কবি নরেশ গুহের জন্মশতবর্ষ উদযাপন

শতবর্ষ অতিক্রম করলেন কবি নরেশ গুহ। আজ প্রায় বিস্মৃত এক নাম। আত্মপ্রচার বিমুখ এক সারস্বত তপস্বী। তাতার সমুদ্রের ঘেরাটোপ অতিক্রম করে তাঁকে ঘিরে চর্চা বাঙালি জীবনে এক সংযোজন-

 

অমিয় দেব তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন অমিয়-অধিগত ছিলেন অনেকটা, অমিয় চক্রবর্তীর মনোজগতের এক দ্বারী’ – নরেশ গুহ (১৯২৩২০০৯) বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। যুগান্তরপত্রিকায় সাংবাদিক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করলেও পরবর্তীকালে কলেজের শিক্ষকতা এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপক এবং বেশ কিছুকাল বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ‘W.B.Yeats in Indian Vision’, অন্যদিকে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সতেরো বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ দুরন্ত দুপুর’ (১৯৫২), ‘তাতার সমুদ্র ঘেরা’ (১৯৭৬), তাঁর সংগৃহীত কবিতা, ‘কবিতা সংগ্রহসাহিত্য অকাদেমি পুরষ্কার লাভ করেছিল। প্রকৃতপক্ষে ১৯২৪ নয়, ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের ৩রা মার্চ, দোলপূর্ণিমায় নরেশের জন্ম হয়েছিল। বুদ্ধদেব বসুর বই আধুনিক বাংলা কবিতায় প্রকাশিত জন্মসালটি ভুল, যা পরবর্তীতে সংশোধিত হয়নি। এই আয়োজন প্রকৃতপক্ষে তাঁর জন্মশতবর্ষপূর্তির উদযাপন। গত ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর অনিতা ব্যানার্জি মেমোরিয়াল হলে সাহিত্য অকাদেমি পূর্বাঞ্চল শাখা এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের যৌথ উদ্যোগে অধ্যাপক নরেশ গুহের জন্মশতবার্ষিকী আলোচনাচক্রের আয়োজন করা হয়। উদ্বোধনী অধিবেশনে সাহিত্য অকাদেমি পূর্বাঞ্চলের আধিকারিক অভিষেক রথ স্বাগত ভাষণ দেন, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সেলিম বক্স মণ্ডল কথামুখের নির্মাণ করেন। বিশিষ্ট বাঙালি লেখক-গবেষক পিনাকেশ সরকার তাঁর মুখ্য ভাষণে চল্লিশের দশকের কবি নরেশ গুহকে চিনিয়ে দেন, কবিকন্যা সুচরিতা গুহ ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা করেন, প্রখ্যাত বাঙালি কবি সুধীর দত্ত সভামুখ্য হিসাবে অমিয় চক্রবর্তীর প্রত্যক্ষ শিষ্য হিসাবে নরেশ গুহের বিবর্তন আলোচনার পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক সুমিত বড়ুয়া ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। এরপর দুটি অধিবেশনে সর্বমোট আটজন বক্তা সভামুখ্য পিনাকেশ সরকারের উপস্থিতিতে প্রায় ক্যালাইডোস্কোপিক বীক্ষায় কবি, প্রাবন্ধিক, অধ্যাপকের জীবন ও সাহিত্যকে পুনর্বিচার করেছেন বলা চলে।

 


অসম্পাদিত রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র -র এগারতম খণ্ডের সমান্তরালে রবীন্দ্রনাথকে লেখা অমিয় চক্রবর্তীর চিঠির সংকলন কবির চিঠি কবিকেএবং প্রমথ চৌধুরীকে লেখা অমিয় চক্রবর্তীর চিঠির সংকলন সাহিত্য সারথি সমীপেপড়লে বোঝা যায়, পুলিনবিহারী সেনের মত সম্পাদকীয় দক্ষতা ও অধ্যবসায়ের পাশাপাশি অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে নরেশের ব্যক্তিগত, ছাত্র-বন্ধুবৎ সম্পর্ক নিবিড় কবিভাষার পাঠোদ্ধারে সাহায্য করেছিল। দীর্ঘ টীকা, সম্পাদকের সঙ্গে অমিয় চক্রবর্তীর ব্যক্তিগত চিঠির প্রসঙ্গোল্লেখ অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার জীবনীভিত্তিক সমালোচনার দিকেও নিয়ে গিয়েছে। অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার আশাবাদী ভাবনার অভ্যন্তরে প্রবহমান অগ্রজের আত্মহননের আকস্মিক বেদনা তাঁকে ব্যক্তিক স্তরে বিষাদাচ্ছন্ন করে রেখেছে আজীবন। খাটের নিচে ট্রাঙ্কে রাখা নরেশ গুহকে লেখা একাধিক সুধীজনের চিঠিপত্রের সংকলন, যামিনী রায়ের চিরকুট স্কেচ, আসল ছবি, চিত্তপ্রসাদের আঁকা ছবি, ফোটোকপি ও নিজের হাতে লেখা প্রায় এক হাজার চিঠির পুনর্লিখন, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, অশোক মিত্র, যামিনী রায়, জীবনানন্দ দাশ, শিবরাম চক্রবর্তী, পুলিনবিহারী সেন, অম্লান দত্ত, শামসুর রহমান, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের চিঠির ক্যাটালগ তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ এক যুগের নির্মাণ করেছে। পরবর্তীকালে সিগনেট প্রেসে যুক্ত থাকাকালীন নরেশ অমিয় চক্রবর্তীর দূরযাত্রী ও পারাপার প্রকাশনায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। পরবর্তীকালে দুই খণ্ডে অমিয় চক্রবর্তীর কাব্যসংগ্রহ সম্পাদনা করেছিলেন তিনি। প্রবাসী কবির বিস্মৃতপ্রায় ও লুপ্ত বহু রচনা সংগ্রহের জন্যে নরেশ দীর্ঘকাল বিভিন্ন পত্রপত্রিকা খুঁজে বেড়িয়েছেন।

 


ইউরোপীয় কবি হিসাবে ইয়েটসের রচনায় ভারতীয় দৃষ্টিকোণ অর্থাৎ বুদ্ধভাবনা, তন্ত্র, বৈষ্ণবীয় ও রাবীন্দ্রিক প্রভাব কতটা আসছে বুঝতে চেয়ে নরেশ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের তুলনা করেছেন। ইয়েটস শেষতম রোমান্টিক কবি বলে নিজেকে চিহ্নিত করলেও তথাকথিত রোমান্টিকতা ও সৌন্দর্যকে বিশ্বরাজনীতির থেকে আলাদা করে দেখেননি। নরেশ বাংলা কাব্যে আইরিশ প্রভাব নিয়ে আলোচনা করছেন, ইয়েটসের ভুল ধরিয়ে দিয়েছেন, ‘রাজানাটকের প্রতিগ্রহণে ইয়েটসের ইতিহাস ভাবনার আলোচনা করেছেন। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের শেক্সপিয়ার পাঠ নিয়ে ও উইটম্যানের প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতায় অভিঘাত আলোচনা করছেন। অনুবাদক হিসাবেও তাতার সমুদ্র ঘেরা-র কিছু কবিতা, সাত্রেঁর কপাটঅনুবাদ, আটটি রবীন্দ্র কবিতার রামানুজনের সঙ্গে ইংরেজি অনুবাদ দেখে বোঝা যায়, নরেশের কবিতার সারথি বুদ্ধদেব বসু এবং অমিয় চক্রবর্তী হলেও নরেশ গুহ কেন চিরকালীন ইয়েটস এবং রবীন্দ্রপন্থশিল্পী রয়ে গেলেন। তাঁর কবিতা Religious নয়, spiritual – সত্তার বিস্তৃতি বিধৃত হয়েছে তাঁর লেখায়। মহাবিশ্বচেতনায় তিনি বিভোর, অস্তিত্ববাদী শূন্যতা, নিত্যচ্ছন্দ, স্বতন্ত্র কাব্যভাষার স্বতন্ত্র চিহ্নিতকরণে কবিত্বের সামাজিক চিহ্ন বহন করেন। তাঁর কবিতা আক্রান্ত বা বিপন্ন করে না। রোমান্টিকের Negative capability ধারণ করে তাঁর কাব্যপ্রতিমা তথা চিৎপ্রতিমা অন্তর্গত সংলাপের মানচিত্র রচনা করে। তাঁর আত্মার আত্মীয় রবীন্দ্রনাথ, সমকালের অশান্ত জীবন তাঁর কবিতায় না থাকলেও এক রোমাণ্টিকের করুণ রাগিণী তাঁর রচনায় দেখা যায়। তিনি রোম্যান্টিক কবি হলেও নজরুলের মত বীরত্ব রয়েছে তাঁর, তাই মৃত্যুকে দিয়ে মৃত্যুকে হব পারলিখতে পারেন। বুদ্ধদেব বসু বদ্যলেয়ারের অনুবাদের ভূমিকায় রোমান্টিকদের খারিজ করে নাস্তিক্যবাদী দর্শন ও চরম ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে আধুনিকতার জয়গান করলেও নরেশের রোম্যান্টিক কবিমন আত্মহারা, ‘জলে নাম লিখে চলে যেতে হবে’ – কীটস্-এর এপিটাফের প্রতিধ্বনি ধ্রুবপদের মত নরেশ গুহের কবিতায় ফিরে এলেও হাহাকার থেকে উপলব্ধিতে তিনি উপনীত হন। একদিকে তিনি দীক্ষিত বৌদ্ধ, বৈষ্ণব নন অর্থাৎ তিনি বুদ্ধদেব বসু নন, বিষ্ণু দে -এর উত্তরসাধক। তাঁর লোকটাকবিতা নিষ্কম্প্র, সটান, আধুনিক, আধুনিকতা ও রোমান্টিকতার টানাপোড়েনে যৌগিক কবিমানুষ বিপন্ন।

 


১৯৪৭-১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে প্রধানত জীবিকার কারণে যুগান্তর পত্রিকায় সম্পাদকীয় বিভাগে প্রমথনাথ বিশীর সুপারিশে সাব-এডিটরের চাকরি করেন। ১৯৪৭ সালে নোয়াখালি ও বিহারের দাঙ্গায় গান্ধির সফরে অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে নরেশও গিয়েছিলেন। এই দাঙ্গাবিধ্বস্ত সময়ের জার্নাল থাকলেও সাংবাদিক হিসাবে প্রকাশিত লেখার সন্ধান মেলেনি। স্বভাবলাজুক নরেশ গুহ সাংবাদিকসুলভ ভঙ্গিতে আঁতের কথা বের করে না আনলেও বিহার সরকারের সরকারি হিসাব তুলে ধরেছেন, তথ্যকে ক্রমাগত নির্ভুল করতে চেয়ে নিখুঁত দাঙ্গার সমাজের বিভিন্ন স্তরের উপস্থাপনা, প্রতিবেশিতার মানবিক চিত্র, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ভিন্ন প্রতিক্রিয়া তুলে এনেছেন। স্বাধীনতা ও দেশভাগের প্রাক্কালে বিপন্নতা প্রত্যক্ষ করলেও তাঁর সেই লেখায় তা প্রকাশ পায়নি। দিনেশ দাস, মঙ্গলাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ তরুণ কবিদের উপস্থিতিতে বুদ্ধদেব বসু এবং বিষ্ণু দে -এর পৃথক ভৌগোলিক ও নান্দনিক অবস্থান শুদ্ধ কবিতাচর্চা প্রাণিত করেছিল। তাঁর জীবিকার সঙ্গে জীবনের বিরোধ হয়নি, নিজের গান ভুলে যাননি। তাঁর স্বল্পসংখ্যক কবিতা ছদ্মবেশী প্রেমের কবিতা। দারিদ্র, সমসাময়িক অস্থিরতা, স্বল্প হলেও সাংবাদিকতাসূত্রে বীভৎসতার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা কবিসত্ত্বায় প্রবেশ করেনি। তাঁর সুকুমারমতিত্ব কবিতাকে ছুঁয়ে থেকে প্রকৃতি, শহর ও গ্রামজীবনের ছবি, জীবনযাপনের আখ্যান প্রকৃতিদর্শন মিশে গেছে। তাঁর অনেক কবিতার বিষয় নির্দিষ্ট নয়, কিন্তু কবিতার যাত্রাপথে বিষয়হীনতা বিষয় হয়ে উঠেছে পরবর্তী রচনায়। প্রসন্নতা তাঁর রচনার গুণ, প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের মত সেই প্রসন্নতায় নিহিত বোধ কন্টকিত করে না। অসামঞ্জস্য ততখানি পীড়িত করে না, ছলনা তিক্ত করে তোলে না। বিপদ-অপ্রাজ্ঞতা তাঁর জোর বা দুর্বলতা। প্রসন্নতার উদযাপনও নয়, অনুদ্বেগ তাঁর কাব্যপ্রস্থান। এই সরল কবিসত্তা নরেশ গুহ নির্মাণ করেছেন অভিজ্ঞতা থেকে নিষ্কাশিত করে।

 


আলোচনাচক্রে জয়দীপ ঘোষ সম্পাদক নরেশ গুহকে নিয়ে আলোচনা করেছেন। ঋতম মুখোপাধ্যায় তুলনামূলক সাহিত্যচর্চায় নরেশ গুহবিষয়ে রিচার্ড এলম্যান, বিশিষ্ট ইয়েটস বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে নরেশের গবেষণার পাশাপাশি তাঁর কাব্যবিশ্বের রূপরেখা নির্মাণ করেছেন। অহর্নিশপত্রিকার সম্পাদক শুভাশিষ চক্রবর্তী ব্যক্তিগত কথনে নরেশ গুহের সঙ্গে শেষ কিছু বছরের স্মৃতিচারণার সঙ্গে ছোটগল্প ও চিঠিপত্রে নরেশ গুহশীর্ষক আলোচনা করেছেন। স্বাতী ভট্টাচার্য নরেশ গুহের সাংবাদিক পরিচয় নিয়ে কথা বলেছেন। হিন্দোল ভট্টাচার্য নরেশ গুহের কবিতায় আধ্যাত্মিকতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। রণজিৎ দাশ রোমান্টিক কবিমানস: নরেশ গুহের কবিতাশীর্ষক আলোচনায় দুই যুযুধান পক্ষ আধুনিকতা ও রোমান্টিকতার আলোচনা করেছেন। সুজিত সরকার রবীন্দ্রপ্রভাবমুক্ত কবিতা রচনার প্রতিবেশে, বিভিন্ন স্বদেশি ও বিদেশি ঘটনার অভিঘাতে তিরিশের দশক থেকে চল্লিশের দশকের স্বাতন্ত্র্য ও নরেশ গুহের কবিতার চারিত্র বিশ্লেষণ করেছেন। সুতপা সেনগুপ্ত বিরল সরলতার কবি নরেশ গুহশীর্ষক আলোচনায় সরলতার মুখপাত্র নরেশ গুহকে ভাবতে চেয়েছেন। দ্বান্দ্বিকতাহীন উদার জীবনের চিহ্ন নরেশ গুহের কাব্যবিশ্বে ইতস্তত ছড়িয়ে রাখা। পাঠক্রমের সীমানা পেরিয়ে নরেশ গুহের এই বহুমাত্রিক অধ্যয়ন উপস্থিত সকলকে সম্বৃদ্ধ করেছে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে।
 

  • কৃষ্ণ শিঞ্জিনী দেব