বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কাব্যগ্রন্থ হিমযুগ : ছয় দশকের সংশয়িত ‘সূর্যকরোজ্জ্বলতা’র উত্তরাধিকার

বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে ‘সন্ত্রাসকালের বীর্য’ ততটা নয়, ‘জ্বালা, ঘৃণা ও কারুণ্য’ই তীব্রভাবে স্পর্শ করেছিল। কিন্তু তাঁর আবেগ বিস্তৃত হলেও তা অনেকটাই উপরিতলের, দেশের এই স্থায়ী প্রতিকূল অবস্থাটাই বেশি বিপক্ষে ছিল। ফলস্বরূপ তাঁর কবিতা ‘আর্ত নয়, ক্ষুব্ধ; গভীর নয়, স্মার্ট; সরাসরি নয়, প্রতীক ও প্যাটার্নে অন্বিত’। ‘দ্রুত, উত্তেজিত, খোলামেলা ও উদ্ভট চিত্রে’ আকীর্ণ তাঁর ছয় দশকের কবিতা ‘বলিষ্ঠতা, নতুনত্ব ও সাম্প্রতিকতা’র জন্য প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই সমাদৃত হয়েছিল। ১১

 


‘পৃথিবী’ কবিতায় যুক্তি এবং অ্যাবসার্ডিটি একসঙ্গে চলেছে। ব্যাঙ থেকে ব্যাঙাচির বিবর্তনের উল্টোদিকে যে মাৎসান্যায়ের চিত্র রয়েছে তা অসম্ভব ‘ছোট মাছ গিলে ফেলছে বড় মাছ’ বা ‘মানুষের মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে ছাগল’। আবার পাগলের পাগলামির সঙ্গে আগামী বিশ্বায়নের আভাস দ্রষ্টা কবির মানসচক্ষে ফুটে উঠেছে, কিন্তু আবার তা মুহূর্তেই অসাম্ভাব্যতাকে জাপ্টে ধরেছে, তাইপৃথিবীর ছোট হতে হতে চামড়ার বল হয়ে যাওয়া, সোঁ-সোঁ করে ফাঁকা একটা গোলপোস্টের দিকে এগিয়ে যাওয়া, মিলেমিশে অর্থ ও অর্থহীনতার পথে অধিবাস্তবের জটিল চিত্র তৈরি করেছে। ১২

 


‘চলো যাই’ কবিতায় অধোগামী পিঁপড়েই এখন জীবনের আদর্শ, তার মতো সরু গর্তই আমাদের আকাঙ্ক্ষিত আশ্রয়। ধ্বনিত হয়েছে অধোগমনের আহ্বান: ‘চলো আরও নিচে নেমে যাই’।
ওইখানে রয়েছে নাকি আলো, রয়েছে কি 
সূর্যকরোজ্জ্বলতা, আমরা যা চেয়েছি চিরদিন, 
চলো, সরু গর্ত ভেতরে, চলো নিচে নেমে যাই ১৩

 


অতীত-ভবিষ্যত স্বপ্নহীন সময়ে গর্তের ভেতরে সেঁধিয়ে যাওয়ার কথা, ‘অর্থহীন বোঁচা কালো ভোর’, আরও নিচে নামার কথাই কবিতার মূলসুর। কবিতায় শ্রমশ্রান্ত মানুষের কাছে ধৈর্যবান, কঠোর-পরিশ্রমী, সংগ্রহপ্রবণ, লাল পিঁপড়ের শ্লাঘনীয় দৃষ্টান্ত ছিল। লাল পিঁপড়েকে দেখলেই তার পিঁপড়ে জন্মের কথা মনে পড়ে যায় –
লাল পিঁপড়ে, যখনই তোমাকে দেখি, মনে পড়ে
আমার পিঁপড়ে-জন্মের কথা।
আর এইটুকু ছোট্ট পিঁপড়ে-বৌ অপেক্ষা করত কখন, 
কখন ফিরে আসব ঝুরঝুরে ঘরে,
কোনওদিনই এসে পৌঁছতে পারতাম না আমি। ১৪

 


আগামী জন্মে সে এক ভারবাহী বলদ হবে, যার ‘পিঠের দু’পাশ দিয়ে বিশাল চিনির বোঝা ঝুলে পড়েছে আর সে টলতে টলতে এগিয়ে চলেছে।রহস্যময় উপন্যাসে বুদ্ধদেব লিখেছেন –

 

আবার নতুন করে শুরু করা যায় না? একেবারে প্রথম থেকে? তা হলে যত ভুল করেছে অর্ণব তার সবটাই শুধরে নিত সে। খুঁজে বার করতই তার চারপাশে সেইসব অত্যল্প মানুষদের যাদের সঙ্গে তার আসল কথা বা যোগাযোগ হতে পারত। বা খুঁজে বার করত সেই পৃথিবী যেখানে গোপন মায়ার মতো আরও কিছু আছে। যেখানে কথা শব্দের চেয়েও সহজ কোনওভাবে প্রকাশ করা যায়। শব্দ ব্রহ্ম। একবার বললে আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না।' জয়া বলেছিল যেদিন বিয়ের সময়টা আরও অন্তত এক বছর পিছিয়ে দেওয়ার ইচ্ছাটা জানিয়েছিল অর্ণব। তার কথা দেওয়া সময় থেকে পিছিয়ে এসে। শব্দ ব্রহ্ম নয়। শব্দের কোনও মানে নেই। শব্দ শুধুই কিছু স্বর। শব্দকে কখনওই বিশ্বাস করা উচিত নয়। আজ যে শব্দ জন্ম নেয় কাল বা পরশু বা তারও কিছু পরে তা উড়ে যায় কোনও চিহ্ন না রেখে, কোনও বিশ্বাস না রেখে। জুড়ে বসে আর যেসব শব্দ আবার কিছু সময়ের জন্য, আগের শব্দের সঙ্গে তাদের কোনও মিলই নেই। এখন এসব বুঝতে পারে অর্ণব। যখন সত্যিই সময় ফুরিয়ে আসার সময় শুরু হয়ে গেছে।১৫

 


পরদিন দুপুরবেলা অর্ণবের আবার সেই ঘুসঘুসে জ্বর আসে। বাস্তব আর অধিবাস্তবের দোলাচলতায় জননান্তর স্মৃতি তাকে গ্রাস করে –
দেওয়ালে একটা ভাতকে ঠেলে নিয়ে চলেছে পিঁপড়ের সারি। একটা পিঁপড়ে আর একটা পিঁপড়েকে কিছু বলছে। তারপর এগিয়ে চলেছে আবার। অর্ণব পিঁপড়েদের ভাষা জানে না তবু বুঝতে পারল সব। আগের জন্মে পিঁপড়ে হয়ে জন্মেছিল অর্ণব। ছোটোবেলায় পিঁপড়েদের পেছন পেছন হেঁটে যতবার সেই গাছটির কাছে পৌঁছোতে, ততবার তার মনে হত জন্ম-জন্মান্তরের কথা। তার পিঁপড়ে-জন্মের কথা। তার পাখি-জন্মের কথা। তার ফুল হয়ে জন্মে ঝরে যাওয়ার কথা। সেই গাছটাও বেঁচে নেই। তার কথা বুঝত শুধু সেই গাছ। হাত বাড়ালে একটা পাতা প্রত্যেকবার ফেলে দিত তার হাতে।১৬

 


হঠাৎ থানা থেকে তিনজন পুলিশ এসে ‘অর্ণব সরকার’কে কোনও কারণ না বলেই থানায় যেতে বলেন। অর্ণব যাবে, কাউকে আর খবর পাঠাতে হবে না বলে জ্বরের ঘোরে, একটু পরেই মাটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ‘যেন বহুকাল এখানেই আছে’ এমন তাঁর মনে হয়। আবার স্বপ্ন ঘিরে আসে –
স্বপ্নে এসেছিল সেই গাছ। ডাল নামিয়ে দিয়েছিল তার মাথায়, চুলে, শরীরে। খোলা হাতের ভেতর সবুজ একটা পাতা রেখে গিয়েছিল। স্বপ্নে এসেছিল তার আগের জন্মের পিঁপড়ে-বউ। অনেক কথা হল তার সঙ্গে। জন্ম-জন্মান্তরের কথা। অনেকদিন অপেক্ষা করে আছে তার পিঁপড়ে-বউ তার জন্য। অর্ণব তাকে বোঝাল। আর তো কিছু বছর। তারপরই আবার তারা সংসার পাতবে। এঁকেবেঁকে উঠে যাবে গাছের গুঁড়ির ওপর তাদের ঝুরঝুরে ঠান্ডা আধো-আলোর মাটির ঘরের ভেতর।১৭

 


থানায় গেলে অভিযোগের সাপেক্ষে অর্ণবকে জেলে পাঠানো হয়। জেলের ভেতর এক মাস অতিক্রান্ত। এখন কারোর কথাই তার মনে পড়ে না, এমনকি মায়ার কথাও নয়। ভোরের দিকে যখন তন্দ্রালস চোখ প্রায় বুজে আসে, হইহই করে সবাই চা জল-খাবারের জন্যে তাড়া পড়ে যায়, তখনও অর্ণবের কোনও তাড়া থাকে না। সকালে কয়েদিদের কাজকর্ম ও স্নানের পরে সকলের সঙ্গে খেতে খেতেও অন্যবোধে সে আক্রান্ত হয়–
পৃথিবীটা আসলে বিশাল লম্বা একটা চাদরের মতো, ভেসে চলেছে মেঘের ওপর দিয়ে, মেঘের ভেতর দিয়ে আর সেই চাদরের ওপর বসে আছে সে। নিচে তাদের গড়িয়ার বাড়িটা দেখা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে পাইকপাড়া, রেখাদের বাড়ি, দেখা যাচ্ছে চক্রধরপুরের রেলস্টেশনের পাশে স্টেট ব্যাঙ্ক- ঘাড় নিচু করে কাজ করছে অশোক, অশোকের বাড়িতে ঘুমিয়ে আছে জয়া, ওই তো মানবোধ, টেবোর রাস্তা দিয়ে মহুয়ায় বুঁদ হয়ে টালমাটাল হেঁটে যাচ্ছে। নিচে তার ভাতের থালায় উঠে আসছে পিঁপড়ে। ঠেলে নিয়ে চলেছে একটা ভাতকে, অনেক দূর অনেক দূর যাবে সে। ১৮

 


উপন্যাসে অর্ণব-জয়ার ভালোবাসা কোনও পরিণতিতে উত্তরিত হয়েছে এমনটা বলা যায় না। জয়া চলে ছেড়ে চলে যায়। অর্ণব আবার অধিবাস্তবের আওতায় পড়ে যায়। উপন্যাসের এই অংশটির মধ্যে ঔপন্যাসিকের মানসগঠনের ছাঁদ লক্ষ করা যায় যা আংশিক উদ্ধৃতিযোগ্য –
...তার এক সময় টের পায় সেই উড়ন্ত চাদরটা নেমে এসেছে তার পায়ের তলায়। তারপর অর্ণবকে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে অনেক দূরে। উড়তে-উড়তে চারদিক অন্ধকার হয়, তবু উড়তে থাকে সেই চাদর। তার ওপরে বসে থাকে অর্ণব। আলো আসে, আলো নিভে যায় আবার। মেঘ আসে, বৃষ্টি হয়ে নামে। উড়ে যায় সেই চাদর বৃষ্টির ভেতর দিয়ে। শীতের ভেতর দিয়ে। গ্রীষ্মের ভেতর দিয়ে। আর অর্ণব বৃষ্টিতে ভেজে, শীতে কাঁপে, গ্রীষ্মে শুকায়।

 


কতকাল যে সেই চাদর অর্ণবকে নিয়ে উড়ে যায় অর্ণবের কোনও খেয়াল থাকে না। তারপর একদিন একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে থামে। দরজাটাকে চিনতে পারে অর্ণব। কতবার হেঁটে গিয়েছে একটা স্বপ্ন পেরিয়ে আর একটা স্বপ্নের দিকে এই দরজার ভেতর দিয়ে। দরজাটা তাকে ভুলে যায়নি আজও। অর্ণব ছুটতে শুরু করে। দরজাটার কাছে পৌঁছে হাত দেওয়া মাত্রই খুলে যায় সেই দরজা। অর্ণব হাঁটতে শুরু করে। বুঝতে পারে আবার একটা খেলা শুরু হল। হয়তো সম্ভব হবে এখানে। হাঁটতে হাঁটতে দেখা হয়ে যাবেই কারও না কারওর সঙ্গে যাকে সে বলতে পারবে সব। তার সমস্ত কথা বলতে না পারা, যোগাযোগ না করতে পারা, ইঙ্গিত না পাঠাতে পারা সব কিছুই হয়ত এ বার সম্ভব হবে। হয়ত শুরু হল তার নতুন জীবন। তার পিঁপড়ে-জীবন। তার পিঁপড়ে-বউ কতকাল বসে আছে। অপেক্ষা করে আছে তার জন্য। সব বলবে তাকে। তার পিঁপড়ে-বউকে। পিঁপড়ের ছেলে-মেয়েকে। পিঁপড়েদের বেঁচে থাকাও কম রহস্যময় নয়। ১৯

 
উপন্যাসের এই স্বপ্ন আর বোধগুলোই বীজাকারে কবি বুদ্ধদেবের কবিতায় কবিতায় ছড়িয়ে রয়েছে। চল্লিশ বছর পরে প্রকাশিত ভূতেরা কোথায় থাকে (২০১৭) কাব্যগ্রন্থের ‘করা না-করার কবিতা-১’য় পিঁপড়ে-জীবনের অনুষঙ্গে মানুষের যাপনচিত্র ফুটে উঠেছে। ব্যক্তিগত জীবন, যৌনজীবন বা অফিসের যে কোনও কাজেই উৎসাহহীন ‘আমি’ বা কবির আত্মজৈবনিক বয়ানে জতিস্মরের স্মৃতির রেখা জেগে উঠে পিঁপড়ে জীবনের মুখোমুখি করেছে, রচিত হয়েছে কাল্পনিক সংবদল –
কী করি কী করি ভাবতে ভাবতে একদিন 
একটা পিঁপড়ের পেছন ধরলাম 
চলতে চলতে আমি ভুলে গেলাম সব কিছু 
আর তখনই দেখলাম কোটি কোটি 
নানান রঙের পিঁপড়েদের পৃথিবী 
পিঁপড়েটা আমার কানের কাছে এসে বলল– 
সামনের জন্মে তুমি আবার পিঁপড়ে হয়ে 
আমাদের মধ্যে ফিরে আসবে। 
ওই দেখো তোমার পিঁপড়ে বউ 
যে এখন থেকেই প্রস্তুত তোমার জন্য, ওই দেখো 
তোমার পিঁপড়ে ছেলে আর পিঁপড়ে মেয়েরা 
কেমন খিলখিল করে হাসছে...২০

 


‘আমি’ ‘ফিশফিশ করে’ জন্মান্তরে মানুষ হয়েই ফিরে গিয়ে সিনেমা-কবিতা-গান-ভালোবাসায় থাকতে চাইলে পিঁপড়ে তা নাকচ করে দেয়। মানুষ জন্মে ফিরে গিয়েও ‘কিছু ভ্যানতাড়া’ও ‘হাজার গন্ডা শয়তানি’ ছাড়া আর কিছুই করা হয়নি। এইসব শুনতে শুনতে নিজের অজান্তেই আরেক জন্মান্তরে অনুপ্রবেশ ঘটে, যেখানে ‘পিঁপড়ে বউ’ তাঁকে মানুষের জীবনের কৃতকর্মের একটা আশ্বাসজনক কৈফিয়ৎ শোনায় তা উদ্ধারযোগ্য –
দেখলাম পিঁপড়ে বউ 
তার ঠোঁট বাড়িয়ে দিচ্ছে আমার দিকে 
জাপটে ধরেছে আমার পিঁপড়ে শরীর, আর বলছে –
আর মন খারাপ কোরো না, মানুষ তো ওরকমই হয় 
ওরকমই-ই তো হয়।২১

 


‘মানুষ’ কবিতায় ঠায় একজনের একটি বছর একটি চেয়ারে বসে থাকার ছবি রয়েছে। কিছু বলবে? তেতো, বিরক্ত হয়ে কাঠের চেয়ার কাঠ হয়ে উড়ে গেল গাছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি কিছু বলবে? পাখির বিষ্ঠা ফেলে যাওয়া, কাঠঠোক্‌রার কান খুঁটে খাওয়া, শেষে কাঠ ভেবে মানুষটিকে করাতকলের আশেপাশে নিয়ে যাওয়ার ছবির পরেও সেই এক প্রশ্ন, কিছু বলবে?কিন্তু কোনও উত্তর মেলেনি – ‘কেশে ওঠে হাজার হাজার কাঠ, হেসে ওঠে কাঠের ভেতরে’।২০ মানুষের এই না-মানুষ হয়ে ওঠার ইঙ্গিত কি কবি দিতে চেয়েছেন?

 


‘হাসি’ কবিতায় অতীতের হাস্যময় ‘অদ্ভুত সুন্দর’ দিনের কথা রয়েছে। দিনানুদৈনিক কাজে মানুষের মুখে হাসি ছিল, কিন্তু তারপর থেকে ক্রমে ক্রমে ‘শুধু হাসির শব্দ এক কান দিয়ে ঢুকে আজ শোঁ শোঁ করে বেরিয়ে যাচ্ছে অন্য কান দিয়ে’।২১এই ছবিও কি মানুষের ক্রমশ সংবেদনহীন হয়ে ওঠার ইঙ্গিতময়? ‘আকাশ’ কবিতায় ‘আকাশ’ বলতে ‘কালো ও গম্ভীর এক আকাশ’-এর কথা কবি বলেছেন যা চিরকাল মাথার ওপর ‘থমথম’ করত। ক্রমাগত মাথায় ‘আকাশ ভেঙে’ পড়ায় ‘সমস্ত আকাশ’ মানুষদের জন্য শেষ হয়ে গিয়েছিল। স্বপ্নের ভেতর ক্রমাগত ছুটে চলে অবশেষে ‘কালো ও গম্ভীর, আর থমথমে এক আকাশ’-এর কথা মনেও পড়ে না।২২এই কবিতায় আশ্রয়হীনতায় বেপথুমান মানুষের কথাই এখানে ফুটে ওঠে। ‘যেখানেই যাও’ কবিতায় কোনও এক ‘তেলেনাপোতা’র অদ্ভুত ‘থমথমে দেওয়াল, থমথমে হাড়পাঁজরা, থমথমে পাশের বাড়ি’তে বুড়ো কেশে যাচ্ছিল সারারাত। এই অসুস্থতা, জীর্ণতাআমাদের মধ্যে সঞ্চারিত হওয়ার আত্মদর্শন কথা কবি এঁকেছেন – 
...বুড়ো ডেকে আনছে আর-এক বুড়োকে,
আর-একজন বুড়ো ডেকে আনছে আরও, আরও একজন বুড়োকে, 
লাখ লাখ বুড়ো কাশতে কাশতে ভিড় করে দাঁড়াচ্ছে জানলার নিচে 
আর মাটির মধ্যে মিশিয়ে দিচ্ছে রাত; ছুটে, তুমি জ্বালিয়ে দিলে আলো, 
ছুটে, যেই দাঁড়ালে আয়নার সামনে 
আঁতকে উঠলে তুমি, কুঁকড়ে উঠলে, কুঁজো হয়ে কাশতে থাকলে ভয়ংকর ভাবে।২৩

 


‘হাড়’ কবিতায় মেঘেদের গতায়াত ও সোঁ সোঁ হাওয়ার চিত্রের সঙ্গেই পৃথিবীর স্থিতাবস্থা রয়েছে, নাকি হিমযুগ এসেছে – এই প্রশ্ন ধুয়ার মতো কবিতায় ঘুরে ফিরে এসেছে। অতীতের স্বাভাবিক মানুষের ‘চামড়া ও মাংসের কথা’ উঠে আসার বিপ্রতীপে বর্তমান পৃথিবীর ক্ষুধা সমস্যার কথা, খাবারের স্বপ্ন দেখার কথা উঠে এসেছে – 
তেমনই আছে তো, নাকি এসেছে হিমযুগ?
শুয়ে থাকো চুপচাপ, মাড়িতে মাড়ি চেপে সহ্য করো সব, 
যখন বিন্দু বিন্দু জল ফুটে বেরুচ্ছে হাড়ের ওপর
যখন হাড়ের হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছি আষ্টেপৃষ্ঠে তোমার হাড়ের গলা।২৪
সাত দশকের কঠিন সময়, অস্থির পৃথিবীর চালচিত্র কি সংবেদনশীল কবিকে ‘হিমযুগ’-এর দুঃস্বপ্ন দেখতে বাধ্য করেছে, তিনি অশনি সংকেত টের পেয়েছেন। ‘হাড়’ কবিতাটি এই কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতার ব্যঞ্জনা লাভ করেছে।  

  • সুমিত বড়ুয়া
  • দ্বিতীয়