তাল নিয়ে তালবেতাল

তালের দিন প্রায় যায় যায় করছে। বর্ষা যাব যাব বলেও যাচ্ছে না। আসলে এখন কোনটা বর্ষা, আর কোনটা নিম্নচাপ, সেটা ঠাওর করতে গেলে বেশ বেকায়দায় পড়ে যেতে হয় আর কি। তবুও এ বছর সেই অনেক কাল আগের মত একটা দুটো রাত ঘিরে বৃষ্টি বেশ মন মজিয়ে ছিল। টুপটুপ করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। জানলা দিয়ে তার আওয়াজ আসছে। এমনটা বহুকাল পর এই বছর শুনতে পেলাম।

 

 

তবে আমাদের এই শহুরে ভাললাগা যে জেলার কিছু মানুষের জীবনে কতটা বিপর্যয় নিয়ে এসেছে, তা টেলিভিশন, খবরের কাগজ খুললেই বুঝতে পারা যায়। বন্যায় সাধারণ মানুষের জীবন কিভাবে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তার প্রতিদিনই করুণ চিত্র আমরা দেখছি। আশ্বিন মাস পড়ে গেছে। মানে শরৎ ঋতু এসে গেছে খাতায়-কলমে। কিন্তু খাতায়-কলমে বর্ষায বিদায় নিয়েছে এমনটাও কি আবহাওয়া দপ্তরের মানুষজনেরা বলেছেনমনে হয় না বলেছেন। বলে থাকলেও তাঁদের অনুমানের মধ্যে বোধহয় কোথাও কোথাও ভুল থাকলেও থেকে যেতে পারে।

 

 

কারন, যাই যাই করেও বর্ষা যাচ্ছে না। এই তো কাল রাত্রে প্রবল বৃষ্টির দাপটে চামড়ার চটি হাতে নিয়ে খালি পায়ে জল পেরিয়ে চা খেতে গেলাম। চামড়ার চটি যদি জলে ভিজত, তাহলে সেই আমসত্ত্ব শুকোতে কতদিন লাগত, তা গুনেও বলা যায় না। আর সেই আমসত্ত্ব শুকিয়ে আবার তাকে চটিত্ব প্রদান করবার মতো সূর্যবাবাজি উদয় হতেন কি না, তার হদিস আবহাওয়া দপ্তর ঠিক দিতে পারবে এমনটাও মনে হয় না।

 

           

বলতে বলতেই আবার আকাশে মেঘের ঘনঘটা। যেন রবীন্দ্রনাথের সেই গান; কোন্ ক্ষ্যাপা শ্রাবণ ছুটে এল আশ্বিনের আঙ্গিনায়। আশ্বিনের আঙিনায় ছুটে আসা ক্ষ্যাপা শ্রাবণের দুলিয়ে জটা ঘনঘটা আমাদের উনানে খিচুড়ির হাড়ি বসিয়ে দেয় আর কী! কত রকম ফের আছে খিচুড়ির। বেশ একটু জ্বলজ্বলে খিচুড়ি। হাপুস হুপুস করে খাব। এমন খিচুড়িকে আবার কেউ কেউ বলে থাকেন ছত্তরের খিচুড়ি। আজকের প্রজন্ম অবশ্য ছত্তরের খিচুড়ি বললে ঠিক বুঝে উঠতে পারবে না। আজকের প্রজন্মের মধ্যে কতজন সমরেশ, সুনীল, শক্তি, সিরাজ আছেন কে জানে, যাঁরা হরিহরছত্র থেকে গালুডি হয়ে, মধুপুরের পথে 'জীবন যে রকম' সেটা উপলব্ধি করতে চান!   

               

 

তবে যাঁরা বিভূতিভূষণের লেখার সঙ্গে নিজেদেরকে পরিচিত করে নিয়েছেনতাঁদের কাছে অবশ্য এই ছত্তর শব্দটা খুব একটা অপরিচিত ঠেকবে না। বিভূতিভূষণের অপরাজিত উপন্যাসে কাশীধামের নানা ধরনের সামাজিক বর্ণনার ভেতরে এই ছত্র বা ছত্তর, আর সেখানকার খাওয়া-দাওয়ার অনেকটাই পরিচয় আছে। তাছাড়াও বিভূতিভূষণের বেশ কিছু ছোটগল্প, যেখানে কাশী প্রসঙ্গ কোনও না কোনওভাবে এসেছে, সেখানেও অনেক ক্ষেত্রেই এই ছত্তরের খিচুড়ি প্রসঙ্গটা এসেছে। 

                 

 

এমন ট্যালট্যালে খিচুড়িকে অনেকে অবশ্য বলে থাকে লবসি। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, মীনাক্ষী দত্ত, জয়া মিত্রদের জেল জীবনের যেসব অভিজ্ঞতা বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছে, সেখানে জেলের খাওয়া দাওয়ায় এরকম ট্যাল ট্যালে জলের মতো খিচুড়িকে লবসি বলা হয়। এই লবসি অনেক উদাহরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। সতীনাথের 'জাগরী' -তে আছে। দেখেছেন তো! তাল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে খিচুড়িতে চলে এলাম। মানে বেতাল হলে যা হয় আর কি! তাল নিয়ে গুনকীর্তন করি আর নিন্দে মন্দই করি, আলাপ আলোচনাটা তো তালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত ছিল। তা না ধান ভানতে ভাঙ্গা কুলোর মতন তাল নিয়ে গল্প করতে করতে, এসে হাজির হলুম, মেঘলা আকাশ। আর তার থেকে খিচুড়ি। বর্ষা মানেই খিচুড়ি।

 

 

জামা কাপড় শুকোনোর নানা ধরনের ঝামেলা। প্যাচপ্যাচে কাদা। এসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, শুধু খিচুড়ি খাও। ডিম ভাজা খাও। ইলিশ মাছ খাও (দাম? নজর দিও নিকো!!) আর ঘুমাও। এমন যদি সত্যি হত আমাদের বর্ষার দিনযাপনে! ভালো লাগত? আসলে জীবন যদি কোনওরকম লড়াইয়ের কেন্দ্রিকতার মধ্যে না থাকে, তাহলে সে জীবন কেমন যেন একটা পানসে লাগে না? বৃষ্টির দিনে, একটু রোদ উঠেছে। সারা ঘর মেলে রাখা ভেজা জামাকাপড় দিয়ে আসা হয়েছে ছাদে। রোদের তাপে একটু ভেজা ভাবটা যেই না, সেইসব জামাকাপড়ে কেটে গেছে। এমন সময়, হঠাৎ আকাশ ছেঁপে বৃষ্টি নামল। দৌড়, দৌড়, দৌড়। কে কোথায় রয়েছে, সবাই ছাদে হাজির হল। প্রাণপণে শুকিয়ে ওঠা কাপড়গুলোকে একটু বাঁচাবার চেষ্টা। তার মধ্যে যদি ক্লিপ আঁটা থাকে, তাহলে সে ক্রিপ খুলতে খুলতে গজরগজর করা। ক্লিপগুলোকে ছাদে ছড়িয়ে ফেলে, কাপড়গুলোকে নিয়ে কোনও মতে মাথা বাঁচিয়ে, কাপড় বাঁচিয়ে, নীচে নেমে আসা। এই দৃশ্য এই যাপন আমাদের বাঙালি জীবন থেকে প্রায় হারিয়ে গেছে। কারন, এখন বাড়ি বলতে গেলে হাতে গোনা। আর বাড়িতে মানুষজনও হাতে গোনা। 

 

 

তাই বর্ষা এলে ডাই ডাই ভিজে কাপড় নিয়ে তাল বেতাল হওয়া, এসবও হারিয়ে গেছে বাঙালির জীবন থেকে। এখন তো ওয়াশিং মেশিনে অর্ধেক শুকিয়ে যায় কাপড়চোপড়। জল ঝরে যায়।তারপর ছোট্ট জায়গায় সেসব অল্প সল্প কাপড়-চোপড় মেলে দেওয়ার জন্য কত রকম নতুন ভাবনাচিন্তা মাথায় খেলানো শুকোতে দেওয়ার জায়গা। সামান্য একটুখানি জায়গায় কত বেশি কাপড় শুকাতে পারা যায়, তার জন্য জিনিসপত্র আবিষ্কারেকোম্পানিতে কোম্পানিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ইঞ্জিনিয়ার-ইঞ্জিনিয়ারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা।

 

 

আর সেসব পরখ করে আমাদের ছোট্ট ফ্ল্যাটে ঢুকছে অমনতরো জিনিস। বর্ষা চলে গেলে আবার সেসব ছোট্ট করে গুটিয়ে আমরা কোনও একটা চোর কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখতে পারছি। আ মলো যা, চোর কুঠুরি আবার ফ্ল্যাটে কোথায়? চোর কুঠুরি কনসেপ্টটা তো আজকের ফ্ল্যাটের মানুষজন প্রায় জানেই না।

 

 

কাপড় শুকাতে দেওয়ার ক্লিপ এখন তো সবই প্লাস্টিকের। একটা সময় এই কাপড় শুকাতে দেওয়ার ক্লিপ ছিল কাঠের। ব্যবহার করতে করতে পটপট করে ভেঙে যেত। ক্লিপের মাঝে একটা ভারী সুন্দর লোহার আংটা থাকত, যা কাঠের দুটো পার্টকে ধরে রাখত। ক্লিপ ভেঙে গেলে সেগুলো হয়ে উঠতো ছোটদের খেলার সামগ্রী। ছোটরা কত ইঞ্জিনিয়ারিং চালানোর চেষ্টা করত সেই ভাঙ্গা ক্লিপ জোর লাগাবার তাগিদে। হয়ত ভাঙ্গা মন জোড়ার পারিপার্শ্বিকতা তখন থেকেই তাদের মধ্যে ভিড় করতে শুরু করেছিল। তারপরে এল টিনের ক্লিপ। সেগুলো অত সহজে ভাঙত না। তবে তুবড়ে যেত। কিন্তু ভাঙত না। এই যে প্রযুক্তির অদলবদল ঘটতে থাকল সেই ছয়, সাতের দশকে, সেসব কথার জাবর কাটলে আজকে হয়ত অনেকেই তাল বেতালের জবরজং শিরোপা দিয়ে আমাকে তনখাইয়া করে দিতে পারে।

 

 

তনখাইয়া শব্দটা ঘিরে হয়ত সাধারণ বাঙালি পাঠকের কাছে একটু অচেনা শব্দ বলে মনে হবে। আসলে আমরা যারা প্রায় বুড়োর দলে নাম লিখেছিআমাদের কাছে আটের দশকে প্রথম দিক, যখন অগ্নিগর্ভ পাঞ্জাব। অপারেশন ব্লুস্টার হল এবং সেই সময় দেশের রাষ্ট্রপতি পদে আসীন জ্ঞানী জৈল সিং। তখন এই তঙখাইয়া নামক গুরুমুখী শব্দটি খুব খবরের কাগজে আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছিল। তখন তো খবরের কাগজ আর রেডিওই একমাত্র গণমাধ্যম। কিছু বাড়িতে টেলিভিশন ঢুকেছে। তবে সেটা বেশিরভাগই উচ্চবিত্ত ধ্বনির ঘরে। আমজনতার ঘরে তখনও টেলিভিশন প্রবেশ করেনি।

 

 

তখন অপারেশন ব্লুস্টার পরবর্তী কর্মকাণ্ড, সেই সবের বিষয় নিয়ে আলোচনায় এই গুরুমুখী শব্দটি বারবার উঠে আসত। সংবাদমাধ্যমে তখনকার দিনে রেওয়াজ ছিল, বাংলায় যদি অচেনা অজানা কোনও প্রতিবেশী ভাষার ব্যবহার করা হয়, তাহলে বন্ধনীর মধ্যে তার অর্থটা দিয়ে দেওয়া হত। তাই আমরা জানতে পারলাম, সেই বন্ধনীভুক্ত শব্দের ভেতর দিয়ে এই তনখাইয়া মানে হচ্ছে ধর্মচ্যুত বা সমাজচ্যুত। আর এই সমাজচ্যুত থেকে আবার সমাজভুক্ত হতে গেলে স্বর্ণমন্দিরে দাঁড়িয়ে ভক্তদের পা ধুয়ে দিয়ে আবার তাঁকে সমাজভুক্ত হতে হত। পাঞ্জাবের স্বর্ণমন্দিরে অপারেশন ব্লুস্টারের পর যখন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জৈল সিংকে তংখাইয়া ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন এভাবে তিনি ধর্মীয় নির্দেশ মেনে আবার সমাজভুক্ত হন। সেই থেকে এই তনখাইয়া শব্দটির বাংলা ভাষায় ব্যবহারের ক্ষেত্রে খুব জলচল হয়ে গেল। এখন অবশ্য সময় বদলে গেছে। আর এই বদলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে- এই ধারাও ক্রমশ শুকিয়ে এসেছে। তাই আজকের সাধারণ মানুষ এই শব্দটার সঙ্গে তেমন একটা আর পরিচিত নয়।

  • শ্যামলী ভট্টাচার্য