অস্তিত্বের সঙ্কট: সঙ্কটের অস্তিত্ব

নিজের ভিতরে নিজেকে খুঁজতে খুঁজতে খুঁজে না পাওয়ার যন্ত্রণার ভিতর দিয়েই পরিস্ফুট হতে থাকে অস্তিত্বের সঙ্কটের গ্রন্থিমোচন। যুগ থেকে যুগান্তরের যাত্রাপথে এই সঙ্কট দেশ - কাল- সমাজ- সময় আর মানুষকে ছুঁয়ে যায়। মানুষ তাঁর অস্তিত্বের আরোহিনীতে সুরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি রণিত অনুরণিত করতে করতেই অনুভব করে এই অস্তিত্বের সঙ্কটের দ্যোতনা। মানুষ সেই সঙ্কট থেকে উত্তরিত হতে চায়।সময় চায় অস্তিত্বের সঙ্কটকে অতিক্রম করতে। দেশ চায় অস্তিত্বের সঙ্কটকে জয় করে নিজের অস্তিত্বকে আরও বেশি করে দেশ, কাল, সময়, সংস্কৃতির কাছে জানান দিতে।সঙ্কটকে অতিক্রম করার মামুলি পন্থার ভিতর দিয়েই মানুষ চায় নিজের অস্তিত্বের সূক্ষ্ম তন্তুগুলিকে একটা সুনির্দিষ্ট পথের দিকে পরিচালিত করতে। যে পরিচালনার ভিতর দিয়ে মানুষ নিজেকে জানতে চায়। নিজেকে বুঝতে চায়। নিজেকে হারিয়েও আবার খুঁজে পেতে চায় চিরন্তনভাবে। নিজেকে খুঁজে পাওয়ার চিরন্তন ইচ্ছের ভিতরেই জেগে থাকে কাল সমুদ্রের বুকে আলোর যাত্রার ধ্বনি প্রতিধ্বনি।

 


এক একটা সময় আসে যখন নিজের অস্তিত্ব সময়ের বুকে কেমন যেন এক প্রশ্ন চিহ্ন নিয়ে এসে হাজির হয়। আমি কে? এই প্রশ্নটিও অতিক্রান্ত হয়ে যায় কালের নিপুণ কারিগরের হাতে। কে আমি আর আমি কে -এই অস্তিত্বের দোলাচাল আমাদের মনে জাগায় একটা আলোড়ন। শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ র চেতনা যেন আমাদের স্থিত থেকে অস্তিত্বেল ভাবনাকে বার বার একটা যতি চিহ্নের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয়। বঙ্কিমের সেই চিরন্তন প্রশ্ন, "পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছো?" আমাদের টলায়মান সময় সংস্কৃতিকে এক অজানা পথ থেকে জানা পথের দিকে ঠেলে দেয়। বন্ধনহীন গ্রন্থির মতোই আমরা সবাই চলতি হাওয়ার পন্থি হয়ে উঠতে চাই আমাদের অস্তিত্বের সঙ্কটের দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার পথ থেকে সহজে উত্তরিত হওয়ার তাগিদে। সেই তাগিদ যেন আমাদের ভাবায়, "হেথা নয়, হেথা নয়। অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে" তে। অন্যত্র -র প্রবল বাসনা মানুষকে তার ক্ষুদ্রতর পরিসর থেকে বৃহত্তর পরিবেশের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। সেই অন্যত্র -র তাগিদ আবার মানুষকে একমাত্রিক চেতনা থেকে বহু মাত্রিক চেতনার স্তরে উত্তরীত হতেও অনেকখানি সাহায্য করে। মানুষ ভাবে তার অন্তরের তাগিদকে। সেই অন্তরের তাগিদকে নিজের ভাবনা দিয়েই সে কালোত্তরণের পথে অতিবাহিত করতে সচেষ্ট হয়। নিজের অস্তিত্বের সঙ্কটকে সময়ের নিরিখে ডালপালা বিস্তারের ভিতর দিয়ে কালের অস্তিত্বের সঙ্কটে রূপান্তরই যেন মানব জীবনের কাল সমুদ্রে আলোর যাত্রা। সেই আলোর যাত্রাই মানুষকে যাত্রী করে সময়ের পাখনার উপর ভর করে। এই যাত্রীকে কেউ রুখতে পারে না। এই যাত্রীকে কেউ বাঁধতে পারে না। অস্তিত্বে মানুষের যতোই সঙ্কট আসুক না কেন, যতোই দুর্যোগের ঘনঘটা ঘনাক না কেন, মানুষ সেই সঙ্কটকে জয় করবার বীজমন্ত্র যেন বুকে ধারণ করে। সেই বীজমন্ত্রকে ধারণ করেই সে যেন বলতে চায়; "যাত্রী আমি, ওরে পারবে না কেউ রাখতে ধরে।" 
   

                    

সময়ের গতিবেগে ভর করে এই যাত্রাই মানুষকে তার অস্তিত্বের আবরণে একটা আবেশ জাগায়। মানুষ কল্পলোকের বাসিন্দা নয়। মানুষ তার জীবন সঙ্কটকে সমাজ - সময়- কাল বহির্ভূত কোনও সঙ্কট বলে মনে করে না। এটা মনে করে না বলেই সে শত সঙ্কটে নিজের অস্তিত্ব হারায় না।দুর্যোগ আসে। দুর্দিন আসে। ভয়ঙ্করের ঘনঘটা চারপাশ অন্ধকার করে দেয়। তবু সেই সঙ্কট সে তার ইপন ব্যক্তিত্ব, সততা, অধ্যাবসায়, চারিত্রিক মাধুর্য দিয়েই অতিক্রম করে।মানুষের নিজের জীবনের অস্তিত্বের সঙ্কট অনেক ক্ষেত্রেই জাতীয় জীবনের অস্তিত্বের ঘনায়মান সঙ্কটের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা পড়ে যায়। সেই সঙ্কটের মেলবন্ধন মানুষকে সাময়িক বিপত্তির দিকে ঠেলে দিলেও ক্রমে তা উত্তরণের নিজের পথ নিজেই তৈরি করে নেয় সময়ের নৌকাতে পাল তুলে। "সময়" তার নৌকাতে পাল তুলে দেয় সময়ের রথচক্রে কালযাপনের তিয়াশায়। সময়ই এগিয়ে নিয়ে চলে আমাদের অস্তিত্বকে। সেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভিতর দিয়েই ঘটে উত্তরণ ঘটে সঙ্কটের ঘূর্ণাবর্ত, ঘটে সময়ের মেলবন্ধন। ইচ্ছে নদীর ডানায় ভর দেওয়া এই "সময়" নামক জাদুদন্ডই যেন আমাদের স্থিতাবস্থার অস্তিত্বের প্রমাণ। আবার আমাদের অস্থিতাবস্থার অস্তিত্বের সঙ্কটের একটা যতি চিহ্ন।
                        


সাম্প্রতিক অতীতে বাঙালি জীবনের সব থেকে বড়ো অস্তিত্বের সঙ্কট ধ্বনিত হয়েছিল দেশভাগের সময়ে। দেশভাগ আমাদের বাঙালি জনজীবনের অস্তিত্বকেই একটা বড়ো প্রশ্ন চিহ্নের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। সেই প্রশ্নচিহ্নের উত্তর বুঝি বা বাঙালি সমাজ দেশভাগের একাত্তর বছর পরে ও ঠিক মতো পায়নি। সামাজিক অস্তিত্বের সঙ্কট কীভাবে জীবন - জীবিকার অস্তিত্বের সঙ্কটের বেড়াজালের ভিতর দিয়ে সমাজদেহেই দূরারোগ্য কর্কট রোগের মতো বাসা বাঁধে - এই দেশভাগ যেন চোখে আঙুল দিয়ে তা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে। "ঘর ভাঙে, দেশ ভাঙে, ভাঙো ভাঙো বিশ্ব।মানুষের অন্তরে মানুষটা নিঃস্ব।" মানুষের অন্তরের এই দৈন্য দেশভাগের ভিতর দিয়ে যেভাবে বাঙালি জীবনে অস্তিত্বের সঙ্কট ডেকে এনেছিল, এমনটা আমাদের দেশ ভারতবর্ষের অন্য কোনও অঙ্গরাজ্যের মানুষের জীবনে ঘটেনি। দেশভাগজনিত অস্তিত্বের সঙ্কটের যে যবনিকা বাঙালি জনজীবনের উপরে গত শতাব্দীর চারের দশক থেকে চেপে বসেছিল- সেই কালচক্র আমাদের আজও এক কালান্তক নাটকের পানেই যেন নিরন্তর টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কালের রথচক্রের সেই ঘূর্ণায়মান চাকার হাত থেকে আজও আমরা নিস্তার পাচ্ছি না। আমাদের অস্তিত্বের সঙ্কট মুহূর্তের ধ্বনি প্রতিধ্বনিকে যেন সব সময় এক অন্তহীন জাগরের পানে আজও টেনে নিয়ে চলেছে এই দেশভাগ। দেশভাগই আমাদের অস্তিত্বের সঙ্কটকে এতোখানি প্রলম্বিত করেছে যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিয়োগান্তক নাটক অভিনীত হওয়ার এই এতোকাল পরেও বিষে আমরা নীল হয়ে রয়েছি। দেশভাগের সময়কালের সাম্প্রদায়িকতার আগুনই আজ আমাদের অস্তিত্বের আরোহিনীতে নতুন করে এক ক্রান্তিকাল ডেকে আনছে। সেই ক্রান্তিলগ্ন থেকে উত্তরণের পথ আমরা হাতড়ে মরছি। যথাযথ উত্তরণের পথ কিন্তু আমাদের সামনে কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না। উত্তরণের পথ ধরা দিচ্ছে না? নাকি পথের দহে আমরা কেবলই বেপথ হয়ে যাচ্ছি? সেই বেপথ হওয়ার ভ্রান্তিতেই আমরা আরও বেশি করে অস্তিত্বের সঙ্কটের ঘূর্ণায়মান আবর্তে কেবলই ঘুরে মরছি। "এমনি করে ঘুরিব দূরে বাহিরে,/ আর তো গতি নাহিরে মোর নাহি রে।।/ যে পথে তব রথের রেখা ধরিয়া/আপনা হতে কুসুম উঠে ভরিয়া,/ চন্দ্র ছুটে, সূর্য ছুটে , সে পথতলে পড়িব লুটে--/ সবার পানে রহিব শুধু চাহি রে।।/ তোমার ছায়া পড়ে যে সরোবরে গো/ কমল সেথা ধরে না, নাহি ধরে গো।/ জলের ঢেউ তরল তানে সে ছায়া লয়ে মাতিল গানে,/ ঘিরিয়া তারে ফিরিব তরী বাহি রে।/ যে বাঁশিখানি বাজিছে তব ভবনে / সহসা তাহা শুনিব মধু পবনে।/ তাকায়ে রব দ্বারের নানে, সে তানখানি লইয়া কানে/ বাজায়ে বীণা বেড়াব খান গাহি রে।" 

 


আজ থেকে একশো বছরেরও বেশি সময় আগে, ১৯১২  সালে রবীন্দ্রনাথ রচিত এই মন্ত্রখানি যেন আমাদের অস্তিত্বের সঙ্কটে একখন্ড হীরকদ্যুতি। মানবজীবনকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সৃষ্টিতে "বাঁশি" র সঙ্গে অনেক জায়গাতেই তুলনা করেছেন। সেই বাঁশির সুরের মোহনধ্বনির সঙ্গেই আমাদের অস্তিত্ব যেন খুঁজে পায় তার সঙ্কটের আবর্ত থেকে উত্তরণের এক দিগন্ত প্রসারী পথনির্দেশিকা। দেশভাগ ভারতবাসীর জীবনে যে অস্তিত্বের সঙ্কট ডেকে এনেছিল তা থেকে উত্তরণের চেষ্টা মানুষ আজও করে যাচ্ছে। চেষ্টায় আন্তরিকতা থাকলেও সময়ের নৌকায় পাল তুলে আজও দেশবাসী সেই সঙ্কট থেকে পরিপূর্ণ উত্তরীত হতে পারেনি।অর্থনৈতিক সঙ্কটকে হয়তো সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষ একটা নিজস্ব আঙ্গিক দিতে পেরেছে। যে আঙ্গিকের উপর ভরসা রেখে দেশভাগ আমাদের বেঁচে থাকার তাগিদকেই যে চ্যালেঞ্জের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছিল, সেই চ্যালেঞ্জকে হয়তো আমরা এখন অনেকখানিই জয় করে নিতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের সক্ষমতার ভিত্তি ও সময়ের হাপড়ের টানে এখন অনেকটাই শক্তপোক্ত বনিয়াদের উপরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। বনিয়াদকে শক্তপোক্ত করবার জন্যে সময় হল একটা দারুণ রকমের বিশল্যকরণী।আমরা সেই বিশল্যকরণীর মৌতাত অন্তরে ধারণ করে অস্তিত্বের সঙ্কটকে অতিক্রম করতে দৃঢ় সংকল্প।

 


সেই সংকল্পে কি স্থিত হতে চায় মন? মনের সেই সুলুক সন্ধান জানেই বা কে? মনের উপর তো কোনও উপলখন্ড বাসা বাঁধেনি। উপলের, অর্থাৎ; শ্যাওলা যদি বাসা বাঁধতই মনের উপরে তাহলে তার পিছলে পড়া চরিত্রের দৌলতে জীবন কি পিছলে যেতে পারত? জীবন পিছলে গেলে শ্যাওলার ওই মনোহরণ, হালকা সবুজ রঙের ভেলভেটের মত রূপটা কি শেষ পর্যন্ত বেঁচে বর্তে থাকত? 

 


পাঠক লক্ষ্য করবেন, এখানে কিন্তু একটিবারের জন্যেও শ্যাওলার সবুজ রঙের টিকে থাকাটাকে বোঝাতে ব্যবহার করা হয়নি, অক্ষুন্ন রাখা শব্দটা। কেন হয়নি? অমন শব্দ ব্যবহার করলে কি গুরুচন্ডালী দোষ হত? সুনীতিকুমার থেকে এ যুগের বরেন্দু মন্ডল খুব রেগে যেতেন? আসলে গোঁড়া হিন্দু হলেও সুনীতিকুমারের মধ্যে একটু ব্রাহ্ম সমাজী পিউরিটান ধারা ছিল। ও হোঃ। এই যে ব্রাহ্ম সমাজীদের সঙ্গে 'পিউরিটান' শব্দের সংযোগ ঘটানো, সেটা কিন্তু এই শম্মার কীর্তি নয়। এই শম্মার কীর্তি না হলে, এটা কার কাজ? তাহলে অবলীলায় বলেই দেওয়া ভাল, এমনতরো কথা বলতে মুখের লাগাম ছিল না আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের।

  • গৌতম রায়