বাঙালিয়ানা

জাতি ছিল ধর্মভিত্তিক? নাকি, সংস্কৃতি কেন্দ্রিক? এই বিতর্কের সমাধান, আমরা ভেবেছিলাম গত শতকেই হয়ে গেছে। এখন কী ভাবব, সকলি গরলি ভেল?

 

 

রাঁধা তরকারিকে সবজিবলবার রেওয়াজ বছর পঞ্চাশ আগেও আম বাঙালির ছিল না। কাঁচা আনাজ আর রাঁধা আনাজ, উভয়কেই, 'তরকারি' বলতে বাঙালি অভ্যস্থ ছিল। এমনকি দেহাতি হিন্দিভাষীরাও অনেককাল বাংলায় থেকে, 'ডাল ভাত তরকারি' বলতে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছিলেন।  রাঁধা তরকারিকে 'সবজি' বলার চল বাংলার বাইরে থাকলেও বাংলার এই শব্দটা আমি প্রথম শুনি শ্রীমতী আমতা থিরোর কাছে। আমাদের তিরুদি। এসএসকেএমের উডবার্ণ ওয়ার্ডের এক দক্ষ নার্স।

 

 

ডাঃ সূর্য ভট্টাচার্য যখন প্রফুল্লচন্দ্র সেনের হাঁটুতে একটা অপারেশন (নি-রিপলেসমেন্ট নয়)করেন, তখন ওঁর সেবিকা ছিলেন তিরুদি। সেই পরিচয়ের সূত্রপাত। অজয় মুখোপাধ্যায় শেষ জীবনে উডবার্ণে ভর্তি হওয়ার, ওঁর শেষদিন পর্যন্ত সেবা করেছেন তিরুদি। চাঁইবাসা অঞ্চলের আদিবাসি খ্রিস্টান। অজয়বাবুকে ডাকতেন, 'বাবা'। তিরুদি বলতেন, বাবারা থালায় করে খাবার সাজিয়ে রেখে গিয়েছেন। এখন সবাই খাচ্ছেন। এখন বাঙালি সমাজ যত বহিঃর্মুখী হয়েছে, ততই হয়ত, 'দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে' -র দৌলতে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি, পোষাক, লব্জ, খাদ্যাভ্যাস এমনকি সামাজিক আচরণ, বাঙালির কাছ থেকেই হারিয়ে যেতে বসেছে। রাঁধা তরকারি এখন আর আম বাঙালির কাছে কেবলমাত্র 'তরকারি' নয়। কাঁচা আনাজ যদিও বা তরকারি নামে অনেক জায়গাতেই এখনও টিকে রয়েছে। কিন্তু রাঁধা তরকারি এখন প্রায় এপার বাংলার আম বাঙালির কাছে 'সবজি' তে রূপান্তরিত হয়েছে। যে এলাকায় বা বাড়িতে সেভাবে উত্তরপ্রদেশ বা বিহার কিংবা রাজস্থান, ছত্তিশগড়ের তেমন একটা প্রভাব প্রতিপত্তি নেই, সেইসব এলাকাগুলোতেও বাঙালির কথ্যরীতি, ভঙ্গিমার মধ্যে অদ্ভুতভাবে হিন্দি তথা রাজনৈতিক হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বেশ অনেকদিন ধরেই।

 

 

এই পরিস্থিতির মধ্যে যে একটা রাজনৈতিক সমাজতত্ত্ব কাজ করছে, বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে -এই বোধটা কিন্তু সার্বিক ভাবে বাঙালির মধ্যে আজও বিকাশ লাভ করেনি। ভাবি, সাধারণভাবে হয়ত আম বাঙালির কাছে নিত্য ব্যবহার্য শব্দের এই অদল বদল ঘিরে তেমন একটা মাথাব্যথা নেই। মাথাব্যথা অবশ্য কাল-অকালের মধ্যে খুব প্রকট হয়ে ওঠে, যখন প্রচলিত বাংলা শব্দ বা বাক্যের মধ্যে কোনওরকম আরবি 'ফারসি শব্দের ব্যবহার আমরা দেখতে পাই। 

 

 

তখনই একটা চারিদিক থেকে গেল গেল রব ওঠে। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দুধর্মের একটা সংযোগ ঘিরে এপার বাংলাতে যেমন একটা টানাপোড়েন চলতে থাকে। ঠিক তেমনভাবেই ওপার বাংলায় অর্থাৎবাংলাদেশে সেখানকার প্রাতিষ্ঠানিক ইসলাম ধর্মের সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির একটা অদ্ভুত টানাপোড়েন চলতে থাকে। এপারে হিন্দি সংস্কৃতি মিশ্রিত শব্দের বাহুল্যে যখন বাংলা ভাষার মূলগতিবিধিতাই পরিবর্তিত হতে থাকে, তখন তা নিয়ে বেশিরভাগ লোকেরই খুব একটা মাথাব্যথা দেখা যায় না। কিন্তু কেউ যদি প্রচলিত বাংলা ভাষার মধ্যে আরবি-ফারসি মিশ্রিত কোনও শব্দ এমনকি কোনও বাংলাভাষী মানুষ জলের বদলে, 'পানি' শব্দ ব্যবহার করে, তা নিয়েও আশেপাশের মানুষের ভ্রূকুঞ্চন নতুন করে দেখা দিতে শুরু করে। ঠিক একই অবস্থা হয় ওপার বাংলায় আরবি-ফারসি বর্জিত কোনও শব্দ যখন সাধারণ মানুষ ব্যবহার করেন, তখন সেই মানুষটির দিকে প্রাতিষ্ঠানিক সমাজ একটু ভিন্ন চোখে তাকাতে শুরু করে। ভাষার এ অদ্ভুত সাম্প্রদায়িকীকরণ, এটা কিন্তু '৪৭ -এ স্বাধীনতা -দেশভাগের অব্যবহিত পরে দুপার বাংলাতেই এত তীব্রভাবে কখনও প্রকট হয়ে ওঠেনি। বাঙালি মুসলমানের মধ্যে আরবি-ফারসি মিশ্রিত ধর্মীয় দোত্যনা সম্পৃক্ত শব্দের প্রতি এত অধিক পক্ষপাতিত্ব বিগত তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে বাংলাদেশে সেভাবে তীব্র হয়ে ওঠেনি। আর এই প্রবণতা বাংলাদেশে যখন খুব প্রকট হয়ে উঠতে শুরু করে, তার একটা অদ্ভুত প্রভাব এপার বাংলায়, বাঙালি মুসলমানের একটা অংশের মধ্যেও পড়তে শুরু করে।

 

 

বিশেষ করে নয়ের দশকের একদম সূচনাপর্বে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর, বাঙালি মুসলমানের মধ্যে যে খুব যন্ত্রণা বহুল যাপনচিত্রের সূচনা হয়, তার প্রেক্ষিতে অদ্ভুতভাবে একটা সাংস্কৃতিক সংকট, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে গোটা বাঙালির জীবনকেই ঢেকে দিতে শুরু করে। আর সেই সুযোগে পশ্চিমবঙ্গের সামগ্রিক বাঙালি সমাজের উপর হিন্দি, রাজনৈতিক হিন্দু সংস্কৃতি নানা ধরনের আঙ্গিকে একটা সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক অভিপ্রায় নিয়ে ক্রমশঃ প্রকট হতে শুরু করে। স্বাধীনতা আন্দোলনের একটা পর্যায়ে এই ধরনের সাংস্কৃতিক সঙ্কট বাঙালি জীবনে খুব জোরদার ভাবে নেমে এসেছে। জাতীয়তাবাদ যেভাবে আমাদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনে মূল উপাদান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে, তার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেই জাতীয়তাবাদের চরিত্রের মধ্যে একটা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের অনুসঙ্গ দানা বাঁধে শুরু করে। এই অবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক হিন্দু ধর্মের অনুসঙ্গ ধীরে ধীরে আকীর্ণ করে তোলে রাজনৈতিক হিন্দু জাতীয়তাবাদের চিন্তা চেতনার ভুবন।

 

 

ফলে ধীরে ধীরে এক অদ্ভুত সামাজিক পরিস্থিতি তৈরি হয়। যে পরিস্থিতির পাল্টা হিসেবে জাতীয় স্তরে উদ্ভব ঘটে মুসলিম জাতীয়তার ক্রমে তা একটা বড় রকমের বিভাজনের মানসিকতায় পর্যবসিত হয়। এই যে উনিশ শতকের নবত্থিত জাতীয়তার হিন্দুত্বকরণ, আর তার পাল্টা হিসেবে একটা বড় অংশের মুসলমান সমাজের মধ্যে মুসলিম জাতীয়তার বিকাশ, তা সর্বভারতীয় প্রেক্ষিতে এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করে। আর বাঙালি জীবনে তার এক ধরনের প্রভাব বিস্তার ঘটতে থাকে। এই প্রভাবে বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যে এক দুঃখজনক, দুর্ভাগ্যজনক বিভাজন ঘটতে শুরু করে। সেটি ঘটে পোশাকের ক্ষেত্রে। সেটি ঘটে খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রে। এমনকি বাঙালির সাংস্কৃতিক রীতির মধ্যে তেমনটা ঘটতে শুরু করে। মুসলিম লীগের বঙ্গীয় প্রাদেশিক শাখা, নেতৃত্বে নির্বাচনে অবিভক্ত বর্ধমানের আবুল হাশেম প্রার্থী হওয়ার পর, তাঁর বিরুদ্ধে মৌলবাদী শক্তি প্রচার করতে শুরু করেছিল, তিনি ধুতি পরেন।

 

 

অথচ উনিশ শতকের আলোকপ্রাপ্ত বাঙালি সমাজের হিন্দু-মুসলমান উভয়েই ধুতি পোশাকটিকে কখনও কোনওরকম ধর্মীয় দ্যোতনায় দেখেননি। অবিভক্ত বাংলার রাঢ় অঞ্চল; মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, বীরভূম, রাজশাহী ইত্যাদি যে এলাকাগুলি, সেখানকার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে শিক্ষিত আলোকপ্রাপ্ত সম্ভ্রান্ত বাঙালির মধ্যে, ধুতি পরবার রেওয়াজ যথেষ্ট পরিমাণে ছিল।

 

 

সাম্প্রতিক অতীতেও আমরা দেখেছি সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের মত কোনও রকম ধর্মীয় সংকীর্ণতায় আবদ্ধ না থাকা কিংবদন্তি লেখক, জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই, কাজের পোশাক হিসেবে ধুতিকেই ব্যবহার করেছেন। কিন্তু জাতীয় আন্দোলনের একটা স্তরে, এই ধুতি হয়ে উঠেছিল হিন্দুর পোশাক। সম্ভ্রান্ত মুসলমান সমাজের যাঁরা ধুতি ব্যবহার করতেন, তাঁদের প্রতি এক ধরনের সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী আক্রমণ মুসলমান সমাজেরই একটা অংশের মধ্যে থেকে করা হত। আক্রমণের শিকার বর্ধমানের আবুল হাশেমকে মুসলিম লীগের বঙ্গীয় প্রাদেশিক শাখার দলীয় নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পর খুব চরমভাবে হতে হয়েছিল। উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে সংস্কারবাদী আন্দোলন কীভাবে বাঙালি সমাজে একটা মেরুকরণের পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, তার অসামান্য বিবরণ প্রখ্যাত সাহিত্যিক গৌরকিশোর ঘোষ, তাঁর কালজয়ী জল পড়ে পাতা নড়ে, প্রেম নেইপ্রতিবেশী -এই ট্রিলজির ভিতরে করে গিয়েছেন।

 

 

সেখানে নিত্য ব্যবহার্য শব্দের মধ্যে কীভাবে সাম্প্রদায়িকতার বিষের প্রবেশ ঘটছে, তার এক অনবদ্য বিবরণ রেখেছেন গৌরকিশোর। কীভাবে কাকাতুয়া হয়ে উঠছে চাচাতোয়া, কলাপাতার সামনের দিকে খাওয়াটা হিন্দুদের রীতি। তাই কলাপাতা উল্টে নিয়ে খাওয়া হয়ে গেল মুসলমানদের আদত, না হলে হাদিসদের প্রভাবে, তার এক অসামান্য সামাজিক বিবরণ এই ট্রিলজির মধ্যে গৌরকিশোর রেখেছেন।

 

 

আমরা ভেবেছিলাম আমাদের অতীত ইতিহাসের এই বিয়োগান্তক মর্মস্পর্শী দিকগুলি হয়ত আমরা অতিক্রম করে আসতে পেরেছি। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আমাদের প্রার্থনা ছিল, আমরা চলি সমুখ পানে, কে আমাদের বাঁধবে রে। রইল যারা পিছুর টানে, কাঁদবে, তারা কাঁদবে রে- সে প্রত্যাশা আমাদের সময়ের নিরিখে নানা উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে গেলেও, আমরা কিন্তু আশাভঙ্গ হইনি। আমরা কিন্তু একবারের জন্যও মনে করি না, এই সংকট থেকে, এই তমসা পূর্ণ পরিবেশ-পরিস্থিতি থেকে আমরা উত্তরিত হতে পারব না। এই উত্তরণে আমাদের হাতিয়ার রবীন্দ্রনাথ। আমাদের হাতিয়ার নজরুল, আমাদের হাতিয়ার কাজী আবদুল ওদুদ। অন্নদাশঙ্কর। সুফিয়া কামাল। গৌরকিশোর ঘোষ। গৌরি আইয়ুবের মত মানুষেরাই। 

  • সম্পাদকীয়