরা গির্জার কাজে সহায়তা করতে এসেছেন। 

 

 

আমার সঙ্গে সঙ্গে মনে পরে গেল আজ ২৩ শে ডিসেম্বর।  শান্তিনিকেতনে পৌষমেলার সূচনা হয়ে গিয়েছে। বড়দিনের দিন আমাদের উপাসনা মন্দিরে প্রার্থনা হবে। মেরি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কিছু ভাবছো? আমি বললাম, আমাদের দেশে ইন্ডিয়াতে আমাদের শহরে উপাসনা মন্দিরে প্রার্থনা হয় যদিও আমার শহরে খুবই কম খ্রিস্টান থাকে। 

 

 

মহিলা অবাক হয়ে বললেন, বা: এতো দারুন খবর দিলে। কোথায় সে শহর? আমি বললাম, শহরের নাম শান্তিনিকেতন আর সেটি একটি বিশ্ববিদ্যালয় শহর। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা একজন কবি এবং দার্শনিক। তাঁর নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বলে আমি শান্তিনিকেতন সম্পর্কে কিছু কথা বললাম।  ক্রিস্টোফার চোখ মুদে শুনছিলেন।  তিনি বললেন, আমি ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয়তে ধর্ম বিষয়ে আন্ডার গ্রাজুয়েট করে শিকাগো স্কুল অফ ডিভিনিটি থেকে মাস্টার্স করেছি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পোয়েট টেগোর এর পুত্র পড়াশোনা করতে এসেছিলেন। পোয়েট টেগোর অর্বানা শহরে ছিলেন ১৯১২ থেকে ১৯১৩। তিনি সেখানে উনিটারিয়ান গির্জায় বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আমি abode of peace (শান্তিনিকেতন) সম্পর্কে জানি। এরপর তিনি তাঁর স্ত্রীকে বললেন, আমার সঙ অফারিংস বইটা নিয়ে আসবে ডার্লিং। আমি সভয়ে দেখলাম, ভদ্রমহিলা রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে এলেন। ক্রিস্টোফার তার থেকে পড়ে শোনালেন, 

 

 

Though hast made me endless, such is thy pleasure. This frail vessel thou emptiest again and again, and fillest it ever with fresh life.

This little flute of a reed thou hast carried over hills and dales, and hast breathed through it melodies eternally new.

At the immortal touch of thy hands my little heart loses its limits in joy and gives birth to utterance ineffable.

Thy infinite gifts come to me only on these very small hands of mine. Ages pass, and still thou pourest, and still there is room to fill.

 

 

তারপর তিনি আমার সঙ্গে প্রচুর কথা বলতে শুরু করলেন।  আমি তাঁর সঙ্গে এবং তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে গল্পে মজে গেলাম।  আমি তাঁকে বললাম ভারতে সিভিল রাইটস মুভমেন্টের গান খুবই জনপ্রিয়।  প্র্রতিটি তরুণ তরুণী জানেন we shall overcome।  তিনি খুবই খুশি হলেন এবং বললেন ড: কিং তো ভারতের দ্বারা খুবই প্রভাবিত ছিলেন। আমি তখন বললাম পল রবসন খুবই পরিচিত ভারতে, অন্তত পশ্চিমবাংলায়। তখন উনি গম্ভীর হয়ে গেলেন।  তারপর বললেন, তুমি জানো পল কমিউনিস্ট ছিলেন। আমি বললাম, জানি। তিনি তখন হাসলেন। তারপরে আবার বললেন, কিন্তু পল এবং হ্যারি বেলা ফন্টেন ঈশ্বরের কাজ করেছেন। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করার কথা বলেছেন। এটা খুবই খ্রিস্টান কাজ। তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি ধর্মে খুব একটা বিশ্বাস করো না। আমি নীরব রইলাম। তারপরে উনি বললেন, পোয়েট টেগোর এবং প্রভু যীশু দুজনেই মানুষে বিশ্বাস করতেন। পোয়েট Tagore প্রাচ্য এবং প্রতীচ্যের সম্মিলন চেয়েছিলেন। তুমি আমাদের অতিথি হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্টের এক অজ পাড়াগেঁয়ে এলে  আমাদের কাছে এটাও মানবতার মিলনের বাণী। প্রভু আমাদের কাছে তোমায় পাঠিয়েছেন। তুমি বসে থাকো। তোমার যাওয়ার আগে আমরা তোমার জন্যে প্রার্থনা করি।  সকলে একসঙ্গে বলে উঠলেন, আমেন।  

 

 

প্রার্থনা শেষে আমি বললাম, তুষার ঝড় শান্ত হয়েছে। আমি তাহলে আসি। বাইরে বেরিয়ে দেখলাম অমাবস্যার রাতের তারার আলোয় মৃদু আলোকিত তুষারাবৃত পথ। গাড়ি চালাতে চালাতে আমার শুধু মনে হল আমাদের কবির সৃষ্টি পৃথিবীর কোনও অজ্ঞাত প্রান্তের মানুষকে কী সহজে এক করে দিল। মানবতার পথ আমাদেরকে উচ্চতর জীবনের সন্ধান দিয়েছে।

  • শুভ বসু
img
আগের পাতা
এই সময়