প্রতিবাদ-প্রতিরোধের জয়

আজ গোটা বিশ্বের দিকে তাকিয়ে জয় গোস্বামীর, 'হিংসার উৎসব' কবিতাটা আমাদের মনে হয়, সময়ের এক নিঃশব্দ কথোপকথন। উৎপলেন্দু চক্রবর্তী সদ্য প্রয়াত হয়েছেন। তাঁর 'চোখ' ফিল্মটি দেখার অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে ফিল্মটি যখন চরম ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে গিয়েছে, সেই সময়ের অনুভূতি আর 'হিংসার উৎসব' কবিতায় জয়ের উচ্চারণ,' সকালে রুটির থালা টেনে নিলি? তরকারির পাশে/দ্যাখ তো কী ওটা? ওটা মানুষের চোখ।'(পৃষ্ঠা-১৬৯) 

 

 

সাতের দশকের শেষদিকে আমাদের প্রথম যৌবনের কালে সিনেমাহলে বসে উৎপলেন্দুর 'চোখ' ছবিটা দেখবার অভিজ্ঞতা এবং ছবির শেষপর্বে গোটা পর্দা জুড়ে ভেসে ওঠা একটা উপড়ানো চোখ - জয়ের এই কবিতার ভিতর দিয়ে, এই প্রৌঢ়ত্বেও মনে হল সেদিন আর এদিন- মেহের আলি যতই চিৎকার করে চলুক না কেন, তফাৎ আদৌ নেই এতটুকু। এত আটপৌরে শব্দচয়ন, কিন্তু এত নিগূঢ় শাব্দিক দ্যোতনা, 'আলু-ঢ্যাঁড়শের ফাঁকে কী ভাজা রে? বাচ্চার আঙুল।/ স্তনমাংস পাশের বাটিতে।'( পৃ-১৬৯) -এ বুঝি জয় গোস্বামীর পক্ষেই সম্ভব।

 

 

কবিতাতে কেবল আটপৌরেয়ানা নয়, প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের সংকল্পকে আদ্দিকালের বদ্দিবুড়োর ধারণা থেকে বের করে এনে একটা নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপিত করবার জন্যে মনের বাতি জ্বালা -এ কাজে জয় গোস্বামী সাম্প্রতিককালে এক এবং অনন্য। জয় যখন লেখেন, 'এবার খেতে পারলে খা। নয়তো চোরের ওপরে/রাগ করে শুয়ে পড় গে করবের তলার মাটিতে।'(পৃ-১৬৯) 

 

 

কবির এই ব্যঞ্জনা যেন আমাদের এক অতি বাস্তবতার নিগূঢ়  বোধের উপর উপস্থাপিত করে দেয়। এই যে 'হিংসার উৎসব' নামক কবিতাটিসেই কবিতার মধ্যে দিয়ে সেকাল-সমকাল এবং ভাবিকাল -এই সমস্ত কিছুর সন্মিলন ঘটাতে গিয়ে কবি যখন উচ্চারণ করছেন; এবার খেতে পারলে খা। অর্থাৎ, খেতে পারলে এবারেই পেট ভরবে। আর যদি খেতে না পারা যায়, যদি খাবারটা ফসকে যায়, তাহলে পেট ভরবে না। অর্থটা দাঁড়ায় উপোষী হয়ে থাকতে হবে তাহলে।

 

 

আর এই উপোষটা কিন্তু শুধু সমকালই নয় ভাবিকালেরও এই উপোষের যন্ত্রণা। খালি পেটের ব্যাথা আমাদের বিদ্ধ করবে। আমাদের দূরত্ব তৈরি করবে মানব সমাজের যাবতীয় ঋদ্ধতার সঙ্গে। মিতালি পাকানোর পাতানোর সমস্ত ধরণের ইচ্ছেকে। আমরা কি ইচ্ছের দাসানুদাস? নাকি ইচ্ছেকে আমরা পরিচালিত করি সমসাময়িকতার ভিত্তিতে? এখানে যেন একটা ছোট্ট ছয় লাইনের কবিতার মধ্যে দিয়ে সেই চিরন্তন প্রশ্নকে উসকে দিচ্ছেন কবি জয় গোস্বামী। আলু, ঢেঁড়সের মতো অতি সাধারণ আটপৌরে শব্দ ব্যবহার করে কীভাবে জীবনযন্ত্রণার এক নিগূঢ় সত্যকে, সমাজ জীবনের সামনে উপস্থাপিত করতে পারা যায়, তার জীবন্ত চলোচ্ছবি হয়ে এই কাল সমুদ্রে ভাসছে জয়ের কবিতাটি। কেবলমাত্র এই একটি কবিতায়ই নয়। সমগ্র গ্রন্থের সব কটি কবিতা। কিছু গদ্য কবিতা বা কিছু গদ্যলেখ, সমস্ত কিছুর মধ্যে দিয়েই আমরা প্রেমে প্রতিবাদে প্রতিবাদী জয় গোস্বামীকে আবার যেন নতুন করে আবিষ্কার করছি।

 

 

ঠিক যেন সেই রবীন্দ্রনাথের কথার মত, নতুন করে আবিষ্কার। আর সেই নতুন করে আবিষ্কারের জন্যই আমরা মাঝে মাঝে হারিয়ে ফেলি কবিদের সেই সতর্কবাণী, যা উচ্চারণ করেছিলেন কবিদের কবি শঙ্খ ঘোষমদ খেয়ে তো মাতাল হয় সবাই। কবিই শুধু নিজের জোরে মাতাল। "এই ঘরে পড়শি ছিল আমার লালন, এ- পল্লীতে/আসতেন কুবির গোঁসাই, এ নদীতে নাইতেন চন্ডিদাস/ কবির পাশের গাঁয়ে কবি ছিল, গানের পাশের গাঁয়ে গান। ..."(পৃ-৭১)

                   

 

ঘরের পাশে আরশি নগরে বাস করা পড়শীর খোঁজ, সে যেন সেই সত্যজিৎ রায়ের অটোগ্রাফার খাতায় রবীন্দ্রনাথের লিখে দেওয়া  কবিতাবহুদিন ধরে বহু ব্যয় করে দেখিতে গেছিনু পর্বতমালা, দেখিতে গেছিনু সিন্ধু। দেখা হয় নাই দুই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া, একটি ধানের শীষের উপর একটি শিশির বিন্দু। ঠিক এভাবেই যেন জয় গোস্বামী তাঁর প্রেমে প্রতিবাদে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন অন্তস্থল আর বহিস্থলের এক কেন্দ্রবিন্দুর চিরজাগরুক সত্ত্বাকে। সাধারণভাবে আজ যদি কোনও বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে কুবির গোঁসাই -এর কথা বলা হয়, হয়ত সে উত্তরই দিতে পারবে না। লোকায়ত জীবন ও ধর্মের এই বিশিষ্ট চরিত্রকে বহু পরিচিত লালনের সত্ত্বার সঙ্গে সংমিশ্রিত করে, সদ্য অতীতকে প্রলম্বিত অতীতে, চন্ডীদাসের কবিগানের শীর্ষবিন্দুতে উপস্থাপন করা -এক অদ্ভুত সমন্বয়ী চেতনা, এই চেতনার জন্যই ভয়কে জয় করে জয় গোস্বামীর কবিতা আমাদের কাছে এত বাঙ্ময় হয়ে রয়েছে। এত দিক চিহ্নবাহী হয়ে রয়েছে। এত আগামীর পদ শব্দবাহী কথামালার সমষ্টি হয়ে রয়েছে।

               

 

জয় যখন লেখেন; 'এ কোন গরলসুধা এল গেলাসে গেলাসে?'(পৃ-৭১) আমাদের যেন মনে করিয়ে দেয় কালকূটের সেই উচ্চারণ, অমৃত বিষের পাত্রে। আমরা বিষের পাত্রে অমৃত সুধা পান করতে উৎসুক এবং উন্মুখ। কিন্তু আমরা নীলকন্ঠ হতে পারি না। ধারণ করতে পারি না স্বকন্ঠে বিষ। হয় উদগার করে বিষ ঢেলে দিই সমকালের বুকে। নয়ত সেই বিষ পাকস্থলীতে চালান করে ডেকে আনি নিজের স্বেচ্ছামৃত্যু। সে মৃত্যুর সাম্রাজ্যে ভাসতে ভাসতে কোন ও গহীন অন্তর্লোকে আমরা পৌঁছতে পারি না। আর পারি না বলেই, 'বাড়ির কুয়োর মধ্যে বালতি নামালে উঠছে/ তোমার নিখোঁজ হওয়া লাশ!'     

 

              

সেই লাশ যেন আমরা খুঁজে বেড়াই। আমাদের, 'এই ঘরে পড়শি ছিল' কবিতাটি পৌঁছে দেয় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সেই কালজয়ী সৃষ্টি 'দূরবীনে'র হেমকান্তের জীবনের কুয়োতে বালতি পড়ে যাওয়ার ঘটনা, আর সেই ঘটনার ঘূর্ণিপাকে আমাদের জাতীয় আন্দোলন আর জাতীয় আন্দোলন পরবর্তী সময়ের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে হেমকান্ত, কৃষ্ণকান্ত আর ধ্রুব -এর ঘূর্ণিপাকের চিত্র। আর সেই ঘূর্ণিঝড়েই ভেসে উঠতে থাকে রঙ্গময়ী, ভেসে উঠতে থাকে বিশাখা। ভেসে উঠতে থাকে রেমির মত ক্ষণজন্মা নারীচরিত্র।

 

 

এই যে মহৎ ব্যক্তিত্বের চিন্তা চেতনার স্তরের সাযুজ্য, জয়ের কবিতায় লালন, কুবির গোঁসাই, চন্ডীদাস গরল সুধা আর কুয়োর মধ্যে বালতি নামালে উঠে আসা লাশ, সে যেন কোথায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় শীর্ষেন্দুর সেই উপন্যাসের শশী নামক চরিত্রটিতে। যে চরিত্রটি দেশমাতৃকার শৃঙ্খলমোচনের জন্য নিজেকে ফাঁসির প্রকাশ্যে সঁপে দিতে দ্বিধা করে না।

 

 

জয়ের প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের সংকল্প, কোথায় যেন আমাদের সতীনাথ ভাদুড়ীর জাগরী থেকে শীর্ষেন্দু -র দূরবীনের সেই চরিত্রগুলিকে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দেয়। আসলে যাঁরা প্রতিবাদে স্থিত হন, কোনওরকম জাগতিক চিন্তাভাবনা না করে, দেনাপাওনার হিসাব নিকেশ না থাকা এটা তাঁদের সৃষ্টির মধ্যে যে অদ্ভুত এক মায়াজাল বিকীর্ণ করে থাকে, সেই মায়াজাল আমাদের আগামীর পথ চলার একটা ভাবনা জুগিয়ে চলে। আমরা ভাবতে থাকি, আমরা আমাদের চেতনায় স্থিত হতে থাকি। সেই স্থিত-চেতনার মধ্যে দিয়ে একটা নবযুগ বারবার সংকল্পে আমাদের মনের মধ্যে যেন রণিত অনুরনিত হয়। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় সেই কবিতাকমরেড আজ নবযুগ আনবে না, চন্ডীদাস-লালন-কুবির গোঁসাই থেকে নজরুল, সুভাষ, বিষ্ণু, অমিয়, শামসুর, সুনীল, শক্তি, শঙ্খ -এই ধারাতেই জয়ের কলম চলছে, চলবে। জয় আমাদের বেঁচে থাকার জয়ের আনন্দকে কখনও নিরানন্দ হতে দেবেন না।

 

 

প্রতিবাদে জয়

জয় গোস্বামী

আনন্দ পাবলিশার্স

৮০০ টাকা

  • শঙ্খদীপ্ত ভট্টাচার্য