রুমিনার গল্প লেখা

আজ সকাল থেকেই সারাদিন বৃষ্টি। কখনও ঝমঝম কখনও টিপ টিপ। একভাবে রুমিনা কাগজ আর কলম নিয়ে জানালার পাশে বসে আছে একটা ছোট গল্প লিখবার জন্য। সকাল থেকেই সারাদিন ভেবে যাচ্ছে লেখা আসছে না মাথায়। এদিকে সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত্রি নামে।              

         

 

মা মীনা দেবী বলে ওঠেন, রুমিনা খাবি আয় রাত্রি কটা হলো খেয়াল আছে? সেই সকাল থেকে ভালো করে খাওয়া নেই, নাওয়া নেই, কী গল্প লিখবার চক্করে পড়ে আছিস! তাড়াতাড়ি আয় বলছি। ধমকের সুরে এক নিঃশ্বাসে মা মীনা দেবী বলে ওঠেন। সংসার বলতে মা আর মেয়ে। বাবা অনিল চ্যাটার্জি মারা গিয়েছেন। রুমিনার যখন তিন বছর বয়স। মা মীনা দেবীই রুমিনার মা আর বাবা। অনেক কষ্টে মা রুমিনাকে বড় করেছে পড়াশোনা করিয়েছে কোনওরকমে সেলাইয়ের কাজ করে। সেলাই মেশিনটা রুমিনার বাবা অনিলবাবু মীনা দেবীকে কিনে দিয়েছিলেন। আজ রুমিনার উনিশ বছর হল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স নিয়ে মহসিন কলেজে পড়াশোনা করে এবং টুকটাক কবিতা গল্প লেখে।

 

 

রুমিনা বলে ওঠে, হ্যাঁ মা দাঁড়াও, এই তো হয়ে গিয়েছে লেখাটা লিখেই আসছি। হঠাৎ বাইরে একটা বিকট আওয়াজ, রুমিনা জানলার বাইরে তাকিয়েই আঁতকে ওঠে, চিৎকার করে বলে ওঠে মা মা মা, তাড়াতাড়ি এসো দেখো সীতারামদাকে, ওরা মেরে ফেলছে। মা ছুটে এসে একপ্রকার টানতে টানতে রুমিনাকে শোওয়ার ঘরে নিয়ে যান। রুমিনা আবার বলে ওঠে, মা ওরা সীতারামদাকে মেরে ফেলবে তো? ফেলুক গে, তুমি শুতে চলো।

 

 

মা মেয়ের খাওয়া-দাওয়া মাথায় ওঠে। বাইরে তখনও ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি। সারাটা রাত রুমিনা বিছানার এপাশওপাশ করতে থাকে। কিছুতেই দুচোখের পাতা এক করতে পারে না। সীতারামের করুণ মুখটা রুমিনার মনে পড়ে। বাঁচবার কী করুন আর্তি। সীতারাম রুমিনাদের হুগলির বাঁশবেড়িয়া ছোট্ট মফস্বলের প্রতিবাদী যুবক। রুমিনা তখন অনেকটা ছোট, মনে পড়ে যাচ্ছে সেই দিনের কথা। যেদিন তাদের প্রতিবেশী কবি লেখক পিনাকী ঠাকুর আদিসপ্তগ্রাম স্টেশনে আটকে গিয়েছিল। লোকাল কয়েকজন দুষ্কৃতী পিনাকি ঠাকুরকে আটকে রেখেছিল সর্বস্ব লুট করে নেওয়ার জন্য। সীতারাম খবর পাওয়ামাত্রই সদলবলে ছুটে গিয়েছিল সেদিন আর সম্পূর্ণ নিরাপদে পিনাকি ঠাকুরকে পৌঁছে দিয়েছিল তাঁর বাড়ি। বাঁশবেড়িয়া একটা সময় গমগম করত। তখন শহর বলা যেতে পারত। একদিকে ডানলপ কারখানা। একদিকে কেশোরাম স্পানপাইপ কারখানা অন্যদিকে গ্লাস ফ্যাক্টরি পেপারমিলের মতো শিল্পাঞ্চল। এসব রুমিনার জন্মের আগেই মৃত হয়ে যায়। এখন বাঁশবেড়িয়া অন্ধ। চারিদিকে চুরি জোচ্চুরি। আর কীই বা করবে? পেট যে বড় বালাই। দুমুঠো খাবারের জন্য মানুষের কত কষ্ট। এই মফস্বল ভেঙে ভেঙে পিনাকী ঠাকুর কলকাতায় যেতেন। আগে পিনাকী ঠাকুর 'দেশ' পত্রিকায় চাকরি করতেন। তারপর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'কৃত্তিবাস' পত্রিকায়। বাড়ি ফিরতে ফিরতে কখনও লাস্ট মোকামা এক্সপ্রেস হয়ে যায়। এসব কথা রুমিনা তাঁর মায়ের থেকে শুনেছে। ধীরে ধীরে রুমিনাও টুকটাক লেখালেখি করতে থাকে এবং পিনাকী ঠাকুরের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেলে। আর পিনাকী ঠাকুর কেন জানি না রুমিনাকে ভীষণ স্নেহ করতে আরম্ভ করেন। সব কিছু মনে পড়ছে আজ রুমিনার। পিনাকী ঠাকুর যেদিন মারা গেলেন সে কি কান্না রুমিনার। পড়াশোনা, নাওয়া-খাওয়া সমস্তই প্রায় বন্ধ হতে বসেছিল মাসখানেক। ধীরে ধীরে নিজেকে শক্ত করে তোলে। 

       

 

আজ নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না রুমিনা। সকাল হতে না হতেই মাকে কিছু না বলেই রুমিনা বেরিয়ে পড়ে। গতরাত্রে ঠিক যেখানে ঘটনাটা ঘটেছিল সেখানে প্রথমে যায়। গিয়ে দেখে সব পরিষ্কার কিচ্ছু নেই। নিজেকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় রুমিনার। তবে কী স্বপ্ন দেখল রুমিনা? নিজেকে প্রশ্ন করে। দূরে তখন খগেন দাস চায়ের দোকান খুলছে। গুটিগুটি পায়ে রুমিনা খগেন দাসের চায়ের দোকানে গিয়ে বলে, বলছি কাকু কাল রাতে কী হয়েছিল তুমি কিছু জানো? খগেন দাস ধমকের সুরে রুমিনাকে বলে, হ্যাঁ সে তো সারা পাড়া জানে। কিন্তু তুই এত ভোরবেলা কী করছিস? রুমিনা বলে, আমি দেখেছি কাকু। এইবার খগেন দাস বেশ রেগে ওঠে। চিৎকার করে বলে ওঠে, না রুমি একদম না। যা তুই বাড়ি যা, তোর মা কোথায়? রুমিনা আর একটা কথাও না বলে ছুটতে থাকে। খগেন দাস রুমিনাদের দুতিনটে বাড়ির পরেই থাকেন। রুমিনাদের বাড়ির সঙ্গে খগেনবাবুর পরিবারের ভীষণ ভাল হৃদ্যতা এবং খগেনবাবু ছোট থেকেই রুমিনাকে যথেষ্ট চোখে চোখে রাখেন। খগেনবাবুর কথা কোনদিনও রুমিনা অমান্য করেনি কিন্তু আজ কোনও বাধাই রুমিনাকে আটকাতে পারল না। ছুটতে ছুটতে সোজা কলবাজার ফাঁড়িতে। বাঁশবেড়িয়ার একমাত্র ফাঁড়ি। আর থানা বলতে মগরা থানা।

স্যার, ভেতরে আসতে পারি?

ভারী গলার আওয়াজ, হ্যাঁ কে?

আমি স্যার।

আরে বাবা আমিটা কে? আর এত সকালেই বা কেন? ইন্সপেক্টর চিৎকার করে বলে ওঠেন।

রুমিনা আস্তে আস্তে জবাব দেয়, বলছিলাম স্যার সীতারামদাকে ওরা মেরে ফেলেছে। 

হ্যাঁ, তো? ইন্সপেক্টর সঙ্গে সঙ্গেই বলে ওঠেন। আবার ইন্সপেক্টর বলেন, আপনি তখন অত রাত্রে কী করছিলেন?

রুমিনা বলে, স্যার গল্প লিখছিলাম।

             

কী? গল্প লিখছিলেন? হা হা করে ইন্সপেক্টর হেসে ওঠেন। রুমিনা বলে, হ্যাঁ স্যার লিখছিলাম না, মানে ভাবছিলাম। 

ওঃ ভাবছিলেন! হাঁ করে ইন্সপেক্টর তাকিয়ে থাকেন রুমিনার দিকে।

           

এবার বেশ ঝাঁঝালোভাবে ইন্সপেক্টর বলে ওঠেন, এখানে কী মশকরা করতে এসেছেন? যান বেরিয়ে যান, বাড়ি চলে যান। এক প্রকার ব্যাঙ্গাত্মক কন্ঠে ইন্সপেক্টর বলে ওঠে। একদম দুমড়ে মুচরে রুমিনা ছোট হয়ে যায়। কী করবে? কী করা উচিত তাঁর কিছুই ভাবতে পারে না সে। চোখ মুছতে মুছতে ধীর পায়ে রুমিনা থানা ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসে। সূর্য তখন ধীরে ধীরে পূবের আকাশ ছেড়ে উঠে আসছে। নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না রুমিনা। অদ্ভুত একটা পাপবোধ ওর মধ্যে জেগে ওঠে। কিছুই হল না এ জীবনে। না হল গল্প লেখা, আর না হল সীতারামদাকে বাঁচানো। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে পড়ে রুমিনা। যেন সেই জলে আ-সমুদ্র হিমাচল থেকে সম্পূর্ণ পৃথিবী কেঁদে ওঠে।

             

 

ততক্ষণে মা খগেনবাবু সবাই সেখানে চলে এসেছেন। মা ছুটে গিয়ে রুমিনাকে জড়িয়ে ধরেন। আর রুমিনা ছাড়া মা মীনা দেবীর আর যে কিছুই নেই যা তিনি আঁকড়ে ধরে পরবর্তী জীবনটা পার করে দিতে পারবেন। খগেনবাবুদের পরিবারও প্রত্যেকেই ছুটে এসেছেন। খগেনবাবুর মায়াময় দুটি চোখ স্হির দাঁড়িয়ে আছে। ওই চোখ দেখলেই বোঝা যায় কী গভীর মায়া-মমতা জড়িয়ে আছে। আসলে এটাই হয়তো হয়। মানুষের জীবনে একজন অন্যজনের পরিপূরক। অনেকটা লতানো গাছের মতন। বিশেষ করে গরিব বা মধ্যবিত্ত মানুষদের মধ্যে পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করার প্রবল উদ্যম থাকে। একটু শহরের দিকে গেলে হয়তো এ সমস্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাজ নিয়ে ছুটে চলেছে। কিন্তু রুমিনাদের বাঁশবেড়িয়া শহরটা একটু অন্যরকম। যা রুমিনাকে ভাল মানসিকতা পেতে সাহায্য করেছে। খগেন বাবুরা নিঃসন্তান। চায়ের দোকান চালিয়ে মোটামুটি তাঁদের দুজনের চলে যায়। খগেনবাবুর স্ত্রী তাঁর তো সাত চরে রা নেই। রুমিনাকে পাড়াপড়শীর সাহায্যে ঘরে আনা হয়। সন্ধ্যেবেলায় পাড়ার নেতা মাখনবাবু রুমিনাদের বাড়িতে আসেন। এই লোকটাকে মোটেই মীনাদেবী সহ্য করতে পারেন না। কিন্তু এখন অসহায় মীনাদেবী মেয়েকে আগলে রাখতে চাইছেন। মাখনবাবু এসে পাড়া পড়শির সঙ্গে কথা বলে তারপর রুমিনার মাকে বলে, আর কোনও ভয় নেই বৌদি, এ যাত্রায় বেঁচে গেলেন। ভাগ্যিস আমি সমস্ত কিছু শুনলাম। ফ্যাল ফ্যাল করে মীনা দেবী আর রুমিনা মাখনবাবুর দিকে চেয়ে থাকেন। নিঃশব্দ চাহনি। এক পৃথিবী পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে পারে এই চাহনিতে। কত যে আগুন আছে তা হয়তো মাখনবাবু বুঝতে পারলেন না। হয়তবা পারবেন কোনও একদিন যেদিন পতনের নিম্ন শিখায় পুড়তে থাকবে ক্ষমতা।

  • সংবেদন চক্রবর্তী