ভগিনী নিবেদিতা ও রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী সমাজের পরিকল্পনা অনুসারে আন্দোলন শুরু করেন। আবশ্যিকভাবে স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহারের কথা বলেন। অরবিন্দের ছোট ভাই বারীন ঘোষকে দায়িত্ব দেওয়া হয় শহর ও গ্রামের বিপণন কেন্দ্রে স্বদেশী দ্রব্য সরবরাহের। নিবেদিতা শহরে কাজ শুরু করেন এবং রবীন্দ্রনাথ গ্রামে। স্বদেশী আন্দোলনের প্রথম যুগে রবীন্দ্রনাথ এবং নিবেদিতা শুধু বক্তার আসনে থাকেননি। তাঁরা ভারতবর্ষকে শিল্পে স্বাবলম্বী হতেও শিখিয়েছেন। নিবেদিতা রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধক বাণীগুলিকে ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে রঙিন করে লিখিয়ে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখতেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জোড়াসাঁকোয় দেখা করে তাঁর লেখা স্বদেশী সংগীতগুলির প্রশংসা করেন। তবে রবীন্দ্রনাথ দেশের জন্যও সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দিতে চাননি। নিবেদিতার সঙ্গে এই বিষয়ে তাঁর মতপার্থক্যের কথা তিনি স্পষ্টভাবে বলেওছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “তোমার বিশ্বাস আছে, শক্তি আছে। তুমি হিংসাত্মক বিপ্লবের কথা বলিতে পার, কিন্তু তোমার চারিদিকে যে যুবকদল আসিয়া জুটিয়াছে তাহাদের বিশ্বাসও নাই, শক্তিও নাই। তাহারা হাতের কাছে যেমন তেমন একটা কাজ চায় মাত্র। তুমি না থাকিলে তাহারা কিছুই করিতে পারিবে না।”

 

 

নিবেদিতার লেখা ‘দ্য ওয়েব অফ ইন্ডিয়ান লাইফ’ এর ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবি বইটির ভূমিকা বাক্যে লিখেছিলেন She did not come to us with the impertinent curiosity of a visitor nor did she elevated herself on a  special high pitch with the idea that a bird’s eye view is truer than the human view because of its superior aloofness She lived our life and came to know us by becoming one of ourselves. রবীন্দ্রনাথই তাঁকে বলেছিলেন ‘লোকমাতা’! ভারতবাসীর সঙ্গে নিবেদিতার ছিল বাৎসল্যের সম্পর্ক। ঠাকুরবাড়ীর আর একগুণী প্রতিভা শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিবেদিতা সম্পর্কে বলেছিলেন ভারতবর্ষকে  বিদেশি যারা সত্য ভালবেসেছিলেন নিবেদিতার স্থান সব থেকে বড়রবীন্দ্রনাথগভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন ভগিনী নিবেদিতা একান্ত ভালোবাসিয়া সম্পূর্ণ শ্রদ্ধার সঙ্গে আপনাকে ভারতবর্ষে দান করিয়াছিলেন, তিনি নিজেকে কিছুমাত্র হাতে রাখেন নাই। অথচ নিতান্ত মৃদুস্বভাবের লোক ছিলেন বলিয়াই যে নিতান্ত দুর্বলভাবে তিনি আপনাকে বিলুপ্ত করিয়াছিলেন তাহা নহে। পূর্বেই এ কথার আভাস দিয়াছি, তাঁহার মধ্যে একটা দুর্দান্ত জোর ছিল এবং সে জোর যে কাহারও প্রতি প্রয়োগ করিতেন না তাহাও নহে। তিনি যাহা চাহিতেন তাহা সমস্ত মনপ্রাণ দিয়াই চাহিতেন এবং ভিন্ন মতে বা প্রকৃতিতে যখন তাহা বাধা পাইত তখন তাঁহার অসহিষ্ণুতাও যথেষ্ট উগ্র হইয়া উঠিত। তাঁহার এই পাশ্চাত্য স্বভাবসুলভ প্রতাপের প্রবলতা কোনও অনিষ্ট করিত না তাহা আমি মনে করি না — কারণ, যাহা মানুষকে অভিভূত করিতে চেষ্টা করে তাহাই মানুষের শত্রু — তৎসত্ত্বেও বলিতেছি, তাঁহার উদার মহত্ত্ব তাঁহার উদগ্র প্রবলতাকে অনেক দূরে ছাড়াইয়া গিয়াছিল। তিনি যাহা ভাল মনে করিতেন তাহাকেই জয়ী করিবার জন্য তাঁহার সমস্ত জোর দিয়া লড়াই করিতেন, সেই জয়গৌরব নিজে লইবার লোভ তাঁহার লেশমাত্র ছিল না। দল বাঁধিয়া দলপতি হইয়া উঠা তাঁহার পক্ষে কিছুই কঠিন ছিল না, কিন্তু বিধাতা তাঁহাকে দলপতির চেয়ে অনেক উচ্চ আসন দিয়াছিলেন, আপনার ভিতরকার সেই সত্যের আসন হইতে নামিয়া তিনি হাটের মধ্যে মাচা বাঁধেন নাই। এ দেশে তিনি তাঁহার জীবন রাখিয়া গিয়াছেন কিন্তু দল রাখিয়া যান নাই “তিনি নিবেদিতার এদেশের প্রতি ভালবাসাকে প্রকাশ করতে গিয়ে একটি অভিনব উপমার সাহায্য  নিয়েছেন। শিবের রূপ দর্শনীয় না হওয়া  সত্ত্বেও পার্বতী তাঁকে পাওয়ার জন্য কঠিন তপস্যায় ব্রতী হয়েছিলেন নিবেদিতা এই মূর্ছিত পীড়িত তমসাচ্ছন্ন দেশকে  ভালবেসেছেন হৃদয় দিয়ে অন্তর দিয়ে। নিবেদিতার এই ভালবাসাই  তাঁকে এ দেশের মানুষের জন্য গভীর আত্মত্যগ ও কঠিন কর্মসাধনায় ব্রতী করেছিল কবি লিখেছেন শিবের প্রতি সতীর সত্যকার প্রেম ছিল বলিয়াই তিনি অর্ধাশনে অনশনে অগ্নিতাপ সহ্য করিয়া আপনার অত্যন্ত সুকুমার দেহ ও চিত্তকে কঠিন তপস্যায় সমর্পণ করিয়াছিলেন। এই সতী নিবেদিতাও দিনের পর দিন যে তপস্যা করিয়াছিলেন তাহার কঠোরতা অসহ্য ছিল — তিনিও অনেকদিন অর্ধাশন অনশন স্বীকার করিয়াছেন, তিনি গলির মধ্যে যে বাড়ির মধ্যে বাস করিতেন সেখানে বাতাসের অভাবে গ্রীষ্মের তাপে বীতনিদ্র হইয়া রাত কাটাইয়াছেন, তবু ডাক্তার ও বান্ধবদের সনির্বন্ধ অনুরোধেও সে বাড়ি পরিত্যাগ করেন নাই এবং আশৈশব তাঁহার সমস্ত সংস্কার ও অভ্যাসকে মুহূর্তে মুহূর্তে পীড়িত করিয়া তিনি প্রফুল্লচিত্তে দিনযাপন করিয়াছেন — ইহা যে সম্ভব হইয়াছে এবং এই সমস্ত স্বীকার করিয়াও শেষ পর্যন্ত তাঁহার তপস্যা ভঙ্গ হয় নাই তাহার একমাত্র কারণ, ভারতবর্ষের মঙ্গলের প্রতি তাঁহার প্রীতি একান্ত সত্য ছিল, তাহা মোহ ছিল নামানুষের মধ্যে যে শিব আছেন সেই শিবকেই এই সতী সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করিয়াছিলেন। এই মানুষের অন্তর-কৈলাসের শিবকেই যিনি আপন স্বামীরূপে লাভ করিতে চান তাঁহার সাধনার মতো এমন কঠিন সাধনা আর কার আছে?”

 

 

রবীন্দ্রনাথ, জগদীশ চন্দ্র বসু, নিবেদিতা, ক্রিস্তিন, অবলা বসু,  ক্লিফ দম্পতি, স্বামী সদানন্দ,  বেলুর মঠের সপ্তম অধ্যক্ষ স্বামী শঙ্করানন্দ বুদ্ধগয়াতে গিয়েছিলেন ১৯০৪ সালের অক্টোবর মাসে এই পবিত্র তীর্থস্থানে আনন্দময় দিন কাটিয়েছিলেন তাঁরা বুদ্ধগয়াতে তাঁরা মহান্তর অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন প্রতিদিন সন্ধার পরে নিবেদিতা light of asia ওয়রেন এর বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করতেন কবিগান করতেন ও আবৃত্তি করতেন এক একদিন বৌদ্ধ র্শ নিয়ে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হত  আচার্য বসুও এই আলোচনায় অংশ নিতেন রথন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পিতৃস্মৃতি গ্রন্থে লিখেছিলেন এক একদিন নিবেদিতা এক-একটি তর্ক তোলেন রবীন্দ্রনাথ চেষ্টা করেন যথাযোগ্য উত্তর দিতে এই তিন মনীষীর একত্রসমাবেশ একটি মনমুগ্ধকর পরিবেশ তৈরি করেছিল কয়েকদিনের তীর্থভ্রমণতার-  মধ্যে  কত গল্প কত আলোচনা কত পরামর্শই না হয়েছিল কবিপুত্র দুঃখ করে লিখেছেন আজ সেই আলোচনার কোনঅনুলিপি নেই

 

 

কবির সঙ্গে ভগিনীর সম্পর্ক ছিল মননের, অন্তরের এবং শ্রদ্ধার  দুজনেই দুজনের মননশীলতাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিলেন এই অন্তরঙ্গতা আমাদের সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করেছে গভীরভাবে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “যেমনই হউক, তিনি হিন্দু ছিলেন বলিয়া নহে, তিনি মহৎ ছিলেন বলিয়াই আমাদের প্রণম্য। তিনি আমাদেরই মতন ছিলেন বলিয়া তাঁহাকে ভক্তি করিব তাহা নহে, তিনি আমাদের চেয়ে বড়ো ছিলেন বলিয়াই তিনি আমাদের ভক্তির যোগ্য। সেই দিক দিয়া যদি তাঁহার চরিত আলোচনা করি তবে, হিন্দুত্বের নহে, মনুষ্যত্বের গৌরবে আমরা গৌরবান্বিত হইব।

 

 

তাঁহার জীবনে সকলের চেয়ে যেটা চক্ষে পড়ে সেটা এই যে, তিনি যেমন গভীরভাবে ভাবুক তেমনি প্রবলভাবে কর্মী ছিলেন। কর্মের মধ্যে একটা অসম্পূর্ণতা আছেই — কেন না তাহাকে বাধার মধ্য দিয়া ক্রমে ক্রমে উদ্ভিন্ন হইয়া উঠিতে হয় — সেই বাধার নানা ক্ষতচিহ্ন তাহার সৃষ্টির মধ্যে থাকিয়া যায়। কিন্তু ভাব জিনিসটা অক্ষুন্ন, অক্ষত। এই জন্য যাহারা ভাব-বিলাসী তাহারা কর্মকে অবজ্ঞা করে অথবা ভয় করিয়া থাকে। তেমনি আবার বিশুদ্ধ কেজো লোক আছে তাহারা ভাবের ধার ধারে না, তাহারা কর্মের কাছ হইতে খুব বড়ো জিনিস দাবি করে না বলিয়া কর্মের কোন অসম্পূর্ণতা তাহাদের হৃদয়কে আঘাত করিতে পারে না

 

 

কিন্তু ভাবুকতা যেখানে বিলাসমাত্র নহে, সেখানে তাহা সত্য, এবং কর্ম যেখানে প্রচুর উদ্যমের প্রকাশ বা সাংসারিক প্রয়োজনের সাধনামাত্র নহে, যেখানে তাহা ভাবেরই সৃষ্টি, সেখানে তুচ্ছও কেমন বড়ো হইয়া উঠে এবং অসম্পূর্ণতাও মেঘপ্রতিহত সূর্যের বর্ণচ্ছটার মতো কিরূপ সৌন্দর্যে প্রকাশমান হয় তাহা ভগিনী নিবেদিতার কর্ম যাঁহারা আলোচনা করিয়া দেখিয়াছেন তাঁহারা বুঝিয়াছেন

 

 

কবি এই মহীয়সী নারীর অন্তনিহিত প্রেরণাশক্তিকে তাঁর আদর্শকে কর্মপ্রকৃতিকে গভীর অনুভবের সঙ্গে বিশ্লেষণ করেছেন তিনি একথাও বলেছেন, নিবেদিতার কাছে তিনি যে উপকার পেয়েছেন তা আর কারকাছে পাননি নিবেদিতার আন্তরিকতা   হৃদয়বত্তা আর কবির সুগভীর সংবেদনশীল চিন্তার পরম্পরা ও ভাববিনিময় এই দুই মহান মনীষীর সম্পর্ককে গৌরবমথিত করেছে

 

 

রবীন্দ্রনাথের স্বদেশী সমাজের পরিকল্পনা অনুসারে আন্দোলন শুরু করেন। আবশ্যিকভাবে স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহারের কথা বলেন। অরবিন্দের ছোট ভাই বারীন ঘোষকে দায়িত্ব দেওয়া হয় শহর ও গ্রামের বিপণন কেন্দ্রে স্বদেশী দ্রব্য সরবরাহের। নিবেদিতা শহরে কাজ শুরু করেন এবং রবীন্দ্রনাথ গ্রামে। স্বদেশী আন্দোলনের প্রথম যুগে রবীন্দ্রনাথ এবং নিবেদিতা শুধু বক্তার আসনে থাকেননি। তাঁরা ভারতবর্ষকে শিল্পে স্বাবলম্বী হতেও শিখিয়েছেন। নিবেদিতা রবীন্দ্রনাথের দেশাত্মবোধক বাণীগুলিকে ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে রঙিন করে লিখিয়ে দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখতেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে জোড়াসাঁকোয় দেখা করে তাঁর লেখা স্বদেশী সংগীতগুলির প্রশংসা করেন। তবে রবীন্দ্রনাথ দেশের জন্যও সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দিতে চাননি। নিবেদিতার সঙ্গে এই বিষয়ে তাঁর মতপার্থক্যের কথা তিনি স্পষ্টভাবে বলেওছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “তোমার বিশ্বাস আছে, শক্তি আছে। তুমি হিংসাত্মক বিপ্লবের কথা বলিতে পার, কিন্তু তোমার চারিদিকে যে যুবক দল আসিয়া জুটিয়াছে তাহাদের বিশ্বাসও নাই, শক্তিও নাই। তাহারা হাতের কাছে যেমন তেমন একটা কাজ চায় মাত্র। তুমি না থাকিলে তাহারা কিছুই করিতে পারিবে না।”

 

 

নিবেদিতার লেখা ‘দ্য ওয়েব অফ ইন্ডিয়ান লাইফ’ এর ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবি বইটির ভূমিকা বাক্যে লিখেছিলেন She did not come to us with the impertinent curiosity of a visitor nor did she elevated herself on a  special high pitch with the idea that a bird’s eye view is truer than the human view because of its superior aloofness She lived our life and came to know us by becoming one of ourselves. রবীন্দ্রনাথই তাঁকে বলেছিলেন ‘লোকমাতা’! ভারতবাসীর সঙ্গে নিবেদিতার ছিল বাৎসল্যের সম্পর্ক। ঠাকুরবাড়ির আর একগুণী প্রতিভা শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিবেদিতা সম্পর্কে বলেছিলেন ভারতবর্ষকে বিদেশি যারা সত্য ভালবেসেছিলেন নিবেদিতার স্থান সব থেকে বড়রবীন্দ্রনাথগভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করেছিলেন ভগিনী নিবেদিতা একান্ত ভালোবাসিয়া সম্পূর্ণ শ্রদ্ধার সঙ্গে আপনাকে ভারতবর্ষে দান করিয়াছিলেন, তিনি নিজেকে কিছুমাত্র হাতে রাখেন নাই। অথচ নিতান্ত মৃদুস্বভাবের লোক ছিলেন বলিয়াই যে নিতান্ত দুর্বলভাবে তিনি আপনাকে বিলুপ্ত করিয়াছিলেন তাহা নহে। পূর্বেই এ কথার আভাস দিয়াছি, তাঁহার মধ্যে একটা দুর্দান্ত জোর ছিল এবং সে জোর যে কাহারও প্রতি প্রয়োগ করিতেন না তাহাও নহে। তিনি যাহা চাহিতেন তাহা সমস্ত মনপ্রাণ দিয়াই চাহিতেন এবং ভিন্ন মতে বা প্রকৃতিতে যখন তাহা বাধা পাইত তখন তাঁহার অসহিষ্ণুতাও যথেষ্ট উগ্র হইয়া উঠিত। তাঁহার এই পাশ্চাত্য স্বভাবসুলভ প্রতাপের প্রবলতা কোনও অনিষ্ট করিত না তাহা আমি মনে করি না — কারণ, যাহা মানুষকে অভিভূত করিতে চেষ্টা করে তাহাই মানুষের শত্রু — তৎসত্ত্বেও বলিতেছি, তাঁহার উদার মহত্ত্ব তাঁহার উদগ্র প্রবলতাকে অনেক দূরে ছাড়াইয়া গিয়াছিল। তিনি যাহা ভাল মনে করিতেন তাহাকেই জয়ী করিবার জন্য তাঁহার সমস্ত জোর দিয়া লড়াই করিতেন, সেই জয়গৌরব নিজে লইবার লোভ তাঁহার লেশমাত্র ছিল না। দল বাঁধিয়া দলপতি হইয়া উঠা তাঁহার পক্ষে কিছুই কঠিন ছিল না, কিন্তু বিধাতা তাঁহাকে দলপতির চেয়ে অনেক উচ্চ আসন দিয়াছিলেন, আপনার ভিতরকার সেই সত্যের আসন হইতে নামিয়া তিনি হাটের মধ্যে মাচা বাঁধেন নাই। এ দেশে তিনি তাঁহার জীবন রাখিয়া গিয়াছেন কিন্তু দল রাখিয়া যান নাই “তিনি নিবেদিতার এদেশের প্রতি ভালবাসাকে প্রকাশ করতে গিয়ে একটি অভিনব উপমার সাহায্য  নিয়েছেন। শিবের রূপ দর্শনীয় না হওয়া  সত্ত্বেও পার্বতী তাঁকে পাওয়ার জন্য কঠিন তপস্যায় ব্রতী  হয়েছিলেন নিবেদিতা এই মূর্ছিত পীড়িত তমসাচ্ছন্ন দেশকে  ভালবেসেছেন হৃদয় দিয়ে অন্তর দিয়ে। নিবেদিতার এই ভালবাসাই  তাঁকে এ দেশের মানুষের জন্য গভীর আত্মত্যাগ ও কঠিন কর্মসাধনায় ব্রতী করেছিল কবি লিখেছেন শিবের প্রতি সতীর সত্যকার প্রেম ছিল বলিয়াই তিনি অর্ধাশনে অনশনে অগ্নিতাপ সহ্য করিয়া আপনার অত্যন্ত সুকুমার দেহ ও চিত্তকে কঠিন তপস্যায় সমর্পণ করিয়াছিলেন। এই সতী নিবেদিতাও দিনের পর দিন যে তপস্যা করিয়াছিলেন তাহার কঠোরতা অসহ্য ছিল — তিনিও অনেকদিন অর্ধাশন অনশন স্বীকার করিয়াছেন, তিনি গলির মধ্যে যে বাড়ির মধ্যে বাস করিতেন সেখানে বাতাসের অভাবে গ্রীষ্মের তাপে বীতনিদ্র হইয়া রাত কাটাইয়াছেন, তবু ডাক্তার ও বান্ধবদের সনির্বন্ধ অনুরোধেও সে বাড়ি পরিত্যাগ করেন নাই এবং আশৈশব তাঁহার সমস্ত সংস্কার ও অভ্যাসকে মুহূর্তে মুহূর্তে পীড়িত করিয়া তিনি প্রফুল্লচিত্তে দিনযাপন করিয়াছেন — ইহা যে সম্ভব হইয়াছে এবং এই সমস্ত স্বীকার করিয়াও শেষ পর্যন্ত তাঁহার তপস্যা ভঙ্গ হয় নাই তাহার একমাত্র কারণ, ভারতবর্ষের মঙ্গলের প্রতি তাঁহার প্রীতি একান্ত সত্য ছিল, তাহা মোহ ছিল নামানুষের মধ্যে যে শিব আছেন সেই শিবকেই এই সতী সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করিয়াছিলেন। এই মানুষের অন্তর-কৈলাসের শিবকেই যিনি আপন স্বামীরূপে লাভ করিতে চান তাঁহার সাধনার মতো এমন কঠিন সাধনা আর কার আছে?”

 

 

রবীন্দ্রনাথ, জগদীশ চন্দ্র বসু, নিবেদিতা, ক্রিস্তিন, অবলা বসু,  ক্লিফ দম্পতি, স্বামী সদানন্দ, বেলুর মঠের সপ্তম অধ্যক্ষ স্বামী শঙ্করানন্দ বুদ্ধগয়াতে গিয়েছিলেন ১৯০৪ সালের অক্টোবর মাসে এই পবিত্র তীর্থস্থানে আনন্দময় দিন কাটিয়েছিলেন তাঁরা বুদ্ধগয়াতে তাঁরা মহান্তর অতিথি হয়ে গিয়েছিলেন প্রতিদিন সন্ধার পরে নিবেদিতা light of asia ওয়রেন এর বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করতেন কবিগান করতেন ও আবৃত্তি করতেন এক একদিন বৌদ্ধ র্শ নিয়ে তাঁদের মধ্যে আলোচনা হত  আচার্য বসুও এই আলোচনায় অংশ নিতেন রথন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর পিতৃস্মৃতি গ্রন্থে লিখেছিলেন এক একদিন নিবেদিতা এক-একটি তর্ক তোলেন রবীন্দ্রনাথ চেষ্টা করেন যথাযোগ্য উত্তর দিতে এই তিন মনীষীর একত্রসমাবেশ একটি মনমুগ্ধকর পরিবেশ তৈরি করেছিল কয়েকদিনের তীর্থভ্রমণতার-  মধ্যে কত গল্প কত আলোচনা কত পরামর্শই না হয়েছিল কবিপুত্র দুঃখ করে লিখেছেন, আজ সেই আলোচনার কোনঅনুলিপি নেই

 

 

কবির সঙ্গে ভগিনীর সম্পর্ক ছিল মননের, অন্তরের এবং শ্রদ্ধার  দুজনেই দুজনের মননশীলতাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিলেন এই অন্তরঙ্গতা আমাদের সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করেছে গভীরভাবে  রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “যেমনই হউক, তিনি হিন্দু ছিলেন বলিয়া নহে, তিনি মহৎ ছিলেন বলিয়াই আমাদের প্রণম্য। তিনি আমাদেরই মতন ছিলেন বলিয়া তাঁহাকে ভক্তি করিব তাহা নহে, তিনি আমাদের চেয়ে বড়ো ছিলেন বলিয়াই তিনি আমাদের ভক্তির যোগ্য। সেই দিক দিয়া যদি তাঁহার চরিত আলোচনা করি তবে, হিন্দুত্বের নহে, মনুষ্যত্বের গৌরবে আমরা গৌরবান্বিত হইব।

 

 

তাঁহার জীবনে সকলের চেয়ে যেটা চক্ষে পড়ে সেটা এই যে, তিনি যেমন গভীরভাবে ভাবুক তেমনি প্রবলভাবে কর্মী ছিলেন। কর্মের মধ্যে একটা অসম্পূর্ণতা আছেই — কেন না তাহাকে বাধার মধ্য দিয়া ক্রমে ক্রমে উদ্ভিন্ন হইয়া উঠিতে হয় — সেই বাধার নানা ক্ষতচিহ্ন তাহার সৃষ্টির মধ্যে থাকিয়া যায়। কিন্তু ভাব জিনিসটা অক্ষুণ্ন, অক্ষত। এই জন্য যাহারা ভাব-বিলাসী তাহারা কর্মকে অবজ্ঞা করে অথবা ভয় করিয়া থাকে। তেমনি আবার বিশুদ্ধ কেজো লোক আছে তাহারা ভাবের ধার ধারে না, তাহারা কর্মের কাছ হইতে খুব বড়ো জিনিস দাবি করে না বলিয়া কর্মের কোন অসম্পূর্ণতা তাহাদের হৃদয়কে আঘাত করিতে পারে না

 

 

কিন্তু ভাবুকতা যেখানে বিলাসমাত্র নহে, সেখানে তাহা সত্য, এবং কর্ম যেখানে প্রচুর উদ্যমের প্রকাশ বা সাংসারিক প্রয়োজনের সাধনামাত্র নহে, যেখানে তাহা ভাবেরই সৃষ্টি, সেখানে তুচ্ছও কেমন বড়ো হইয়া উঠে এবং অসম্পূর্ণতাও মেঘপ্রতিহত সূর্যের বর্ণচ্ছটার মতো কিরূপ সৌন্দর্যে প্রকাশমান হয় তাহা ভগিনী নিবেদিতার কর্ম যাঁহারা আলোচনা করিয়া দেখিয়াছেন তাঁহারা বুঝিয়াছেন

 

 

কবি এই মহীয়সী নারীর অন্তনিহিত প্রেরণাশক্তিকে তাঁর আদর্শকে কর্মপ্রকৃতিকে গভীর অনুভবের সঙ্গে বিশ্লেষণ করেছেন তিনি একথাও বলেছেন, নিবেদিতার কাছে তিনি যে উপকার পেয়েছেন তা আর কারকাছে পাননি নিবেদিতার আন্তরিকতা   হৃদয়বত্তা আর কবির সুগভীর সংবেদনশীল চিন্তার পরম্পরা  ও ভাববিনিময় এই দুই মহান মনীষীর সম্পর্ককে গৌরবমথিত করেছে

  • সরোজ উপাধ্যায়
  • দ্বিতীয়
img
আগের পাতা
মাগরিবের ছায়া