মাগরিবের ছায়া

হাতের আঙুলে কিছু একটা জড়িয়ে শূন্যে পাক খাওয়াতে খাওয়াতে তারামনকে মাঠের আলপথ দিয়ে আনমনে চলে যেতে দেখে ওর বাপের সঙ্গে যারা কাজ করে বেশ অবাক হয়ে গেল। জোরে ডাক দিল একজন; ওরে তারা, যাছিস কোন দিকি? তোর আব্বায় ঠিক আছে তো? মাঠে আসিনি কেনে আজ?

 


মাঠ থেকে ডাক শুনে সম্বিত এল তারার। এতক্ষণ আনমনে দাদি আম্মার কাছ থেকে পাওয়া তছবিটাকে খেলার জিনিস ভেবেই নিজের মনে সে ঘুরিয়ে চলছিল। কোথায় যে যাচ্ছিল, তা সে নিজেই জানে না। হঠাৎ করে বাড়ির পরিবেশটা যে বদলে গেছে সেটা বুঝেছে তারা। কিন্তু সেই বদলের কারণ কী? মৃত্যুপথযাত্রী দাদি আম্মাকে ঘিরে বাড়ির সকলের, এমনকী পড়শিদের ভিতরেও যে বিষাদমাখা স্বরলিপি উঠে আসছে, সেই সুরের সাম্পানকে কানে নিলেও, কলজেতে নেওয়ার মতো বয়স তখন তাঁর হয়নি। মৃত্যুর বিচ্ছেদ এই শিশুমনটাতে তার আগে কখনও দাগ কাটতে পারেনি। পড়শি দু’চার জনের যে তারা হাঁটতে চলতে পারার পর ইন্তেকাল হয়নি, তা নয়। তবে আশপাশের জনমানুষের ঘরের শোকের স্পর্শ তারার দিলে কোনও অনুভূতি জাগাতে পারেনি। আজ ঘরের মানুষ, তার দাদা আম্মা, যার কোলেপিঠে করে তারার বেড়ে ওঠা, তাঁর মৃত্যুশয্যাও তাই বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি তার পক্ষে।
  
   

          
দাদি আম্মাকে নামাজের শেষে এই সাদা স্ফটিকের মালা আঙুলে করে ঘোরাতে দেখেছে তারা। স্ফটিক বোঝার মতো অবস্থাও তখন তার নয়। তারার কাছে দাদা আম্মার তছবি হল; ভারি সুন্দর সাদা পুঁতির মালা। যে মালাতে রোদের ছোঁয়া লাগলেই রঙিন ঝিলিক বের হয়।
                  
 


নানাভাবে দাদি আম্মার কাছ থেকে সেই মালাটা হস্তগত করবার চেষ্টা যে তারামন করেনি, তা কিন্তু নয়। কিন্তু তারার কাছে যেটা নিছক খেলার সামগ্রী বলে মনে হয়েছিল, সেটা যে তার দাদি আম্মার প্রাণ। খাজাবাবার দরগায় এস মে আজমে আত্মনিবেদিত এক ফকির সাবে যে তাঁকে এই তছবি দিয়েছেন। এই মহার্ঘ্য বস্তুটি তিনি করে দেবেন নাতনিকে? যতোই প্রাণের ধন হোক তারামন,  তছবির গুরুত্ব যে বোঝার বয়স তার এখনও হয়নি।
   


 
সেদিন তছবিটি প্রাণের নাতনিকে না দিলে পারলেও আজ মৃত্যুব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে তারার দাদি আম্মা যখন বুঝলেন এই দুনিয়াদারির মায়াজাল কাটানোর সময় তাঁর হয়ে এসেছে, তখন আর এক মুহূর্ত দেরি করলেন না। খালাস চাওয়ার আগেই তছবিটা সঁপে দিলেন প্রাণের তারার ছোট্ট হাতখানাতে। সেই হাতেই তুলে দিলেন জায়নামাজটাও।
                        
 


তারার আব্বার শার্গিদেরা  যখন দেখল সেই মালাটা, তাদের বুঝতে অসুবিধা হল না সবটা। তারা নিজের দাদির কাছ থেকে পাওয়া তছবি নিয়েই আনমনে হেঁটে চলেছে, এটা না বুঝলেও সেই চাষাভুষো মানুষেরা ভাবলেন; খেলার ছলে কার না কার তছবি নিয়ে পথে নেমে পড়েছে মেয়েটা।
 উরি ছ্যেমড়ি রে, কার থনে তছবি নিয়ে তুই খেলা করথিছিস?
মোরে তো এটি দাদিআম্মু দিলেক। মুই কেনে পাড়া ঘরের মাইনসের জিনিস লিতি যাব? কয় বলে, বেবাক বাড়িতি কাঁইন্দতে নেগেছে, আমার বাপু অতো কাঁন্দন ভালো লাগেনি।
কান্দে ক্যান তোর ঘরের মানসে?- তারা কে প্রশ্ন করে তার বাপের সহকর্মীরা।
মোর দাদিআম্মু শুইয়া শুইয়া ফ্যাল পাড়ি প্যাঁচাল পাড়তিচে। তাই তো আব্বুও বাচ্চার পানা কাইন্দতে নেগেচে।
তারামনের কথা শুনেই ওর বাপের মাঠের সাথিরা খানিকটা আন্দাজ করতে পেরেছে কী ঘটনা ঘটছে।
তুই এখন যাস কোথা? এট্টা দাঁড়া। আমরা হাতের কাজটুক শেষ করেই তোর বাড়ি যাচ্ছি।
কথাগুলো শুনে তারামন কেমন অবাক হয়ে গেল। তার আব্বার সঙ্গে মাঠে যারা কাজ করে, তারা কখনও সখনও তাদের বাড়ি যায় বটে, কিন্তু এই ভরদুপুরবেলা, মাঠের কাজ ফেলে রেখে কেউ কখনও একা নয়, আবার দল বেঁধে তাদের বাড়ি গিয়েছে বলে তো মনে পড়ে না-- তারামন ভাবে আর হাতের আঙুল দিয়ে বনবন করে ঘোরাতেই থাকে দাদি আম্মার কাছ থেকে কিছু সময় আগে পাওয়া তছবিটা।
    


                      
আব্বার সাগরিদদের সঙ্গেই বাড়িমুখো হয় তারামন। ভরা চাষের কালে মাঠ ছেড়ে সকলে আসতে পারেনি। কিন্তু তারার বাপের এই বিপদকে এড়িয়ে যাওয়াও তার সহকর্মীদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। কাজের সময়ে নিজেদের ভিতরে কাজের কিসিম নিয়ে বিবাদ - বিসংবাদ যে হয় না, তা নয়। তাই বলে কারও বিপদ শুনলে কানে রুই এঁটে থাকবে- এমনটাও কেউ নয়। তাই হাতের কাজ সামলেই কয়েকজন মিলে পা চালায় তারামনের বাড়ির দিকে।
    


                       
বাড়ির পিছন দিকের ডোবার ধার ঘেঁষে সরু পায়ে হাঁটা পথ দিয়ে রাস্তা সহজ করে নেওয়া অভ্যাস তারার। এই শর্টকার্ট পথ আবার জানা নেই তার বাপের সহকর্মীদের। তাই সবাইকে পথ দেখিয়েই আনতে হচ্ছে তারাকে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই বাড়ির দিক থেকে সমবেত কান্নার আওয়াজ পায় তারামন। প্রথমটায় বুঝতে পারে না কোন দিক থেকে আসছে এই আওয়াজ। আর সমবেত কান্নার আওয়াজের সঙ্গে সেভাবে পরিচয়ও নেই তার। ফলে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আসা আব্বার সঙ্গে মাঠে চাষ করা মানুষজনের দিকে কেমন যেন একটা বিস্ময় ভরা চোখে তাকায় সে। মনের বিস্ময় তারার চোখের চাউনিতে ফুটে উঠেছে।

   

                               
মুক্তোপুর শ্মশান লাগোয়া গঙ্গার ঘাটে যখন ময়নার ছোট বোন লায়লা জলে ডুবে গিয়েছিল, সেই সময়টায় কুমোরপাড়াতে বেশি সময় থাকত না তারামন। ভোলা মিঞা বেঁচে থাকতে বরের সোহাগ তো দূরের কথা, দু’বেলা পেট ভরে খাবার জুটত না এখানে। কেন যে জুটত না, তার হিশেব নিকেশ করলে চমকে ওঠে তারা। ভোলার ছিল নদিয়া মিলে পার্মানেন্ট চাকরি। চটকলের তখন বেশ রমরমাও। তাই হপ্তা যখন মিলত সেকালের হিসেবে খুব কম টাকা আসত না ভোলার হাতে।
   

                  
 
মিলের গেট তখন ছিল ঘোষপাড়া রোড থেকে ডান দিকে যে রাস্থাটা শ্মশানের কাঠ জোগানদার কমল সিংয়ের বাড়ি, সেই রাস্তাতে। একটু গলির ভিতরেই চটকল শ্রমিকদের তৈরি করা শিব মন্দির, স্থানীয় লব্জে যেটা হয়ে গেছে, 'পান্ডাল', সেই মন্দিরটার ঠিক পিছন দিকটাতে ছিল মিলের গেট। গেট বরাবর ছিল কয়েকটা চায়ের দোকান। উৎকলবাসীদেরও বেশ রমরমা ছিল এই নদিয়া মিলকে ঘিরে। সংগঠিত সাম্প্রদায়িক ভাবনা তেমন কিছু না থাকলেও ওড়িয়াভাষী শ্রমিকেরা হিন্দিভাষী -এর চায়ের দোকানে খুব একটা ভিড় জমাত না। তারা যেত পান্ডালের একটা পিছন দিকে, নদিয়া মিলের গেটের উল্টো ফুটে রাজার দোকানে আর খুচখাচ দু’একটা চায়ের দোকান থাকলেও, মিল শ্রমিকদের ভিড়ে সারাটাদিন একদম জমজমাট হয়ে থাকত ঘোষপাড়া রোডের উপরে,  কুলি ডিপো বাস স্টপেজটার ঠিক গায়েই পরসাদীর দোকানে।
 

           
 
উথলে পড়া যৌবনের, গায়ে গতরে বেশ হৃষ্টপুষ্ট ময়নাকে বিয়ে করে আসার থেকেই দেখছে তারামন। গাঁয়ের মেয়ে তারা। বিয়ে নামক দুর্ঘটনাটির আগে সেভাবে কখনও শহরমুখো হয়নি তারামন। একবার মামনীদের সঙ্গে গিয়েছিল হাজিনগরে চশমাবাবার ঔরসে।ওইটুকুই যা তার শহর দেখা। পায়ে হেঁটে গাঁ থেকে ভাটপাড়া মোড় পর্যন্ত আসতেই সময় লেগে গিয়েছিল প্রায় ঘন্টা দেড়েক। জোহর ওরা রওনা হয়েছিল ছেরামপুর থেকে। আর ভাটপাড়া মোড়ে পৌঁছে একটা মিষ্টির দোকানে যখন ওদের একটু জল খাওয়াতে নিয়ে গেল মামুজান, তার একটু পরেই আসেরের আজান পড়েছিল। মিষ্টির দোকানে সকলকে বসিয়ে পাশের মসজিদে নামাজ আদায় করতে গেছে মামাজান।
 

              
 
বছর বারো তেরোর তারামন তখন অবাক চোখে সামনের রাস্তাঘাট দেখছে। ঘোষপাড়া রোড দিয়ে তখন শুধু বাসই নয়,  রমরমিয়ে চলা চটকলগুলোর কাঁচামাল নিয়ে যাওয়ার ঢাউস লরির নিত্য আনাগোনায় রাস্তা একদম সরগরম। যে দোকানটায় ওদের বসিয়ে গিয়েছিল মামা, তার ঠিক উল্টো দিকে লম্বা রাস্তা চলে গিয়েছে গঙ্গার দিকে। পাশেই ফায়ার ব্রিগেডের অফিস। বড় বড় দমকলের গাড়িগুলো মাঝে মধ্যেই ঢং ঢং ঘন্টা বাজিয়ে চলে যাচ্ছে। আবার কোনও কোনওটা কাজ মিটিয়ে আসছেও ওইরকমই ঘন্টা বাজাতে বাজাতে।

 


                          
অমন বড় লাল রঙের গাড়ির পিছনে পেল্লায় পেতলের ঘন্টা বাজাচ্ছে খাঁকি রঙের পোষাক পরা একটা লোক-- এমন দৃশ্য কখনওই -এর আগে তারামন দেখেনি। ডাগর চোখে এইসব মফস্বলী শহুরের কেতা দেখছে না তারামন, কার্যত গিলছে। শেষে আর থাকতে না পেরে দমকলের গাড়িগুলো ঘিরে নিজের বিস্ময়ভরা প্রশ্ন করেই বসল আম্মি কে- ও আম্মু, অমন তরো লাল লাল ঢাউস গাড়িতে ঢং ঢং করে ওই নোকটা ঘন্টা দেছে ক্যেনে?

 

                    
কোতাও হয়তো আগুন লাগিয়ে, তাই ওরা নোক নস্কর লয়ে যাচ্ছে কুনি। তাদের গাঁয়ে তো কতোই ঘরে আগুন লাগে, যে যেখানে থাকে, হুল্লোর করে জোটে। বালতি, ঘটি, বদনা, সানকি করে ডোবা, তালাও - যেখান থেকে পারে পানি আনে। দৌড়োদৌড়িই সার হয়। পানি পড়তে থাকে আগুনে। কিন্তু আগুনও তার লকলকে জিভ বাড়াতেই থাকে। কই মোদের গেরামে তো আগুনের তরে অমন গাড়ি আসেনি কো-- ভাবতেই থাকে তারামন।

 (ক্রমশঃ)

  • গৌতম রায়