সবুজতন্ত্র

তুমি তো গ্রামের ছেলে? গল্প লেখো, মুথা ঘাস চেনো? পাতি? ওগড়া? 
আমি মুথা ঘাসের মূল চিবিয়ে, রাঙচিত্রার মধু খেতে খেতে, ওগড়ার বোঝা মাথায় মাঠ থেকে ঘরে ফিরেছি। খালি গা ভরে গেছে বনতুলসীর শুকনো ফুলের রোঁয়ায়। কাটা-ছেঁড়ায় দূর্বা, কালা ঘাসের রসই যথেষ্ট।

 

 
   
অগ্রজ লেখকের মুখে প্রসন্ন হাসি। বললেন, লেখার মধ্যে এগুলো আনতে হবে। 
বললাম, আপনি আমাকে শিকড়ে ফিরিয়ে দিলেন। আপনাকে ধন্যবাদ। তবে কি জানেন, আমি এখন অন্য কারণে মনের আনন্দে ঘাসের দেশে ঘুরে বেড়াছি। ঘাস চিনছি। আগে ভাবতাম, ঘাস আবার চিনব কি। পায়ের তলায় ঘাস নিয়েই তো জন্মেছি। ঘাসের উপর দৌড়েছি, ক্লান্ত হয়ে ঘাসের উপর শুয়েছি। আসলে কৌতূহল বিমুখ হলে কিছু দেখার নেই, চেনার নেই। এখন যতই চিনছি ততই অবাক হচ্ছি। সত্যি সেলুকাস কি বিচিত্র এই সবুজ ঘাসের দেশ! জাতি বর্ণের কোনও শেষ নেই। শুধু কে কাকে ছাড়িয়ে উঠবে তার প্রতিযোগিতা আছে। এক একটা জেলাতেই নাকি সাতশো থেকে হাজার প্রজাতি। গত কয়েক মাসে আমার জেলাতেই সাড়ে তিনশো প্রজাতির ঘাসফুল সংগ্রহ করে তাদের দেশি বিদেশি নাম জেনেছি। আগ্রহ দেখে সহকর্মী অধ্যাপক বোটানি বলেছে, অথচ আমাদের ডিপার্টমেন্টের ছাত্রেরা পঞ্চাশটাও সংগ্রহ করতে পারে না। ওদের আসলে কোনও চোখ নেই।  

 


    

দেখেছি জঙ্গলের মধ্যে নানা প্রজাতির ঘাসফুল পরস্পরের সঙ্গে জড়াজড়ি করে কীভাবে সব ফুটে আছে। কি আশ্চর্য! জাতি দাঙ্গা এদেশে নেই। পরস্পরকে জড়িয়েই এদের বেঁচে থাকা। হাজার বৈচিত্র্য নিয়েও ওদের পরিচয় একটাই। ঘাসফুল। দেখতে দেখতে আমার তাই মনে পড়ে একদিন আমরাও বুঝি এভাবেই বাঁচতুম। ঘাসের মধ্যে ঘাস হয়ে। ছেলেবেলায় এক বাউল এসে বলত, মানুষের আবার জাত কী রে? মানুষ ভজ, মানুষ ভজলে সোনা হবি। বড়ো হয়ে জানলুম কথাটা লালনের। জীবনানন্দের কবিনায়কও ঠিক তাই চায় জানেন, তাই তো সুরঞ্জনাকে উদ্দেশ্য করে বলে- ‘আকাশের আড়ালে আকাশে/মৃত্তিকার মতো তুমি আজ/তার প্রেম ঘাস হ’য়ে আসে।/সুরঞ্জনা, তোমার হৃদয় আজ ঘাস;/বাতাসের ওপারে বাতাস-/আকাশের ওপারে আকাশ।’- সত্যিই তো! ঘাসেরা এতটা তুচ্ছ হলে তারা মানুষের হৃদয়ের এতটা কাছাকাছি এল কীভাবে!  

 


    
আপনার হয়তো শুনতে ভাল লাগছে না, না? 
না, না, ভালই তো লাগছে! আসলে অল্প বয়সের লেখায় একটু কাব্যিক টাচ থাকে। তুমি বলো। আমি শুনছি। 
আমি কিন্তু ঐ ঘাসের দেশের কথাই বলব। শুনুন, ছোট বড় মাঝারি শুধু নয়, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর -এমন প্রজাতিও আছে যাদের খালি চোখে দেখা যায় না। যেমন ছত্রাক, ভাইরাস তেমন ঘাসও আছে। ঘাসের দেশ জলে স্থলে, সমতলে-অসমতলে, পাহাড়ে-পর্বতে বালিয়াড়ি-মরুভূমিতে সর্বত্র ছড়ানো। সমুদ্রের তলদেশেও ঘাস আর প্রবাল মিলেমিশে বাস করে। এরা কেউ ভাসে, কেউ জলের স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছোটে। আবার রুক্ষ পাথর সাজানো টিলা পর্বতের সমস্ত শরীর সবুজ চাদরে মুড়ে দেয় ঘাসদের ছোট বড় নানা প্রজাতি। কত রঙের বাহার, জেল্লা তাদের। শুধু কি সবুজ, বর্ণময়, বর্ণচোরা, এমনকী বিবর্ণ সাদা ঘাসের আস্তরণও কত দেখেছি। এদের কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন মনটা হঠাৎ ‘লোচনদাস কারিগর’ হয়ে ওঠে। সেই যে উৎপলকুমার বসু লিখেছিলেন- ‘যখন ছিলাম শূন্যে ভাসমান তুমি ছিলেন কোথায় হায় রে/যখন ছিলাম ঘাসে ঘাসবীজ তুমি ছিলে কোথায় হায় রে/আগুন নেভার পর বুনো ঘাস উড়ছে বাতাসে’।     

 

 

     
অগ্রজ লেখক বললেন, উৎপলকুমার বসু আমাদের সময়ের খুব বড়ো কবি। বেশ গভীরতা থাকে ওর কবিতায়। তবে প্রকৃতি সংলগ্নতা একজন গদ্যকারেরও থাকতে পারে। কিন্তু তাকে কবিতার মতো বিমূর্ত হলে চলে না। তুমি আবার ওসবের ফাঁদে পড়ো না। 

 


    

বললুম, ঘাসেদের নিয়ে কি আর কাব্য করা চলে! তাছাড়া আমরা তো এখন আর ঘাসে ঘাসবীজ হয়ে নেই। অনুভব উপলব্ধিতেও নেই। বরং সবুজ ধ্বংসের উৎসবে মেতে আছি। সমস্ত জঙ্গল চেঁচে-মুছে সাফ। অথচ আমার ঠিক কি মনে হয় জানেন, কেন মনে হয় ঠিক জানি না, মাঠে ঘাটে পথে ঘাস আমাদের দেখে হাসে। আমাদের বোকামিকে দেখে হাসে, শত্রু জেনেও হাসে। কারণ সবুজ দেশে কোনও শত্রুতা নেই। প্রকৃতির রাজ্যে কোনও অহং নেই। অহং থেকেই আসে শত্রুতা। 

 


    

আচ্ছা! অহং আমাদেরও কি কখনও ছিল বলুন? আমরা এখনও সবুজ দেখে আনন্দ পাই। আর সবুজ দেশে সহিষ্ণুতাই ওদের ধর্ম। অবশ্য শুধু ঘাস নয়, সমস্ত উদ্ভিদের ধর্মও তাই। তুচ্ছতা ওদের ভাবায় না। সহিষ্ণুতা একদিন আমাদেরও ছিল কি? কী জানি! শুনলে অবাকই হবেন, ঘাসের কথা ভাবলেই আমার আবার চৈতন্যের শিক্ষাষ্টক শ্লোক মনে পড়ে- ‘তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুনা’। সত্যিই তো, এমন নিরহংকারী হয় না কেন মানুষের দেশ, মানুষের সভ্যতা! নীচুর কাছে নীচু হতে আর শেখা হল না। যাই হোক, আমি এই ঘাসের দেশে যাতে দিশেহারা হয়ে না যাই সেই ভয়ে কোনও একটা ঘাসের সংসারে ঢুকে পড়তে চাই। 

 

 

দুই       
অগ্রজ বললেন, বা! তোমার আইডিয়া খুব ভালো। বেশ বৈচিত্র্য আছে দেখছি। তার মানে তুমি বোধহয় ইকোলজি নিয়ে কিছু লিখতে চাও? তা বেশ! তবে কি জানো, এসব ভাবনা শুধু মানুষের। উদ্ভিদ কিংবা অন্য প্রাণীর এ ব্যাপারে কোনও মাথাব্যথা নেই। ওরা তো আর ইকোলজি ধ্বংস করছে না! তাছাড়া গল্প কিন্তু মানুষের কথাই বলে।  

 

 

বললাম, আমার গল্প এখনও শুরুই হয়নি। অব্যক্ত আর ব্যক্তের সেতুবন্ধনে মেতেছি। সফল হব বলতে পারছি না। আপনি আমাকে শিকড়ের সন্ধান দিয়েছেন। আপনাকে ধন্যবাদ। আবার তাহলে শুরু করি?    
হাঁ! হাঁ, নিশ্চয়ই। অগ্রজ সম্মতি দেওয়ায় বললাম, সবুজ আসন পেতে আমাকে বসতে দেয় দূর্বা। দূর্বার ঘন সবুজ আস্তরণ দেখলে কার না একটু বসতে ইচ্ছা হবে? সেই ছেলেবেলা থেকে রাস্তার ধারে, খেলার মাঠে, স্কুল মাঠে, ডাঙায়, জমির আলে, এমনকি শ্মশানে সর্বত্র দূর্বার আসনেই বসে এসেছি। কোথা নেই ওরা! শুধু মাটি তো নয়, ইট, পাথর, যে কোনও শিলা সবাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে বাঁচে। বাহুর বাঁধন বড় শক্ত। ধরলে ছাড়ানো দায়। রোদ বৃষ্টি সহ্য করার ক্ষমতাও অসীম। উত্তাপে জ্বলে-পুড়ে গেলেও এক পশলা বৃষ্টি পেলেই বেঁচে ওঠে। কখনও কখনও আমার মনে হয় পৃথিবী যেদিন সমুদ্র থেকে মাথা তুলে দাঁড়ায় সেদিন দূর্বাই আগে জন্মে মাটিকে জাপটে ধরেছিল। আর ছাড়েনি। কেউ ওর ঝুঁটি ধরে টানলে বিছার পায়ের মতো সরু সরু শিকড় না ছেঁড়ার আগে পর্যন্ত লড়াই চালায়। আচ্ছা, উদ্ভিদ ও প্রাণীর সহজ সম্পর্কে কি আমাদের প্রয়োজন নেই!  

 


     
আছে কি জানি না, তবে আমার এই প্রথমেই দূর্বার সংসারে ঢুকে পড়ার যথেষ্ট কারণ আছে। ছোট থেকে শুনে এসেছি দূর্বার অসীম শক্তি। কেটে যাক বা ছড়ে, দূর্বার রস মহৌষধি। তাছাড়া দূর্বার লকলকে ঢ্যাঙা প্রজাতি এ দেশের সমস্ত মঙ্গলকর্মের সঙ্গে যুক্ত। ধানের সঙ্গে মিশলেই আর ঘাস থাকে না, জাতে ওঠে। উৎসবে অনুষ্ঠানে দূর্বার অনেক কদর। ধান-দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ না করলে পুণ্য হয় না। অথচ যেমন বাউরি ডোম ধর্মের পাটা মাথায় নিলে জাতে ওঠে বাকি সময় মাটি কামড়ে পড়ে থাকে, ওদের অবস্থাও তাই। 

 


    
ঘাসেরা শুধু সুন্দর নয়, আমাদের উৎসবের সঙ্গে জড়িতই নয়, আমার তো মনে হয়, মনে হবে কেন সত্যিই তো ওরা আমাদের সভ্যতার প্রাণ প্রতিষ্ঠার এক একটা আদি প্রজাতি। আমাদেরই পূর্বপুরুষ। আমাদের গ্রামে তখন কারেন্ট ছিল না, গ্রীষ্মের রাতে পুবের মাঠের এক কোণে শ্মশানে দূর্বার নরম বিছানায় দিব্বি ঘুমাতাম। ঘুম না এলে আকাশের তারা গুনতাম। দূর থেকে বাতাসের ভেলায় ভেসে আসা পাঁচালি কিংবা কীর্তনের সুর শুনতাম। আর ভয় পেলে একটু দূরে ঘাসের চাদর ফুঁড়ে দাঁড়ানো লঙ্কাশিরের গাছকে দেখে মনে মনে বলতাম, ওটা বোধহয় আমার ঠাকুমাই হবে! চাঁদের আলোয় গাছটাকে ঘোমটা মাথায় দাঁড়ানো ঠাকুমাই যেন মনে হত। আর পাশের ঝাঁকড়া গাছটা নিশ্চত দাদু। ঠিক ওখানটাতেই তো ওদের পোড়ানো হয়েছিল। এখানে আমার ভয় কি! মানুষ পুড়ে ছাই হয়। ছাই মাটি হয়। সেই মাটিতে বাতাসে উড়ে এসে পড়ে ঘাসের দানা। অবশেষে শ্মশানে পূর্বপুরুষদের চিতায় ঘাসের জন্ম হয়। আমার ঐ ঘাস জন্মের কথা মনে পড়ে। আরও মনে পড়ে কি আশ্চর্য্য! মা বলত, এই সংসারে তোদের জন্য খেটে খেটে আমার হাড়ে দুলপো ঘাস জন্মে গেল। শেষপর্যন্ত দেখি কথাটা মিথ্যা নয়, তাই-ই হয়। মা কোথা! মা নেই। মায়ের চিতার চারপাশও এখন সবুজ ঘাসের চাদরে মোড়া। আর কয়েক পশলা বৃষ্টি পেলে হয়তো ওর ওপরেও কোনও লঙ্কাশিরের কিংবা অন্য কোনও গাছ জন্মাবে। বস্তুত উদ্ভিদ আর প্রাণীর এই সম্পর্কটা আমার ঘাস চেনার আনন্দকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। 

 


     
জানেন, ভাবতে ভাবতে আমার মন চলে যায় আরও অনেক দূর। বলতে কি সেই বেদ, উপনিষদের যুগে। বৈদিকরা ব্রহ্ম উপাসনা করতেন। কিন্তু ব্রহ্মের স্বরূপ কী? নানা ঋষির নানা মত। অবশেষে উপনিষদের এক ঋষি বলে ফেলেন, ব্রহ্ম কী? না অন্নই ব্রহ্ম। জীবমাত্রই অন্ন ছাড়া বাঁচে না। আর ঘাস প্রাণীকুলের আদি অন্ন। ঘাসের যেমন মাটি, জল, খনিজ ইত্যাদি। শুধু প্রাণীরাই খাদ্যশৃঙ্খলে বাঁধা নয়, উদ্ভিদ ও জীবকুলও খাদ্য ও খাদক। জাগতিক চেতনার উৎস ঐ অন্নরূপ ব্রহ্ম। বন্ধুদের কাছে ঠাট্টা করে বলি, আমি তাই ঘাস চিনতে চিনতে ব্রহ্মকে চিনেছি। জলজ ঘাস শ্যাওলা পৃথিবীর আদি প্রাণ। খাদ্যের জন্য প্রাণ বাঁচে। জলজ উপাদান খেয়ে বাঁচল আদিম ঘাস। ঘাসকে আদিম খাদ্য রূপে পেয়ে জন্ম নিল জলজ প্রাণী। তারাই তো একদিন উঠে এল ডাঙায়। আমাদের পূর্বপুরুষ অ্যামিবার থেকেও ঘাসেরা প্রাচীন। কেউ ভাবুক আর নাই ভাবুক আমি জেনেছি, ওদের রক্ষা করতেই হবে। কারণ ঘাস আমাদের আদিম খাদ্য শৃঙ্খলে বেঁধে রেখেছে। আমাদের পরম আত্মীয় ঘাস। 

 


    
আমি জানি, আমার মতো পাগল ছাড়া কেউ এভাবে ঘাস চিনতে বা ঘাসফুল সংগ্রহ করতে যাবে না। কেউ সংগ্রহ না করাতেই ঘাসেদের কত প্রজাতি যে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে তার ইয়াত্তা নেই। কোথাও বেড়াতে গিয়ে অজানা ঘাস দেখলে শিকড় শুদ্ধ তুলে আনি। পথে ঘাটে যেখানে ইচ্ছা লাগিয়ে দিই। আচ্ছা, সবুজ ধ্বংস করে আমরা কি বাঁচব! আমরা বাঘ, সিংহ, কুমির, সাপের মতো হিংস্র, বিষধর প্রাণীদের সংরক্ষণ করছি অথচ জীবকুলের আদি খাদ্য যে ঘাস তাদের ধ্বংসে কী উৎসাহ আমাদের। শত উপেক্ষা সত্ত্বেও যারা আমাদের বেঁধে রেখেছে তাদের প্রতি আমাদের এই নির্মমতা কেন তা জানি না। আমরা পৃথিবীর বুক থেকে ঘাসের সমস্ত চাদর সরিয়ে ইট, পাথর, কনক্রিটের চাদর বিছিয়ে নগর গড়তে চাই। আমরা নগর চাই, উন্নয়ন চাই, তাই ঘাস উপড়ে কৃত্রিম ঘাসের পার্ক বানাই। মাটির গন্ধ ভুলে ঘাসের গন্ধ ভুলে জাগতিক সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন হতে চাই। তাই আমি যখন ঘাস চেনার আনন্দে মেতে উঠি, যখন বলি, ঘাসেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে বাস্তুতন্ত্রের সেই আদিম সম্পর্কে ফিরে পেতে চাইছি তখন বন্ধুরা আমাকে পাগল বলে ঠাট্টা করতে ছাড়ে না। তাতে অবশ্য আমার উৎসাহে বিশেষ ভাঁটা পড়েনি। 

তিন     
বা! তোমার আইডিয়া সত্যিই ভাল, বেশ বৈচিত্র্য আছে। কিন্তু গল্পের খাঁচা কই- বললেন অগ্রজ। এও বললেন, তোমরা তরুণ লেখক তোমাদের জানা চাই, আসলে ননফিকশানও এক ধরনের ফিকশান। 

 


     
বললাম, খাঁচার পাখি শেখানো কথা বলে। এ গল্প তো নতুন গল্প। নতুন কথাই বলবে। তাছাড়া বাস্তুতন্ত্র ও পুরাণের সংঘাত আমি চাই না। আপনি আমাকে সতর্ক করে দিলেন। আপনাকে ধন্যবাদ। আবার শুরু করছি শুনুন- 
শুনতে খারাপ লাগছে না! বলো- 
দূর্বার কথা রেখে এ বার আমি বর্মা পাড়ার দিকে হাঁটি। প্রতিবেশি নিয়েই তো পরিবেশ। আমাদের এই জলাভূমির দেশে সবুজের যে সুবৃহৎ চাদর দূর্বার মতো তার অনেকটা ক্ষেত্র জুড়ে আছে বর্মা। আমাদের সকলের বিচরণক্ষেত্র, বিশেষত যাদের শৈশব মাটি চিহ্নিত। ফড়িং ধরতেই হোক কিংবা শালিকের খাবার ঘাস ফড়িং খুঁজতে, বর্মা আমরা দু’পায়ে মাড়িয়েছি। আহা! বর্মা ঘাসে শিশির ভেজা মাকড়সার জালে রামধনু আজও চোখের উপর ভাসছে। অথচ কী আশ্চর্য বর্মার ইতিহাস আজও জানা হল না। বার্মা যুদ্ধের কথা জানি কিন্তু বর্মা বার্মা থেকে এসেছে কি না বলতে পারি না। 

 


     
আমার বোধহয় পৃথিবীর সমস্ত জলাভূমিতেই বর্মা জন্মে থাকে। ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভাষায় নিশ্চয়ই ভিন্ন নাম। তবে আমাদের এই নিম্নবঙ্গে এদের একচ্ছত্র প্রাধান্য। একটু নরম জলজ কিংবা স্যাঁতসেঁতে মাটি যেমন পছন্দ তেমনি শক্ত ইট-পাথরের ফাঁক ফোকরেও এরা জন্মাতে পারে। যেখানে সেখানে সাপের ফনার মতো মাথা তোলে বর্মার লকলকে ডগ। টান মেরে কাণ্ড পটাপট ছিঁড়ে ফেলা যায় কিন্তু শিকড় ঠিক থেকে যায় মাটির গভীরে। মাকড়শার জালের মতো সরু সূতোর শিকড় দিয়ে মাটিকে জড়িয়ে থাকে। তাই ছেঁড়া শিকড় মাটিতে পড়ে থাকলে পুনর্বার জন্মানোর ক্ষমতা ওদের আছে। ওদের জীবনীশক্তি দেখে ভাবি আমাদের জীবনীশক্তিই বা কম কীসে! আমরাও তো কতভাবে ছিন্নমূল হই, ভাসতে ভাসতে আবার নতুন বসত গড়ে তুলি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা রাজনৈতিক, ঝড়ে গাছ পড়ে শিকড় ছেঁড়ে, তাতে কি! দূর্বার মতো, বর্মার মতো আমরাও সমস্ত বাধা বিঘ্ন উপেক্ষা করে বেঁচে আছি, ছড়িয়ে আছি কত দেশ, কত যুগ ধরে। 

 


     
তাছাড়া আমাদের কাছে বর্মা শুধু ঘাস নয়, শাক। মানে সেই আদিম খাদ্য। উদ্ভিদ ও প্রাণীর খাদ্যশৃঙ্খল। এই শাক-পাতা খেয়েই আমাদের পূর্বপূরুষ কত জন্ম বেঁচে থেকেছেন। গরিবের খাদ্য বলতে শাক পাতা। ক্ষুদ-কুঁড়ো না জুটলে পাঁচমিশালি শাক খেয়েই...। মনে পড়ে পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষের কথা বলতে গিয়ে আমাদের নব্বই পেরোনো ঠাকুমার দু’চোখ জলে ভরে যেত। বলতেন- ‘কী বলব রে বাবা, সেসব দিনের কথা। তিন মাস ভাত চোখে দেখিনি। বর্মা, হিঞ্চে, থারকুল, বিড়মি(ব্রাহ্মী), কলমি, মেতি, সুজনি, তেলাকুচো, এইসব শাক, ঘাস বাছাবাছি নেই যা পাই তাই খেয়েই কতদিন বেঁচে থেকেছি। আর রাস্তার দু-ধার সব ফালা ফালা। শেষে যে কোনও ঘাস-পাতা-শিকড়, কচু-মানকচু-তেলাকচু যা পেয়েছে লোকে তাই ছিঁড়ে এনে সিদ্ধ করে খেয়েছে। পেটের জ্বালায় সেসবই যেন অমৃত।’ আমরা স্বচ্ছল হলে ঘাসের চিহ্ন মুছে ফেলতে চাই অথচ ঘাস....   

 


    
শুধু মানুষ তো নয়, কত কীটপতঙ্গ পোকামাকড় সরীসৃপ বর্মাকে, ঘাসের সবুজ আস্তরণে ঢাকা মাঠ, কিংবা ছোট-খাটো খানা, ডোবা, জলাশয়কে আশ্রয় করে বেঁচে থাকে। ঘাস ফড়িং ঝাঁকে ঝাঁকে লাফাতে দেখেছি, শহরে মফঃস্বলে বর্মা, কচুরি-পানায় মজে যাওয়া পুকুর ডোবায়। ঘাসের চাদর বিছানো জলাশয় আমাদের শহরের ফুসফুস।    

 

 

চার
এ বার দেখি অগ্রজের চোখে মুখে বিরক্তি। বললেন, ‘এভাবে গল্প হয়? এ তো নিছক প্রতিবেদন লিখে যাচ্ছ। গল্প কই?’ 
বললাম, সত্যিই এখনও গল্পটা বলিনি। এবার বলছি, শুনে দেখুন -
মাকড়শার জাল বিছানো জলাশয়ে ভোরের কুয়াশা সূর্যের হালকা নরম রোদে চিকচিক করছিল। ঢোল কলমির পাতায় ঝুলে থাকা শিশিরে সকালের পূর্বাভাস। প্রতিদিনের মতো সেদিনও এক পা, এক পা করে এগিয়ে গিয়েছিল সুতপা ঐ জলাশয়ের দিকে। ওর কাছে ওটাই এখন ওদের ঘাসের দেশ।      
      

 

আমাদের ছাত্রী সুতপা। ইদানিং সমস্ত ক্লাসেই আমি আমার ঘাসের দেশে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দের কথাই বলি। ব্যাপারটায় সুতপার আগ্রহ ও উৎসাহ দেখে ওকে আমি র্যা চেল কারসনের ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’ বইটা পড়তে দিই। আর তারপর থেকেই মাটি, জল, আকাশ, গাছ আর আমার মতো তুচ্ছ ঘাসকেও ও এখন পরম আত্মীয় ভাবতে শুরু করেছে। ঘাসের কথা ভাবতে ভাবতে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়া আমি এখন রোজ ওর সঙ্গে ক্লাসের শেষে মত বিনিময় করি। বন্ধুরা পছন্দ না করলেও আমরা দু’জন পাশাপাশি হাঁটি। সবুজের আস্তরণ দেখলেই দাঁড়িয়ে পড়ি। আমি ওঁকে ঘাস চেনাতে থাকি। মাটির রাজ্য নিয়ে কথা বলি। জৈব-অজৈব মিশ্রণে মাটির উৎস কথা, উদ্ভিদ ও প্রাণীর খাদ্য-খাদক সম্পর্কের কথা আমাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের বয়সের তফাৎ যাই হোক, সুতপা এখন নিঃসঙ্কোচে আমার সঙ্গে মেশে। আমিও। আমি মজা করে বলি, সুতপা, ‘তোমার হৃদয় আজ ঘাস।’ আর সুতপা তখনই আমার কানে কানে বলে, ‘যখন ছিলাম ঘাসে ঘাসবীজ তুমি ছিলে কোথায় হায় রে!’  
    

 


ওদের ফ্ল্যাটের পাশে এই পড়ে থাকা জলাশয়ের ধারে ঘাসের দেশে রোজ ও ঘুরতে আসে। এখানে দূর্বা, মুথা, বর্মা, ছাড়াও হিঞ্চে, কলমি, ছাড়া, ম্যালেরিয়া আর জলাশয় ভর্তি টোপা পানার অদ্ভুত সমারোহ। সুতপা বলে, সকালে এখানে এলে মনটা সারাদিন আনন্দে ভরে থাকে। মনে হয়, জন্ম-জন্মান্তর এই জল-মাটি-শ্যাওলা-ঘাস আমাদের অতীত শিকড়কে বেঁধে রেখেছে। ওখানে আমাদের কত পূর্ব-পুরুষের দেশ আছে। বইটা আমার সত্যিই চোখ খুলে দিয়েছে। এবার আমরা আমাদের এই জলাশয়টাকে বাঁচাবই।  

 

                         
    

নিতান্ত শহুরে মেয়ে। ঘাসের অঙ্কুশের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা এখনও হয়নি। তাই একেবারে খালি পায়ে যায়নি। পাতলা একটা চটি সে পায়ে গলিয়ে নিয়েছিল। সে চটি অনায়াসে ডুবে যায় ঘাসের পুরু আস্তরণে। তাই সবুজ ঘাসের স্পর্শে পায়ে এক অদ্ভুত শিহরণ অনুভবে বাধা নেই। শিশির ঝরে পড়ছিল ওঁর পায়ের পাতায়। ভেজা শিশিরের এমন গন্ধ ছেলেবেলায় এভাবে কখনও অনুভব করেনি। তাই থমকে দাঁড়িয়ে চটি খুলে একটু পায়ে শিশির মাখতে ইচ্ছে হয়েছিল সুতপার। খালি পা ঘাসে দেওয়া মাত্র আহা! উন্মুক্ত ঘাসের চাদর মুহূর্তে যেন হেসে উঠেছিল। আর সে হাসি ছড়িয়ে পড়েছিল ওঁর চোখে মুখে। তখনি কিছু একটা ঘটছে ভেবে ছোট কতকগুলি পোকা লাফিয়ে দূরে সরে গিয়েছিল। সুতপার বলতে ইচ্ছে করেছিল, আরে! আরে! তোরা আবার যাস কোথা? আয় এক সঙ্গে একটু খেলি! এমন অনুভূতি নাকি ওঁর প্রায়শই হয়। এমনই জানিয়েছিল সুতপা।  

 


    
কিন্তু আজ আর ওঁর দাঁড়িয়ে এভাবে সময় নষ্ট করার সময় ছিল না। সিদ্ধান্ত ওঁরা একপ্রকার নিয়েই ফেলেছে। দিন শুরু হওয়ার আগে ওদের যা করার করে ফেলতে হবে। ওঁদের মানে সুতপা, সুনীল, কিশলয়, দীপক। চার মূর্তি। সবুজতন্ত্রের সৈনিক। সুতপার কথায়, সবুজতন্ত্রের সঙ্গে বাস্তুতন্ত্রের সম্পর্ক তাঁর নিজের বুঝতে যত সময় লেগেছে ওদের বোঝাতে তত সময় লাগেনি। কারসনের বইটা পড়া ছিল বলেই কত আশ্চর্য কথা তখন ওঁর মাথায় এসে গিয়েছিল। যেমন সুতপা আবিস্কার করে ওদের প্রত্যেকের নামের সঙ্গেই সবুজতন্ত্রের ভাবনাটা জড়িত। এটা অবশ্য আগে ভেবে দেখেনি। হঠাৎই বলতে গিয়ে মনে এসে যায়। তিনজনকে একসঙ্গে ডেকে বলেছিল- ভাবত, তুই, মানে কিশলয়, সবুজ ঘাসের পাতা, আর সুনীল মানে সুনীল আকাশ, আর দীপক মানে আলো- এখানে পরপর কয়েকটা ফ্ল্যাট তৈরি হলে এর কোনটা থাকবে? কোথায় আশ্রয় হবে তোদের! সেই কংক্রিটের জঙ্গলে আকাশ আর আলোর অভাবে সবুজ কিশলয় কীভাবে বেঁচে থাকবে! 

 


    
ওদের নামের যে এমন মাহাত্ম্য আছে বা থাকতে পারে তা সুতপার কাছে শুনে ওরা অবাক হয়ে গিয়েছিল। দুদিনের মধ্যেই সুতপা ওদের বুঝিয়ে দিয়েছিল, এখন কী ওদের কর্তব্য। পরিবেশ রক্ষার একটা প্রাথমিক পাঠ সকলের থাকে, ওদেরও ছিল। কিন্তু মানুষ ও প্রকৃতির সেই সম্বন্ধ যে এত গভীর তা ওরা কেউ জানত না। আকাশ-মাটি-জল, নদ-নদী-সমুদ্র, শ্যাওলা-প্রবাল-ঘাস-গাছপালা, জলচর-উভচর-খেচর, কীট-পতঙ্গ, পশু-পাখি, জন্তু-জানোয়ার, মানুষ সবাই যে একই বাস্তুতন্ত্রের অধীন সুতপা ওদের বোঝাতে পেরেছিল। সেই থেকে সকাল-বিকাল-সন্ধে এই বদ্ধ জলাশয়ের পাশে বসে ওরা সময় কাটায়। ওরা ঘাসের দেশ, মাটির দেশ, সবুজতন্ত্র নিয়ে নিরন্তর কথা বলে। ওদের এই বসে থাকা এত ঘনিষ্ঠ ও নিয়মিত যে নাগরিক প্রতিবেশীদের মনে নানা জল্পনার জন্ম দেয়। পাশ দিয়ে যেতে যেতে সুতপাকে শুনিয়ে শুনিয়ে কেউ হয়ত বলে যায়-
‘কী যুগ এল রে ভাই! একাই তিনটে ছেলেকে চরাচ্ছে! এদের মা-বাপ কিছু বলে না!’  
কিংবা কিশলয়, সুনীল, দীপককে উদ্দেশ্য করে অন্য কেউ হয়ত বলে যায়-
‘কী আমদগেড়ে ছেলে রে ভাই, একটা মালের পিছনেই তিনজন? আমাদের এই শহরে কি আর মেয়ে নেই!’   
সুতপা ও তাঁর বন্ধুরা এসব কথা শুনেও শোনে না। অথবা শুনলেও ওঁরা উত্তেজিত হয় না। ওঁরা মনকে বোঝায় সবুজ দেশে কোনও অহং নেই, ঈর্ষা নেই, সংকীর্ণ স্বার্থ নেই। সহিষ্ণুতা ওঁদের ধর্ম। ওঁরা ঘাসের মতো সাবলীলভাবে বাঁচতে চায়। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচতে চায়। তাই শুধু তিনজন কেন ওঁরা আরও অনেককে এমন করে ওঁদের মতো করে কাছে পেতে চায়। কিন্তু সহজ কথা সহজে হয়তো বোঝা যায়, সকলকে বোঝানো যায় না। তাই আপাতত জলাশয় বাঁচানোর উদ্যোগটাকে সামনে রেখে পরিবেশ রক্ষার বার্তা ছড়িয়ে কিছু মানুষকে এক জায়গায় করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এমনই সিদ্ধান্ত হয়েছিল ওদের। আজ থেকেই আসরে নেমে পড়ার কথা ছিল। 

 

 

কিন্তু ওঁরা এখনও আসছে না কেন? সুতপা মনে মনে বলে, ঐ কুড়ের হদ্দগুলোকে সঙ্গে নিয়ে কি কিছু করা সম্ভব! সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হয়ে গিয়েছে। বলা যায় না, পরিবেশ সংক্রান্ত খবরে এখন সাংবাদিকদের খুব আগ্রহ। সূর্য ওঠার আগেই চলে আসতে পারে খবর করতে। তার আগেই তো জলাশয়ের চারদিকে টাঙিয়ে দিতে হবে প্রতিবাদী ব্যানার, ক্যাপশন। চারজনের লেখা, ছড়া, কবিতায় সেজে উঠবে তাদের এই সবুজ দেশ। গত তিনদিন ধরে ওরা বানিয়েছে প্লাস্টিক বা সিনথেটিক নয়, পরিবেশ বান্ধব কাপড়ের ব্যানার আর পিচবোর্ডে হাতে লেখা পোস্টার। পোস্টারে লেখা - ‘সবুজ বাঁচলে শহর বাঁচবে/ নদী বাঁচলে দেশ।’ কিংবা ‘রোদ বৃষ্টি মাটি আকাশ আগুন বাতাস জল/ পশু পাখি পোকা মাকড় সবুজ বাঁচাই চল।’ এমন আরও কত।  

 

            
    
আমি জানি এত বড় জলাশয় এই ছোট মফঃস্বল শহরে আর একটাও নেই। প্রমোটারদের দৃষ্টি এখানে পড়বেই। মালিকানা যারই হোক দখল ওদের নিতেই হবে। জল, জমি, পাহাড়, জঙ্গল সবই ওঁরা গোগ্রাসে গিলতে চায়। সুতপার কাছে শুনেছি অনেক আগেই একবার দখল করার চেষ্টা করেছিল। মালিকানা সংক্রান্ত জটিলতায় কোর্টের ইঞ্জাংশনে বাধা পেয়ে তাৎক্ষণিক সরে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিল। এখন আবার সরকার বদল হতেই নতুন করে শুরু হয়েছে প্রমোটাররাজ। একের পর এক সবুজ ধ্বংস করে গড়ে উঠছে পাঁচতলা সাততলা ফ্ল্যাট। অবশিষ্ট বলতে এইটুকু। তার মধ্যে এই কতকগুলি ছেলেমেয়েদের আনাগোনা ওদের ভাবায়নি। কিন্তু একবার জলাশয় রক্ষার পোস্টার পড়লে ওরা নিশ্চয়ই বসে থাকবে না। 
 


   
আর কিছুক্ষণ পরেই ওদের সাজানো ঘাসের দেশ দেখতে আসবে চেনা, না-চেনা অনেক বন্ধু। উৎসাহে উদ্দীপনায় কাল সারা রাত সুতপা ঘুমাতে পারেনি। রাত দুটো পর্যন্ত ওরা চারজন কনফারেন্স কলে ছিল। কতজন আসবে, কতজন বিশ্বাস করবে ওদের কথা, কীভাবে সবুজতন্ত্রের মন্ত্রে বশ করতে হবে সকলকে- এ নিয়ে আলোচনা কিছুতেই শেষ হচ্ছিল না। শেষে কিশলয় বলেছিল, দেখ আমাদের প্রথমেই বুঝিয়ে দিতে হবে এই জলাশয়টুকু আমাদের পাড়ার ফুসফুস। আশপাশে আর সবুজের চিহ্ন নেই। একে আমাদের বাঁচাতেই হবে। পরের কথা পরে। 
 

  

কিন্তু এত কিছু প্ল্যান করার পর এখনও ওদের দেখা না পেয়ে সুতপা দুঃশ্চিন্তায় পড়ে। ঘুম থেকে উঠেও সকলকে একবার ফোন করেছিল। কিন্তু আশ্চর্য সকলের ফোন বন্ধ। তখন ভেবেছিল কুড়ের হদ্দগুলো ভোররাতে ঘুমিয়েছে তাই বোধহয় উঠতে পারেনি। এদিকে ঢোল কলমির মাথায় দিনের প্রথম সূর্যের আলো এসে পড়েছে। শিশিরে ভেজা বর্মার ডগ, হিঞ্চের কচি সবুজ পাতা সকালের রোদে চকচক করছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্য পূর্ণতেজে উঠে পড়বে। এখনও সকলের ফোন বন্ধ দেখে আর অপেক্ষা না করে সুতপা, সুনীলের বাড়ির দিকে পা বাড়ায়। 
    

 

পাড়ার কাছে এসেই বুঝতে পারে কেমন একটা থমথমে ভাব পাড়াটায়। প্রতিদিনের মতো সকালের ব্যস্ততা নেই। একটামাত্র রিক্সা ওদের গলির মোড় থেকে বেরিয়ে গেল। ওকে দেখামাত্র কোথা থেকে ছুটে বেরিয়ে এল সুনীলের ভাই। চোখে মুখে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ। একপ্রকার হাত ধরে টেনে আড়ালে সরিয়ে নিয়ে বলল- 
‘সুতপাদি ওদিকে যেও না। ওরা তোমাকেও খুঁজছে।’
‘আমাকে, কারা?’ 
‘আমাদের বাড়ি ভোর থেকে ঘিরে ফেলেছে পুলিশ। আমি পিছনের দিক থেকে পালিয়ে দীপকদা, কিশলয়দাকে ডাকতে গিয়ে দেখি ওখানেও একই অবস্থা। তাই তোমাদের বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম। তোমাদের বাড়িতেও পুলিশ। তুমি এখুনি এখান থেকে পালিয়ে যাও।’

 

 


সুতপার ফোন পেয়ে আমি মুহূর্তে ছুটে আসি। ফুটফুটে উজ্জ্বল মেয়েটা আকস্মিক ঘটনার অভিঘাতে একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। শিকড় ছেঁড়া ঘাসের মতো আমার কাঁধে মাথা রেখে কেঁদে চলেছে। আমি ততক্ষণে জেনে গেছি সুনীল, দীপক, কিশলয়ের সঙ্গে সুতপার নামেও সন্ধ্যায় ওই জলাশয়ের ধারে বসে মদ, গাঁজা খাওয়া এবং এসব পাচারের চক্র এরা চারজন- এই অভিযোগ করা হয়েছে থানায়। সুতপার বাড়িতেই আগে গিয়েছিল পুলিশ। সুতপা আগে বেরিয়ে আসায় বাকি তিনজনের বাড়িতেই ওকে পাওয়া যাবে এই ভেবে ওদের সকলের বাড়ি ঘিরে ফেলা হয়েছে। 

 

 

   
সুতপাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই। এত আর মৃত্যুশোক নয়, সবুজ ধ্বংসের শোক। আমাদের সভ্যতা ধ্বংসের শোক। এ শোক সকলকে স্পর্শ করে না। কোনওদিন করবে কিনা তাও আমাদের জানা নেই। 

 


   
সুতপা কাঁদছে আর বলছে- ‘আসার সময় দেখি, পুলিশ দাঁড়িয়ে থেকে জলাশয় পরিস্কার করাছে। আমাদের সবুজের দেশ ওরা তছনছ করে দিল। এবার ওটা প্রমোটিং হবে। ওখানেও কংক্রিটের জঙ্গল আর দশতলা ফ্ল্যাট উঠবে। আমরা পারলাম না, আমাদের এই শহরের ফুসফুস, জলাশয়টাকে বাঁচাতে।’    

  • উত্তম পুরকাইত