মাগরিবের ছায়া

দাদিআম্মা মরজুল মউতের কালে নিজের তছবি টা সঁপে দিয়েছিল তারামণের হাতে।তখন বছর চারেকের শিশু তারামণ।তছবির ব্যবহার ঘিরে কোনো ধারণাই তার নেই।তাই দাদিআম্মার থেকে হাত বাড়িয়ে তছবিটা নিয়েই সেটা গলায় পড়বার তাল ই করেছিল বছর চারেকের তারামণ। দাদিআম্মা তখন খালাস চাইছে আত্মীয় পরিজনদের কাছে।গোটা বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেছে।পাড়া প্রতিবেশিরাও ঝেটিয়ে ভিড় করেছে তারামণদের বাড়িতে।
                ফাঁক গলে বাড়ির বাইরে চলে এসেছে তারামণ। ছেরামপুর গাঁয়ে তখন এতোটুকু মেয়ের পর্দা ঘিরে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না।আসলে গ্রামেগঞ্জে খেঁটে খাওয়া বৌ ঝি দের পর্দা ঘিরে এতো বাছবিচার করতে হলে পেট চলবে কি করে? মাঝেমধ্যে কে জানে কোথা থেকে সব হুজুরের দল আসে গাঁয়ে।এশার নামাজের পর জালসা হয়।মাতব্বরদের মাথা চিবোয় ওই সব ভিন জায়গা থেকে আসা হুজুরের দল।তখন দু বার দিন কেউ কেউ পর্দা নিয়ে খুব মাথা ঘামায়।কিন্তু বাড়ির বৌ, ঝিয়েরা যদি বাদ জোহর মাঠে খাবার না পৌঁছে দেয়, মাঠে কাজ নিয়ে ব্যস্ত মানুষটার পেট ভরবে কি করে? অ্যান্ডা গ্যান্ডা গুলো যদি গোরু, ছাগল না চড়ায়, গবাদি পশু গুলো ই বা খাবে কি? অতো বিছুলি, খোল , দানা কেনার টাকা কোথায় গাঁয়ের মানুষদের?
                        মাঠের কাজে যখন ঝিমুনি আসে পেটের জ্বালায় তখন আপনিই চোখ চলে যায় দূরের পানে।কাকে যেন খুঁজে পেতে চায় চোখ? না না, পেটের জ্বালা।পেটের খিদে উসকে দেয় চোখের চাউনি।মাটি নিয়োনো , কি সার দেওয়া, বা ঘোঘ কেটে আলের জল জমিতে ঠিক মতো যাতায়াতের ব্যবস্থা করা - সব যেন মাথায় ওঠে তখন মাঠের মানুষ।কেউ হয়তো রাতের চাট্টি পান্তা খেয়ে এসেছে।অনেকের ই তা জোটে না।রাতে ভাত জোটে এমন ঘরের সংখ্যা এই ছেরামপুর গাঁয়ে কম ই আছে। এক টুকরো ভেলি গুড় বা বড় এক ঘটি জল- এই খেয়েই বেশিরভাগ চাষী সকালে মাঠে আসে।
             কোনো ঘরে একটু চায়ের রেওয়াজ আজকাল হয়েছে।ফজরের আজানের বেশ কিছু পরে , মাঠ করে এসে  গাঁয়ের দুটো চারটে ঘরে শুকনো পাতা, আকড়াবাকড়া কাঠ দিয়ে চায়ের রেওয়াজ কিছুকাল হলো চালু হয়েছে।   
                গরীবের ও গরীব দু পাঁচটা ঘরের লেখারা ভাটপাড়া, জগদ্দল, নৈহাটি - এমন কি কাঁচড়াপাড়া তেও চলে যায় কাগজ কুড়োতে, প্লাস্টিক কুড়োতে।গাঁয়ের একটু সম্পন্ন চাষী, দিনমজুরেরা ওইসব কাগজকুড়োনে ছেলেপুলের ঘর থেকে উনুন ধরাবার জন্যে কাগজ , ' পেলাসটিক' , সব কিনে আনে।এইসব থাকলে ঘরের বৌ বিটিলোকের চুলো ধরাতে সুবিধে হয়।
                            তারামণের বাপ খুব একটা সম্পন্ন চাষী নয়।তার উপরে বাড়িতে পেট কম নয়।তারামণের বাপের ফুফু বেওড়া হয়ে তারার দাদার আশ্রয়ে উঠেছিল। তারামণের আপন ফুফুর ও সেই এক ই রকম পোড়া নছিব।তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে বড় ভাইয়ের সংসারেই আছে তারা ফুফুজান। হিন্দুর ঘরে বেশিরভাগ সময়েই যেমন ঘরের মেয়ে বিধবা হয়ে ফিরলে তার দায় এড়িয়ে সেই মেয়েকে কাশীতে পাঠাবার রেওয়াজ থাকে , আর সেই রেওয়াজের জেরে সঞ্জীবন ঠাকুরদের আঙুল ফুলে কলাগাছ হতেই থাকে , তারামণদের দুনিয়াটা গরীব, বর পেট ভাত খেতে না পেলেও ফুফু , খালা, বুবুদের সম্পর্কে অমন নির্দয় নয়। বিধবা আত্মীয় দেখলে খেঁদিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ বাংলার মুসলমানের ঘরে কখনো ই নেই। একমুঠ ভাত দেওয়ার তরাসে ভয় পেয়ে ঘরের মেয়েকে কার্যত নছিবের ভরসায় পথে র শুকনো পানিতে ভাসাতে বাংলার মুসলমান সমাজ জানে না।
                  তাই সংসার চালানোর হাজার ও জোয়ারে কলুর বলদের থেকেও খারাপ দশাকে ডরায় না তরামণদের আব্বারা।দুমুঠ ভাত যদি আমার বৌ বিটিদের জোটে, মোর আম্মার জোটে, তবে আমার বেধবা ফুফু আর তার বালবাচ্চাদের ও জোটবে।খোদাতালা এই দোয়া থেকে মোকে করবিন নি কো-- মজলিসে বসে  আব্বার কাছে এই কথা শুনে , সেকথার অর্থ কি তা বোজার মতো বয়স তখন তারামণের হয় নি।তবে ফুফাতো বুইনরে যে তার গরীব বাপে কখনো ভেন্ন করে মোট্টে দেকে না-- এটা ঠাওর হয়েছিল তারা র সেই ছোটবেলাতেই বাদ জোহর বাপকে মাঠে খাবার পৌঁছে দিতে গিয়ে।
                      ইফফাত আর তারা দুজনে একসাথে মাঠে খাবার পৌঁছতে যায়।তারা তার নিজের মেয়ে আর ইফফাত বাপ মরা এতিম- এটা কখনো বোঝার উপায় ছিল না বজলুর আচরণে।বৌ ঘরের থেকে যা পা পাঠাত, মেয়ে আর ভাগ্নীর সঙ্গে ভাগ করে খাওয়াতেই অভ্যস্থ ছিল তারামণের বাপ।
            আল্যুমিনিয়ামের যুগ তখন ও আসে নি।স্টেনলেস স্টিল তো তার ও অনেক পরের কথা।বজলুর গাঁয়ের সাদেকুর কাজ করতো পলতার বেঙ্গল এনামেলে। সাদেকুরের বিবির কাছ থেকে তারামণের আম্মা অনেক তোষামদ করে এই কলাইকরা খাবারের কৌটো আনিয়েছিল। তখন ই সেই বড় সাদা , গা টা তেলতেলে, উপরে নীল রঙের বর্ডার দেওয়া কৌটোটার দাম পড়েছিল আট টাকা। নগদ টাকায় কিনতে বেশ কষ্ট ই হওয়ার কথা , তবু ও কষ্ট হয় নি তারার আম্মার।জায়নামাজের কুলুঙ্গি তে চার আনা , আট আনা, একটা- দুটো টাকা করে জমানো র চেষ্টার সুফল সেদিন পেয়েছিল বজলুর বিবিসায়েবা।
                             পুকুর ধারে ছাই দিয়ে মাজতে মাজতে সেই কৌটোর জেল্লা এখন আর নেই।তা বলে অযত্নে কৌটো বাতিল হয়েছে, তা ও কিন্তু নয়। সাদেকুরের বিবি একদিন তো দেউরির ডোবাতে বাসন মাজতে এসে তারার আম্মার নুড়োতে বাসি ছাই মাখিয়ে সেই কৌটো ডলা দেখে প্রায় রে রে করে উঠেছিল।
              আরে ইমনি করে এই বর্তন ডল্লি কি আর চেকটাই টুক থাকে কিচু এর?
                সাদেকুরের বিবি বর্ণিত ' বর্তনে' র চেকনাই তার অনেককাল আগেই উধাও হয়েছে।কলাইকরা বাসনের উপরে যে কেমিকালের পালিশ থাকে, সেই পালিশ সুখী প্রিয়তমার মতোই শৌখিন।তেলকালির দাগে প্রিয়তমার সুখী সুখী চাঁদ মুখে যেমন ঘাম, ক্লান্তি আর বিরক্তির প্রলেপ লেগে যায়, এই কলাইকরা বাসন ও হলো অনেকটা তাইই।সোহাগ করে না রাখতে পারলেই বাসনের চাম - মাস উঠে কঙ্কাল টি উঁকি দিতে থাকে।
                        তারামণের আব্বা খাবারের কৌটো টা খোলার আগে মেয়ের হাত থেকে পানির বদনাটা প্রায় কেড়েই নেয়।ঢক ঢক করে পানি ঢালে গলায়।তারামণ প্রথমটায় একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে বাপের তৃষ্ণা মেটানো মুখের দিকে।পানি গলার ভিতর দিয়ে নামার তাগিদে শিরা উপশিরা গুলোর সঙ্কোচন- প্রসারণ ও যেন নজর এড়িয়ে যায় না এতোটুকু মেয়ের।
                  তোমায় না বলিচি আব্বা, এমন ধুপের ভেতোর পানি খেয়োনিকো।ইট্টুখানি গাছের তলায় বসে, জেরিয়ে লয়ে পানি খেতে কি হয়?
                   মেয়ের গিন্নিপনায় মজাই পায় তারামণের বাপ। কৌটোর মুখ টা আলগা করে ভাত মাখতে শুরু করে দিয়েছে তখন বাপে, তারামণ আবার ঝাঁঝিয়ে ওঠে;
                     কতোকরে তোমাকে বলিচি, ভাত মাকার আগে পানি দে হাতটা ভালো করে ধুয়ি নিতে। আমার একটা কতা যদি মোর আব্বা শোনে।
                      মেয়ের আবার গিন্নিপনায় থতমত খেয়ে বদনার পানিতে হাত ধোয় , মুখে ও পানি দিয়ে কুলকুচি করে।মাঠে যারা একসাথে কাজ করছিল, তাদের ও বাড়ি থেকে খাবার এসেছে।সেসব চাষীভুষো রা তারামণের আব্বার বিটির কথায় এই স্বাস্থ্যবিধি মানা নিয়ে নিজেদের ভিতরেই হাসাহাসি করতে থাকে।সেসব দিকে এখন নজর নেই তারার বাপের।পেটে আগুন জ্বলছে।ভাত টা ফলুই মাছের ছালুন ডেলে ভালো করে মেখেছে  কি মাখে নি, না, লোকমা নিজের মুখে তুললো না সেই মানুষটি।প্রথম লোকমা তুলে ধরলো বোনের এতিম মেয়ে ইফফাতের মুখে।তারপর নিজের মেয়ে তারামণের মুখে।ভাত চিবোতে চিবোতেই ছোট্ট হাতে এক লোকমা ভাত আব্বার মুখে তুলে দিলো তারামণ।আগে অবশ্য ই হাত ধুয়ে নিয়েছিল বদনার পানি দিয়ে।
                        মাঠে থাকলে বাপ মেয়ের মুখে আগে খাবার দেবে আর মেয়েও যেন রোজা খুলছে বাপের , এমন ই পরম তৃপ্তিতে ভাতের লোকমা তুলে দেবেই বাপের মুখে। এমন বাপসোহাগী বিটি এই মফস্বল লাগোয়া গাঁয়ে বড়ো একটা চোখে পড়ে না।( ক্রমশঃ)

  • গৌতম রায়
  • (৩)
img
আগের পাতা
দৈত্য ও মানুষ