বুনো ছাতিম ফুল ও অন্যান্য

এই শরতের বেশ কয়েকটা শরৎ আগে, তখনও শরৎ এলেই মনের মধ্যে এক আলাদা উত্তেজনা তৈরি হত৷ ইউটিউব, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ যুগের পূর্ববর্তী সেই সময়ে আমরা দিন গুনতাম পুজোর। মোটামুটি ১৫ই আগস্ট এলেই পুজো পুজো ব্যাপারটা শুরু হয়ে যেত। আর হিসেব করতাম পুজোয় ক'টা জামা হল। জিন্সটা 'মাস্ট''ড্যামেজ জিন্সের' তখনও তেমন চল হয়নি আমাদের এই আধা শহরে। কিন্তু 'ডেনিম'টা নিতেই হবে।  আলোচনা হত, পুজোর একটা দিনে ইংলিশ ব্যাচের  সুন্দরী মেয়েটাকে নিয়ে বেড়োতে পারব কিনা! যে এই অসাধ্য সাধন করবে সেই, বন্ধুদের মধ্যে 'হিরো'। যদিও শেষ অবধি দেখা যেত সেই মেয়েটি অষ্টমীর বিকেলে হাত ধরে বেড়াতে ঠিকই। কিন্তু সেটা বি-টেক পড়া আমাদের  কোনও এক সিনিয়র দাদা'র সাথে। আর আমরা এগরোল খেয়ে বাড়ি চলে আসতাম!  অতিসাহসী কেউ কেউ একটু 'বিজার' (বিয়ারের চেয়েও কম অ্যালকোহল যুক্ত পানীয়) ট্রাই করত!

 

 

'সঙ্গীত বাংলা' নামের একটি গানের চ্যানেলে সেসময়  দেব-জিৎ -দের পুজোর ছবির গান একটা করে রিলিজ করত। স্কুল থেকে ফিরে সবার আগে সেই চ্যানেল চালিয়ে আগে শুনে নিতাম সেই সব গান। তারপর পড়ার ব্যাচের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটাকে 'ইম্প্রেস' করার জন্য সেই গান নিজের 'মাল্টিমিডিয়া' ফোনে ভরে নিতে  হত। সেই সময়  এই 'মাল্টিমিডিয়া' ফোন যার কাছে থাকত, সে নিজেকে একটা কেউকেটা ভাবত। আর সেই ফোনে যদি লেটেস্ট গান ভরা থাকে, তো সোনায় সোহাগা। ব্লু-টুথে সেই গান 'ট্রান্সফার' করার সঙ্গে মন 'ট্রান্সফারের'ও একটা মারাত্মক চেষ্টা থাকত। সেই চেষ্টা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হলেও, সদ্য গোঁফ গজানো একটা ছেলের কাছে সেটাই ছিল বিশ্বজয়ের সামিল। এখন মনে হয়, এই সবই  প্রস্তর যুগের ঘটনা।

 

 

অথচ বেশিদিন না, এগুলো  এই শতাব্দীরই প্রথম দশকের ঘটনা। তখন ১০ টাকা দিয়ে পাড়ার সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে মোবাইলে গান ডাউনলোড করা যেত। সাইবার ক্যাফেগুলো'র বাইরে তখন কত সাইকেলের ভিড়। কেউ গান ভরাচ্ছে, কেউ 'ভিডিও গেম' খেলছে, কেউ 'ফেসবুক' চালাচ্ছে! হ্যাঁ, মানে 'জেন এক্স' এখন এসব পড়লে ভাবতেই পারে, সাইবার ক্যাফে'তে গিয়ে কে ফেসবুক করে? আসলে, এই মাঝের একটা দশকে যে 'ডিজিটাল বিপ্লব'টা ঘটে গেছে, তাতে কত অভ্যেসই তো পালটে গেছে! অর্কুট উঠে গেছে। ফেসবুক নিজেকে আপডেট করে টিকে আছে। ইনস্টাগ্রাম এখন বাজার কাঁপাচ্ছে। সাইবার ক্যাফেতে এখন টুকটাক ফর্মফিলাপ ছাড়া কেউ যায় না। আসলে এই পাল্টে যাওয়াটাই  নিয়ম। এক সময়ের গ্রামোফোনের ডিস্ক থেকে রেডিও এসেছে। কয়েক দশক বাজার কাঁপিয়েছে রেডিও! তারপর এসেছে ক্যাসেট  প্লেয়ার। ক্যাসেট নিয়ে বড় দাদাদিদি'দের মধ্যে  কাড়াকাড়ি দেখেছি খুব ছোটবেলায়। এক জ্যাঠতুতো দিদি জেদ ধরেছিল মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করলে, 'দেবদাস' -এর ক্যাসেট কিনে দিতে হবে। সঞ্জয়লীলা বনশালি আর শাহরুখ খানের 'দেবদাস'। যে ছবিতে গান গেয়ে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন শ্রেয়া ঘোষাল। সেই অ্যালবাম তখন 'হটকেক'। প্রত্যেকটা গান হিট! জ্যেঠু যথারীতি প্রবল আপত্তি করেছিলেন ক্যাসেট কেনা নিয়ে। কারণ, আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে তখনও একটা অঘোষিত নিয়ম, হিন্দি সিনেমা'র (যদিও 'সিনেমা'র জায়গায় 'বই' শব্দটাই বেশি শুনেছি) গান শুনলে ছেলেমেয়েরা বখে যায়! অবশ্য  পিসিদের থেকে শুনেছিলাম, সেই জ্যেঠু নিজে কলেজে পড়াকালীন ছিলেন শাম্মি কাপুরের বিরাট ফ্যান! 'চাহে কোই মুঝে জাংলি কাহে'র ডিস্ক কেনার জন্য ঝামেলা করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছিলেন! 'দেবদাস' -এর ক্যাসেট'টা যদিও শেষ অবধি আমার বাবা'ই কিনে দিয়েছিলেন আমার জ্যাঠতুতো দিদি'কে। সঙ্গে গিয়েছিলাম আমি। সেই সময় ক্যাসেটের দোকানগুলোর চাকচিক্য আর ভিড়ের সঙ্গে একমাত্র এখনকার 'ধনতেরাসে'র দিনের সোনার দোকানগুলোর তুলনা হতে পারে! সেই একই ক্যাসেটের দোকানটা দেখলাম ক'দিন আগে। প্রায় উঠে যাওয়ার আগের অবস্থা। ধুলো জমে কালচে হয়ে গেছে একসময়ের ঝকঝকে কাঁচগুলোতে। ক্যাসেট বিক্রেতা বোধহয় এখন রেডিও সারান। মহালয়া আসছে, বছরের এই সময়টাতেই লোকজন একটু রেডিও সারাতে দেয়! দেখে মনে হল, উঠে যাবে দোকানটা। আর বেশিদিন টানতে পারবেন না ভদ্রলোক। যুগের সাথে তাল না মেলাতে পারলে এমনই হয় বোধহয়।

 

 

সে যাক, আমরা ক্যাসেটে ফিরি। এই ক্যাসেটের সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার ছিল এর জড়িয়ে যাওয়া! ক্যাসেটের ফিতে একবার 'টেপ রেকর্ডারের' ভিতর জড়িয়ে গেলে হত মস্ত বিপত্তি।  জট ছাড়িয়ে, ক্যাসেটের মাঝে পেন্সিল বা পেন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ক্যাসেটের জট ছাড়ায়নি এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু তারপরেও আশি-নব্বই আর এই শতাব্দীর প্রথম দিকের কয়েকটা বছর  ক্যাসেটেরই রমরমা বাজার ছিল!  সুমনের 'তোমাকে চাই', নচিকেতা''নীলাঞ্জনা', অঞ্জন দত্ত''রঞ্জনা-বেলা বোস', শিলাজিতের 'ঝিন্টি', ক্যাসেট হয়েই বেড়িয়েছিল। সে সময় নিজের একটা ক্যাসেট বের করতে পারাটাই ছিল শিল্পীদের জীবনের প্রধান লক্ষ্য। আর আমাদের এই মফস্বলের ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল, কার কাছে ক'টা ক্যাসেট আছে তা নিয়ে! 

 

 

এরপর এল সিডি। পার্কস্ট্রিটের 'মিউজিক ওয়ার্ল্ড' আমাদের ছোটবেলার একটা 'ড্রিম ডেস্টিনেশন' ছিল। কিন্তু যতদিনে বড় হলাম, ততদিনে মিউজিক ওয়ার্ল্ড পাততাড়ি গুটিয়ে ফেলেছে! পুজোর গান বলে আলাদা কিছু আর বেরোয় না তখন। মান্না-আশা-আর.ডি'দের সুপারহিট পুজোর গান নিয়ে তখনও স্মৃতিকাতর আমাদের আগের প্রজন্মের বাবা কাকারা। ২০০৮-০৯ নাগাদ সুমন, নচিকেতা, চন্দ্রবিন্দু আর পুজোয় নতুন অ্যালবাম বের করছে না।  কিন্তু হ্যাঁ, পুজোয় বাংলা সিনেমা এল একটার পর একটা। জিৎ তখন সুপারস্টার। দেব আসছেন আমাদের প্রজন্মের  নতুন মহাতারকা হয়ে!  আর তার সঙ্গে জিৎ গাঙ্গুলি'র সব সুপারহিট গান! তার কিছুদিন বাদেই পুজোয় সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সাথে আত্মপ্রকাশ হবে অনুপম রায়ের! সেও এক পুজোর ছবিতেই (অটোগ্রাফ, ২০১০)।  যেসব গান 'সঙ্গীত বাংলা'য় দেখে তারপর সদ্য কেনা মাল্টিমিডিয়া ফোনে ভরে নিতে হত। 'চায়না ফোন' বলে একটা বস্তু এসেছিল ওই ২০০৮-০৯ নাগাদ। সস্তার ফোন। 'ডক' এরিয়া থেকে চোরাই পথে আসত বোধহয়। কিন্তু, মারাত্মক আওয়াজ। সেই ফোনেই পুজোর সময় রিলিজ হওয়া গান চালিয়ে সাইকেল নিয়ে ব্যাচে পড়তে যাওয়া। গঙ্গার ধারের ঘাটে প্রথম কাউন্টারে সিগারেটে টান। বাড়ির ফেরাপথে মুখে সিগারেটের গন্ধ লুকোনোর জন্য চুইংগাম কিনে নেওয়া। পুজো বোধহয় বাঙালির জীবনে আসেই প্রত্যেকটা বাঙালিকে একটু 'বড়' করে দিতে। পরিণত করে দিতে। 

 

 

এই পুজো আসছে ব্যাপারটার মধ্যে একটা আলাদা ভালোলাগা কাজ করে। এলেই পরপর চারটে দিন ঝড়ের বেগে কেটে যায়৷ তার চেয়ে এই আসবে মুহূর্তগুলোই ভাল। নতুন প্রেমের মতো। এলেই তো পুরোনো হয়ে যাবে। ঝগড়া হবে। মুখ দেখাদেখি বন্ধ। তারপর একদিন দুজনের মোবাইলের ব্লকলিস্টে থাকবে দু'জনের নম্বর।  আজকাল এই সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে খুব বৃষ্টি হয়। পুজোয় বৃষ্টি হবে কি না, তা নিয়ে আতঙ্কে থাকে বাঙালি। কী জানি, বর্ষার 'এক্সটেনশন' হয়েছে বোধহয়। বেশ লাগে এই সময়টা। ভোরের দিকে একটা বেশ ঠান্ডা হাওয়া দেয়। কাজের সূত্রে ভোরবেলা অবধি জেগে থাকতে হয় মাঝেমধ্যে। রুপম ইসলামের লেখা লাইনগুলো একটা সময় শুনতাম। গাইতাম। বুঝতাম না কিছুই। আজও কি বুঝিজানি না ঠিক। তবে, "ভোরের বাতাসে যত স্নিগ্ধতা আছে, বন্ধক রেখেছিলাম প্রেমের কাছে..গানটায় ভোরের আকাশের যে স্নিগ্ধতার কথা রুপম লিখেছিলেন সেটা বোধহয় এই শরতের ভোরের কথা ভেবেই। গ্রীষ্মের ভোর বিচ্ছিরি! শীতের ভোরে তো কিছু দেখাই যায় না। একমাত্র শরৎ আর হেমন্তর ভোরটাই স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দেয়। হাল্কা একটা ঠান্ডা হাওয়া দেয়। সবাই বলে শরৎ মানে নাকি শিউলি ফুল। কিন্তু শিউলি ফুলকে আজকাল  বড্ড 'ওভাররেটেড' লাগে। এখনকার  ফুড ভ্লগারদের দেখানো বিরিয়ানির দোকানের মতো। শরতের আসল গন্ধ ছড়িয়ে দেয় বুনো ছাতিম ফুল। মাতাল করে দেয় গন্ধটা। বুনো ছাতিম ফুল আর হাসনুহানা অনেকটা একরকম। বন্য গন্ধ। আলাদা নেশা আছে গন্ধটায়। এই গন্ধেই সদ্য ইলেভেনে ওঠা একটা কিশোর  অন্ধকার গলিতে বা গঙ্গার ঘাটে প্রথমবার সাহস করে ঠোঁটে ঠোঁট রাখে প্রেমিকার। প্রথম প্রেমপ্রথম চুমু'কে আরও 'ম্যাজিকাল' করে দিত সোডিয়াম ভেপারের কমলা আলো। এখন যদিও মফস্বলেও সোডিয়াম ভেপার বাতিল হয়ে যাচ্ছে বেশিরভাগ জায়গায়। এলইডি'র সাদা ফ্যাটফ্যাটে আলো আরও সাদাটে করে দেয় রাস্তাঘাটগুলো। 'ম্যাজিক মোমেন্ট'টাও তাই উধাও হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।

 

 

পুজোর পরেই মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের 'টেস্ট'। রবিবারের বিকেলেও কাঁধে ব্যাগ নিয়ে পড়তে বেড়োতে হয়টেন-ইলেভেন-টুয়েলভের ছেলে-মেয়েগুলোকে। ওরা এখনও রুপমের গান শোনে! বাংলা গান শোনে! বি.টি.এসের যুগেও রুপম-অনুপম হিট! বি.টি.এস-এড শিরান'ও শোনে নিশ্চয়ই স্পর্টিফাই'তে৷ এই বিশ্বায়নটা দুর্দ্দান্ত হয়েছে আজকাল! একটা সময় ইংরেজি গান শোনার জন্য অল ইন্ডিয়া রেডিও'র ওপর ভরসা করে থাকত বাঙালি। রাতের দিকেইংরেজি গান শোনাত রেডিও স্টেশন। সেখানেই কত বাঙালি  প্রথম ডিলান বা বিটলস শুনেছে৷ চিনেছে বব মার্লে নামের এক অসামান্য  জামাইকান গায়ককে! তারপর  কলকাতার সাহেব পাড়ায় বা পার্কস্ট্রিট ঘুরে ঘুরে ডিস্ক জোগার করেছে এই সব বিদেশি শিল্পীদের। আর এখন হাতের মুঠোয় সারা বিশ্ব।  

 

 

আমাদের মফস্বলের এঁদো গলিতে এখনও কোনও আঠেরো উনিশের ছেলে বা মেয়ে ''সেপ্টেম্বর এন্ডস'' শুনছে। সেপ্টেম্বর এলেই গ্রিন ডে''ওয়েক মি আপ হোয়েন সেপ্টেম্বর এন্ডস' গানটা সোশ্যাল মিডিয়াতেও  খুব ভাইরাল হয়। আসলে এই সেপ্টেম্বর থেকেই তো প্রকৃতি হঠাৎ বদলাতে থাকে। আলাদা মায়া লাগে। দিন ছোট হতে শুরু করে। উৎসব আসবে আসবে এমন একটা আমেজ তৈরি হয়। এই হুট করে যে বদলটা প্রকৃতিতে আসে, তেমন আমাদের জীবনেও আসে। হঠাৎ করেই আসে। উৎসব আসলেই আরও বেশি করে একা লাগবে। উৎসব বুঝিয়ে দেবে আসলে আপনি বা আমি কতটা নি:সঙ্গ। ভিড় থেকে আলগা হতে চাইবে কিছু একলা মানুষ। 

 

 

তারপর কোনও একদিন ক্লান্ত শরীর নিয়ে ফেরার পথে ডাউন লোকাল ট্রেনের কামরায় পুরনো প্রেমিক বা প্রেমিকাকে দেখে চোখ সরিয়ে নিতে হয়। খানিক অস্বস্তি হয় বটে। কিন্তু, ওই যে আলাদা হয়ে যেতে হয়। তাই, সন্তপর্ণে চোখ সরাতে হয়। তারপর ভিড় ট্রেনে কখন সে কোন স্টেশনে নেমে যায় খেয়াল থাকে না।  এমন অনেক কিছুই খেয়াল রাখতে নেই। শরৎ আসলে এক অদ্ভুত মন খারাপ ডেকে আনে। পুরোনো অভিসম্পাত মনের ভিতর ভয় ধরায়। সেই সব ভয়কে মনের মধ্যে রেখেই এগিয়ে যেতে হয়, হবে। 'গ্রিন ডে' গানের লিরিকটা বারবার লুপে বাজতে থাকে,

"Here comes the rain again

Falling from the stars

Drenched in my pain again

Becoming who we are

As my memory rests

But never forgets what I lost

Wake me up when September Ends...”

 

বুনো ছাতিম ফুলের গন্ধটা মারাত্মক বাজে। খুব বাজে একটা নেশা ধরায় প্রতিটা শরতে। দশকের পর দশক ধরে..

  • শমিত ঘোষ   
img
আগের পাতা
সবুজতন্ত্র