মানিকের 'অপ্রকাশিত' ভাবনা জগৎ : কলকাতা-দাঙ্গার চারটি দিন ও এক সংকটাপন্ন সময় চেতনা

মসজিদের কাছে আনোয়ার শা রোডের একদল মুসলিম স্বীকার করলেন মিটমাট দরকারকয়েকজন উত্তেজিতভাবে বললেন মেরে পুড়িয়ে তারপর এখন মিটমাটের কথা কেন? অন্যেরা তাঁদের থামালেন ফাঁড়ি পেরিয়ে পুলের নীচে যেতে এল বিরোধিতাহিন্দুদের কাছ থেকে কিসের মিটমাটমুসলমানেরা এই করেছে, ওই  করেছে! 'ব্যাটা কমিউনিস্ট' বলে আমায় মারে আরকি! প্রায় দেড়শো লোক মিলে ধরেছিল" ১৮ অগাস্ট, রবিবারে হিংসা ও উত্তেজনার ছবি অপরিবর্তিত রয়েছে মানিকের ডায়েরির পাতায় মিটমাটের চেষ্টা ব্যর্থ হবে, তিনি বুঝতে পারছিলেন তথাকথিত নেতাদের বক্তৃতায় সাম্প্রদায়িক কু-যুক্তির চাষ কীভাবে হয় তা মানিকের বিবরণীতে উঠে এসেছে কে.পি রায় লেনের বাঁকে পুনরায় মানিককে উগ্র-সাম্প্রদায়িক হিন্দু ছোকরার দল ঘিরে ধরে মানিকের নিজের কথায় - "K.P.Roy Lane দিয়ে বাঁক পর্যন্ত এসেছিলাঠি হাতে এক ছোকরা পথ আটকেছিলফের আমায় ভিড় ঘিরে ধরল এক ছোকরা লাঠি দিয়ে মারে আর কি! — নিজেই ধমক দিয়ে তাকে ঠান্ডা করলাম ধীর শান্ত আত্মপ্রতিষ্ঠভাবনা বজায় রাখতে পারলে নিশ্চয় মার খেতাম 'শালাকম্যুনিষ্ট!' 'মুসলমানেরদালাল' রব উঠেছিল চারিদিকে" এইদিন বিকেলে পুনরায় মানিক ফাঁড়ির সামনে দিয়ে পুলের তলা হয়ে কে.পি লেন দিয়ে ঘুরে আসেন চারু মার্কেটে হাঙ্গামা, পাশে একটি বাড়িতে আগুন লাগার খবর পান মানিক উত্তেজিত-হিংস্র সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে এক সাহিত্যিকের একলা চলার অবস্থান উঠে এসেছে বারবার – "K.P Lane- এ বহুলোকউত্তেজিত, হিংস্র ছাদ থেকে এক বেটা চীৎকার করল — 'ওই সেই ব্যাটা ঔপন্যাসিক যায়!’ ধীরপদে চলতে  লাগল [লাগলাম] একজন পাশে চলতে চলতে লজ্জিতভাবে বলল — ‘দেখে যা ভাবছেন তা নয় কিন্তুসবাই উত্তেজিত কিন্তু aggressive নয় "১৮ তারিখের ডায়েরির 'এন্ট্রি' শেষ হয় এইভাবে - "ব্রিটিশ সিংহ বুঝি মুচকে হাসছে?" মানিক সম্ভবত জানতেন, ১৯৩২ সালে 'সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা নীতি'র মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসন ভারতবর্ষের বুকে যে দ্বিজাতিতত্ত্বের বীজ বুনেছিল তা এই চরম অবস্থায় এসে সফল হয়েছে ধর্মে-ধর্মে বিভেদ তৈরি এবং ধর্মের ভিত্তিতে দুটি দেশের নির্মাণ প্রকৃতপক্ষে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের গভীর পরিকল্পনার অংশ 'ব্রিটিশ সিংহে'র মৃদু হাসি কি সেই কারণেই নয়?

 

 

১৯ অগস্ট ১৯৪৬, সোমবার ধীরে ধীরে মানিকের এক সংকটাপন্ন ও ক্ষয়িষ্ণু মনের সন্ধান আমরা পাই  তিন হাজার জনের মৃত্যুর খবর পান তিনি রেডিও মারফত হিন্দফৌজের প্রাক্তন একমেজরের প্রসঙ্গ এই অংশে এসেছে গলির মোড়ে মোড়ে কাঁটাতারের বেড়া ফেলা হয়েছে তার পরামর্শে প্রথমে মানিক এই উদ্যোগে খুশি হলেও, ক্রমে বুঝতে পারেন যে 'তিনি শুধু হিন্দু সংগঠন করছেন' মানিকের বয়ানে এই মিলিটারির উদ্দেশ্য 'সংঘর্ষ বাঁচানো', শান্তি রক্ষা নয় –"গলির মোড়ে মোড়ে তারকাঁটার বেড়া পড়েছেহিন্দফৌজের ভূতপূর্ব্ব একজন মেজরের পরামর্শে কথা শুনে প্রথমটা খুশি হয়েছিলামপাঁচ মিনিটের মধ্যে টের পেলাম তিনি শুধু হিন্দুসংগঠন করছেন তাদের কাছে Military disciple [discipline?] দাবি করছেন: সংঘর্ষ বাঁচানো, শান্তি বজায় রাখা আসল উদ্দেশ্য নয়"

 

 

তবে নতুন ধরনের চেতনাও অনেকের মধ্যে দেখা যাচ্ছিল কয়েকজন হিন্দু ও মুসলিম জনগণ যথাক্রমে সারোয়ার্দ্দি ও হিন্দুনেতাদের সমালোচনায় মুখর উভয়পক্ষের নেতাদের প্রতি এক অনাস্থা ধীরে ধীরে মানিক দেখতে পেয়েছিলেন মানুষের মধ্যে – “তাঁরা টের পেয়েছেন যে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট নেতাদের নাচাচ্ছেকংগ্রেস লীগ দুয়েরই নেতাদের নেতারা এসে হাঙ্গামা মেটাতে পারবেন সাধারণের মনে এ বিশ্বাসের একান্ত অভাব দেখলাম গুজব যে জিন্না সায়েব কলকাতা এসেছেন কংগ্রেস নেতা আসছেন কিন্তু কেউ ভরসা পেয়েছে মনে হয় নাএই দিনের লেখার শেষ কয়েকটি বাক্যে মানিকের ভেতর এক হতাশার ভার ক্রমে বেড়ে উঠেছে সেজন্যই হয়ত আর এইসময়কে কেন্দ্র করে কোনও লেখা ডায়েরিতে পাওয়া যায় না ১৯ অগাস্টের পরবর্তী ডায়েরির 'এন্ট্রি' সোজা ৭ ডিসেম্বর, ১৯৪৬ তারিখে, সম্পূর্ণ এক ভিন্ন প্রসঙ্গে চারদিনব্যাপী যে ভয়াবহ হিংসা তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন তা জন্ম দিচ্ছে এক আপশোষও কিছুটা বোধহয় অক্ষমতারও তিনি বুঝতে পারছেন মানুষের মধ্যে ভয়, উত্তেজনা, অবিশ্বাস কমতে কমতে সাধারণ অবস্থা ফিরে আসছে উস্কানি না থাকলে কয়েকদিনের মধ্যেই অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে যাবে, এমনই তাঁর আশা কিন্তু তার আগে মানিকের এক সংকটাপন্ন স্বর পাঠক শুনতে পান - "উত্তেজনা, উগ্র ভয়ার্ত্ত হিংস্র উত্তেজনা, নিজেকে ক্ষয় করছে টের পাচ্ছি অসুবিধায় সকলের প্রাণান্ত হচ্ছে কার কি লাভটা হল বারবার কানে আসছে" শুধুমাত্র সাহিত্য ও জীবনের আদর্শের জন্য, নিজেকে ক্ষয় করেও, মানিক পৌঁছিয়ে দিতে চেয়েছিলেন মানুষে-মানুষে শান্তির বার্তা দাঙ্গাবিধ্বস্ত শহরে চারটি দিন মধ্যবিত্তসুলভ ভয়কে অগ্রাহ্য করে তিনি বেরিয়ে পড়েছিলেন শহরের প্রকাশ্য রাজপথে বুঝতে চেয়েছিলেন দাঙ্গার প্রকৃতি, চেষ্টা করেছিলেন শান্তি প্রতিষ্ঠার শুধুমাত্র শব্দের ভাঁজে আবদ্ধ রেখে নয়, তা অতিক্রম করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এভাবেই হয়ত নিত্যযাপনের মধ্যে ধারণ করে রেখেছিলেন তাঁর আদর্শকে তাঁর জীবনকে 'পড়া'র তাৎপর্য ঠিক এখানেই

 

     

কলকাতা দাঙ্গার এই চারটি দিন মানিকের চোখে যেভাবে উঠে এসেছে তার ভূমিকা হয়ত মানিকের নিজস্ব সাহিত্য ভাবনার সঙ্গেও কিছুটা যুক্ত 'লেখকের কথা' গ্রন্থের অন্তর্গত 'সাহিত্য করার আগে' প্রবন্ধটিতে মানিক লেখেন, "ভদ্রজীবনের বিরোধ, ভন্ডামি, হীনতা, স্বার্থপরতা, অবিচার, অনাচার, বিকারগ্রস্ততা, সংস্কার-প্রিয়তা, যান্ত্রিকতা ইত্যাদি তুচ্ছ হয়ে এ মিথ্যা কেন প্রশ্রয় পায় যে ভদ্রজীবন শুধু  সুন্দর ও মহৎ? ভদ্রসমাজের বিকার ও কৃত্রিমতা থেকে মুক্ত চাষি-মজুর-মাঝি-মাল্লা-হাড়ি-বাগদিদের রুক্ষ কঠোর সংস্কারাচ্ছন্ন বিচিত্রজীবন কেন অবহেলিত হয়ে থাকে, কেন এই বিরাট মানবতাযে একটা অকথ্য অনিয়মের প্রতীক হয়ে আছে মানুষের জগতেসে সত্যটা স্থান পায় না?" মানিকের জন্মগত অবস্থান এই মধ্যবিত্ত ভদ্রজীবনের অন্দরমহলেই কিন্তু তাঁর সাহিত্যভাবনা শ্রেণিচেতনায় দীপ্ত এই ডায়েরিতে উঠে আসা মানিকের দৃঢ় সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী অবস্থান তাঁর জীবনকেও তাঁর সাহিত্যভাবনার প্রতিনিধি করে তুলতে পেরেছে দাঙ্গার সময়ে সকলে যখন নিজের স্বার্থ বা জাতিস্বার্থ নিয়ে ভাবিত তখন মানিক নিজের ভেতর স্বার্থপরতার পাথরের এতটুকু ভার জমতে দেননি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছেন, গেছেন মুসলমান-পাড়ায়, কথা বলেছেন মানুষের সঙ্গে বিভেদের যে চরম বিকার তার বিরুদ্ধে ভালোবাসার মানবিক আবেদন হয়ে উঠেছে মানিকের প্রধান হাতিয়ার আপাতভাবে পৃথক মনে হলেও, আমাদের মতে এই অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদের ভাবনা তাঁর শ্রেণিচেতনারই এক অবিচ্ছিন্ন অংশ অসাম্প্রদায়িকতার তাৎপর্য যে এখনও  কতখানি প্রাসঙ্গিক বর্তমান ভারতবর্ষে তা আমাদের জানা প্রতিদিন খবরের কাগজে উঠে আসছে বর্তমানের বিপর্যস্ত সময়ের ছবিসেই তাৎপর্যে ও ডায়েরির এই নির্দিষ্ট অংশের একটি আবশ্যক পাঠ তৈরি হতে পারে সর্বোপরি মানিকের এই 'দেখা'র মধ্য দিয়ে পাঠক একপ্রকৃত শিল্পীর সংকটাপন্ন সময়চেতনার ঝলক দেখতে পান নিজের সময়ে দাঁড়িয়ে, রাজনীতির তোয়াক্কা না-করে, শ্রেণিস্বার্থের তোয়াক্কা না করে তিনি বুঝছেন, বোঝার চেষ্টা করছেনকোণঠাসা মানুষের জীবন এক অবিনাশী দ্রষ্টার সময়চেতনা, তা যতই সংকটে বিধ্বস্ত হোক না কেন, শেষ অবধি বলে মানবতার কথাই সময়ের সংকটও শিল্পীর আদর্শের সংঘাত যতই অসম হোক না কেন, কোথাও না কোথাও আদর্শের সত্য পায় এক বৃহত্তর জয় সময়কে ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর অবধি প্রসারিত তাঁর কথা এই ডায়েরিতেই মানিক এক জায়গায় লিখছেন, "ভালোবাসতে না দেওয়াই চরম নিষ্ঠুরতা" এই 'নিষ্ঠুরতা'র বিরুদ্ধে মানিক লড়াই চালিয়েছেন আজীবন এই চারটি দিনের মতো আরও অনেক-অনেকদিন ধরে চলেছে তাঁর লড়াই সাহিত্যের ভেতরে, সাহিত্যের বাইরে সব ধরে রাখতে পারেনি তাঁর ডায়েরি যে টুকু রাখতে পেরেছে, সেটুকুই সম্পদ তা যেন 'অপ্রকাশে' না থাকে বেশিদিনএ দায়িত্ব আমাদের

 

তথ্যসূত্র :

 যুগান্তর চক্রবর্তী (ভূমিকা, টীকা ভাষ্য ও সম্পাদনা) – অপ্রকাশিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় : ডায়েরি ও চিঠিপত্র

 মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় - 'লেখকের কথা'; ভূমিকা ও সম্পাদনা সুশান্ত পাল

 The British Library Archives, London - 'Report to Viceroy Lord Wavell'.

 Ramchandra Guha (23 August, 2014) —   "Divided or Destroyed – Remembering Direct Action Day" (The Telegraph).

  • দীপ্তাংশু রায় মুখার্জি
  • দ্বিতীয়