কতো নদী সরোবর, বাংলাদেশের কিশোর সাহিত্যে বাংলা ভাষার ইতিহাস

এক

বিংশ শতাব্দীতে উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতীয় প্রাকমহাদেশে শিল্পকলায় বিষয় অপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ভাষা – জীবন ও রাজনীতির বিভিন্ন এলাকাকে তীব্র ঝাঁকুনি দেয় মানুষের বাকযন্ত্র থেকে উৎসারিত ধ্বনিপুঞ্জ। স্থানিক এবং কালিক মাত্রা অতিক্রম করে মানুষ বুঝতে পেরেছে ভাষা তার কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত ধ্বনিমাত্র নয়, তার অস্তিত্বের একটি বৃহদাংশ। সে জন্মসূত্রে পাওয়া ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করে, আবার বহুক্ষেত্রে ভাষাও নিয়ন্ত্রণ করে তাকে। ভাষা তাকে স্বাধীনতা-পরাধীনতা উভয়েরই আস্বাদ ও আশ্রয় দান করেছে, ক্ষেত্রভেদে তাকে করে তুলেছে পর্যুদস্ত বা দ্রোহী। বিপ্লবের অভিজ্ঞানে ভাষার শরীর থেকে রক্তক্ষরণের মাধ্যমে রঞ্জিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষাপ্রদেশ এবং ভাষারাষ্ট্রের জয়ধ্বজা। বাংলাদেশের সমাজবিপ্লবের সঙ্গেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে ভাষা, আটচল্লিশ থেকে বাহান্নোর ভাষা আন্দোলনের আক্রান্ত বাংলা ভাষার রক্তস্রোত ধরে একাত্তরে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের ফলে এর উপসংহার ঘটেছে। স্রোতের প্রতিকূলে চলা সত্যভাষ্যের অনন্য পথিক হুমায়ুন আজাদ (১৯৪৭-২০০৪) স্বাধীনতা পরবর্তী হতাশা অনুভব করেছিলেন মর্মের অন্তঃস্থলে, প্রকাশ্য বিরোধ না থাকা সত্ত্বেও সংগোপনে ব্যক্তি, গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান বা আন্তর্মানসিকতায় বহুমুখী শত্রুতার ফলেই বাংলাভাষার বাংলাদেশে দ্বিতীয় শ্রেণির ভাষায় পরিণত
হয়েছিল বলে তাঁর ধারণা। বাঙালির কাছেই তার মাতৃভাষা শ্রদ্ধেয় নয়, এই আক্ষেপ থেকে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন বাংলা ভাষার পুনরুজ্জীবনে সচেষ্ট হয়েছিলেন।

 

দুই

‘বাঙলা ভাষার শত্রুমিত্র’ (১৯৮৪) প্রচ্ছদ-প্রবন্ধরূপে সাপ্তাহিক বিচিত্রা-র ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এই প্রবন্ধে স্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ও বাঙালির পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে হুমায়ুন আজাদ বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। বাঙালি সাড়ে চারশ বছর আগে শ্রদ্ধা করত ফারসিকে, বিগত দুই শতাব্দী ধরে শ্রদ্ধা করে আসছে ইংরেজিকে – “দুটিই সাম্রাজ্যবাদী রাজভাষা, যা বাঙালির কাছে আভিজাত্যের প্রতীক। বাংলা শুধুই গ্লানি সঞ্চার করে।”১ ইংরেজিমনস্ক শ্রেণির একাধিক সদস্য বাংলাকে বাতিল করেছেন অনুন্নত, প্রয়োজনীয় পারিভাষিক শব্দহীন এবং জ্ঞানবিজ্ঞান ব্যবসাবাণিজ্যের জটিল প্রক্রিয়া প্রকাশে অক্ষম হিসেবে। পেশার ভাষা নয় বলে বাংলা ভাষার গুরুত্ব ক্রমহ্রাসমান। দেশের যারা প্রত্যক্ষ শক্তি, তারা আদতে ক্ষমতাহীন-চাষী, শ্রমিক, ভিক্ষুক, নিম্নপদস্থ পেশাজীবী বাদ দিলেও তাদের একটি বড় অংশ ছাত্র-তাদের ভাষা ‘প্রতারিত, পরিত্যক্ত, শোষিত, অসহায়’। মধ্যযুগে মুসলমান বাঙালি প্রথম ভাষাপ্রশ্নে দ্বিখণ্ডিত হয়েছিল –“এক  গোত্রে গুটিকয় সুবিধাভোগী যাদের স্বপ্নে ইরান-তুরান, আরবি-ফারসি; অন্য  গোত্রে বিশাল বাঙালি মুসলমান শ্রেণি বাংলাদেশ ও বাংলাই ছিল যাদের  বাস্তব ও স্বপ্ন।”২ দেশভাগের পর আবদুল লতিফ পাকিস্তান সরকারকে জানিয়েছিলেন, মুসলমানের ভাষা উর্দু, বাংলা নয়। ‘অজস্র অপস্বাপ্নিকে পূর্ণ পাকিস্তানের’ বাঙালি শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান বাংলাকে আরবিলিপি দ্বারা পর্যুদস্ত করতে চট্টগ্রাম বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুর রহমান বেখুদকে দিয়ে হুরুফুল কোরান-এর নামে আরবি বর্ণমালাকে দিয়ে বাংলা বর্ণমালা বিনাশের প্রচেষ্টা করেন। তিনি প্রচার করেছিলেন বাঙালি মুসলমানের ভাষা উর্দুরই রূপান্তরমাত্র, যাকে সেমীয় লিপিতে লিখলে উর্দু মনে হবে। স্বাধীন বাংলাদেশে এই প্রবণতা আপাতভাবে হ্রাস পেলেও উর্দুর পরিবর্তে সেখানে প্রাধান্য লাভ করে ইংরেজি।

 
ইংরেজি সাহিত্যের সহৃদয় সামাজিক পাঠক হওয়ার ঐকান্তিক বাসনা থেকে নয়, ‘পাকস্থলীর প্ররোচনা’তেই বাঙালি এই ভাষা শিখেছিল। ইংরেজি শক্তিমানের স্বার্থরক্ষা করে, বাংলা শক্তিহীনদের স্বার্থ সুরক্ষায় ব্যর্থ। যাবতীয় উচ্চপদস্থ কাজকর্মের ক্ষেত্রে ইংরেজি সিদ্ধ, বাংলা অসিদ্ধ। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে সামাজিক অর্থনৈতিক স্বীকৃতিলাভের লক্ষ্যে বাংলা শেখার আগ্রহ বাড়লেও পঁচাত্তরের পর স্রোত বিপরীতমুখী হয়ে ওঠে।  প্রতিক্রিয়াশীলতায় উগ্র হয়ে ‘বাংলাদেশ বেতার’, ‘চালনা বন্দর’, ‘পৌরসভা, ‘রাষ্ট্রপতি’ হয়ে ওঠে ‘রেডিও বাঙলাদেশ’, ‘পোর্ট অব চালনা’, ‘মিউনিসিপাল করপোরেশন’, ‘প্রেসিডেন্ট’-অর্থাৎ রেজিস্টারের বিপুল বদল ঘটে।৩ আর্থসামাজিক সূত্রই উল্লিখিত ভাষাপ্রবণতার নিয়ন্ত্রক, ভাষাতাত্ত্বিক কোনও সূত্রের প্রভাব এতে নেই। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রথমে রচিত হয় ইংরেজিতে, পরে তাকে অনুবাদ করা হয় বাংলাভাষায়। ভাষা ঋণের প্রাথমিক সূত্র মেনে Prestige Motive-এর কারণে বাংলাদেশের বাঙালি আরবি-ফারসি এবং ইংরেজি ভাষার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিল। ‘তেরশত ঊনআশি বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসের আঠারো তারিখ মোতাবেক উনিশশত বাহাত্তর খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসের চার তারিখে রচিত, বিধিবদ্ধ ও সমবেতভাবে গৃহীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’-এর তৃতীয় অনুচ্ছেদে আছে তিন শব্দের একটি বাক্য ‘প্রজাতন্ত্রের

রাষ্ট্রভাষা বাংলা’।৪ পরবর্তী সময়ে বিবিধ পরিবর্ধন, পরিমার্জন সত্ত্বেও এই বাকোর পরিবর্তন ঘটেনি। অতএব বাংলাদেশের প্রতিটি সরকারের দায়িত্ব রাষ্ট্রের সমস্ত কাজে বাংলার ব্যবহার, অন্য ভাষা ব্যবহার এক্ষেত্রে সংবিধান অবমাননার সামিল। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানে ইংরেজি ঢুকেছে, ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে, ভারতের সঙ্গে চুক্তিরূপে, পরে ১৯৭৮  খ্রিস্টাব্দে দি সেকেন্ড গ্রোক্লেমেশন (ফিফথ অ্যামেন্ডমেন্ট) অর্ডার নামে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে স্বাধীনতা লাভ করা দেশের মারাত্মক সাধারণ ব্যাধি হল ঔপনিবেশিক ঘোর বা কলোনিয়াল হ্যাংওভার, তার জেরেই বাংলাদেশে ব্যাপকহারে কোড মিক্সিং এবং দ্বিভাষিকতার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। কিন্তু বাংলাভাষার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম সম্ভবত পৃথিবীর দীর্ঘতম সংগ্রাম, যা প্রায় উনিশ বছর ধরে চলেছিল। বাংলা আজাদের কাছে দ্রোহীসুন্দর ভাষা, শত্রুতার আগুনের আঁচে যে অধিকতর শক্তিশোভা অর্জন করে। বাংলা ভাষার উৎপত্তি সংস্কৃত থেকে হলেও তিনি নিঃসন্দেহ ছিলেন যে তাঁর মাতৃভাষা বাংলাই। নিজের মাতৃভাষার হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে তাই তিনি বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।

  • কৃষ্ণ শিঞ্জিনী দেব