মাগরিবের ছায়া

ভোলা মিঞার ইন্তেকালের পর থেকে বেঁচে থাকা কাকে বলে সেটা শেখার শুরু তারামনের। দাদিআম্মার তছবি যেন শীতের হাওয়ার শিরশিরে ফন্দিফিকিরের মতো কোথায় যে কর্পূরের মতো হঠাৎ একদিন ভ্যানিশ হয়ে গেল- তার হদিস তারা যেমন সেদিনও পায়নি, আজও সবটাই রহস্যই থেকে গিয়েছে তার কাছে। আসলে হঠাৎ করে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরে যে পরিবেশটা তারাকে সব থেকে বেশি সমস্যার ভিতরে ফেলে দিল, তা হল সাংস্কৃতিক ফারাক।
                       

 

তারামন চটকল লাগায়ো একটা মফসসল শহর ঘেঁসা গ্রামে বড়ো হওয়া মেয়ে। তারার গ্রাম শ্রীরামপুরে প্রায় সকলেই ধর্মে মুসলমান হলেও জাতে ছিল বাঙালি। হিন্দি জবান আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে এই উত্তর চব্বিশ পরগণার চটকল লাগোয়া ভাটপাড়া, কাঁকিনাড়া, আতপুর, জগদ্দলে গমগম করলেও একটু দূরের গ্রামগুলোতে হিন্দির কোনও চলই ছিল না। গ্রাম থেকে তখন চটকলে কাজ করতে আসা মানুষ প্রায় ছিল নাই বলা চলে।
                            

 

তবে চটকলের শ্রমিক হিসেবেও বিহার-উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা মানুষজনেদের একছত্র আধিপত্য তখন ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। দেশভাগের পর থেকেই পুববাংলা থেকে আসা মানুষজনেদের ভিতরে পেটের টানকে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টা একটু অন্যরকমই ছিল। ভাটপাড়া, আতপুর, জগদ্দলের পুরনো বাঙালি মানুষজন, দেশভাগের পর ছিন্নমূল মানুষদের কাছে যারা 'এদেশি' বলেই নিজেদের ভিতরে পরিচিত হয়ে আসছে, সেই এদেশিরা হাড়ের গরমে এতোটাই মটমটে ছিল যে, বাপঠাকুর্দার ঘটি গড়িয়ে পেট চালানোটাকেই তারা অনেক বেশি সুবিধাজনক মনে করত একটা সময়ে। ফলে গোটা বারাকপুর মহকুমাতে প্রায় দেড়শ বছরেরও বেশি সময় ধরে গঙ্গার ধার ধরে যেসব চটকলগুলো তৈরি হয়েছিল, সেইসব চটকলে একটা সময়ে বাঙালি লেবার ছিল হাতে গোনা।
                       

 

নদিয়া মিল তৈরিরও আগেরকালে ভাটপাড়ার ভটচায্যি বামুনদের দাপটে তখন টেকা দায়। ভাটপাড়া মিলের লালমুখো সাহেবদের সঙ্গে লুকিয়ে চুড়িয়ে এ কথা- কুকথার বোল বলা এইসব বশিষ্ঠ গোত্রীয় বামুনদের তখন সবে শুরু হচ্ছে আর কি। সাদা চামড়ার নামেই তো তখন মাল ঠাকুরদের পূর্বপুরুষদের জিভের ডগায় নোলার জল একদম চকচক করে। তা সেইসব চটকলে কেষ্টবিষ্টু হয়ে বসা সাহেবরা ইংলন্ডের বাপে খেদানো, মায়ে তাড়ানো কুলোর বাতাসে উড়ে আসা আস্তাকুঁড়ের সকড়ি কি না, তা নিয়ে এতো ভাবনাচিন্তার জো কোথায় বামুন ঠাকুরদের? আলিনগর নাম দেওয়ার আগে সেই কলকেতার গড় আক্রমণ করবার কালে চব্বিশ পরগণার কুমারহট্টের উপর দিয়ে যখন গিয়েছিলেন নবাব সিরাজদ্দৌলা, সেখানকার বারেন্দ্র বামুনদের হাভেলি দেখে উচ্চারণ করেছিলেন,' হাভেলী সহর'। কনৌজ থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা সেই বশিষ্ঠ গোত্রীয় মেড়ো বামুনরা তখন কুলশ্রেষ্ঠ হওয়ার তাড়নায় নবাবের পায়ে পড়বে, না ক্লাইভের চেলাচামুন্ডাদের অন্ডকোষ চেটে দেবে- ঠিক মতো ঠাওর করে উঠতে পারছে না।
               

 

বরেন্দ্রভূম থেকে উজিয়ে এই ভাটির দেশে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের বিদ্যাচর্চার ধারা খুব অল্প সময় কুমারহট্টে থেকেও বুঝে নিতে দেরি হয়নি নবাবের। পূর্বপুরুষদের সঙ্গে পূর্ববঙ্গের যোগসূত্র ধরে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের সময়ের নিরিখে আধুনিকতা ঘিরে উচ্চ ধারণাই ছিল সিরাজদ্দৌলার। কোটালিপাড়ার বৈদিক বামুনেরা যে বামাচারী তন্ত্রসাধনার ভিতর দিয়ে ধর্মের নামে নারী শরীরকেই কেবল  ভোগ চায় সেইখবর ও নবাবের কাছে ছিল। সুরা আর নারীর কবল থেকে হিন্দুধর্মকে বাঁচাতে চৈতন্যদেব মনস্থির করবার পর এই কুমারহট্টতেই এসে খুঁজে পান তাঁর গুরু ঈশ্বরপুরীকে। নীতিনিষ্ঠ নামাজী শিয়া নবাব সিরাজ কুমারহট্টে শেষদিনটি কাটাচ্ছেন যখন সেই নিশুতি রাতে চেয়েছিলেন একবার চোখের দেখা দেখতে সেই পুন্যস্থানটিকে, সেই পুকুরটিকে যার জলে মিশে আছে চৈতন্যের পদধুলি, মিশে আছে ঈশ্বরপুরীর দেহচিহ্ন। হয়তো সিরাজ চেয়েছিলেন ভাদ্রের সেই গ্রীষ্মের রাতে খাজা খিজিগের উদ্দেশে মকরবাহিনীর বুকে ভাসানো চিরাগকে মনের মাধুরীতে এই চৈতন্যডোবায় ভাসিয়ে দিয়ে স্বদেশ রক্ষার সংকল্পে মোনাজাত করতে।
                           

 

গঙ্গার ধারে তাঁবু পড়েছে নবাব শিবিরের। হঠাৎ সিরাজের কানে এল সুমিষ্ট কন্ঠের পাঠ;
ঈশ্বরপুরীর সঙ্গে প্রভুর ভোজন।
ইহার শ্রবণে মিলে কৃষ্ণপ্রেমধন।।
আপন শ্রীহস্তে লেপিলেন দিব্যগন্ধে।
যতপ্রীত ঈশ্বরের ঈশ্বরপুরীতে।।
আপনে ঈশ্বর শ্রীচৈতন্যভগবান।
দেখিলেন ঈশ্বরপুরীর জন্মস্থান।।
প্রভু বোলে কুমারহট্টেরে নমস্কার।
শ্রীঈশ্বরপুরী যে গ্রামে অবতার।।
             

 

শ্রীচৈতন্যভাগবতের পঞ্চদশ অধ্যায়ের এই পাঠ কেমন যেন আনমনা করে দিল তরুণ সিরাজকে। বাংলা জবান যে নবাব খুব ভাল জানেন, এমনটা নয়। আবার একদম জানেন না, বোঝেন না, তাও নয়। অস্থির মন এখন নবাবের। সাহেবদের একদম সাতসমুদ্দুর তেরো নদী পার করে দিতে পারলেই যেন সব থেকে সুখের হত। কিন্তু দিল্লির ক্ষয়িষ্ণু মুঘলেরা নিজেদের বাঁচার তাগিদেই কি তলে তলে চাইছে সাহেবরা বাণিজ্য করুক? বুঝতে পারেন না তরুণ নবাব। বুঝতে চাইবেন, কারও কাছে- ভরসা করে তেমনটাও পারেন না। সাহেবদের ঘিরে দিল্লির বাদশাকে নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধছে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাবের মনে- এই কথা তাহলে হাওয়ার থেকে জোরে ছুটবে। দিল্লির বাদশার কানে যেমন যাবে, তেমনিই পৌঁছে যাবে কলকাতার কেল্লায় ক্লাইভ আর তার দলবলের কাছে। মুর্শিদাবাদে ফতেহ চাঁদদের কাছেও নবাবের জিজ্ঞাসার কথা গোপন থাকবে না। ফতেহ চাঁদ তো এখন নিজেকে জগৎ শেঠ বলেই পরিচয় দেয় দশজনের কাছে। নবাবকেও ঠেকায় বেঠেকায় হাত পাততে হয় ফতেহ চাঁদের কাছে। নিজেকে আবার বর্ধমান মহাবীরের পরম ভক্ত বলে মুখে কাপড়ের ফেট্টি আটকে রাখে জগৎ শেঠ। নবাবের আসরে সুরা স্পর্শ করতে গেলে ফেট্টি খুলতে হবে, হাওয়া গলে হাওয়ায় ভাসা কোনও পোকাও যদি মেরে ফেলে, তার পাপ হবে-- এমনটা বললেও ক্লাইভের মাইফিলে কোনও কিছু খুলতেই কসুর করে না ফতেহ চাঁদ, সেই খবরও নবাবের কাছে আছে। আবার ভেসে আসছে হিন্দুদের পাঁচালীর মতো সেই সুর। এই গভীর রাতে শ্রীচৈতন্যভাগবতের পঞ্চদশ অধ্যায় কেমন যেন আনমনা করে দেয় নবাব সিরাজকে;
প্রভু বোলে ঈশ্বরপুরীর জন্মস্থান।
এ মৃত্তিকা আমার জীবন ধন প্রাণ।।
হেন ঈশ্বরের প্রীতি ঈশ্বরপুরীতে।
ভক্তেরে বাড়াতে প্রভু সেই শক্তি ধরে।।
প্রভু বলে গয়া করিবারে আইলাম।
সার্থক হইল ঈশ্বরপুরী দেখিলাম।।
আর দিনে নিভৃতে ঈশ্বরপুরীর স্থানে।
মন্ত্রদীক্ষা চাহিলেন মধুর বচনে।।
পুরী বোলে মন্ত্র বা বলিয়া কোন কথা।
প্রাণ আমি দিতে পারি তোমারে সর্বথা।।
তবে তান  স্থানে শিক্ষাগুরু নারায়ণ।
করিলেন দশাক্ষর মন্ত্রের গ্রহণ।
তবে প্রভু প্রদকাষিণ করিয়া পুরীতে।
প্রভু বোলে দেহ আমি দিলাম তোমারে।।-
                     

 

বাংলার নবাবের সেই চাঁদনী রাতের আনমনা দৃষ্টিই যেন মোহময়ী করে তুলেছিল তাঁরই দেওয়া নামের, 'হাভেলি সহর' কে। তাকে গাঁ ঘরের মানুষজনেরা 'হালিসহর' করে তোলা -র সময়কালেও সাবর্ণ বংশীয় মহাপন্ডিত ঈশ্বরপুরীর পান্ডিত্যের রেশ ছড়িয়ে ছিল আশেপাশে কাঞ্চনপল্লী থেকে একদম হাজিনগর, নৈহাটি হয়ে ভাটপাড়া, এই তারামনবিবির আজকের আস্তানা মুক্তোপুরের আশুবাবুর লাইনের গা ঘেঁসে জগদ্দল, আতপুরও পেরিয়ে মূলাজোরের ধার দিয়ে কোম্পানীর গোলা বারুদের কারখানা ধরে সোজা চানকের দিকে। সিপাই যুদ্ধ হয়ে গেলেও চানকের  তখনও বারাক ধরে নাম হয়নি। রাণীর মেয়ের মা অন্নপূর্ণার মন্দির কি তখন সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে? এই যে সেই দক্ষিণেশ্বর থেকে এলেন শ্রীরামকৃষ্ণ, অন্নপূর্ণা মন্দিরে যাওয়ার পথেই তো পড়ল বাল্যসখা গয়াবিষ্ণুর দোকানটা।
                    

 

গয়াবিষ্ণু হঠাৎ দেখে একটা ছোট জুড়ি গাড়ি খরখর আওয়াজ তুলে এসে দাঁড়াল তার দোকানের সামনে। ওমা! গয়া তো বিস্ময়ে হতবাক। কে নামছে গাড়ি থেকে?  সেই কামারপুকুরের ছোটবেলার খেলার সাথী গদাই না? মাঝে দেশে গিয়ে গদাইকে নিয়ে দুকথা, চার কথা কানে এসেছিল বুঝি গয়াবিষ্ণুর। গদাইয়ের নাকি মাথার ব্যামো হয়েছে। কেউ বলে ভুতে পেয়েছে। খুড়িমা নাকি চন্ড ও নামিয়েছিলেন ভিনগাঁয়ের ওঝা এনে। তা যাই শুনে থাকুক না কেন গয়া তার সাঙাত গদাইকে ঘিরে, তার কাছে গদাই মানে ভূতির খালের পাড় ধরে দূরে হারিয়ে যাওয়া। মানিক রাজার আম বাগানে খেলতে খেলতে কেমন আনমনা হয়ে পড়ত গদাই, কখনও কখনও ঠিক করে পা ফেলে হাঁটতেই চাইত না। এক জায়গায় ঠাঁই কাড়া হয়ে থাকত। ঠাঁই নাড়া করতে গেলেই যেন ঝড়ো শালপাতার মতো উঠে আসত গদাইয়ের হালকা পাতলা শরীরখানা। আর তখন ওর সোনার বরণ গায়ের রঙ যেন আরও ঠিকরে বের হয়ে আসত।

 


সেই গদাই তো এখন জানবাজারের রাণীর মন্দিরে রাণীর জামাইয়ের বড়ো আদরের 'বাবা' র মতো থাকে। কলকেতার কত মান্নিগন্নি নোকজনেরাও নাকি আমাদের কামারপুকুরের হালপুকুরে ঝাপাই দিয়ে এপার ওপার করা গদাই বলতে অজ্ঞান- মনে মনে ভাবে গয়া। সেই গদাই নিজে এসেছে তার মতো ছেলেবেলার এক অনামী গেঁয়ো মুদির দোকানদারের কাছে? ভাবতেই আন্দাশ্রুতে চোখ ভিজে আসে গয়াবিষ্ণুর। ছেলেবেলার দুষ্টুমিও একটু তার মধ্যে পেয়ে বসে বইকী। গয়া ভাবে, আচ্ছা, এতো মান্নিগুন্নি নোকের সাথে কতা কইতে গেলিই সেই ছেলেবেলার মতো একনো তোতলায়নি কো তো আমাদের গদাই ঠাকুর?( ক্রমশঃ)

  • গৌতম রায়
  • ষষ্ঠ