সৈয়দ মুজতবা আলীর জীবন ও সাহিত্য সমালোচনার বিকল্প পাঠ

আমাদের স্মৃতির ইমারতে মাঝে মাঝে উঁকি দেওয়া চরিত্রগুলো ঘিরে চর্চার ধারা এখন প্রায় শুকিয়ে যেতে বসেছে। সেই ধারাকে পুনরুজ্জীবিত করবার প্রয়াস এই গ্রন্থ-
সৈয়দ মুজতবা আলীকে (১৯০৪-১৯৭৪) নিয়ে এন জুলফিকার সম্পাদিত ‘সৈয়দ মুজতবা আলী স্মৃতি সত্তা সাহিত্য’  বইটি বেশ চমকপ্রদ একটি উপস্থাপনা। লেখক ব্যক্তিত্বের নানা অচেনা তথ্য খুব সাবলীল ভঙ্গিতে হাজির করা হয়েছে। যেমন আশরাফ সিদ্দিকীর স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে দুটি তথ্য। এক. রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র সংকলনের প্রাথমিক পরিকল্পনায় মুজতবাও অংশীদার ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলিকে সংকলনভুক্ত করতে তিনিই অসংখ্য চিঠির কপি তৈরি করে বিশ্বভারতী প্রেসকে সাহায্য করেন। দুই. ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ প্রণেতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিকশনারি কপি করার কাজও তিনি করেছেন। অংশত এই শব্দকোষ সম্পর্কিত কাজের অভিজ্ঞতাই পরবর্তীকালে তাঁকে প্রেরণা দিয়েছে ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক চর্চায়। যদিও প্রথম কাজটা মুজতবার পক্ষে করাটা আকস্মিকও নয়, অপ্রাসঙ্গিকও নয়, কারণ হীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতিচারণা (পুনর্মুদ্রিত) অনুযায়ী তিনি শান্তিনিকেতনের মানুষ। ওখানকার সংস্কৃতির অংশস্বরূপ এবং এই কাজের জন্য যোগ্যতম ব্যক্তিত্ব। তবে এই তথ্যসমূহ এটাই প্রমাণ করে যে একটা বই, বিশেষ করে শব্দকোষ বা রবীন্দ্র চিঠিপত্রের সংকলনের মতো বিরাট অথচ গবেষণার জন্য দরকারী বইয়ের মুদ্রিত রূপ, বাস্তবায়িত হওয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকা প্রেসের মানুষের শ্রমবহুল অথচ প্রয়োজনীয় কাজের স্বীকৃতি সবসময়ে যথার্থভাবে হয়নি।

 


তাঁর জনপ্রিয় গ্রন্থ ‘দেশে বিদেশে’-র পাণ্ডুলিপি পরিমার্জন নিয়ে শিলাদিত্য সিংহরায়ের আলোচনাও মুজতবাকে নিয়ে গবেষণার নতুন অবসর তৈরি করে। সাধারণভাবে তাঁর লেখা পড়লে মনে হতে পারে যে আড্ডার কথোপকথন ভঙ্গিতে বক্তব্যের সূত্র অনুযায়ী তাঁর যা যা মনে এসেছে তাই হয়ত লিখে দিয়েছেন কোনও কাটাছেঁড়া না করেই। কিন্তু আদতে এই আপাত যত্নহীন আগোছালো ভাবটাও যে ‘যত্ন’ করেই লেখক মুজতবা করতেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর এডিট করা পাণ্ডুলিপির সঙ্গে প্রকাশিত গ্রন্থের তুলনা করলে। লেখক হয়ে নিজের লেখাকেও নির্মমভাবে সংশোধন করেছেন। ‘লেখক’ হিসেবে মুজতবার স্বীকৃতি ঘটেছে বেশ বিলম্বেই। সে বিষয়ে দৃকপাত করেছেন আবদুশ শাকুর (পুনর্মুদ্রিত)। তাঁর বক্তব্যে উঠে এসেছে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৯২-১৯৭০) ‘বাংলা সাহিত্যে বিকাশের ধারা : আধুনিক যুগ’ গ্রন্থে মুজতবার অন্তর্ভুক্তি না হওয়ার কথা। গ্রন্থটির ১ম সংস্করণ ১৯৫৯ খ্রি., ২য় সংস্করণ ১৯৬৩ খ্রি., ৩য় সংস্করণ ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত। এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স-মাস্টার্সের তৎকালীন পাঠক্রমে প্রথম সংস্করণেই অন্তর্ভুক্ত হলেও মুজতবা সেই লেখক তালিকার নির্ঘন্টে ছিলেন না। ততদিনে ‘দেশে বিদেশে’ (১৯৪৯ খ্রি.) এবং ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘পঞ্চতন্ত্র’ শিরোনামে লেখাসমূহের সংকলনের ১ম পর্ব (১৯৫২ খ্রি.) প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে। 

 


বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদক মুজতবা সম্পর্কে দিলীপ ঘোষের প্রবন্ধটিও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। মুজতবার যাবতীয় ছোট ছোট লেখার মধ্যে বিশ্বসাহিত্যের অনু-পরমাণুর স্বাদ লেখক পাইয়ে দেন কোনওরকম আত্মপরিচয় না দিয়ে। ওমর খৈয়াম, হোমার, চেকভ, মপাঁসা, টলস্টয়ের লেখার টুকরো অংশ ছড়িয়ে আছে ‘পঞ্চতন্ত্র’(১ম ও ২য় পর্ব), ‘ময়ূরকণ্ঠী’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘কত না অশ্রুজল’ বইয়ের একাধিক লেখায়। এছাড়া আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরির সারাংশ, হিটলারের জীবনীর অনুবাদ সেগুলোও অনায়াস দক্ষতায় হাজির করেছেন। তাঁর অনুবাদধর্মী উপন্যাসগ্রন্থ হিসেবে উল্লেখযোগ্য ‘প্রেম’ শীর্ষক উপন্যাস, যার মূল উৎস-গ্রন্থ রুশ ধ্রুপদী ঘরানার লেখক নিকোলাই সেমিত্তোনোভিচ লেসকভের লেখা ‘Ledi Makbet Mtesenskovo Uzeda’(১৮৬৫ খ্রি.) বইটি। কিন্তু এক্ষেত্রে আলোচকের খেদোক্তি সব মুজতবা রসিকের মনের কথা বলে। বহুভাষাবিদ মুজতবা চাইলে আরও অনেক কিছুই দিয়ে যেতে পারতেন। সে তুলনায় কমই পেয়েছে বাংলা সাহিত্য। এই গ্রন্থে সংকলিত দিলীপ ঘোষের আর একটি লেখা ‘মুজতবা আলী : সংবাদ মূলত সাহিত্য’ শীর্ষক লেখা যেখানে প্রাবন্ধিক একটি তর্ক উশকে দিয়েছেন। সেটি হল এই যে নিয়মিত সংবাদপত্রের পাতায় লিখে চলা কলামনিস্ট মুজতবার সমকালীন তথ্যধর্মী লেখাগুলিকে কি সংবাদের শিরোনামে চিহ্নিত করা যায় নাকি সেগুলো আসলে সাহিত্যের অংশ। তার কারণ সংবাদের বিচার বিশ্লেষণও তো এখন ‘soft news’ হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে লেখা বিশ্লেষণগুলিকে সংবাদ না সাহিত্য কোন শিরোনামে পড়া যায় সে বিষয়ে পাঠক ভেবে দেখতে পারেন। 

 


জুলফিকার সম্পাদিত প্রাগুক্ত গ্রন্থের আলোচনাসমূহ তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত। সাহিত্য সমালোচনা, স্মৃতিচারণা, জীবনী। এর মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য জীবনী অংশটি। কারণ এ পর্যন্ত মুজতবার গোটা জীবনকে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ এবং প্রামাণিক কোনও কাজ হয়নি। ভীষ্মদেব চৌধুরীর এ বিষয়ে একটি লেখা বাংলা একাডেমি ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। সেটিকে সংগ্রহ করে এই সংকলনগ্রন্থে যুক্ত করার কৃতিত্ব সম্পাদকের প্রাপ্য। এর পাশাপাশি মুজতবার সংক্ষিপ্ত তথ্যভিত্তিক জীবনপঞ্জি বা সাল অনুযায়ী নির্ঘন্ট যোগ করায় বিষয়টি সুসংগত হয়েছে। সাহিত্য সমালোচনা অংশে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর সাহিত্যপাঠের পটভূমিকা হিসেবে গৃহীত হতে পারে। যেমন ‘দেশে বিদেশে’-র ভাবনাবিশ্ব নিয়ে তপোধীর ভট্টাচার্যের উপলব্ধি যথার্থ মনে হয়, ‘দৃষ্টান্তের অপেক্ষায় না থেকে বইটি বারবার পড়ে নেওয়াই কাঙ্ক্ষিত। ভূগোল-ইতিহাস-রাজনীতির ত্রিবেণী সঙ্গম আর রকমারি মানুষের সমারোহ যে রসের নির্ঝর তৈরি করেছে, তাতে অবগাহনের আনন্দই আলাদা’। অর্থাৎ পরের মুখের ঝাল না খেয়ে মুজতবা সৃষ্ট রসের স্বাদ না নিলে পাঠকেরই ঠকবার সম্ভাবনা প্রবল। বিষ্ণু বসুর লেখায় উঠে আসে মুজতবার লেখাগুলিকে চিহ্নিত করার জন্য যথার্থ শব্দবন্ধের অনুসন্ধান, যেহেতু এগুলিকে কোনও একটি নির্দিষ্ট সংরূপে বেঁধে ফেলবার অসুবিধে রয়েছে। তাঁর লেখায় সেজন্য ব্যব্যহৃত হয়েছে ‘ননফিকশনাল প্রোজ’ বা নকাল্পনিক গদ্যসাহিত্যের ধারণা যাকে সামগ্রিক ভাবে ‘রচনা’ হিসেবে ধরা যেতে পারে। মুজতবার পাণ্ডিত্যবহুল এবং বহু সম্ভাবনাময় লেখাগুলিকে তিনি একটা বড়ো পরিসর দিতে চেয়েছেন। পৃথ্বীশ সাহার পঠনে ‘চাচাকাহিনী’র একটি সংক্ষিপ্ত অথচ প্রয়োজনীয় বিশ্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সংযুক্ত করা হয়েছে মুজতবার জর্মানি বাসকালীন সময়ের। সেখানে জার্মানির উত্থানের ইতিহাস এবং তার পশ্চাদবর্তী কারণটি শুধু ‘চাচাকাহিনী’ নয়, মুজতবার আরও অনেক লেখার পূর্ববর্তী আবশ্যিক পাঠ হিসেবে গৃহীত হতে পারে। নূরুর রহমান খান এবং মলয় মণ্ডল, এঁদের আলোচনায় মুজতবার গদ্যের ভাষা অনুসন্ধানও লেখক-মুজতবার আস্বাদ্যমানতার রহস্য উন্মোচন করে। যেমন মলয়ের পাঠ অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ‘মুজতবা আলীর আরবি-ফারসি কিংবা জার্মান ভাষার সঙ্গে সখ্যতা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে নতুন রক্ত আনতে সক্ষম হয়েছে’। একাধিক ভাষায় দক্ষ হওয়ার কারণে মুজতবা একই সঙ্গে একাধিক ‘কোড’ ব্যবহার করেছেন যা একই সঙ্গে বক্তব্য ও তার প্রকাশভঙ্গিকে বৈচিত্র্যের আস্বাদ দেয়। নুরুর রহমান খানের বক্তব্যও প্রায় কাছাকাছি, ‘তাঁর অবলম্বিত গুরুচণ্ডালিতে শুধুমাত্র সাধু-অসাধু নয়, ‘যাবনিক’ শব্দের সঙ্গে একই পংক্তিতে সংস্কৃত-জার্মান-ফরাসি-ইংরেজি-রাঢ়ী-বারেন্দ্র-বাঙ্গাল শব্দ অতি অবলীলায় আপন আপন স্থান বেছে নিয়েছে’। সাধন চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় মুজতবার ছদ্মনাম বৈচিত্র্য, বরেন্দু মণ্ডলের বিশ্লেষণে মুজতবার জীবনের আন্তর্জাতিক মানচিত্র ও গ্লোবট্রটার সত্তা, তৈমুর খানের বীক্ষণে ‘কবি’ সৈয়দ মুজতবা, বিকাশ রায় ও অরুণা চট্টোপাধ্যায়ের আলোচনায় মুজতবার নারী চরিত্র, ফাল্গুনী ভট্টাচার্যের দেখায় শিক্ষাবিদ মুজতবার মূল্যবান গবেষণা মুজতবার বৈচিত্র্যময় সত্তার উন্মোচনে সমর্থ। তবে আলোচ্য গ্রন্থের সাহিত্য সমালোচনা অংশে একই বিষয়ের পুনরুত্থাপন একটু ক্লান্তিকর ও একঘেঁয়ে বলে মনে হয়। স্মৃতিচারণায় গৌরী আইয়ুবের মুজতবা প্রসঙ্গে আইয়ুব ও মুজতবা এই দুই বন্ধুপ্রতীম ও সতীর্থ পণ্ডিত ব্যক্তিত্বের ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানাপোড়েনের কথা জানা যায়। সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, গৌরকিশোর ঘোষ বা খোদেজা খাতুনের ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় মানুষ মুজতবার উজ্জ্বল কিছু মুহূর্ত আলোকিত হয়েছে। তবে দেশভাগের যন্ত্রণা মুজতবার ব্যক্তিগত জীবনে যে দ্বিধা-সংকোচ আর সমস্যার সৃষ্টি করেছিল তার পরিচয় আছে গৌরী আইয়ুবের স্মৃতিচারণে। তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত কেমন কেটেছিল তার বর্ণনা আছে গোলাম মোস্তাকীমের লেখায়। এ বর্ণনা প্রায় প্রত্যক্ষ দর্শনের মতোই গভীরতা আনে যা পড়ার পর মনে হয় একটা প্রাণোচ্ছ্বল জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটল। লেখাগুলির বিন্যাসে সম্পাদকের অভিজ্ঞতা আর পরিণতমনস্কতার ছাপ চোখে পড়ে। গ্রন্থটি একাধারে মুজতবা সমালোচনা-গবেষণা এবং জীবনী বিষয়ক চাহিদার বিকল্প হতে পারে। 

 

সৈয়দ মুজতবা আলী: স্মৃতি সত্তা সাহিত্য
সম্পাদনা- এন জুলফিকার
অভিযান পারলিশার্স
৭০০ টাকা

  • ব্রতী গায়েন