বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কাব্যগ্রন্থ হিমযুগ : ছয় দশকের সংশয়িত ‘সূর্যকরোজ্জ্বলতা’র উত্তরাধিকার

পাঁচ : পশু-পাখি-পোকার জগৎ আর মানুষের চেনামুখ

হিমযুগ কাব্যগ্রন্থে কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত পশু-পাখি-পোকা-মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের নিরিখে এক পৃথিবীর ছবি উপস্থিত করেছেন। আবার এই পশু-পাখি-পোকারা কখনও মানুষের চরিত্রের বিশ্লেষক, কখনও তারাই মানুষের প্রতীকী ব্যঞ্জনা পেয়েছে। ‘শাদা পোকা’ কবিতায় মানুষের প্রেম-প্রণয়-দাম্পত্য-সামাজিকতা-মৃত্যু সকল কিছুর মধ্যে এক ‘শান্ত’ জীবনপ্রবাহকে কবি বুদ্ধদেব লক্ষ করেছেন। মৃত্যু থেকে নতুন জীবনের ভবচক্রে প্রবাহের এই ভূমিকাকেই কবি আকাঙ্ক্ষা করেছেন –

...এই সুন্দর সকালবেলায়,

লাফ দিয়ে ঢুকে পড়ুক তোমার গর্ভকোষে, ঝলমলে আরও এক শীত ঋতুতে

আমরা তার নাম রাখি শাদা পোকা।৫০

 

 

‘ঢুকে পড়ছে’ কবিতায় জীবজগতের ক্রমাগত এই দৌড়ে বেড়াতে বেড়াতে মানুষের সার্বিক ক্লান্তিকর পরাজয়ের চিত্র ফুটে উঠেছেকুকুরের পেছনে বেড়াল, বেড়ালের পেছনে ইঁদুর আর তার পিছনে মানুষেরছুটতে ছুটতে ‘আশ্চর্য এক ইদুরের গর্তে’ ঢুকে পড়ার পরিণতির কথা এখানে উঠে এসেছে।৫১‘ইঁদুর’ কবিতায় মানুষের অন্ধকারময় বন্দীত্বদশার প্রশ্নই প্রধান হয়ে উঠেছে – “ছোট্ট এক অন্ধকারের কোনায় বসে আছো আজ কতদিন?” অনিশ্চিত সকালের জন্য উৎকণ্ঠাও অসামান্য ভঙ্গিতে কবিতায় ফুটে উঠেছে – “কী হবে, কী হবে আবার সকাল হ’লে?৫২‘বিড়াল’ কবিতায় বিড়ালের জবানিতে আশ্রয়দাতা মানুষের অনুগ্রহে থেকেও নিজ স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে তার সর্বস্ব ক্ষয় কামনা করার কৃতঘ্ন হিংস্রতা ধরা পড়েছে –

মাছের কাঁটার মতো আঙুল চোয়ালে চিবাতে চাই, দাঁতের ভেতর

তোমার সর্বস্ব কিছু, তোমারই খাটের তলায়,

তোমার নারীর কাছে ব'সে চোয়ালে চিবাতে চাই আজআজীবন।৫৩

মধ্যবিত্তের অস্তিত্বের হীনতা, তুচ্ছতা অসার আত্মম্ভরিতার চুপসে যাওয়ার রূপকচিত্র ‘টিকটিকি’ কবিতায় ধরা পড়েছেপ্রথমে ভয়ংকর ডায়নোসরাস হয়ে উঠতে পেরেছে ভেবে টিকটিকির প্রচণ্ড আত্মতৃপ্তি আত্মপ্রসাদ কার্যক্ষেত্রে নিষ্ফলতায় পরিণত হয়। কোনও ভয়ঙ্কর অস্তিত্বের উচ্চতায় নিজেকে তুলতে পারার আত্মপ্রসাদ শেষপর্যন্ত অন্তঃসারশূন্যতা ও তুচ্ছতাকে চাপা দিতে পারে না তাই  ‘স্বপ্ন’-এ ইচ্ছাপূরণ করা ছাড়া কোনও গত্যন্তর নেই।৫৪

 

 

মাগুরমাছের চিত্রকল্পের আড়ালে রয়েছে মানুষচরিত্র। ‘মাগুরমাছ’ কবিতার শেষে স্বপ্নসম্ভব এক পরাবাস্তব আবহ রচিত হয়ে উঠেছেযৌনতাসম্পৃক্ত সহিংসতাকে ব্যবহার করে এক অস্বস্তিকর অবস্থাকে জারিয়ে দিতে কবি বুদ্ধদেবের সিদ্ধি অসামান্যতা লাভ করেছে। জিওল মাছ মাগুর। মাগুরের আন্তর্জাতিক নাম ওয়াকিং ক্যাটফিস রাখার কারণ হল এটি শুষ্ক মাটির উপর দিয়ে অনুকূল পরিবেশ বা খাদ্য সংগ্রহের জন্য যেতে পারে। রান্নাঘরের কোনায় ডেকচির মধ্যে থাকা মাগুরমাছ ‘সারারাত সাঁতার কাটে’, ‘আঁতকে ওঠে’, আবার ‘ঘুমিয়ে পড়ে’। ‘অদ্ভুত সুন্দর’ তার চোখ জুড়ে ‘মাছেদের স্বপ্ন’ নামে। কিন্তু ভোর হলেই ‘রাগী স্বামীর’ কাছ থেকে ‘শান্ত সুন্দর বৌ’, আর ধারালো দা থেকে মাগুরমাছের রক্ত ছিটকে বেরিয়ে আসেচকচকে মোলায়েম মাগুরের শরীর থেকে স্বপ্নেরা একে একে ছিটকে বেরিয়ে আসে। সারা সকাল সারাদুপুর মাগুরমাছের গন্ধে বাড়ি ভরে যায়। তারপর আবার রাত্রি নামলে পৃথিবী শান্ত হয়ে থাকে‘সাঁতার কাটার শীতল নীল দূর-বয়সের দীঘির ভেতর’ বউ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে গত রাতের মাগুরমাছের স্বপ্ন আর পরের রাতের ‘শান্ত সুন্দর’ বউটির স্বপ্নের সমান্তরালতা পাঠকের মনে এক আশু অনির্দেশ্য ভয়ের ইঙ্গিতবাহী হয়ে ওঠে। পরাবাস্তবতার প্রয়োগে জটিল চিত্রটিতে পাঠক শঙ্কিত হয়ে ওঠে হাওয়া আর রান্নাঘরের দরজা ভয়ঙ্কর শব্দ করে খুলে যায়, বউটি আঁতকে ওঠে –

মাগুরমাছ,

মাগুরমাছের পেছনে তাদের স্বপ্ন, মাগুরমাছের সামনে

তাদের স্বপ্ন,

অদ্ভুত শিস দিতে দিতে

মাগুরমাছেরা সারারাত এ-ঘর ও-ঘর করে

আর খুঁজে বেড়ায় সেই শান্ত সুন্দর বৌকে।৫৫

 

 

‘গাধা’ কবিতা উত্তম পুরুষে লেখা হলেও এই কবিতাটি আমাদের আত্মদর্পণ। বংশানুক্রমে আমাদের সমগ্র জীবনে অকারণ ক্লান্তিকর একঘেয়ে বোঝা বইবার চিত্র কবিতায় ফুটে উঠেছে। কী অনায়াসে পুনঃপৌনিক একঘেয়ে কাজের ফিরিস্তির মধ্যে দিয়ে কবি আলগোছে ভয়ঙ্কর শব্দবন্ধের প্রয়োগ করেন যেন সবই স্বাভাবিক – চুল-দাড়ি-নখ কাটার সঙ্গে গলা কাটার কোনও তফাৎ নেই – 

একঘেয়ে এক শব্দ

ভেসে আসে সারাদিন – মানুষ চুল কাটে, দাড়ি কাটে নখ কাটে, বৌ

মাছ কাটে গলা কাটে, ছেলে করাত চালায় –

আর তার শব্দ ভেসে আসে।৫৬

কথক তাঁর বাবার থেকে শোনা ‘একটা চাবুকের গল্প’ তার ছেলেকেও বলেন। বাবা-ছেলে-তার ছেলে বংশানুক্রমিকভাবে গাধার খাটুনিই খেটে যায়। পরম্পরাগত গাধার খাটুনি তথা দাসত্বের আর চাবুক খাওয়ার নেশার কথা, যাতে নিজেই নিজের পিঠে চাবুক কশাতে হয় – এইভাবেই দাসত্ব-মনোবৃত্তি, প্রভুর নিপীড়ন সহ্য করা, মজ্জাগত হয়ে যায়। অ্যালফ্রেড অ্যাডলারের মতে মানুষের মনের বিকৃত আগ্রাসী তাড়না কোনও বিশেষ বিষয়ে চালিত হলে তা Sadism বারূপভেদে Masochism হয় অন্যকে পীড়ন করে বিকারগ্রস্ত নিষ্ঠুরতা দ্বারা যৌনপ্রবৃত্তি চরিতার্থতা বা আনন্দ লাভ করা হল Sadism বা ধর্ষকাম এতে যৌনতা থাকতে পারে, কিন্তু তা আবশ্যিক শর্ত নয় অন্যদিকে শারীরিক অথবা মানসিক আত্মনিগ্রহ, (বিশেষত যৌন আচরণকে গুরুত্বদান) আত্মঅবমাননা, লজ্জা, গ্লানির মধ্য দিয়ে এক বিকৃত আনন্দলাভ Masochism অ্যাডলার Sadistic Masochistic পরিণতিকে যুগপৎ দুটি শক্তিচালনার সঙ্গে যুক্ত দেখিয়েছেন)যৌনতাড়না এবং খ) আগ্রাসী তাড়না আগ্রাসী তাড়নায় ক্ষুধা, ঘ্রাণ, ঈক্ষণ তাড়না রয়েছে, ঈক্ষণ তাড়নার সঙ্গে শ্রবণ তাড়নাযুক্ত অন্যদিকে ধর্ষমর্ষকাম (Sadomasochism)ধর্ষকাম এবং মর্ষকাম একই ব্যক্তির মধ্যে দেখা যায় ‘চাবুক’-এর ‘নেশা’ যা ছিল মালিকের দ্বারা শ্রমিকের প্রতি অত্যাচার-ধর্ষকাম, তাইই আবার অপরের মধ্যে সঞ্চারিত করার ইচ্ছা, যে নেশা থেকে মুক্ত হতে না পেরে আত্মপীড়ন-মর্ষকাম নিজেই যখন নিজের ওপর অত্যাচার করে নিষ্করুণ আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করে তখন আর অপরকে আলাদাভাবে প্রয়োজন পড়ে না, ‘আত্ম’ই হয়ে ওঠে ‘অপর’, তখন তা ধর্ষ-মর্ষকামে পরিণত হয়ে ওঠে।৫৭ কবিতায় এই আত্মনিপীড়নের চিত্র আমাদের ভয়বিহ্বল করে তোলে –

নেশা ধরে গিয়েছিল, রোজ তাই নিজেই নিজের পিঠে...।৫৮

 

 

স্বপ্নের ভেতরও সেই অন্বিষ্ট অশ্রুসজল ‘এক জোড়া চোখ’-এর আত্মদর্শন, যার চোখের জলের আয়নায় ‘মুখের ছবি’ ফুটে ওঠে, আর তারই ‘চোখের রক্তে’ ‘সমস্ত আকাশ লালে লাল হয়ে উঠেছে’।৫৯নিজের শিল্পী-বিবেক বিসর্জন দিয়ে কবি কীভাবে এক হীন ঘৃণিত সত্ত্বায় অধঃপতিত হয়, ‘কেঁচো’ কবিতায় তার প্রকাশ ঘটেছেসময়ের দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে কবি প্রথমে তাঁর দীর্ঘ মানস-পর্যটনের ব্যাপ্ত অভিজ্ঞতা বছরের পর বছর কবিতায় ভাষারূপ দিয়েছেনসময়ের দর্পণের ভিতর থেকে একদিন নগদ পাওনা-লোভী বাণিজ্যিক বুদ্ধির শাসনে, উপেক্ষা-অনাদরের আশঙ্কায় কবি নিজের কবিতার শিল্পধর্মকে পরিহার করে তাকে ‘একঅন্তঃসারহীন বাহ্য চটকে মুড়ে’ দেনযখন অন্য কেউ জীবনের গহন অভিজ্ঞতার অব্যয় কস্তুরী তুলে আনেন, তখনও ওই কবি লিখে তাঁর ‘কেঁচো-জন্মের অভিজ্ঞতার কথা’ লিখে চলেন এই কবিতায় বুদ্ধদেব নিজেকে এবং কবিদের ‘একটা আয়নার সামনে’ দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন৬০

 

 

কবিমাত্রই অনুভূতিশীল এবং অভিমানী। সুতরাং চতুষ্পার্শ্বের ‘অরাজকতা’- (তা যে-স্তরেই হোক)৬১ তাঁর ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠা খুবই স্বাভাবিক। বুদ্ধদেবও তাঁর ক্রোধ প্রকাশের মাধ্যম রূপে কবিতাকে হাতিয়ার করেছেন ‘গোরু’ কবিতায় মাতৃস্বরূপা উপকারী পশুর বয়ানের মধ্যে কবির ন্যায়সঙ্গত ক্রোধ প্রকাশ পেয়েছে। ‘দু’পেয়ে ঘৃণ্য জন্তুদের’ মানুষের নির্দেশমতো সকল দাবি মেটানোর পরেও ‘ছুটি’ মেলে নাগরুদের ‘স্বপ্ন’ তাই শূন্যতায় ভরা। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে গজিয়ে ওঠা ঘাসকে উপভোগ করার উপায়ও থাকে না। একদিন ‘খাড়া ইস্পাতের মত ভোর’ তাদের ‘ঘাড়ের ওপর’ নেমে আসে। দলবদ্ধভাবে একটা গলি পেরিয়ে আরেকটা গলির বধ্যভূমিতে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। এই পরিস্থিতিতে গরুর জবানিতে শেষ ক্রোধের বর্হিপ্রকাশে কবিতাটি অসামান্য হয়ে ওঠে –

আমরা শেষবারের মতো

লাথি মারি মাটি, প্রস্রাব করি আর

গোবরে গোবর করে দিয়ে যাই পথ।৬২

 

 

‘ডিম’ কবিতায় মানুষের মুরগি ও মোরগের নিরীক্ষণে এক বিষাদগাথা অনুরণিত হয়েছে যা কেবল তাদের কথা না হয়ে মানুষের জন্মের ইতিহাসের কারুণ্যকে স্পর্শ করেছে –

তোমার ও আমার কথা, এক মুরগি ও মোরগের

করুণ ও করুণতম কথা শেষ হবে সেইদিন, কেন না বেঁচে থাকা মানেই

ক্রমাগত ডিম-পাড়ার স্বপ্ন দেখা ও ডিম-পাড়ার জন্য অপেক্ষা করা –

আর কিছু নয়,

যার ভেতর থেকে একদিন মাথা ঠুকতে ঠুকতে আমরাও বেরিয়ে এসেছি।৬৩

 

 

তীব্র স্যাটায়ারের খোঁচা আপাত নির্বিষ কবিতার মধ্যে কীভাবে সেঁধিয়ে যেতে পারে তার দৃষ্টান্ত ‘খচ্চর’ কবিতাকবিতাটিতে খচ্চরেরা বলেছে যে মানুষের জন্য রেখে যাওয়া ‘ঘোড়ার ডিম’-এ মা বোন বৌ সবাই একসঙ্গে তার ওপর তা দেবেতারপর সময়কালে ডিম ফুটে বেরিয়ে আসবে ‘খচ্চর ভাইরা’খচ্চরেরা ‘গু-গোবরেরও অধম’ – এতকাল যেসব মানুষ ভেবে এসেছে, তাদের পিঠে চেপে হাজার হাজার ‘খচ্চর ভাইরা’ ‘এই হাজা-পচা গ্রহ’কে প্রত্যাখ্যান করে দূরে, অন্য কোনও গ্রহে ‘লাফ’ দিয়ে স্বাধীন এবং ‘আশ্চর্য এক খচ্চর-পৃথিবী’ সৃষ্টি করে তুলতে চায়৬৪

 

 

নাগরিক কর্মক্লান্ত বিধ্বস্ত মানুষের না হয়ে যাওয়া জীবনের মধ্যে আত্মস্বরূপের উপলব্ধি বা অনুসন্ধান নয়, বরং আত্মবিস্মৃতিও যে তার আত্মরতিতে, অস্তিত্বরক্ষায় সহায়তা করতে পারে তার শ্লেষাত্মক দৃষ্টান্ত ‘বাঘ’ কবিতাটি। মানুষ হিসেবে সংকীর্ণ, বদ্ধ, আজ্ঞাবাহী, হীন জীবনযাপন করেও শীর্ণ দেহ দুর্বল সাধারণ মানুষের নিজেকে অশেষ শক্তিধর বাঘ ভাবতে ইচ্ছা করে। তখন তার ‘পুরোনো বাক্সের মতো’ বাড়িটাকে ‘অদ্ভুত এক ঝোপ’ মনে হয় সে যেন খালের ভেতর জোয়ারের জল ঢুকে পড়ার শব্দ শুনতে পায় আর ‘রোগা, শান্ত, কালো-চোখের বৌ’কে ‘গর্জনরতা বাঘিনী’ মনে হয় কর্মক্ষেত্রে লাঞ্ছিত চাকুরিজীবী মানুষটির অপরিসর ঘরে শুয়ে নিজের ইন্দ্রিয়প্রখর ব্যাঘ্রত্ব অনুভব করে। খট খট টাইপ-রাইটার, ঘর্ঘরে ট্রাম, পেটের ভেতর কচলে-ওঠা ক্ষিদে নিয়ে বাসের পেছনে দৌড়ে বাড়ি পৌঁছে তার নিজের ‘ঝোপ’-এ ক্ষমতা ও যৌনতার দাপট নিরঙ্কুশ –

মানুষের পোশাক খুলে ফেলার যে অসহ্য যন্ত্রণা, সব, সমস্ত কিছুই

ভুলে গিয়ে

সে আশ্চর্য সুন্দর, বিশাল একটা বাঘ হয়ে শুয়ে থাকে গহনগভীর

বিছানায়।৬৫

 

 

যন্ত্রের জগত, প্রকৃতি ও মানুষের কথা

‘সাঁড়াশি’ কবিতায় সাঁড়াশি হয়ে উঠেছে বাক্‌ স্বাধীনতা রোধ বা হরণ করার নিষ্পেষণ-যন্ত্র, আর তাই নিপীড়ক, স্বৈরাচারী রাষ্ট্রশক্তির রূপক হিসেবে একে ভেবে নিলে অসঙ্গত হবে না দাঁতহীন, জিভহীন মানুষদের ক্লীবতা চাটুকারিতার চিত্র কবিতায় প্রবল অস্বস্তির মধ্যে ফেলেসাঁড়াশি ‘স্বপ্ন’ দেখা, আড়মোড়া ভাঙা ক্ষণিক বিরতিমাত্র‘ছোট্ট ছোট্ট দাঁত, ছোট্ট ছোট্ট জিভ নিয়ে বড় হচ্ছে যারা, তাদের মুখের দিকে’ সে আবার এগিয়ে আসবে৬৬ খুব সূক্ষ্ম ঘর-গেরস্থালীর পর্যবেক্ষণ ও অনুভূতির কণা সমন্বিত ‘প্রেসার-কুকার’ কবিতায় যন্ত্রশক্তির সম্মোহনই সূচিত। প্রেসার-কুকারের সিটি ‘এ কালের শ্যামের বাঁশি’শ্যামের মোহনবাঁশির সুরে সম্মোহিতা রাধিকার মতো প্রেসার-কুকারের বাঁশিতে মুগ্ধ হয়ে এক অমোঘ আকর্ষণে লক্ষ লক্ষ রান্নাঘরের ভেতর স্ত্রীরা ছুটে যায় ছুটির দিনের জন্য প্রেসার-কুকার এবং প্রেসার-কুকারের জন্য ছুটির দিনের কথা ভাবতে-ভাবতে স্বামীদের মাথা ক্রমশই গরম হয়ে যেতে থাকে সমস্ত কিছু ‘ভুলে’ ‘একটানা লম্বা এক ছুটির জন্য তৈরি’ স্বামীদের আনন্দটুকু কেড়ে নেয় প্রেসার কুকারের ‘বাঁশি’। ‘সংকীর্ণ সম্ভোগ’-এর পালা শেষ হতে না হতেই কী ছবি তৈরি হয় তার শ্লেষাত্মক সরস বর্ণনার আংশিক উদ্ধারযোগ্য – 

তারপর বাঁশি বাজে বাঁশি বাজে বাঁশি ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে ভাসতে ভাসতে

ঢুকে পড়ে

লাখ লাখ রান্নাঘরের ভেতর, লাখ লাখ স্ত্রী ঝটকা মেরে ফেলে দেয় স্বামীদের,

ছুটে আসে রান্নাঘরে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গালে হাত দিয়ে আশ্চর্য বাঁশির

শব্দ শোনে।৬৭

 

 

‘হ্যাঙ্গার’ কবিতায় দৈনন্দিন জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত, বিপর্যস্ত মানুষ শেষপর্যন্ত প্রবল প্রতিকূল পারিপার্শ্বিকের মধ্যে নিজের অস্তিত্বকে টিঁকিয়ে রাখতে অচেতন জড়বস্তুর কাছ থেকে পাঠ নিতে বাধ্য হয়েছে –

নানা রঙের জামারা তাকে শেখালো কী করে

মাসের পর মাস

বছরের পর বছর, এক জন্ম থেকে আর এক জন্ম

ঝুলে থাকা যায় শুধুমাত্র একটা হ্যাঙ্গার ধরে।৬৮

দাম্পত্য জীবনের যৌনযাপনকে নতুন দৃষ্টিতে সসংবেদ্য করে তোলার আয়োজনরূপে ‘উড়ো-জাহাজ’ কবিতাটি অসামান্য। ভোক্তা-দ্রষ্টা পুরুষ-স্বামী তলায় আর প্রকৃতি-স্ত্রী উপরে – এ চিত্র বিপরীত রতিবিহারের। দ্রষ্টা পুরুষের দৃষ্টিতে প্রিয়ার ‘হাত দুটোকে মনে হয় ডানা’নিজেই নিজের পায়ের দিকে বেঁকে তাকিয়ে থাকলে ‘পাখার মতো ছড়িয়ে যায় পা’ ধ্বনিময় চিত্রটি উদ্ধারযোগ্য –

আর মাথার ওপর দিয়ে কেবলই উড়ে যায় একটা উড়ো-জাহাজ,

তার নিচে, মশারির ভেতর, আমাদের স্বপ্নরাও চায় উড়ে যেতে,

শেষে নেমে যায় নিচে, খাটের তলার আবছায়া অন্ধকারে

ঘাড় গুঁজে

উড়ো-জাহাজের গর গর উড়ে যাওয়ার শব্দ শোনে সারারাত।৬৯

 

 

বিশ্ব দুটি বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকার মুখোমুখি হয়েছে। কোন ধরনে প্রকাশ পাবে তা নিয়ে নিশ্চয়তা না থাকলেও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা যে মানুষকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল তা ‘শেষ মিনি’ কবিতায় ধরা পড়েছে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ‘দেরি’ থাকার অনুমানেও স্বস্তি নেই, হিংসা-দ্বেষ মানুষকে আক্রমণোদ্যত করে তুলেছে – ‘মুখ বদলানোর জন্য মুখ এগিয়ে যাচ্ছে ঘাসের ভেতর, নখের ডগায়, মুখ ছিঁড়ে খুড়ে খেয়ে চলেছে অতীত’ বা এই ঘৃণা এতটাই বলশালী যেন তা মৃতদের মধ্যেও কার্যকরী – ‘পরস্পরের দিকে থুতু ছিটোতে ছিটোতে মৃত অনুপমবাবুর ছেলেরা ফিরে আসছে উকিল নিরূপমবাবুর বাড়ি থেকে’‘চচ্চড়’ করে বাড়ছে ঘাস, আঙুল থেকেও বড় হয়ে যাচ্ছে নখ। অতীতের ক্রমবর্ধমান ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার স্মৃতি থেকে মানুষ বেরোতে পারছে না।রাস্তা ‘ফাঁকা’, ‘কালো’, ‘সোজা’ ও ‘বাঁকা’। মানুষ থেকে যন্ত্র – সর্বত্রই বিনষ্টির ছবি প্রকট। সময়ের মূল্যহীনতাও প্রকাশমান – ‘দম ফুরিয়ে আসছে কয়েক লক্ষ ঘড়ির’ দুর্যোগপূর্ণ রাত্রিময় আকাশের প্রেক্ষাপটে জীবনের অর্থহীন শূন্যতা ‘ফাঁকা মিনি’র প্রতীকে রূপায়িত হয়েছে –

আসছে,

মাটি ফুঁড়ে ছুটে আসছে ফাঁকা মিনি। উড়ে যাচ্ছে

মেঘের ভেতর দিয়ে। অভিযোগ নেই, অভিযোগ করার উপায় নেই।

কেন দাঁড়িয়ে থাকা, কিসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা, কতক্ষণের জন্য

দাঁড়িয়ে থাকা?৭০

 

 

কবি বুদ্ধদেব যে শুধু চারপাশের ‘অসম্ভব’ ভয়াবহতাকে উদঘাটিত করার মধ্যেই মাঝে মাঝে সামাজিক অবস্থার প্রতি তীব্র ব্যঙ্গ করেছেন, কখনওবা সোজাসাপটা ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছেনকবির ব্যঙ্গ করবার ক্ষমতা ও স্যাটায়ার তৈরি করবার কৌশল কুর্নিশযোগ্য। ‘মেশিন’ কবিতায় রূপকের আশ্রয়ে কবি তীব্র সমালোচনা করেছেনআমাদের যান্ত্রিক জীবনযাপন তথা অস্তিত্বের মধ্যে দিয়ে যন্ত্রনির্ভর, যন্ত্রশাসিত বর্তমান মানবসভ্যতার। শিশুরও প্রাণসত্ত্বা অবসিত, সেও এখন যন্ত্র থেকে উৎসারিত যেন। মনের কোমলতা, সুকুমার বৃত্তি, সংবেদনা সবই বিনষ্ট, মৃত যেন এক যন্ত্রমানব রোবট আমাদের সমস্ত শারীরিক ক্রিয়া, আচরণের নিয়ন্ত্রকআমরা যেন একটা মেশিনজাত ‘ভাই-বোন’, ‘স্বামী-স্ত্রী’ ও ‘মা-বাপ’আগামী নবজাতক ‘নতুন আর-এক ঝাঁক মেশিন’ও আসবেকিন্তু কোথাও কোনও মানবিক সংবেদন নেই, কেবল ‘মেশিনের ফুল’ ফোটার অপেক্ষায় ‘একা এক রোবট হেঁটে যায় আমাদের চারদিকে’৭১‘পাহাড়’ কবিতায় যন্ত্রযুগের মানুষের ‘কাজের পাহাড়’-এর ক্লান্তিকর যাপনের নিরুপায়তার কথা বলে‘কাজের পাহাড়’ কর্মক্ষেত্র তো বটেই, পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ক্রমাগত বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যেও যে কল্পনাটুকু থাকে তা বিনষ্টির, শিলীভূত হওয়ার –

আছে সকাল, সন্ধ্যা, রাত্রি তারা যা একটু-একটু করে কাটে প্রত্যেকদিন আর ভাবে, কবে

করে পাথর হবে তারা,

কবে কেউ থাকবে না পৃথিবীতে, শুধু পাহাড় ছাড়া।৭২

  • সুমিত বড়ুয়া
  • চতুর্থ