মানিকের 'অপ্রকাশিত' ভাবনা জগৎ : কলকাতা-দাঙ্গার চারটি দিন ও এক সংকটাপন্ন সময় চেতনা

যে কোনও শিল্পীর আত্মজগতের মুখোমুখি আমরা হই তাঁর পরিচিত প্রকাশকে ঘিরে। এই প্রকাশের আলোয় রাঙা হয়ে থাকে তাঁর সৃষ্টি, তাঁর চিন্তাজগৎ। সাহিত্য সমালোচনার ক্ষেত্রে সেইটুকু অংশের এলোমেলো কিংবা সুগঠিত সঞ্চয়ে আমরা আমাদের দৃষ্টিতে আঁকতে চাই তাঁর অবয়ব। কিন্তু প্রকাশের বাইরে থেকে যায় চূড়ান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার যেদিক তা কি সবসময় ধরা যায়? – 


সেজন্যই হয়ত প্রকাশের বিশ্লেষণের পাশাপাশি একটি জরুরি বিষয় হয়ে ওঠে শিল্পীর 'অপ্রকাশ'কে নিয়ে কথা বলা। সেই 'না-জানা' অপ্রকাশ যা তাঁর দৈনন্দিন যাপনের টুকরো-টুকরো ঘটনা ও ভাবনার মধ্যে ধরে রাখে সেই স্রষ্টাকে। 'অপ্রকাশিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়: ডায়েরি ও চিঠিপত্র'। বইটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য সৃষ্টির আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকা সঙ্কট ও সংশয়ের কিনার ঘেঁষে এগোনো এক যাপনের ইতিকথা। নৈর্ব্যক্তিক ও ব্যক্তিগত মাত্রার একপ্রকার সংযোগ। বিশেষত মানিকের ডায়েরিপাঠের মধ্য দিয়ে নির্দিষ্ট স্থানিক-কালিক-ঐতিহাসিক মাত্রার মধ্যে আবদ্ধ একশিল্পীর দায়বদ্ধতার দিকটি স্পষ্ট হয়। বইটির ভূমিকা অংশে সম্পাদক যুগান্তর চক্রবর্তী লিখছেন, 'মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডায়েরির ব্যক্তিগত লেখার পরিপ্রেক্ষিতে আজ এ কথা বিবেচনা যোগ্য মনে হয় যে, সাহিত্য-সমালোচনার ভাষায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কঠিন নৈর্ব্যক্তিক তা ঠিক ততটাই নৈর্ব্যক্তিক নয় – বা প্রকৃতপক্ষে, বাংলা সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রসিদ্ধ নৈর্ব্যক্তিকতা ও তাঁর চূড়ান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতারই অপর দিক। বস্তুত, তেমন কোনও লেখকের পক্ষেই চূড়ান্ত নৈর্ব্যক্তিক হওয়া সম্ভব যিনি মৌলিক অর্থেও চূড়ান্তভাবে ব্যক্তিগত – যিনি তাঁর নিজের প্রতি দায়বদ্ধ’। বস্তুত মানিকের নৈর্ব্যক্তিক সাহিত্যসত্তাও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্যে জেগে থাকে এক প্রবল দায়বদ্ধ সময়চেতনা, যা বহু ‘অপ্রকাশিত’ সংকটকে ধারণ করে রেখেছে নিজের মধ্যে। তারই কিছু স্থান পেয়েছে তাঁর এই ডায়েরিতে।


মানিকের ডায়েরি নিয়ে যখন কথা হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই অগ্রাধিকার পায় তাঁর জীবনের শেষ বছর দু’য়েক, ডায়েরির পাতা জুড়ে স্থান পাওয়া এক অতিলৌকিক আপাত আত্মবিরোধমূলক স্বর। এছাড়াও মানিকের সাহিত্য-আদর্শের দিকটি কীভাবে ডায়েরির মধ্যে স্থান পেয়েছে, সেই নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। কিন্তু ঐতিহাসিকতার দৃষ্টিতে এমন এক আধুনিক চিন্তকের ভাবনাকে খুব বেশি যাচাই করা হয়নি। সেই সুযোগটি পাওয়া যায় ১৯৪৬ সালের মানিকের ডায়েরির অগাস্ট মাসের চারটি দিনের(১৬ অগাস্ট ১৯৪৬ শুক্রবার, ১৭অগাস্ট ১৯৪৬ শনিবার, ১৮ অগাস্ট ১৯৪৬ রবিবার, ১৯ অগাস্ট ১৯৪৬ সোমবার) অভিজ্ঞতার বর্ণনায়; কলকাতা দাঙ্গার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে। কিন্তু শুধুমাত্র বর্ণনাটুকু নয়, তার বাইরেও মানিকের আদর্শপ্লাবিত সময় চেতনার সন্ধান, পাঠকের কাছে অত্যন্ত জরুরি এক সম্পদ। পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের দাবিতে মুসলিম লিগ ঘোষিত 'direct action day' অর্থাৎ ১৬ অগাস্ট ১৯৪৬ - তারিখে, এলোমেলো অসমাপ্ত গল্পের অজস্র প্লটের খসড়ার মধ্য থেকে হঠাৎ উঠে আসে মানিকের এই স্বর। মহম্মদ আলি জিন্নাহ্ 'direct action day' -এর আহ্বানে সরাসরি ডাক দেন, "We do not want war. If you want war we accept your offer unhesitatingly. We will either have a divided India or a destroyed India."। এরপর সেই অগাস্ট মাসের পুরো সপ্তাহ জুড়ে যে ভয়ংকর মানবতার অপমান ঘটে, যে নৃশংসতার সাক্ষী হয় লক্ষ লক্ষ মানুষ তা ইতিহাসের পাতায় দেশের এক চিরকালীন ক্ষত। Sir Frederick John Burrows ছিলেন তৎকালীন বাংলার শেষ ব্রিটিশ গভর্নর (১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৬ – ১৪ অগাস্ট ১৯৪৭)। 'দ্য ব্রিটিশ লাইব্রেরী আর্কাইভে' সংরক্ষিত তাঁর 'Report to Viceroy Lord Wavell' অনুযায়ী প্রায় ৪০০০ জনের হত্যা ঘটে এই দাঙ্গায়। লক্ষাধিক মানুষ গৃহহারা হন। সেই কুখ্যাত সপ্তাহটিকে ব্রিটিশলব্জ 'The Week of Long Knives' হিসেবে চিহ্নিত করে। এসবই আমাদের জানা। এ সময়ের ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা হয়েছে। কংগ্রেস বলেছে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, লিগ বলেছে তাদের। ব্রিটিশ শাসন হয়েছে সফল, হয়েছে ভারত-বিভাজন। কিন্তু এই বিরাট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের বড়বড় 'ন্যারেটিভ'কে ছাপিয়ে মানিকের মতো যুগ সচেতন শিল্পীর এই সময়টিকে 'দেখা', পাঠকের কাছে হয়ে উঠতে পারে এক নতুন অভিজ্ঞান।


১৯৪৬ সালের এই সময়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় টালিগঞ্জের দিগম্বরী তলায় পৈতৃকগৃহে একান্নবর্তী সংসারে বাস করছিলেন। সম্পাদিত ডায়েরির ২৬—২৯ সংখ্যক অংশে এই বিবরণ ধরা আছে তাঁর কলমে। ১৬অগাস্ট, শুক্রবার – তারিখের লেখায়, গতরাত্রে মানিকের বাড়ির রান্নাঘর থেকে গুড়, তেল, তরিতরকারী, কলাই করাবাটি – এসব কিছু চুরি যাওয়ার প্রসঙ্গ রয়েছে। নৈরাজ্যই সম্ভবত দায়ী এই ঘটনার মূলে। মানিকের বয়ানে 'direct action day' -এর প্রসঙ্গ এসেছে এই লেখায়। কিন্তু তা শুধুমাত্র সংবাদের আকারে নয়। প্রতিটি শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রবল আপশোষ, নৈরাশ্য ও দু:খের স্রোত। একটি আধুনিক অসাম্প্রদায়িক মন যে কতদূর অবধি বিপর্যস্ত হতে পারে এমন একটি সময়ে, তার মাত্রা পাঠক এই অংশ পড়ে অনুভব করতে পারেন। মানিক লিখছেন, "আজ হরতাল – direct action day. দাঙ্গার সংবাদ শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। দাঙ্গা হাঙ্গামা হবে এক রকম জানাইছিল, তবু মনে হল — কি আপশোষ! কি আপশোষ! ক্রমাগত গুজব রটছে — চারিদিকে দারুণ উত্তেজনা। কালীঘাট  অঞ্চলে শিখদের সঙ্গে মুসলিমদের ভীষণ সংঘর্ষ হয়েছে শুনলাম। ফাড়িরও দিকে নাকি গোল বেধেছে। মসজিদের সামনে ভিড় দেখে এলাম। পাড়ার ছেলেরা উত্তেজিত হয়ে defence party গড়ছে। কি হচ্ছে বুঝতে না পেরে – ছোঁয়াচ লেগে – নার্ভাস হয়ে পড়লাম। সন্ধ্যার পর ফাঁড়ির দিকে আগুন লেগেছে নজরে পড়ল।" 


দাঙ্গার আগুনে জ্বলে ওঠা কলকাতা শহরের টুকরো টুকরো ছবি পাঠকের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কখনো কালীঘাট অঞ্চলে শিখদের সঙ্গে মুসলমানদের সংঘর্ষের ঘটনা, কখনো আবার টালিগঞ্জ ফাঁড়ির সামনে গন্ডগোলের খবর। মানিক সেইসময় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেছেন। পার্টির ছেলেদের সঙ্গে 'Peace Committee' গঠনের চেষ্টায় তিনিও তৎপর হয়ে উঠছেন। বাইরে গোটা শহরের মতো মানিকের নিজের মনেও অস্থির উত্তেজনার দাপট। আবার পার্টির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে পুনরায় দৃঢ়চেতা কমরেডের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসছে তার মনে - "রাত প্রায় ১০টায় পার্টির দুটি ছেলে এল। Peace Committee গঠনের চেষ্টা হচ্ছে – সকালে যেতে হবে। ওদের সঙ্গে কথা বলে মনের ভাব বদলে গেল। যতই গুরুতর হোক অবস্থা, হাল ছাড়বার দরকার নেই। অক্ষয়বাবুর ছেলে হৈচৈ-চেঁচামেচি ক'রে – শাঁখ আর হুইসল বাজাবার ব্যবস্থা ক'রে – পাড়াকে সরগরম ক’রে রেখেছে – ১৫/২০ মিনিট অন্তর অকারণে alarm পড়ছে। সারারাত তাই চলল। নিজেকে ছোকরা নেতা বানাচ্ছে — সকলের panic-এর সুযোগ নিয়ে। ছাঁচে ঢালা উত্তেজনা ও ভাবপ্রবণ নেতা!" একদিকে যেমন শহরজুড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় তৎপর অনেকে তেমনই অন্যদিকে উল্লিখিত অক্ষয়বাবুর ছেলের মতো 'ছাঁচে ঢালা উত্তেজনা ও ভাবপ্রবণ নেতা' মানুষের 'প্যানিকের' সুযোগ নিয়ে নিজেকে 'ছোকরা নেতা' বানাতে চেয়েছে। এমন উস্কানি-দেওয়া মধ্যবিত্ত, সুবিধাবাদী মানসিকতার দৃষ্টান্ত মানিক ধরে রেখেছেন তাঁর ডায়েরিতে।

১৭ অগাস্ট, শুক্রবারের সকালে গতদিনের ভয়ানক অবস্থার সংবাদ ধীরে ধীরে মানিক জানতে পারছেন। অনেক গুজবের মধ্যেও তিনি বুঝতে পারছেন শহরের অবস্থা কতখানি সাংঘাতিক। ট্রাম ডিপোর দিকে রাস্তার ধার থেকে মানিকের তরিতরকারি কিনে আনার বর্ণনা উঠে এসেছে - "সকালে Peace Committee গঠনের জন্য ডাকতে এল না, একটু আশ্চর্য হলাম। ভয়ানক সংবাদ আসতে লাগল। গুজব অনেক — কিন্তু তবু টের পেলাম, অবস্থা সাংঘাতিক। ট্রাম ডিপোর দিকে রাস্তার ধার থেকে তরিতরকারি কিনে আনলাম। পাড়ার মুসলিম বস্তির ভেতর দিয়ে গিয়ে আনোয়ার শা রোডের দোকান থেকে সিগারেট — মুসলমানের দোকান থেকে আলু ও সরষের তেল কিনে আনলাম। বস্তির মুসলমানেরা খুব ভয় পেয়ে গেছে। এ অঞ্চলে কোনও গোল নেই।" 

 

মানিকের অসাম্প্রদায়িক অবস্থান যে বুলি সর্বস্বতাকে অতিক্রম যাপনের মধ্যে গ্রথিত ছিল তা এই অংশটি পড়লে বোঝা যায়। 'লেখকের কথা' প্রবন্ধ সংকলনের অন্তর্গত 'লেখকের সমস্যা' (শারদ ১৩৫৪) প্রবন্ধে মানিক লিখবেন - "নিজস্ব একটা জীবন-দর্শন ছাড়া সাহিত্যিক হওয়া সম্ভব নয়। এইজন্য তাঁর শুধু বসে বসে লেখার বা প্রুফ সংশোধন করার শ্রম নয় – সবসময়  সর্বত্র জীবনকে দর্শন করার বিরামহীন শ্রম ও তাকে চালাতে হয়। "এই 'জীবন-দর্শন'ই কার্যত এমন একটি ভয়াবহ উত্তেজনাপ্রবণ অবস্থাতেও মানিককে নিয়ে যায় মুসলমানপাড়ায়। কথা বলেন তিনি তাদের সঙ্গে। ভয়ানক দাঙ্গার দিনগুলিতেও তাঁকে পথে-চলার দীক্ষা দেয়। মুসলমানের দোকান থেকে আলু ও সরষের তেল কেনেন। আপাত সাধারণ এই ঘটনাটির মধ্যে লুকিয়ে থাকে মানিকের নিজস্ব জীবনাদর্শে অটল বিশ্বাসের চিহ্ন। ১৭ তারিখ বিকেলে শান্তি-সভায় সাহায্যের জন্য তিনি এগিয়ে আসেন। তবে দ্বিজাতিতত্ত্ব যে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ভারতীয়দের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিল তার প্রভাবই জয়ী হয়। পশ্চিমের গয়লা গাড়োয়ানরা নেতা 'চৌধুরী'র হুকুমে মুসলমানদের মারে, ঘরে আগুন দেয়। বিকেলে মসজিদের কাছে আনোয়ার শাহ রোডে একদল মুসলমান মিটমাটের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করলে, কয়েকজন তাদের মধ্য থেকে বিরোধিতা করেন। বিরোধিতা আসে হিন্দুদের পক্ষ থেকেও। মানিক বোঝাতে গেলে তাঁকেও আক্রমণের মুখে পড়তে হয় - "বিকালে এ অঞ্চলে শান্তি-সভা হবে শুনলাম। খুশি হয়ে নিজে বার হলাম — যতটা পারি সাহায্য করতে। যাকে দেখছি তাকে বলছি মিটমাটের জন্য সভায় যেতে।

 

চলবে...

  • দীপ্তাংশু রায় মুখার্জি