শান্ত দিঘির মতো পুরনো জল

 স্মৃতির দুনিয়াতে আবার এক সুতো ছেঁড়ার কান্না। একটা সময় যেন হারিয়ে গেল আমাদের চেতনা থেকে ।চলে গেলেন ছন্দা সেন--

নয় ই  আগস্ট, ১৯৭৫। কলকাতা দূরদর্শনের প্রথম ঐতিহাসিক সম্প্রচার। এ’বছরেই ছিল তার পঞ্চাশে পা দেওয়ার জন্মদিন। এখনও তার টাটকা রেশ। তারপর টেনেটুনে এক মাস মাত্র পেরিয়েছে। অথচ তারই মধ্যে আবার থমকানো। নস্টালজিয়ার আকাশে ঝরে গেলেন ছন্দা সেন। ১১ আগস্ট ১৯৭৫, উদ্বোধনের মাত্র তিন দিন পর আকাশবাণী থেকে দূরদর্শন সংস্থায় সংবাদপাঠিকা হিসেবে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। তারপর কেটেছিল তিন দশক। অথচ এভাবে লিখলে, সবই কেমন যেন গতানুগতিক বলে বোধ হয়। আজকের প্রজন্মের কেউ, কতটুকুই বা মনে রাখবে সেই ইতিহাস? তেমন সংবাদপাঠের ধরণটিই তো আজ সম্মিলিত ক্যাকোফনিতে অবলুপ্ত। সাদাকালো যুগের কেবল নস্টালজিয়াই নয়, তারও ভিতরে যে এক অদ্ভুৎ পরিমিতিবোধ আমরা শিখে নিতাম, আজকের এই সব-পেয়েছির পৃথিবীতে তার বড়ই অভাব দেখতে পাই।

 

১৯৭৫এ আমার জন্ম হয়নি। তাই দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, তরুণ চক্রবর্তী, দেবরাজ রায় অথবা ছন্দা সেনের নাম আমরা যখন শুনেছি, তখন তাঁরা মোটামুটি সকলেই ইতিহাসের পাতায় পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছেন। তবু সেই প্রজন্ম-ব্যবধানের পরেও এঁদের নাম অথবা পরিচয় আমাদের কাছে অজানা ছিল না। আজকের এই স্মার্টফোন-সর্বস্ব অথবা ইন্টারনেট-সর্বস্ব, টেলিভিশন-সর্বস্ব সময়ের, জেট-যুগের সহস্রাব্দিক বাসিন্দারা (পড়ুন millenial) ধারণাও করতে পারবে না ছোট্ট সাদাকালো অথবা রঙিন দূরদর্শনের পর্দায় ডিডি বাংলার ‘ক্যামেরা চলছে’ অথবা ‘কথায় কথায়’ অনুষ্ঠান উপভোগের উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা কতখানি আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করতাম। সেখানেই প্রথম শুনেছিলাম ‘খবর পড়ছি ছন্দা সেন’। পেশাদার অথচ সুললিত, চিরপরিচিত সেই কণ্ঠস্বর।

 

‘সত্তরের দশক মুক্তির দশক’ পোস্টার পড়েছিল একসময়। অস্বীকার করা চলে না সবদিক থেকেই, সারা পৃথিবী তো বটেই, আমাদের উপমহাদেশেরও সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসে সত্তর দশক এক যুগসন্ধির সময়কাল হয়ে উঠেছিল। একদিকে চলছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মহান মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলন। অন্যদিকে আকাশবাণীর তরঙ্গে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, “আকাশবাণী কলকাতা, খবর পড়ছি আমি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।” ছন্দা সেন সেই সময়েরই আরেক চলমান ইতিহাস। সেই সময়েই তিনি আকাশবাণীতে প্রথম ও পরে দূরদর্শনে যোগ দেন।

 

২০০৬ সালে দূরদর্শন থেকে অবসর নেন ছন্দা সেন। হিসেব করে দেখেছি তখন আমার বয়স চৌদ্দ। স্কুলের হিসেবে ক্লাস সেভেনের চৌকাঠ। অথচ ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ – বৃহস্পতিবার, মুঠোফোনের পর্দাতে যখন পরিচিত মুখাবয়বটিকে ভেসে উঠতে দেখেছি, মনে হয়েছিল যেন এক পশলা অতীত ফিরিয়ে দিল কেউ। আমার চেয়েও বোধকরি আরও অনেকের তা আরও বেশী করে মনে হয়েছিল। অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে বাড়িতে টেলিফোন করেছিলাম। সচরাচর পথে থাকতে আমি কোনও মৃত্যুসংবাদ বাড়িতে জানাই না। অমঙ্গলের ভয় থেকে নয়। অভ্যাস বলা চলে। কিন্তু ছন্দা সেনের খবরটা দিলাম। ওপারে খানিক নিস্তব্ধতা। “মারা গেছেন?”

 

বাড়ি ফেরার পর ফোনের ওপারের মানুষটিকেই বলছিলাম, “২০০৬এ অবসর, ৭৮ বছর বয়সে চলে গেলেন।” মা হাসলেন, তারপর ডুবে গেলেন অতীতের কথায়। ৭৮। বয়স একটা সংখ্যা মাত্র। ছন্দা সেন অথবা দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মানুষেরা সেই সংখ্যাকে ভুলিয়ে দেন।

 

যে কথা আগেও বলে এসেছি। পরিমিতিবোধ। দূরদর্শনের ইতিহাস বিষয়ে লিখতে লিখতে এর আগেও লিখেছি, কলকাতা দূরদর্শনের যে গতানুগতিক, নিয়মানুবর্তী চেহারা, খবর পড়ার যে চূড়ান্ত পেশাদার ধরণ, আবার পুজোর সময়ে বাংলার বৈঠকী মেজাজে আড্ডার সম্প্রচার, বাংলা টেলিভিশনের একটা বড় অংশই কিন্তু দূরদর্শনের ভাবনা-চিন্তা-পদ্ধতিগুলিকেই অনুসরণ করে বড় হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্রজন্ম পালটানোর সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠানের ধরণও পালটেছে। পালটেছে ‘পেশাদারিত্ব’এর সংজ্ঞা, সম্পাদকীয় মনোভাব ও তার পরিসর ইত্যাদি থেকে শুরু করে আরও অনেক উপলব্ধি, বিশ্বাস, অভ্যাস ও নীতি নির্ধারণ পদ্ধতি। যার সবুটুকুকেই আমি ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’এর নঞর্থক দোহাই দিয়ে আরও দূরত্বে ঠেলে বসতে পারব না, আবার স্বতঃস্ফূর্ত আলিঙ্গনেও আপ্যায়ন করতে পারব না।। কিন্তু পরিমিতিবোধ বিষয়টি ক্রমশ কমতে কমতে আজ যে জায়গাতে এসে অবশেষে থিতু হয়েছে বলে মনে হয়, সেই অবস্থায় ছন্দা সেনেদের মতো একেকজন ভীষণ ভাবে আমাদের স্মৃতিতে ভেসে আসেন। তাঁরা খবর পড়তেন। খবর কোনও দিন তাঁদের ছাপিয়ে যেতে পারত না।

 

যুক্তি-তর্কের আসর বলে এখন যে সম্মিলিত বাগযুদ্ধের আসর বসানো হয়, অথবা খবরের গুরুত্ব না বুঝেই খামোখা সেই খবরকে পণ্য হিসেবে ‘উমদা’ করে তুলতে গিয়ে সংবাদপাঠকেরা মাঝেমাঝেই যে উত্তেজিত অঙ্গভঙ্গিমায় সংবাদকক্ষটিকে প্রায় রণাঙ্গনের মেজাজে নিয়ে যান, ছন্দা সেনেদের তেমনটি করার দরকার পড়ত না। প্রেক্ষাপটে সাদা-কালো অথবা রঙিন একটি স্থিরচিত্র। সাধারণ ভারতীয় পোশাক। মাপা কণ্ঠে থেমে থেমে স্পষ্ট উচ্চারণে পড়ে যাওয়া। সাংবাদিকের নিরপেক্ষতার প্রশ্নে এই উচ্চকিত-উত্তেজনার অভাব, বরং পরিমিত বয়ানে ও মার্জিত দেহভঙ্গিমায় তথ্য-সহযোগে কেবল নির্দিষ্ট সংবাদটুকুই মাত্রা বজায় রেখে পরিবেশন – এমন বিষয়গুলিও সেকালে সম্মান পেতে পারত। খবরটুকুকে বুঝে নেওয়ার পর নিভৃত চিন্তায় নিজস্ব মতামত তৈরির বিষয়ে মানুষের স্বাধীনতা থাকত। জেট-যুগের সাড়ম্বর সংবাদ পরিবেশন সেই শান্ত চিন্তার অবকাশ-অধিকারটুকুই কেড়ে নিয়ে গিয়েছে।

 

“খবর পড়ছি ছন্দা সেন” – স্বরটুকুকে শুনতে শুনতেই এক ম্যাজিক লণ্ঠনের পৃথিবী দেখতে পাই। যে সময়ে হলুদ-কালো ট্যাক্সি চলত। মুঠোফোন ছিল বিলাসিতার আরেক নাম। এভাবে আমজনতার হাতের নাগালে আসতে মুঠোফোনের তখনও দেরী আছে অনেক। ২০০৩ বিশ্বকাপ। “করলো দুনিয়া মুঠঠি মে”র বিপণনী শ্লোগান ক্রমশ ঝড় তুলতে শুরু করেছে। আমার মনে আছে ডিডিবাংলায় দুপুর ২টো বেজে ৩০ মিনিটে সিনেমা দেখানো হত তখন। ৪টেয় থাকত চুম্বকে স্থানীয় সংবাদ। ৭টায় বোধহয় পূর্ণাঙ্গ স্থানীয় সংবাদের সম্প্রচার। এই সন্ধ্যের খবরেই বাঙালির সামনে আসতেন ছন্দা সেন। সেই সময়ে লোডশেডিং হতো। খবর শোনা বাদ পড়লে আবারও সেই রাতের খবর অবধি অপেক্ষা। দূরদর্শনের চেনা জিঙ্গল-শব্দ, প্রথমযুগের এ্যানিমেশন। আবহাওয়া-সংবাদ। আজ যেন কেমন এক উদ্ভ্রান্ত-পথের ঠুলি-পরা পথিক হয়েই আমাদের ছুটে চলা। কোনও এক বন্ধু কিছুকাল আগেই মন্তব্য করেছিলেন মনে পড়ছে, “আজকাল বোধহয় সব খবরই ব্রেকিং নিউজ!” বেসরকারি সংবাদ চ্যানেলগুলিতে অনুষ্ঠান শুরুর সময় থেকে শেষ ঘণ্টার ঘোষণা অবধি কেবলই ঘোষক অথবা ঘোষিকার কন্ঠে সেই একই উচ্চারণ, “দেখছেন এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় খবর!” খবরেরও আকার, আয়তন এমনকি ডেসিবেল-এককে বোধহয় তার দাপুটে শব্দমাত্রারও এখন পরিমাপ করা যায়। ছন্দা সেনের প্রয়াণ এই সব নতুনত্বকেই মনে পড়িয়ে দেয়।

 

পুজো আসছে। তবুও আকাশে মেঘ। এখনও কাশফুল দেখা যায় না। কোনও এক ভোররাত্তিরের কলকাতায় ছন্দা সেনের চলে যাওয়া। সকালের মুঠোফোনে প্রথম খবর। ঘাসেরা হাওয়াতে মাথা দোলায়। তখন ছিল নতুন জামা আর নতুন হাফপ্যান্ট। মাদার ডেয়ারির আইসক্রিম। সাধারণ মেট্রোরেল। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত রেক অথবা স্মার্ট কার্ড ছিল দূর ভবিষ্যৎ। কোনও কোনও মৃত্যু আদতে দুঃখের হয়না। মনের গভীরে তা ব্যথার সঞ্চার করলেও, কোনও কোনও মৃত্যু পথচলতি মানুষকে শৈশবে ফিরিয়ে দেয়। মননের এই ভয়ানক প্রৌঢ়ত্বের সময়ে সেই শৈশবটুকুকেই বোধ করি ছুঁয়ে দেখার, অনুভব করার দরকার পড়ে তখন। সমুদ্র-সৈকতে মানুষ দুহাত বাড়িয়ে তার প্রশান্তিকে উপভোগ করতে চায়। “খবর পড়ছি ছন্দা সেন” – তাঁর কণ্ঠস্বর আমাদের ভাবনা-অনুভূতির জগতে এমনই অণু-পরমাণুর স্পর্শ ফিরিয়ে দেয়। যার ছুঁয়ে যাওয়া মনকে প্রভাবিত করে। তা অতর্কিত ক্যাকোফনি নয়, শান্ত দিঘির মতোই সে পুরনো জল।

  • অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়