মাগরিবের ছায়া

কবরস্থান মাঠ লাগোয়া পুকুরটাতে এখন আর পানি নেই বললেই চলে। তারামন যখন বিয়ের পর প্রথম আসে, তখন আশুবাবুর লাইনে ওঠেনি। ভোলা মিঞার সেই সময়ের আস্তানা ছিল থিয়েটার সাউয়ের বাড়ি। নামে থিয়েটার সাউয়ের বাড়ি হলেও, তার মালিক তখন রামনরেশ মাঝি। শিয়ালদাতে রেলের ট্রলিম্যানের কাজ করে সেই নতুন বাড়িওয়ালা। রোজ কলকাতায় যাতায়াত করে। তাই তারামনের বস্তিবাড়ির ভিতরে একমাত্র কোঠাঘরের মালিক, তাদের বাড়িওয়ালা রামনরেশের খাতিরই তখন অন্যরকম।রাস্তার চাপা কলে বাড়িওয়ালা চান করতে গেলে আর কেউ জল নেওয়ার কথা ভাবতেই পারত না। বস্তির বেশিরভাগ বাসিন্দাই ছিল নদিয়া জুট মিলের লেবার। মুসলমান মাত্র দুই ঘর। তারামনেরা আর বাড়িওয়ালা রামনরেশের ঘরের কাছে থাকত হানিফ।
 

                  

হানিফরা মুজফফরপুরের মানুষ। হানিফের বউ যখন মেয়েকে ডাকতো, গলসনিয়াআআআআ গে এ এ, বেশ অবাকই হয়ে যেত তারা।অজপাড়া গাঁয়ের মেয়ে তারামন হ্যাঁ করে শুনতো মুজফফরপুরের স্থানীয় উচ্চারণে এই 'গেএএএ' র চিলচিৎকার। হানিফের মেয়ের নাম যে গুলশন, সেটা অনেক পরে রামায়ন পাঁড়ের বৌ দেওসুন্দরীর কাছ থেকে জানতে পেরেছিল তারামন।

 


তারামনের গেটের সামনেই ঘোষদের বিরাট কোঠা বাড়ি।আর তারাদের একদম গা লাগোয়া বাগচিদের বাড়ি। এই বাড়িটা একতলা হলেও বেশ ছড়ানো। কিন্তু ঘোষদের বাড়িটা আবার দোতলা। ঘোষদেরই সামনের রোয়াকে অসুস্থ ভোলা মিঞার ঠাঁই হয়েছিল। ঘোষদের খোলা লম্বা বারান্দার পূবদিক ঘেসে ভোলাকে ঘর থেকে বের করে ধরাধরি করে শুইয়ে দিয়ে গেল রামায়ন, মার্কন্ডে আর বিজলী পাঁড়ে।কদিন ধরেই ঘরের ভিতরে ক্রমাগত কেসেই চলেছে ভোলা। হোটেলে খেতেও যায়। খেতে যাওয়ার মতো সামর্থও নেই।পাশের ঘরের রামায়ণের বৌ দেওসুন্দরী দিন কয়েক নিজের সামর্থ মতো ভাত, ডাল, চোখা, ভুজা দিয়ে এসেছে ভোলার ঘরে। একটা দুটো দিন নদিয়া মিলের গেটের সামনের মসজিদের থেকে একজন, দুজন এসেছে। রামায়ণ তাদের বলে; বুড়োহা তবিয়ত তো ঠিক নেইখে লাগত। বুড়িহিয়াকে সমাচার দেনা জরুরত বারণ।
                  

 
মসজিদ থেকে আসা লোকগুলোও স্বীকার করে ভোলার মেহেরারুকে খবরটা দেওয়া জরুরি। সেদিন বিকেলে চা নিয়ে গিয়ে দেওসুন্দরী দেখে কাপটা তুলে মুখের কাছে আনার মতো শক্তি ও ভোলা মিঞার আর নেই। কী করবে ভেবে পায় না রামায়ন। বোঝে ভোলার বৌকে খবর দেওয়া খুবই জরুরি, কিন্তু কোথায় বুড়োর শ্বশুরঘর কিছুই জানে না তারা।
   

                     

রামনরেশের বস্তির একপাশে তিন ঘর ভাড়াটে। প্রথম ঘরটাতে থাকে এখন কেবলমাত্র মার্কন্ডে পাঁড়ে। এই ঘরেই আগে একসঙ্গে থাকতো বিশনাথ, বিজলী, ব্রজরাজ। তারপর এলো মার্কন্ডে। নদিয়া জুট মিলের তখন দারুন রমরমা। অতোগুলো লোক ওই খুপড়ি ঘরে তো আঁটার কথা নয়। আঁটতোও না। প্রবল বর্ষা আর একদম হাড় কাঁপানো শীত ছাড়া ঘরের মানুষদের রাতের ঠিকানা হতো যে এই সামনে ঘোষবাবুদের রোয়াক, এই চটকলিয়া ভাষায় যেটা হয়ে গিয়েছিল,'পাকা'।
 

                  

তাদের পাশের ঘরে থাকত ভোলা আর তার পাশের ঘরে বৌ নিয়ে রামায়ন। ঘরের পাশে একটা কাদার পাঁচিল তুলে নিয়েছিল রামায়ন। পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে রামায়নের আঙনায় ঢুকতে হতো একটা ভারি চটের পর্দা সরিয়ে। আব্রুর জন্যে যে এই কাদার পাঁচিল তুলেছিল রামায়ন, তেমনটা ভাববার আদৌ কোনও কারণ নেই। রামায়নের কাছে তাঁর বৌ দেওসুন্দরী ছিল পরমাসুন্দরী। বৌয়ের জন্যে সেই সাতের দশকেই রিস্টওয়াচ কিনে দিয়েছিল রামায়ন।ঘড়ি দেখতে পারুক আর না পারুক, এই ভাটপাড়ার কুমোরপাড়ার চটকলিয়া ঠমকে যখন বিহারের ছাপড়ার পরসতিপুর গ্রামে যেত দেওসুন্দরী, হাতে রিস্ট ওয়াচটা পড়তে কখনওই ভুলতো না!
 

                 

মুলুকের জাতপাতের বেড়াদরি এই চটকলিয়া আদবকায়দায় উফে যেতে যেতে এখন কেবলমাত্র অপরিচিত পুরুষ দেখলে দেহাতি বৌদের একটু লম্বা করে ঘোমটাটা টেনে দেওয়াতে এসেছে। ভোলার আগের বৌ, এই কুমোরপাড়া, কুলিডিপো, মুক্তোপুরে সে ছিল ইউনিভার্সাল চাচি। বাগচিদের সদর দরজা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে ছিল ভোলাদের ঘরে ঢোকার সদর দরজা। সেই দরজায় পা দিতে গেলে পৌরসভার খোলা ড্রেন টপকাতে হতো। বাগচিরা সেই ড্রেনের উপরে বেশ সুন্দর একটা সিঁড়ি করে নিয়েছিল বাড়িতে ঢোকার সুবিধার জন্যে। তবে অনেক কষ্টেই এই ইমারজেন্সির কাল অতিক্রম করে বাগচি বাড়ি ঢোকার মুখের সিঁড়িটা বেঁচে আছে।
 

                          

ইমারজেন্সির সময়ে কোনটা যে আইন আর কোনটাই বা বেআইনী- না পৌরসভার সে সম্পর্কে এতোটুকু পরিস্কার ধারণা ছিল, না ছিল পুলিশের। যে কোনওরকমের আড্ডাই তখন পুলিশের কাছে জটায়ুর ভাষায়, 'হাইলি সাসপিসিয়াস'। তাই চটকল শ্রমিক মহল্লায় ফাঁকা না থাকা রোয়াকগুলোও হয়ে উঠল পুলিশের কাছে সন্দেহের খুব বড়ো রকমের বিষয়বস্তু। তাই ঘোষপাড়া রোডের উপর সিংহাসনের বাড়ির ঠিক সামনেই বড় রাস্তার বই হাইড্রেনের উপর সিমেন্টের স্ল্যাবগুলো পুলিশকে পাশে রেখে ভেঙে দিল পৌরসভা।

                    

সেসব অবশ্য তারার বিয়ের আগের ঘটনা। রাজনীতির ডামাডোল ওর মফস্বলি শহর লাগানো গাঁ ছেরামপুরকে ততোটা প্রভাবিত না করলেও একদম যে দোলা দেয়নি, তাও নয়। তবে তারামনের শিশু হৃদয়ে রাজনীতির সেই চাপান উতোর কোনও ছাপ ফেলতে পারেনি। যে ভবিতব্যের দিকে তির নসিব ধেয়ে চলেছে, সেই অদেখাজীবনের হাতছানি ঘিরে ছোট মেয়েটার কোনও ভাবনা চিন্তাও ছিল না।
 

              

অথচ সেই সময়েই তারামনের না দেখা সতীন, ভোলা মিঞার বিবি, সানতারের আম্মা, না না, চটকলি বেড়াদরে সম্বোধনের লব্জে মুসলমানত্ব প্রমাণের মরিয়া চেষ্টার ভিতর দিয়ে কিন্তু সানতারের শৈশব - কৈশোর কাল কাটেনি। বাপ ভোলাকে আব্বা বললেও, আশেপাশের হিন্দিভাষী প্রতিবেশি চটকলিয়া ভাইয়ালোকের জবানটাই হয়ে উঠেছিল সানতারের মুখের ভাষা। তাই আম্মা নয়, গর্ভধারিণীকে সানতার 'মাঈ' বলেই ডাকতো। একজন মুসলমান ছেলের মুখের মাতৃসম্বোধনে হিন্দুয়ানি আছে, না মুসলমানত্ব ফুটে উঠছে- তা নিয়ে ভাববার মতো সময় এবং মানসিকতা এই শ্রমিক মহল্লার মানুষদের কারওরই ছিল না। সামতার যেমন ঘোষ বা বাগচি বাড়ির মেয়েদের উচ্চারণে হয়ে গিয়েছিল 'সাঁতার'। আবার এই অভিজাত বাড়ির মেয়েরাই হিন্দিভাষীদের কাছে হিন্দি বলতে পারার চেষ্টায় 'নারায়ন', দেহাতি অপভ্রংশে 'নারাইনা' কে শুদ্ধ হিন্দি উচ্চারণের চেষ্টায় বলে বসতো, 'লালাইনা'।
 

               

ভোলা মিঞার অসুখ করে। সেরেও যায় সেই অসুখ। সেরে উঠেই ঠুকঠুক করে ভোলা যায় মিলে হপ্তা আনতে। এখন আর ফি হপ্তা পুরো টাকা ভোলা পায় না। শরীরের গতিক বুঝে বদলিতে দিয়েছে কাজটা। ভোলার ইচ্ছে ছিল ছেলে সানতারকে নিজের বদলিতে জুড়ে দেয়। কারণ,যদি বদলির লোক পরে আর কাজ না ছাড়ে? ভোলা তখনও আশা করে নিজে সুস্থ হয়ে উঠতে পারবে। আর সুস্থ হলেই নিজের কাজ নিজেই ধরতে পারবে।
 

                   

এই নিজের কাজে বদলি শ্রমিকদের ঢোকানোর ক্ষেত্রে পারমিন্ট, অর্থাৎ পারমানেন্ট শ্রমিকদের ভিতরে একটা ভয় কাজ করে সব সময়ে। ইউনিয়ন থেকে যদি বদলির কাজটা আবার পারমানেন্টের, মানে স্থায়ী শ্রমিকের ধরবার সময় বেগরবাই করে? পারমানেন্ট শ্রমিক, তা সে নিজে যত গরীব ই হোক বা না হোক- সমাজের চোখে সে স্থায়ী চাকুরে। ফলে বদলির লোককে যখন পারমানেন্ট লোক চাকরিতে বসিয়ে দিয়ে, সে নিজের চাকরিটা নিজে ফিরে পেতে চায়, তখন সমাজের গণ্যমান্য মানুষজন, অর্থাৎ; ট্রেড ইউনিয়নের নেতাদের কেউ কেউ হঠাৎ করেই সেই বদলি শ্রমিকের প্রতি একটু বেশি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে। স্থায়ী শ্রমিক, তার সাকুল্যে প্রতি সপ্তাহে হাতে আসে তিরিশ টাকা, যদিও যে জাবদাখাতায় টিপছাপ দিয়ে শ্রমিকটি তার হপ্তা তোলে, সেখানে লেখা থাকছে, শ্রমিকটি পাচ্ছে পঞ্চাশ টাকা। চটকল মালিকরা কখনও শ্রমিকদের ফাঁকি দিতে পারে নাকি? শ্রমিকদের জন্যে চটকল মালিক আর ইউনিয়নের লোকেদের বলে রাতে ঘুম হয় না!

( ক্রমশঃ)

  • গৌতম রায়
  • পঞ্চম