উচ্চ-মধ্যবিত্ত আধুনিক সাংস্কৃতিক সামাজিক স্মৃতির তথ্যচিত্র

এক স্বপ্ন জাদুর অন্বেষণ। স্মৃতি জাগরুক সময় কে ফিরে পাওয়া।স্মৃতির খেয়ায় ,শুধু যাওয়া আসা--
 
যশোধরা রায়চৌধুরী তাঁর ছোট বয়স থেকে বেড়ে ওঠার সময়কাল নিয়ে ডকুমেন্টারি ছবি তৈরি করেছেন অক্ষর সাজিয়ে। বাক্যমালায়। যশোধরার ছোটবেলার সঙ্গে আমার ছোটবেলার সময়কালের পার্থক্য এক যুগেরও বেশি। আর শৈশব কেটেছে একটা উচ্চ-মধ্যবিত্ত আধুনিক সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধ পরিমণ্ডলে, আর আমার শৈশব ছিল নিম্নবিত্ত শিকড় ছেঁড়া সমস্যা জর্জরিত মানুষদের ঘিরে। তবুও কত কিছু মিলে যায়। কত স্মৃতি উসকে দেয় ওঁর এই বই।
 
উঠোনে শেওলা, গঙ্গা জলের চৌবাচ্চা, কলমের লিক সারাই, ব্লটিং পেপার, প্রথম বলপেন, সিনেমা পাড়া, সিনেমা-টিকিট ব্ল্যাক হওয়া, ছাঁট কাগজের খাতা, আমিন সায়ানি, রেডিও সিলোন, সুগন্ধি রবার এরকম কত। যা আমিও দেখেছি এভাবে লেখা হয়নি তো। যে হেতু ওর চেয়ে আমার বয়স অনেকটাই বেশি, তাই আমি আরও এমন কিছু দেখেছি, যা এরকম বই পড়লে যা স্মৃতির জলধি থেকে কমলেকামিনীর মতো হাতে রেকাবি ভরা পুরনো দিনের ডালি নিয়ে আসে। তখন আমারও মনে পড়ে যায় ছাই দিয়ে দাঁত মাজা, বাঙালি পল্টন সাবান, কার্বাইড বাতি, ব্রুক বন্ড চায়ের হলুদ প্যাকেট, আফিমখোর বুড়ো, উত্তম ছাঁট— এরকম আরও কত। স্মৃতি উসকে দিয়েছে যশোধরা। মনে হয়েছে আমিও একটা এরকম স্মৃতিকথা লিখি, কিন্তু সময় পাবো না। মাথায় আরও দুটো উপন্যাসের ভাবনা আছে। ও দুটো লিখতেই হবে। তারপর আর কবে আত্মস্মৃতি লিখব! তারাশঙ্করের লেখা গানটার কথা মনে পড়ে
 
এই খেদ মোর মনে
 
ভালোবেসে মিটল না আশ
 
কুলালো না এ জীবনে
 
হায়! জীবন এত ছোট কেনে এ ভুবনে?
 
যশোধরার এই বইটার নাম 'হারিয়ে যাওয়া গানের খাতা'। শুরুতেই একটি গান। ভক্তিমূলক। আধ্যাত্মবাদী গান। হলদেটে হয়ে যাওয়া পৃষ্ঠা, আর সেই খাতাটির অনুষঙ্গে ছবির মন্তাজ। উত্তর কলকাতার পুরনো সেই বাড়ি, রোয়াক, উঠোন, ধুনুচি, হামান দিস্তায় গুঁড়ো করা ধুনো, রাস্তা ট্রাম, লাইট পোস্টের বাল্বের আলো ফেরিওয়ালার ডাক.... ছবি গুলো ক্রমশ রূপ-বর্ণ-শব্দ-গন্ধ ময় হয়ে ওঠে। ওই যে গানটি, গানের তলায় লেখা খাম্বাজ-একতাল, যশোধারা লেখেন সুরের পিছনে কী আছে? তার উত্তরে আসে এই সব ছবির মিছিল। মানুষেরাও আসে, সেই সব সিপিয়া কালারের মানুষেরাও। এরকম আঙ্গিকেই রচিত এই স্মৃতিচিত্র যশোধরার সঙ্গে এই বই নিয়ে আমার একটা স্বল্প কথালাপে জেনেছি কোভিডের নির্বাক সময় কালেই এটা লেখা হয়েছিল। লেখা হয়েছিল এই বাঙ্ময় লেখা। ও লেখে— ‌‘‌‘সুরের পেছনে কী আছে? গানের পেছনে? আছে হারিয়ে যাওয়া অনেক গল্প। অনেক গাওয়া হারিয়ে যাওয়া সেই সব কাঠরা। যারা একদিন গেয়েছিল। গাইত। এখন, শুধু গল্পকথা বলে মনে হয়। রূপকথার চরিত্রেরা, যারা বেঁচে থাকার ভেতরে অবগাহন করিয়েছিল আমাকে, কিন্তু সেই বাঁচা নিজেদের অজান্তেই আমরা গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়ে অন্য এক তারল্যের দিকে চলে গেছি। ছেঁড়া শালপাতা আর বিসর্জন হয়ে যাওয়া প্রতিমার শোলার মুকুটের মতো সেই সত্যগুলো, সেইসব বাস্তবগুলো ভেসে যায় অনন্তের দিকে, চূড়ান্ত অবাস্তব যেন...।’’
 
নতুন চ্যাপ্টার শুরু হয় আবার অন্য একটি গানের উদ্ধৃতি দিয়ে। দিন এগোয়, শৈশব থেকে বালিকা-কৈশোরের দিকে যায়, গানের কলি পাল্টে যায়। মন চলো নিজ নিকেতনে, এবার আমার উমা এলে আর উমায় পাঠাবো না.... থেকে নতুন চ্যাপ্টার শুরু হয়— ‌‘চল কোদাল চালাই ভুলে মনের বালাই.... প্যার দিওয়ানা হোতা হ্যায় মস্তানা হোতা হ্যায়... খেলাঘর বাঁধতে লেগেছি আমার মনের ভিতরে... ওগো সুন্দর জান নাকি তুমি কে আমার আমি কার, ওগো প্রিয়তম শোননি কি আমি এরকম করেই, এমনই একটা উদ্ভাবনী আঙ্গিকে বইটি লেখা। সত্তর, আশি, নব্বইয়ের দশকে শহুরে জীবনের এত খুঁটিনাটি কথা এ প্রজন্মের তরুণ ছেলেমেয়েরা জানে না।
 
 
 
নব্বই দশকের পর থেকে একটা বিরাট পরিবর্তন হয়েছে বাঙালি জীবনে। কী শহর, কী গ্রাম। সর্বত্র। প্রথম জীবনের পুরনো কথা নিয়ে এই নিবন্ধেই বলব। ইমানুল হক ও অর্ধেন্দু গোস্বামীর বইতে যা দেখেছি। শহর জীবনের এই প্যারাডাইম শিফ্‌ট খুব ভাল ভাবে উঠে এসেছে যশোধরার লেখায়। পরে, আগামী দিনের প্রবন্ধে রেফারেন্স হিসেবে এই বইটির কথা বলা হবে আমার বিশ্বাস।
 
যশোধরার ব্যক্তি পরিমণ্ডল আমার চেয়ে অনেক আলাদা। ওরা গত কয়েক পুরুষের (পুরুষের কেটে প্রজন্ম লিখছি। ওরে ব্বাবা। নারীবাদীরা খুব দোষ ধরেন) কয়েক প্রজন্ম ধরে উচ্চশিক্ষার আলোয় আলোকিত। যশোধরার মা গণিতের অধ্যাপিকা। একা হাতে দৃঢ়তায় সংসার সামলেছেন। (যশোধরা পিতৃহীনা হয়েছিল বড় কম বয়সে) এই মায়ের ছবিটাও আমার কাছে বেশ ভাস্বর।
 
বইটা পড়তে পড়তে কেমন একটা আফশোস হয় হারানো দিনগুলির জন্য। মনের মধ্যে ঘুরে ফিরে আসো ওই গানটি, ‌‘‌আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম’।
 
আশির দশক, অধ্যাপিকার সংসার, উজ্জ্বল দুটি কন্যা। তখনো ‌‘অল্প লইয়া থাকি’ জীবন। অথচ আত্মীয় স্বজন ঘেরা সংসার। দীয়তাং ভুজ্যতাং চলছে।
 
কত ছোটখাটো আপাত তুচ্ছ ঘটনাগুলি যেন মাটি চাপা পড়া প্রত্নক্ষেত্রে হঠাৎ পাওয়া এক টুকরো চিরুনি কিম্বা একটা পোড়ামাটির টুকরো, যা কিনা কণ্ঠহারের লকেট। ফুঁ দিয়ে ধুলো ঝেড়ে আমরা পাই ‌‘হুকাকাশি’র তামাক পাত্র, ‌‘দুধ রাজপুত্রের রাজপোষাকের বোতাম, দাদুর দস্তানাটাও। পাম্প দেওয়া স্টোভের শোঁ-শোঁ শব্দ ভেসে আসে অনেক দূর থেকে জ্বরের শেষের ভাত খাওয়ার স্বাদ ফিরে আসে ফের।
 
কবিতা মসৃণ গালের গদ্যর মধ্যে কোথাও কোথাও ফুটে উঠেছে ব্রনের মতো গদ্যভাষা, আবার উল্টোটাও। যশোধরা যে আখ্যানও ভাল লেখে, সেটা বোঝাই যায় এই স্মৃতিকথা পড়ে। দত্ত মেডিকালের গদাইদার সঙ্গে বাল্য-কৈশোরের প্রেম প্রেম খেলার কথা, সবুজ পর্দা ফেলা ডাক্তারের চেম্বার, টিকা দিতে আসা মাসি এরকম চরিত্ররা কী সুন্দর ছবি বুনে দেয়।
 
আমাদের খাদ্য-অখাদ্যের একটা বিবর্তনও পাই একটা চ্যাপ্টার জুড়ে। মূলত মধ্যবিত্তের খাদ্যরুচি। আমোদ-প্রমোদ, ঘরোয়া আড্ডা, ফেরিওয়ালারা, পাড়ার দাদারা সবাইকেই বেশ দেখতে পাই। এই সব স্মৃতি চুলকোতে বড় ভুল পেয়েছি। কিন্তু দুনিয়ার কোনও কিছুই কি পুরোপুরি ঠিকঠাক হয়? মাপমত সঠিক? এইসব স্মৃতিকথারা নিজের খেয়ালে নিজেই চলে, বাক্যগুলি নিজস্ব চাকা তৈরি করে নেয় নিজের শরীরে, নিজের মতো গড়গড়ায়। লেখকের কথা শোনে না। এখানেও তাই হয়েছে। মনে হয়েছে বড্ড বেশি কথা বলা হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই। কিছু পুনরাবৃত্তি তো আছেই। পড়তে পড়তে যেমন ভাল লাগা বোধে মনে মনে হাততালি দিয়েছি বারবার, মাঝে মাঝে কপাল কুঁচকেও উঠেছে। অতি কথনে। হতেই পারে কারণ এসব লেখাতো ৭, ৫, ৩, ২ ধরনের তুবড়ির মশলার ভাগ নয়, যে সোরা এতটা, গন্ধক এতটা কাঠকয়লা এতটা। স্মৃতি যখন কথা হয়ে আসে কথার ছানাপোনা হয় কথা মায়ের সঙ্গে ছানাপোনাগুলো সঙ্গে সঙ্গে চলে।
 
একটা ব্যাপার। যশোধরার এই লেখাটা আমরা পড়ি না, বরং শুনি। মনে হয় যেন ও বলছে বেশ রসিয়ে রসিয়ে।
 
যশোধরা রায়চৌধুরী
 
হারিয়ে যাওয়া গানের কথা
 
 ৯ঋকাল বুকস
 
প্রকাশ -জানুয়ারি ২০২৩

  • স্বপ্নময় চক্রবর্তী