'মুসলমানীর গল্প ' রবীন্দ্রগল্পের সুন্দর নাট্যরূপ

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প,  গোটা বিশ্বের ছোটগল্পের সম্পদ। তেমন একটি গল্পকে নাটকে ফুটিয়ে তোলা মামুলি কাজ নয়। নাট্যায়ণের মুন্সিয়ানা নজর কাড়ে-


 'বাবা, সমাজ মানে তো তুমি-আমি..... তুমি পারো না এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে!' তিন-মহলার বংশীবদন তালুকদারের ছোট মেয়ে সরলার এমন সরল প্রশ্নের সামনে বিব্রত বোধ করেন তালুকদার মহাশয়। অপরদিকে, দাদার মেয়ে কমলা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পাত্র নির্বাচনে নির্ভিক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল - 'তিনি হিন্দুও নন, মুসলিমও নন ... আমার সকল ধর্ম-কর্ম ওঁর সঙ্গে বাধা পড়েছে। ... আমার না হয় দুই ধর্মই থাক।'  সম্প্রতি শিশির মঞ্চে মৃত্যুর কিছুদিন আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত গল্প অবলম্বনে নাটক 'মুসলমানীর গল্প'  মঞ্চস্থ হল ক্যালকাটা কোরাস থিয়েটারের প্রযোজনায়। ৮০ বছর পেরিয়ে এসেও গল্পের পটভূমিকা,  প্রেক্ষাপট আজও সমানভাবে দৃশ্যমান। অতীতের দর্পণে বর্তমানকে দেখতে চেয়েছে ক্যালকাটা কোরাস।

কাহিনীর কেন্দ্রে রয়েছে বাবা-মা হারা গুণী,  লাবণ্যবতী কমলা। কাকা-কাকিমার সংসারে সে উদ্বৃত্ত। কাকার সস্নেহে কমলা লালিত হলেও কাকিমা সর্বক্ষণ খড়গহস্ত! দুর্ভাগ্যবশত, কাকার মেয়ে সরলা থেকে কমলা সব বিষয়ে এগিয়ে! সে কারণে পিছিয়ে দেওয়ার সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন হয়। 
       
বাড়িতে এক স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও পরমানন্দ শেঠের লম্পট পুত্রের সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হয় কমলাকে। বিয়ে করে ঘরে ফেরার পথে দুর্ধর্ষ ডাকাত মধুমোল্লার দল দ্বারা আক্রান্ত হন। আরও এক ধর্মপ্রাণ মুসলিম বৃদ্ধ হাবির খাঁ মল্ল যুদ্ধে মধুমোল্লাকে পরাস্ত করে কমলাকে উদ্ধার করেন। বে-জাতের ছোঁয়া লাগায় কমলাকে তাঁর পরিবার জাতিচ্যুত করে! তখন নিজের বাড়িতে স্থান দেন হাবির খাঁ। বাড়ির এক মহলায় হিন্দু রীতিনীতি পালন করবার সকল ব্যবস্থা আগে থেকেই চালু ছিল। সকল ধর্মীয় আচার পালনের সুযোগ এবং ভালোবাসার ছোঁয়া পায় অসহায় মেয়েটি। ছোট থেকে কেবল অবহেলা,  লাঞ্ছনাই বরাদ্দ ছিল তাঁর কপালে। এখানে নিজেকে নুতন করে খুঁজে পায়। হাবির খাঁয়ের মেজ ছেলে করিমের প্রণয়-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েন কমলা। তারপর স্বামী এবং শ্বশুরকে সঙ্গে নিয়ে এক দুর্ধর্ষ দল তৈরির কাজে হাত লাগায় কমলা ওরফে মেহেরজান। উদ্দেশ্য - সমাজে লাঞ্ছিত, বিতাড়িত মেয়েদের উদ্ধার করে সসম্মানে বাঁচার সুযোগ করে দেওয়া। 

ঘটনাচক্রে বংশীবদনের ছোট মেয়ে সরলাও বিয়ে করে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার পথে মধুমোল্লার দলের খপ্পরে পড়ে। মুসলিম ছোঁয়া লাগার আগেই সরলাকে উদ্ধার করে কাকা কাকিমার কাছে পৌঁছে দেন কমলা। মেয়েকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে পেয়ে কাকিমা কমলাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে চাইলে অভিমানী কমলা বোনকে দূর থেকে আশীর্বাদ করে করিম খাঁয়ের হাত ধরে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। 

গল্প একাধিকবার ভাঙতে ভাঙতে সমাপ্তির দিকে এগিয়েছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে মেয়েদের অস্ত্রবিদ্যা এবং লাঠি খেলা নাটকে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। কমলা চরিত্রে নবাঙ্কিতা ঘোষ – চোখ মুখ যেমন যন্ত্রণাক্লিষ্ট,  তেমনি সেই চোখে আগুন ঝরিয়েছেন। করিম খাঁ এবং নাট্য নির্দেশক -  উভয় ভূমিকায় শুভ্রজিৎ লাহিড়ী মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছেন। বৃদ্ধ হাবির খাঁয়ের ভূমিকায় প্রবীর আদিত্যের বলিষ্ঠ কণ্ঠ দর্শক-সমাদৃত। অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় কাকার অসহায়ত্ব দারুণ দক্ষতায় তুলে ধরেছেন। কাকিমা মৌসুমী রায় ভয়ংকর সুন্দর। চতুর পরমানন্দ শেঠের ভূমিকায় রানা চ্যাটার্জি যথাযথ। অন্য আর যারা অভিনয় করেছেন - শিবানী দত্ত, রূপা দত্ত চৌধুরী, রেশমি দাসদেব, কণা মোদক, গৌরব সেন, বিকাশ শীল - এছাড়া আরও অনেকে। একটি ছোট্ট অথচ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেবারতি ব্যানার্জির অভিনয় এবং সঙ্গীত এক লহমায় নাটককে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। তবে নাটক দ্রুত এগোতে এগোতে মাঝে মধ্যে ছন্দপতন লক্ষ্য করা গেছে। সংলাপ নিয়ে কলাকুশলী আরও একটু যত্নবান হলে এই নাটক দর্শক মনে আগ্রহ তৈরি করবে।
     
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পকে নাট্যরূপ দিয়েছেন অকৈত মৈত্র। দর্শক ও মঞ্চের মাঝে সেতু বন্ধনের কাজ করেছে সীতেশ হালদারের আবহ। মঞ্চসজ্জা - বিলু দত্ত এবং আলো কল্যাণ ঘোষ। উচ্চ ও নিম্নবর্গের মাঝে ফারাক,  ধর্মীয় বিভাজনকে পেছনে ফেলে ঐক্যের ধ্বজা হাতে কমলা-হাবির খাঁরা আজও পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছেন। উত্তাল এই সময়ে বাংলার চিরন্তন চরিত্র 'ক্যালকাটা কোরাস থিয়েটার'  দর্শকের সামনে তুলে আনাতেই এই নাটকের সার্থকতা।

  • গোপাল বিশ্বাস
  • নাট্য পর্যালোচনা