বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কাব্যগ্রন্থ হিমযুগ : ছয় দশকের সংশয়িত ‘সূর্যকরোজ্জ্বলতা’র উত্তরাধিকার

তিন : ইন্দ্রিয় সংবেদন ও কবির বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতি

হিমযুগ কাব্যগ্রন্থের কবিতামালায় কবি বুদ্ধদেব জীবনকে সামগ্রিকভাবে দেখতে অনাগ্রহী, তিনি অস্তিত্বের অণুকে ফাটিয়ে বিশিষ্ট পরমাণুপুঞ্জ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেবার পর তাদের পুনর্বিন্যাসের কথা ভাবেন এই পদ্ধতিকেই কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত ‘বিশ্লেষণাত্মক’ বলেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১–১৯৪১)কড়ি ও কোমল (১৮৮৬) কাব্যগ্রন্থের ‘স্তন’, বাহু’, ‘চরণ’, ‘তনু’, ‘চুম্বন’২৫ প্রভৃতি ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯০৮–১৯৫৬)মোটা ও মিহিকাহিনী (১৯৩৮) গল্পগ্রন্থের ‘হাত’ (সাপ্তাহিক অগ্রগতি, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৪) গল্পে ইন্দ্রয় বিষয়ে লিখেছেন।২৬‘হাত’ কবিতায় কাহিনি কথনের ভঙ্গিতে কবি লিখেছেন যে উদ্দিষ্ট ‘তুমি’ হাতের জন্য সবসময় অসম্ভব চিন্তা করততারপর একদিন সত্যি সত্যি সেই হাত হারিয়ে গেল যা দিয়ে গালে হাত রেখে অনেক কিছু করার কথা ভাবতোকয়েক দিন কয়েক মাস কয়েক বছর পাগলের মতো ছোটাছুটি করে, মাথা ঠুকতে ঠুকতে ‘তুমি’ একদিন ঘুমিয়ে পড়েঘুম থেকে অনেক রাত্রে ‘তুমি’ উঠে জানলার সামনে দাঁড়ালে জানলা খুলে গেলে দেখা যায় –

অদ্ভুত জ্যোৎস্নায় দেখতে পেলে এক বিশাল মাঠে শুয়ে আছে

তোমার দু’হাত। বৃষ্টি পড়ছে একনাগাড়ে একটি হাতের ওপর, আরেক হাতে

শব্দ করে আস্তে-আস্তে গজিয়ে উঠছে ঘাস।২৭

 

 

ইন্দ্রিয়বিপর্যাসের জটিল চিত্রাঙ্কনে কবি বুদ্ধদেবের মুনশিয়ানা লক্ষ করা যায়। অন্যদিকে পুরো হাত নয়, ‘নুলো হাত’ কবিতায় হাতেরই অংশভাগ একটি আঙুলের সঙ্গে আরেকটি আঙুলের সম্পর্কের কথা বলা হচ্ছেকবিতায় আতঙ্কে, ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়ার চিত্র রয়েছে যেখানে ‘একটা নুলো হাত ডেকে আনে লাখ-লাখ নুলো হাতকে’, আর পৃথিবী ‘ধূসর থেকে আরও ধূসর’ হতে থাকে। ক্রমশ ছোট-হীন হয়ে যাওয়া মানুষের রূপকচিত্রই এখানে ব্যঞ্জিত হয়েছে –

কড়ে আঙুল আবার মাথা উঁচু করে আর

দেখতে পায় আরও, আরও ছোট হয়ে গিয়েছে সে

দেখতে পায় আরও, আরও ছোট হয়ে যাচ্ছে সে।২৮

 

 

উত্তম পুরুষের কথনে দশ রাত ঘুমহীন, বহু বড়ি, ট্যাবলেট খেয়েও অশান্ত ‘সে’-এর গল্প ‘মাথা’ কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে একটা অন্ধকার ঘর থেকেমাথার যন্ত্রণায় সে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে এসে ভয়ঙ্কর রাগে সে দেওয়ালে মাথা ঠুকতে থাকে –‘মাথা ভেঙে চৌচির, ছিটকে পড়ে ঘিলু, হাড় চারদিকে’আতঙ্কে হাত-পা ছোঁড়ার আগেই মেঘের ভেতর থেকে ভাসমান ‘অন্য-এক মাথা’, ‘হাসতে-হাসতে গলার ওপর বসে যায়’‘আশ্চর্য সুন্দর নতুন মাথার নাক মুখ চোখ, জ্বালাহীন, যন্ত্রণাহীন’ যাকে রাস্তায় দেখে মেয়েরা মুগ্ধ হয়ে যায় আজ এগারো দিনের দিন সে ‘আশ্চর্য নিটোল সুখী মানুষের ঘুম’ ঘুমাবে২৯ এই অদ্ভুত আত্মহননের আয়োজন আমাদের শিহরিত করে। ‘কান’ কবিতায় দেখি কানওয়ালা মানুষ কোনও কিছুকেই গুরুত্ব দেয় না, প্রণিধানযোগ্য কথারূপে গণ্যই করে নাএইভাবে উপেক্ষিত হতে হতে, ‘দুঃখে ও লজ্জায় কুঁকড়ে যেতে-যেতে কান ঝরে পড়ে, খসে পড়ে একদিন’ আর তারপরেই পৃথিবীতে ‘কানহীন মানুষের যুগ’ অর্থাৎ নির্লজ্জতার সময়কাল সূচিত হয়সাতের দশকের শোষণ, নিষ্ঠুরতা, শঠতার পাশাপাশি বিমূঢ়তা বা গড্ডলিকা প্রবাহকে তিনি কানকবিতার মধ্যে পৌনঃপুনিক গল্পহীন গল্প বলেছেন

একটা কানকাটা মানুষের সঙ্গে কানকাটা মানুষীর বিয়ে,

লম্বা হয়ে বসেছে তাদের কানকাটা বন্ধুরা, ওই

তারা কনুই ডুবিয়ে

দই খেতে-খেতে কী এক কথায়

হেসে লুটিয়ে পড়ছে,

কেঁদে, ঘুমিয়ে পড়ছে বিছানায়।৩০

 

 

‘জিভ’ কবিতায় সারাদিন শুধু জিভের তড়বড় করে নড়ে ওঠা, মাঝে মাঝে গম্ভীর হয়ে ঠোঁটের দিকে জিভ তাকিয়ে থাকা, ফাঁক হওয়া ও বন্ধ হওয়া, মাঝে মাঝে ‘বাইরের জগৎ’ গোঁফের চুল জিভের ডগায় এসে লাগা ইত্যাদি চলতে থাকলে এভাবেই একদিন জিভ আশপাশের সমস্ত কিছুকে ঘেন্না করতে শিখে চিরদিনের জন্য খসে পড়তে চায়। চারদিকে জিভ খসে পড়ার ঘটনা ঘটার খবর বের হচ্ছে। আরও খবর নিয়ে রিপোর্টারের আপিস যাত্রা ওমুখে হাত চেপে হু-হু করে বাড়ি ছুটে আসার অস্থির চিত্র কবিতায় ফুটে উঠেছে৩১‘পা’ কবিতায় শাসকের দাপটের চালচিত্র ও আত্মসমালোচনা ফুটে উঠেছে। মানুষ ‘সেই জুতোর কথা’ বা শাসকের দাপট ভুলে যেতে চায়, অন্যদিকে নিজেদের ‘লকলকে জিভের কথা’ও মনে রাখতে চায় না। সাধারণ মানুষ জিভকে অদ্ভুতভাবে ব্যবহার করতে শিখেছিল সবকিছুর মধ্যে থেকেও লকলকে ‘সেই বিশাল জিভ দিয়ে জুতোর ধুলো, দুঃখ অপমান মুছিয়ে’ দেওয়ার কৌশল ও রপ্ত করেছিল। মানুষের স্বপ্ন, প্রেম, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং আরও অনেক কিছুর ওপর সেই ‘জুতো দাঁড়িয়ে থাকত’ঘুমের মধ্যে, ছাদের ওপর তার হেটে বেড়ানোর শব্দ শুনে মানুষ নিজেদের চোখকে ভয় পেতে দেখতেন সাধারণ মানুষের বয়ানে কবি-কথিত এই গল্পের বয়ানের বদল ঘটে। তাই হঠাৎ মানুষের অজ্ঞেয় একদিন জুতোর ভেতর থেকে একটা কালো, বাঁকা নখের ভারী পা বেরিয়ে আসে‘জুতোর ধুলো, অপমান, দুঃখ সব ঠিক ঠিক মোছা হয়নি’ বলে শাসকের অত্যাচার, শারীরিক নিগ্রহ চলে –‘লাথি মারল মুখে, পিঠে, থেৎলে দিল জিভ’মানুষের উপলব্ধি ঘটে যে জুতো নয়, সেই পা-ই সব। সেই ভারী পায়ের কথা ভাবলে বুক হিম হয়ে যায়। তাই সাধারণ মানুষের হয়ে ‘সেই জুতোর কথা’ লকলকে জিভের কথার পাশাপাশি নিজেদের কথাও ভুলে যেতে চাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই বিস্মৃতি এতটাই গভীর যে পৃথিবীতে ভারী পা-এর শব্দ ছাড়াও হাজার রকমের শব্দ আছে – এই কথাও ভুলে যেতে চাওয়ার প্রসঙ্গ উঠে এসেছে।৩২

 

 

খাবারের টেবিল হোক বা সিগারেটের টান, ছুঁচলো পেনসিল কাটা বা পাতার পর পাতা ওল্টানো, জুতোর পড়া – সব কাজেই আঙুলের কার্যকারিতা ও গুরুত্বকে কবি ‘আঙুল’ কবিতায় ধরতে চেয়েছেন আঙুলের কার্যকারিতাই মানুষের বুদ্ধির কাছে, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের চালচিত্রকে মানসপটে চিত্রিত করে – ‘মাথাকে তার পেছনের তিরিশ বছর, সামনের তিরিশ বছর, তার নির্বিকার, শান্ত, নির্বিরোধ তিরিশ বছর’আবার এই আঙুলই যেমন দাড়ি কাটতে সহায়তা করে, অন্যদিকে এই আঙুলগুলিই ‘ঠেলতে শুরু করে রেজরকে গলার ভেতর, চামড়ার ভেতর দিয়ে রক্তের ভেতর দিয়ে মাংস ঘেঁটে ঘেঁটে রেজরসুদ্ধ আঙুল এগিয়ে যেতে চায় হাজার হাজার কণ্ঠনালীর দিকে’৩৩পুরুষের বয়ানে লেখা ‘নাক’ কবিতায় নরুনের কথা মনে হ’লে নাক ছোটে, ‘গভীর কান্নায় জলে ভরে’ ওঠার প্রসঙ্গ এসেছে কর্মক্ষেত্রের ক্লান্তি, ঘরফেরত মানুষ নানারকম ‘গন্ধ’-এর মুখোমুখি হয়। গন্ধ চিনে চিনে তার নানা দায় বা আনন্দকর্ম সম্পাদনের নিত্যযাপনের ছবি ফুটে উঠেছে‘ফুটো দিয়ে নানান রকমের ঝোলের গন্ধ, নানান ধরনের গা-গরম করা বিছানার গন্ধ’-এর পরে ঘুমের মধ্যে নাগরিক হতাশা, গন্ধহীনতার কথাই ফিরে আসে‘ঘুমের ভেতর নাক আর এক নাকের কথা’, ‘হাজার হাজার নাক ডাকে হাজার হাজার নাকদের’ কথা ভাবলেও বাডাকলেও‘স্বপ্নে শহর কাঁপিয়ে শোঁ শোঁ করে নরুনেরা ছুটে’ এসে এক একটা নাকের কাছে বসে।৩৪ স্বভাবতই আমাদের বাংলা প্রবাদের কথা মনে পড়ে – ‘নাকের বদলে নরুন’ অর্থাৎ যা প্রাপ্য তার থেকে কম প্রাপ্তিই নাগরিক পুরুষের ভবিতব্য। জীবনানন্দীয় কাব্যভাষাকে আলতো করে ব্যবহার করেও কী অসামান্য অভিশপ্ত ক্ষয়িষ্ণু দাম্পত্যের চিত্র ফুটিয়ে তোলা যায় তার অন্যতম দৃষ্টান্ত ‘চোখ’ কবিতাপ্রেমিকার প্রেমের অনিঃশ্বেষ দৃষ্টিতে ‘যেন দিগন্তের দিকে, মাথার ওপর দিয়ে কোন স্থির অচঞ্চল জল স্রোতে তাকিয়ে’ থাকার চিত্র দিয়ে ‘স্বপ্ন দেখা শুরু’শেষে ‘সেই প্রতীক্ষিত রাত’-এর একান্ত নিবিড় মিলন মুহূর্তে ‘ঘন চোখে’ প্রেমিক ‘ভয়ংকর পাথরের চোখ’ দেখে ভয়বিহ্বল হয়ে ওঠে। প্রেমের এই বিনষ্টি, অতিনৈকট্যের অভিশপ্ত দাম্পত্যচিত্র আমাদের প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছোটগল্পগুলিকে মনে করিয়ে দেয় –

আজো আছি পাশাপাশি; আমাদের কোনও কিছু দেখতে হয় না বলে তোমার চোখের দিকে

চেয়ে থাকি একটানা, বুঝি, এইভাবে অগণন মানুষ

তাদের মানুষীর দিকে তাকিয়ে রয়েছে শান্ত হ’য়ে,

শান্ত হ’য়ে হ’য়ে ঘুমিয়ে পড়েছে ফের মানুষীর বুকে।৩৫

 

 

‘দাঁত – ২’ কবিতাটি একাধারে কয়েক পংক্তিতে একটি অসামান্য ছোটগল্প যা চলচিত্রের প্রকাশভঙ্গীকেও আত্তীকৃত করেছে। জীবনের গতানুগতিক নিত্যযাপনের চিত্র – ‘বছর যায় মাস যায় দিন যায় বাজার যায় দু’পাটি দাঁত’ বাড়ির টেবিলের ভূমিকা এই কবিতায় দাম্পত্য সম্পর্কের নানা ‘মুখোমুখি’ অবস্থার স্মারক। কর্মক্ষেত্রের ক্লান্তিকর অভিজ্ঞতা গতানুগতিক দাম্পত্যযাপনের বিবর্ণতাকে কোনও কোনও দিন অসহনীয় করে তুললে ‘হঠাৎ রাগে ঠক ঠক করে কেঁপে ওঠে দু’পাটি দাঁত, ভয়ে ঠক ঠক ক’রে কেঁপে ওঠে অন্য দু’পাটি দাঁত’ফলস্বরূপ ‘টেবিলের দু’পাশে মুখোমুখি বসে থাকে চার পাটি মাড়ি’ এই ক্ষয়াটে দাম্পত্যচিত্র ‘দাঁতের কাহিনী’ই ‘পর্দায় ফুটে বের হয়’‘হাজার হাজার পাটি দাঁত’-এর লোক নিজেদের যাপনচিত্রই দেখেকিন্তু ভবিতব্য ক্রোধের বহির্গমনহীন নিরুপায়তা –‘ঘরে ফিরে সারারাত জলে-ভরা বাটির ভেতর শুয়ে থাকে’৩৬

 

 

চার : সাত দশকের ভয়াবহতা অব্যাহত

কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ব্যক্তি-প্রসঙ্গের সঙ্গে সমীপ দেশকালের উপদ্রুত পরিস্থিতি জড়িয়ে যায়, তা কবির সময়-সমাজ সম্পর্কিত সচেতন দায়বদ্ধতারই প্রকাশকতাঁর কবিতায় ব্যক্তিসত্তা ও ব্যক্তি-অস্তিত্বের সংশ্লিষ্ট প্রসঙ্গগুলি ব্যক্তির সীমায়িত আয়তনকে প্রায়শই ছাড়িয়ে গিয়ে সমকালীন সমাজ-সভ্যতার নির্দেশকবুদ্ধদেবের কবিতায় সত্তরের দশকের মরিয়া কৈশোর-যৌবনের রক্তাক্ত আত্মক্ষয়ী সংগ্রামের কথা বারবার এসেছে৩৭উত্তমপুরুষে কথিত কফিন কিংবা সুটকেশ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলিতে আমাদের প্রাত্যহিক দিনযাপনের অভ্যাস-জীর্ণ গতানুগতিকতা, তার সমস্ত ক্লেদ, গ্লানি, নিঃসীম শূন্যতা, রিক্ততা ও নিঃসঙ্গতার পাশাপাশি বারুদের গন্ধে ভরা স্বপ্নমুগ্ধ প্রেমিক কিশোরদের আগ্নেয়াস্ত্র তুলে নেওয়া ক্ষুব্ধমূর্তির সত্তরের দিনগুলি উঠে এসেছেএই উপদ্রুত পরিস্থিতির তুমুল আলোড়নে যুকক-যুবতীর হৃদয়-বিনিময়ব্যাহত হয়, চাপা পড়ে, হয়ত বা অবসিত হয়ে যায় অনেকটা আবেগ বিহ্বলতা যুবকদের আদর্শকেও ভ্রান্তপথে চালিয়াছে, কিন্তু এই সংক্ষুব্ধ দিনগুলির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ‘একদিন’, ‘এপ্রিল ’৭১’, ‘মৃত আশুকে’, ‘মা’র জন্য চিঠি’, ‘স্বপ্ন, স্বপ্ন’, ‘ভোর হয়েছে, তবু’, ‘যারা’ প্রভৃতিকবিতায় ক্রোধে, ঘৃণায়, সংরক্ত ভালোবাসার আবেগে সাতের দশকের নতুন জীবনের স্বপ্নমুগ্ধ, কৈশোর ও যৌবনের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কথা কবি স্মরণ করেছেন৩৮ মধ্যবিত্তের আত্মতৃপ্ত, সুখবিভোর, জীবনযাপনের অসারতায় এই উপেক্ষিত, অবহেলিত বিপ্লবী সংগ্রাম-প্রয়াসকে ফ্যান্টাসির কল্পনায়, লঘুচ্ছলে বুদ্ধদেব দেখিয়েছেনমধ্যবিত্তের ভোগলালসা জীবনযাপনের অন্তঃসারশূন্যতার প্রতিকবির ব্যঙ্গ-তির্যক কটাক্ষ যেমন এখানে প্রচ্ছন্ন থাকেনি, তেমনি লঘুতাজড়িত হলেও সাত দশকের বিপ্লবীদের প্রতি কবির আন্তরিক সমবেদনা প্রকাশিত হয়েছে। ‘তৈরি হও’ কবিতায় সাধারণ মধ্যবিত্ত নাগরিককে উদ্দেশ করে মধ্যমপুরুষে সম্ভাষণে আত্মসমালোচনা, আত্মসমীক্ষার পাশাপাশি প্রস্তুতির বার্তা প্রকাশ পেয়েছে৩৯

 

 

হিমযুগ কাব্যগ্রন্থের ‘বন্দুকের গল্প’ কবিতায় সশস্ত্র সংগ্রামীর রূপক হয়ে ওঠে ‘বন্দুক’বন্দুকধারী বিপ্লবীসংগ্রামী সংকল্পের উত্তেজনায় বিনিদ্র থেকে শুধু স্বপ্ন দেখে হাজার হাজার বন্দুকধারী সহযোদ্ধার সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে রাষ্ট্রশক্তি বা অন্য কোনও প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিপক্ষকে আঘাত হেনে ঈপ্সিত নতুন সমাজ ব্যবস্থা, নবীন পৃথিবী ও জীবনধারা প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু তার উপর প্রচারের আলো পড়ে নানাভাবে বাধা এলে সে গোপনতা আশ্রয় করে তার বাধা হয়ে দাঁড়ায় প্রেমিকার জন্য প্রেমিকের ভালোবাসার কোমলতা, সন্তানের প্রতি পিতার বাৎসল্য, খল-স্বভাব কোনও নেতার সেন প্রতিষ্ঠানের দ্বারোদঘাটন, আর জনসাধারণের ভীরুতা ও লোভ। সে ভয় পায়, হয়ত আর কোনওদিনই বিপ্লবের সংগ্রাম শুরু করা যাবে না, কিন্তু তবু সে দিনের পর দিন, উপযুক্ত ক্ষণের প্রতীক্ষা করে, ভেতরে-ভেতরে কঠিন প্রস্তুতি নেয় –

...ভয়ে

নীল হয়ে ওঠে বন্দুকের বুক, দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, বন্দুক

লজ্জা দুশ্চিন্তা ঘৃণার মধ্যে তবুও অপেক্ষা করে, শুধুই অপেক্ষা করে

আর শক্ত হয় ভেতরে-ভেতরে।৪০

 

 

অব্যবহিত দেশ-কালের চাপে মানুষের স্বাভাবিক আবেগ-অনুভূতি স্পর্শাতুরতা হারিয়ে মানুষকে নিস্পন্দ পাথরে পরিণত করেপা, হাত, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস, কথা বলা, প্রেমিকার চোখের জল, মনে পড়া, সব পাথর হয়ে গিয়েশেষ পরিণতি প্রতিবাদহীনতায়‘যখন দাঁড়াই’ কবিতায় এরই কাব্যিক প্রকাশ ঘটেছে –

আস্তে আস্তে পাথর হয় পা, পাথর হয় হাত

পাথর হয়ে যায় আমাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস

পাথর হয়ে যায় কথা বলা পাথর হয়ে যায়

তোমার চোখের জল পাথর হয়ে যায় মনে পড়া, আর

পাথরের কানে ভেসে আসে স্বর-আমরা মানুষ নই

আমরা মানুষ ছিলাম না কোনওদিন৪১

 

 

‘ক্রমশ’ কবিতায় ‘কালো হয়ে উঠছে’ বাক্যাংশটি বারংবার ধুয়ার মতো ফিরে ফিরে এসে অস্বস্তি ও শূন্যতাকে প্রকট করা তুলেছে। কালো হ’য়ে উঠছে ‘জিভ’, ‘নিস্পন্দ দুপুর’, ‘আশা-আকাঙ্ক্ষা’ সবকিছু কালো হয়ে ওঠার মধ্যে ‘শুধু সাদা দুঃস্বপ্ন’ গলায় দমবন্ধ হয়ে নড়াচড়া করছে‘সাদা দুঃস্বপ্ন’ বিছানা থেকে শরীর কাউকেই রেয়াত করেনি।‘নিস্পন্দ হ’য়ে উঠছে’ বাক্যাংশটি বারংবার ধুয়ার মতো ফিরে ফিরে এসে ‘বাতাস’, ‘চোয়ালের হাড়’, ‘ফুলদানির ফুল’ প্রসঙ্গে। ‘সমস্ত কিছু’ নিস্পন্দ হয়ে উঠলেও শুধু ঢোক-গেলার বিকট শব্দে ঠক্ ঠক্ করে পাঁজরা খুলে পড়ছে, আতঙ্কিত মায়ের চিৎকার করে ছুটে আসার চিত্রসমগ্র নিরাপত্তাকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলেছে এক অনিশ্চিত সময়কেই চিহ্নিত করেছে৪২‘হেমন্তকাল’ কবিতায় ‘নিকষকালো আবছা আলোর বিশাল লম্বা টানেল’ প্রতীকায়িত হয়েছেতার দু’প্রান্ত থেকে ছুটে আসা দুটি মুখোমুখি দুই মোটর-সাইকেলের সংঘর্ষে অনির্দেশ্য কারণে ভয়ংকর রাগ আর আক্রোশে কাঁপতে থাকে ছায়াশরীরদের প্রতিশোধের রাজনীতি, খুনোখুনির চিত্র নতুন নতুনতর সংঘর্ষের ইঙ্গিতবাহীটানেল থেকে অজস্র ছায়াদের অজস্র মোটর-সাইকেল চড়ে বেরিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ার ছবি আরও সংশয় ও বিনষ্টির ইঙ্গিতবাহী কালবেলায় কবি ঝরে যাওয়ার, ক্ষয়ের, বিনষ্টির এই অস্থিরচিত্রের ভবিষ্যৎচিত্র মানসচক্ষে দেখতে চানএই সামগ্রিক ভয়াবহতাকে আভাসিত করতে গিয়ে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত সুররিয়ালিস্টিক আঙ্গিক ব্যবহার করেছেনএকটি বাস্তব অনুপুঙ্খকে আরেকটি বাস্তব অনুপুষ্পের সঙ্গে এমন ওলটপালটভাবে উপস্থাপিত করেছেন যে কোনও কোনও চিত্রকল্প আর শেষ পর্যন্ত বাস্তবানুগ থাকেনি –

তারপর আরও একদিন পৃথিবীতে আসে

হেমন্তকাল আর ছায়ারা গোল হয়ে বসে গল্প করে মানুষ সম্পর্কে৪৩

 

 

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সুররিয়ালিজমের সঙ্গে চলচ্চিত্রের কলাকৌশলের মিশেল, ক্যামেরাকে এগিয়ে-পিছিয়ে নিয়ে যে তির্যক-জটিল প্রতিভাস তৈরি করেন, তারও আভাস আছে হিমযুগ-এর কোনও কোনও কবিতায় পাওয়া যায়৪৪ ‘১৯৭৩’ কবিতায় এখনকার মানুষে-মানুষে সংযোগহীনতা, বার্তা-বিনিময়ের অভাবযথাযথ অভিব্যক্তি পেয়েছে কবি যে অস্থির সময়ের কথা বলছেন যখন ‘প্রতিটি বৃত্তে এক আশ্চর্য পৃথিবী’ যে ‘দিনগুলি’র কথা বলছেন ‘যখন সমস্ত কিছু হিমঘরে-বসে-দেখা পরীক্ষামূলক ছায়াছবির মতো’১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনা বাহিনির বিজয়কাহিনির ঝলক কবিতায় উঠে এসেছে –

জেনারেল অরোরার মতো হাস্যোজ্জ্বল

করমর্দন করার তালে তালে যিনি এগিয়ে যাচ্ছেন সামনে, জওয়ানদের দিকে,

বোঝাচ্ছেন দেশ কেমন বিপদ্‌গ্রস্ত আর কীভাবে এগিয়ে যেতে হবে সবাইকে৪৫

কিন্তু কোথাও কোনও নিরাপত্তা নেই। ‘হাজার ভঙ্গিতে’ পশ্চিমবঙ্গের দিনগুলি তখন ‘বৃষ্টি এবং ঝোড়ো বাতাস এক নাগাড়ে ঠুকরে যাচ্ছে শহর যখন প্রতিটি মোড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে গাড়ি, মানুষ খুঁড়ছে রাস্তা, রাস্তা খুঁড়ে খুঁড়ে উপড়ে আনছে সুতানটির রাখাল ছেলের শরীর’সাত দশকে মুখ্যমন্ত্রীর পরিস্থিতির সামাল দিতে সামগ্রিক ব্যর্থতা চারদিকে প্রকটতার সঙ্গে সঙ্গে ‘ভাবী পরিকল্পনার অজস্র ব্লু-প্রিন্ট’-এর আভাসও পাওয়া যাচ্ছে

 

 

চিত্রশিল্পী বিকাশ ভট্টাচার্যের (১৯৪০–২০০৬) কোনও কোনও ছবিতে যে-ভয়াবহতা বর্ণময় হয়ে রয়েছে, বুদ্ধদেবের হিমযুগ-এর অধিকাংশ কবিতাতেই আমরা তার অন্যভাবে প্রতিবেদন পাই‘সে আছে’ কবিতায় বিশ্বায়নের আগ্রাসী পদধ্বনি রয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে মানুষের নিঃসঙ্গতা ও আত্মিক সঙ্কটের ভয়াবহ ছবি প্রকট হয়ে উঠেছে। শুয়োরের মতো মানুষের নির্মম আত্মিক মৃত্যুর আবহ গোটা কবিতা জুড়ে তীব্র ব্যঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। একটা গল্পের আবহ কবিতাটিতে থাকলেও তা পাঠককে কোথাও নিয়ে পৌঁছোয় না। শান্তির বউয়ের ইচ্ছায় শান্তি কিনল ফ্রিজ, টেলিভিশন আর নিজের জন্য কিনল টাইপ-মেশিন। শান্তির বন্ধুরা, আত্মীয়-স্বজন তাকে ভালোবাসত অফিসের কাজ কীভাবে মানুষের ব্যক্তিসত্তাকেই গিলে খায় তার আভাস কবিতায় রয়েছে এর পরের অংশটি কাব্যভাষার স্বাতন্ত্র্যে কবি বুদ্ধদেবের লিখনকৌশলকে চিনিয়ে দেয় –

ভয়ে, গলা শুকিয়ে এল শান্তির

ফ্রিজ খুলে শান্তি খেতে গেল জল –

একটা শাদা হিম হাত ফ্রিজ থেকে

বেরিয়ে এসে শান্তির গলা টিপে ধরল৪৬

 

 

সেক্সের পিছনে ‘লিভিং’ মানে ‘ক্লাস’, ‘সোসাইটি’ থাকেমাস্টারবেটকারী লোক চূড়ান্ত একাকী এবং সে অসুস্থ সমাজের জাতক। লোকটি মানসিক অবস্থা অস্বাস্থ্যকর, কারণ সেক্সের ক্ষেত্রে একজন সঙ্গী চাই। যে লোকটি মাস্টারবেট করছে তার অর্থ তার কোনও সঙ্গী নেই, অথবা তার সঙ্গী জোটানোর মুরোদ নেই, অন্তত সঙ্গী নেওয়ার ক্ষমতা তার আছে কিনা তা নিয়েও সে দ্বিধান্বিত। সে সম্পূর্ণ একজন একাকী মানুষ, সমাজে তার স্বাভাবিক যৌনতার সুযোগ নেই। একটা অসুস্থ সমাজেই লোকে মাস্টারবেট করে। তবে এটা শুধু মুক্ত যৌনতার বিষয় নয়। বহু বিবাহিত লোকেরাও নিয়মিত মাস্টারবেট করেমানে যে ওই কাজটা করে তার কোনও সঙ্গী নেই বা যে সঙ্গী আছে তার সঙ্গে কোনও সম্পৃক্ততা নেই। তার গভীরে ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা রয়েছে যে সব অর্থেই সঙ্গীহীন মানুষ৪৭ আমাদের অনুমান, বুদ্ধদেবের কবিতায় বউ থাকা সত্ত্বেও মাস্টারবেশনের এই চিত্র মানুষের নিঃসঙ্গতাকেই প্রকট করে তোলে। কবিতায় উল্লিখিত দিনে ঘরে নিঃসঙ্গ শান্তি বউ-বাচ্চা শান্তির শালার বাড়ি গিয়েছিল ‘নীল হয়ে’ যাওয়া শান্তির কার্যাবলীর ইঙ্গিত বুঝে নেওয়ার জন্যে কবিতার প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধারযোগ্য –

নীল হয়ে, এক ঝটকায় শান্তি এল

ড্রয়িংরুমে, ঘুরিয়ে দিল টেলিভিশনের নব্‌,

ভেসে উঠল বিরাট বড় হয়ে

একজোড়া ঠোঁট, তারপর ‘থুঃ’, থুতু

ছিটিয়ে দিল শান্তির মুখে।৪৮

 

 

‘১৯৭৬’ কবিতায় ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের অবসানের মধ্যে দিয়ে ইতিহাসের কিছু ইঙ্গিত থাকার প্রসঙ্গ কবি বলেছেন‘ব্যথা-বেদনার মতো কিছু একটা থেকে যাক চিরকাল’ এই প্রত্যাশা মানুষের থাকে। তেতালার ক্লাস থেকে নিচে লাফ দেওয়া, কালো টুপি, কালো কেডস্, সোয়েটার পরে ভোরবেলা বাবার নোয়ানো পিঠ একটু একটু করে ‘ধূসর, ধূসরতম দেশে’ ‘কুয়াশায় মিলে-মিশে’ যাওয়ার অনিশ্চিত চিত্রের পাশাপাশি ‘নতুন একটা বছর’-এর ‘দরজা হবার কথা’, ‘চৌকো কাঠের ফ্রেমে ভারী পাল্লার মতো গম্ভীর হয়ে’ দাঁড়িয়ে থাকার ভবিষ্যৎ চিত্র আগামী দিনের ইঙ্গিতবাহী। 

  • সুমিত বড়ুয়া
  • তৃতীয়