জোছনা হাঁটিয়া মিলায়ে যায়

গাল পেতে থাকা এক গুলতানি। অনিঃশেষ এক কথন। এ বকবকানির যেন শেষ নেই। পথ চলতে চলতে, পথ চলতি কথা-

 

 

বছর চারেক পরে গ্লাসগো থেকে কলকাতা এসে পাড়াসংলগ্ন রাজপথের ফুটপাথের দিকে চেয়ে আমার পরিচিত অধ্যাপক যে গানটি গেয়ে উঠেছিলেন তা হল, ‘কোথা যে উধাও হল। কুড়ি সেকেন্ড গাওয়ার পরে পকেট থেকে রুমাল বের করলেন। চোখ মুছলেন। টি-শার্টে লেখা ছিল, ‘আমার প্রাণের শহর কলকাতা। আমি শুধোলাম, “কিছু খোয়া গিয়েছে নাকি? পার্স-টার্স কিন্তু খুব সাবধানে। দিনকাল যা পড়েছে!উনি তীব্র ঘাড় নাড়ালেন। বললেন, “খোয়া গিয়েছে তো। একেবারে উধাও হয়েছে। আমার ফুটপাথ। এ যে দৃশ্য দেখি অন্য। এত হকার। লোকে হাঁটবে কিভাবে?” ভদ্রলোক খুব আবেগপ্রবণ। পিন আটকে যাওয়া গ্রামোফোন রেকর্ডের চাকতির মতো ক্রমাগত আউড়ে যাচ্ছিলেন, “নিল ছিনিয়ে নিল ছিনিয়ে নিল ছিনিয়ে...।

 

 

হকার উচ্ছেদ এবং তা জবরদখল, ফের উচ্ছেদ এবং আবার দখলদারি নিয়ে ফেসবুকে একটি মিম দেখেছিলাম কয়েক মাস আগে। ছবিটির ক্যাপশন ছিল, ‘কবে আছি, কবে নেই। ইতি, তোমার ফুটপাথ।নিচে লেখা বহু কমেন্টের মধ্যে একটির স্মৃতি এখনও উজ্জ্বল। একজন লিখেছিলেন, ‘না না কিচ্ছু চাই না আমি, আজীবন হেঁটে চলা ছাড়া। তবে প্রশ্ন হল, হাঁটব কোথায়?’

 

 

কয়েকটি সূচক কিংবা ইনডেক্সের কথা আমরা জানি। জগৎসভায় আমাদের অবস্থানের কথাও অজানা নয়। ১২৫টি দেশ নিয়ে করা খিদের সূচকে ভারতবর্ষের স্থান ১১১। একেবারে শেষের বেঞ্চে বসে আমরা বিকাশের গান, বিকশিত হওয়ার গান গাই। পেট না ভরলে মনে সুখ থাকে না। বিশ্ব সুখ সূচক অর্থাৎ ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইনডেক্সে তাই কি আমাদের স্থান ১৪৩টি দেশের মধ্যে ১২৬এ কারণেই কি ১২৫টি দেশ আমাদের থেকে বেশি সুখী? জানা নেই। প্রবাসী অধ্যাপক বলছিলেন, “পরিশ্রম করার জন্য, পেট ভরানোর জন্য, সুখ আহরণের জন্য তো কাজের সন্ধানে যেতে হয়। হাঁটতে হয়। আমার এ দেশ যে লোকজনদের নিশ্চিন্তে হাঁটতেও দেবে না। ওয়াকাবিলিটি ইনডেক্স তো সেকথাই চোখে আঙুল দিয়ে বলে। আমরা সেখানেও ফেলটুস।হাঁটারও সূচক আছে তাহলে! বিপুলা এ ধরণীর কতটুকু জানি! ভ্রমি বিস্ময়ে। এর সংজ্ঞা বলে, কোনও জায়গা হাঁটার জন্য কতটা উপযুক্ত, সেটারই মান নির্ণয় করে ওয়াকাবিলিটি ইনডেক্স। সাধু বাংলায় কী বলা যেতে পারে একে? হন্টনক্ষমতা সূচক? তাই বলি, ভয়ে ভয়ে। ভাষাবিদরা মার্জনা করবেন। কিছু বইপত্র এবং ওয়েবসাইট ঘেঁটে জানা গেল, হাঁটা সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে এই সূচক। কোনও জায়গার জনঘনত্ব, একটি রাস্তা অন্য রাস্তার সঙ্গে কতটা সংযুক্ত, রাস্তা পারাপার করা কতটা সুবিধাজনক, মূল রাস্তা সংলগ্ন ফুটপাথ পথচারীদের হাঁটার জন্য কী মাত্রায় উপযুক্ত, আলোকিত এবং সুরক্ষিত, পথচারীদের সুরক্ষার জন্য প্রশাসনিক পদক্ষেপ সব কিছু মিলিয়ে নির্ণয় করা হয় হন্টনক্ষমতা সূচক। সহজভাবে বলা যেতে পারে, এই সূচকের উপরে নির্ভর করে কোনও শহর কিংবা জায়গায় হাঁটার সার্বিক অভিজ্ঞতা। এই স্কেল শুরু হয় শূন্য থেকে। শেষ হয় একশোয়। ৯০ থেকে ১০০ -এর মধ্যে যে শহরেরা নাম লিখিয়েছে, তার গায়ে তকমা জুটেছে ওয়াকার্স প্যারাডাইজ’-এর। অর্থাৎ, হেঁটে চলা মানুষদের কাছে স্বর্গ! ৭০ থেকে ৮৯ -এর মধ্যে নম্বর পাওয়া জায়গাগুলো হাঁটার পক্ষে দারুণ উপযুক্ত। আর ৫০ থেকে ৬৯-এর মধ্যে আছে যারা, তারা মোটামুটি উপযুক্ত। সূচক আরও নীচে অর্থাৎ পঞ্চাশের কম থাকলে বুঝতে হবে, পথচলতি মানুষদের আরামের জন্য এই জায়গাগুলোয় বড় খামতি আছে। হেঁটে সুখ নাই!

 

 

হাঁটার আনন্দ নিয়ে পশ্চিমি দেশগুলোতে যত সমীক্ষা হয়েছে, আমরা তার ধারেকাছেও নেই। পেটে খিদে নিয়ে, মনে অশান্তি নিয়ে হয়তো বৃথা এ আয়োজন। একটি দেশজ সমীক্ষা বলছে, মার্কশিটে আমাদের প্রাপ্ত নম্বর হল ৫২। অর্থাৎ, ‘মোটামুটি উপযুক্তপথঘাট নিয়েই আমরা হেঁটে চলেছি প্রতিদিন। ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ জার্নাল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (আইআরযেইটি)-র ২০১৭ সালে প্রকাশিত রিপোর্টে বিশদে জানা যায় ভারতবর্ষের হাঁটাহাঁটির মান নিয়ে। দেশের মোট তিরিশটি শহরের মধ্যে সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। দেওয়া হয়েছিল ওয়াক স্কোর। সবচেয়ে খারাপ নম্বর পেয়েছিল শিমলা। প্রাপ্ত নম্বর ২২। আর সবার শীর্ষে ছিল চন্ডীগড়, ৯১-এর মুকুট পরে। চেন্নাই, কলকাতা, মুম্বই ও দিল্লির প্রাপ্ত নম্বর ছিল যথাক্রমে ৭৭, ৮১, ৮৫ এবং ৮৭। এর অর্থ হল, মুম্বই ও দিল্লির রাস্তায় হাঁটা কলকাতার তুলনায় বেশি আরামদায়ক। অন্য দিকে, চেন্নাই ও বেঙ্গালুরুর তুলনায় এগিয়ে রয়েছে এ শহর। তবে তা নিয়ে কলার তুলতে চাইলে ওয়াকিবহাল শিবিরের বিশেষজ্ঞরা তির্যক হাসি উপহার দেন।

 

 

এই সমীক্ষার তথ্যের সঙ্গে অবশ্য বিস্তর ফারাক রয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্তরের সমীক্ষার। রাস্তাঘাটের ভালমন্দ নিয়ে চর্চা করেন যাঁরা, “দুনিয়ার কোন শহরে হেঁটে সবচেয়ে বেশি সুখ?”, জিজ্ঞেস করলে তাঁদের পাঁচ জনের মধ্যে চার জনই সমস্বরে বলে উঠবেন, “নিউ ইয়র্ক। একাধিক সমীক্ষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই শহর সেরার শিরোপা পেয়েছে, হাঁটার ক্ষমতার সূচকে। নিউ ইয়র্কের ওয়াকাবিলিটি ইনডেক্স ৮৯, হাঁটার স্বর্গ থেকে মাত্র ১ নম্বর দূরে। কলকাতার ৮১। তথ্য বলছে, সানফ্রান্সিসকো, বস্টন কিংবা আমস্টারডামের ক্ষেত্রে এই সূচক যথাক্রমে ৮৯, ৮৮ এবং ৮৫। ভ্যাঙ্কুভারের ৮০। এর অর্থ দাঁড়ায়, হাঁটার সূচক অনুযায়ী কলকাতায় হেঁটে ভ্যাঙ্কুভারের তুলনায় বেশি সুখ! ওয়াকাবিলিটি ইনডেক্সে দিল্লি হেলায় হারিয়ে দিচ্ছে আমস্টারডামকে। আর আমরা কি নির্বোধ! কয়েক লক্ষ টাকা জলে দিয়ে বিদেশে ঘুরতে যাই। সব পেয়েছির দেশে থেকে তার মর্ম বুঝি না!

 

 

হন্টনক্ষমতা সূচক নিয়ে যত তথ্য মন্থন করি, মনকে তত ঘিরে ফেলে ধোঁয়াশা। বুঝতে পারি, ওয়াকাবিলিটি ইনডেক্স নিয়ে বিশ্বজুড়ে গ্রহণযোগ্য কোনও ফর্ম্যাট আপাতত নেই। কিংবা, থাকলেও সেটি গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেনি এখনও। সূচকে কোন প্যারামিটারকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে, দেশ পাল্টালে তার অঙ্কও পাল্টে যায়। হাঁটার এই সূচকের শীর্ষে যে শহরগুলি আছে, তাদের রাস্তাঘাট সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রথমেই যে লাইন কম্পিউটারের পর্দায় ফুটে ওঠে তা হল, ‘এ শহর গাড়িঘোড়ার তুলনায় বেশি প্রাধান্য দেয় পথচারি এবং সাইকেল আরোহীদের।শহরবাসীদের এই সচেতনতা রাস্তায় হাঁটার সুখ কী পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে পারে তা আন্দাজ করতে কষ্ট হয় না। ইউটিউবে এই শহরগুলির ফুটপাথ দেখি। ফিরে আসি স্বদেশে। ওই তো! সামনের লোকটা তেড়ে ফেলে দিল পানের পিক। ফুটপাথে। কেউ কিছু বলল না, স্বাভাবিক নিয়মেই। ফুটপাথ দখল করে রাখা হকারের দুটো গুমটির মধ্যে আঁধারে লুকিয়ে পড়লেন একজন। প্রকৃতির ডাক? ঘুগনিওয়ালার পাশে কচুরীপানার মতো জমতে থাকছে থার্মোকলের এঁটো প্লেট। দিনের শেষে ব্যবসা গুটিয়ে চলে যাবেন তিনি। প্লেটগুলো থেকে যাবে ফুটপাথ গর্ভে। চায়ের দোকানে তর্কে মজেছে আম-আদমি। ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের কাপ ঘন হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি। ওই তো! মত্ত লোকটা আজ এসেছে ফের। আমি জানি, ফুটপাথে ঘন্টাখানেক গড়াগড়ি খেয়ে, পথচলতি লোকেদের প্রাণভরে খিস্তি করে ও বমি করতে শুরু করবে। রোজ করে। এটাই নিয়ম।

 

 

যে শহরগুলো ওয়াকাবিলিটি ইনডেক্সে বিশ্বের শীর্ষে, সেখানে রাস্তা নোংরা করার জরিমানা সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে করল। যা ফুটে এলো, তা রূপকথা। নিউ ইয়র্কে রাস্তা নোংরা করার প্রথম বারের অপরাধে ৩০০ ডলার পর্যন্ত জরিমানা। এক বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বার অপরাধ করলে জরিমানার অঙ্ক ছুঁতে পারে ৫০০ ডলার। আমস্টারডামে এর পরিমাণ ১৪০ ইউরো। শহর বদলায়। তবে জরিমানার পরিমাণ দেখে বিস্ময়ভাব বদলায় না। গ্লাসগোনিবাসী অধ্যাপক বলছিলেন, “আমরা তো প্রশ্ন করি, এটুকু অপরাধে এত অর্থদন্ড? কিন্তু দেখেছি, ওটাই দস্তুর। তাই রাস্তায় আবর্জনা ফেলার কথা ভাবলে শিড়দাঁড়ায় ঠান্ডা স্রোত খেলে যায়।সমীকরণ বলে, রাস্তা ভাল এবং চলাচলযোগ্য হলে বেড়ে যাবে দ্বিধাহীনভাবে হাঁটার ক্ষমতাও। বাড়বে ওয়াকাবিলিটি ইনডেক্স! ফুটপাত দিয়ে হেঁটে বলব, “আঃ! কি আরাম।ছবি তুলব। আমার শহরের ফুটপাথ হয়ে উঠবে ডিসওয়াশার থেকে সদ্য বের করা চীনামাটির প্লেটের মতো ঝকঝকে। কী আরাম।  

 

 

বৃষ্টিস্নাত দিন ছিল। সকাল নটা। অফিস যাওয়ার ভিড়। মেট্রো স্টেশনগামী ফুটপাথে প্রবল গতিতে উঠে পড়ল একটি স্কুটি। কাদাজল ছিটকে উঠল। গর্জাল জনতা। বলল, “এটা স্কুটার চালানোর জায়গা নাকি? এটা ফুটপাথ। নামুন রাস্তায়।ততোধিক চিৎকারে মাতিয়ে দিলেন স্কুটিচালক। মাতল রে ভুবন। বললেন, “এটা হাঁটার জায়গা আপনাদের কে বলল? এটা ফুটপাথ। জ্ঞান পকেটে রাখুন। নামুন রাস্তায়। সব এই হকারগুলোর জন্য।কেন জানি না, আমার মধ্যে চকিতে ভর করলেন রাজা রামমোহন রায়। একজন হকারের গুমটির সামনে দাঁড়িয়ে আমি চিল্লিয়ে বললাম, “আপনাদের জন্যই ওয়াকাবিলিটি ইনডেক্সে আমরা শেষ বেঞ্চে বসে থাকি। লজ্জা করে না? আমাদের কত ইনডেক্স জানেন? খবর রাখেন?”

 

 

উটের মতো গ্রীবা নিয়ে আমার সামনে চলে এলেন দোকানমালিক। ওঁর মুখের মধ্যে সিমেন্ট মেশানো মেশিনের মতো তৈরি হচ্ছিল পান মশলা। চোখে রাঙা ফ্লাডলাইট। চেয়ে রইলেন। আমি গাল পেতে রই।

  • অম্লানকুসুম চক্রবর্তী