ডিহি কলকাতার দিননামা

বাঘের ডাকের একটা নিজস্ব গাম্ভীর্য আছে। বিশেষত রাতের অন্ধকারে সেই ডাক আরো ভয়ংকর শোনায়। তবে দু তিনবার ভীম গর্জনের পর একটা স্তব্ধতা নেমে আসে।
যদিও রাতের অন্ধকারে আচমকা মশালের আলো জ্বলে ওঠা এবং প্রবল চিৎকারে গাছ গাছালির মধ্যে ঘুমিয়ে পড়া পাখিরা হঠাৎ জেগে উঠে ভীষণ চেঁচামেচি শুরু করে।
জটাকেশ তীক্ষ্ণ চোখে জলের দিকে তাকিয়ে থাকে। কারণ সুন্দরবনের বাঘ নিঃশব্দে সাঁতার কেটে উঠে নৌকা থেকে মানুষ নিয়ে গেছে এরকম ঘটনা অসংখ্য।
তবে সুন্দরবনের বাঘ চট করে মানুষ খেকো হয় না এই যা ভরসা। বাঘ ছাড়াও জঙ্গলের এই পথে ডাকাতের ভয় ছিল প্রবল।
কালীঘাটের দিকে দক্ষিণের জঙ্গল জুড়ে মনোহর  ডাকাতের আড্ডা। যেমন উত্তরে ছিল চিতে ডাকাত। মনোহর  ডাকাতের কাটানো পুকুরের নামই হয়ে আছে মনোহর পুকুর।

কালীঘাটের কালী ক্ষেত্র থেকে কিছু দূর পুবে গেলে জঙ্গলের মধ্যে মনোহর ডাকাত তার নিজের কালী মন্দির তৈরি করেছিল। কিছুদিন আগেও সেখানে নরবলি হতো বলে শোনা যায়।
মনোয়ার ডাকাত অবশ্য পরে এক কুড়িয়ে পাওয়া ছেলেকে মানুষ করতে গিয়ে ডাকাতি ছেড়ে দেয়।
যুধিষ্ঠিরের নৌকা এবার প্রায় কালীঘাটের কাছাকাছি এগিয়ে আসে। কালীঘাটের মন্দির এলাকার থেকে সামান্য আগে নিষিদ্ধ আকর্ষণের পল্লী। আপাতত যুধিষ্ঠির এবং কানাইদের যেটা মূল গন্তব্য।
হাজরা কাটার ঘাটে নৌকা ভিড়োয় যুধিষ্ঠিররা। এর থেকে সামান্য দূরেই কালীঘাটের ঘাট।
জটাকেশ বললো, তোমরা নামো। কালু তো নৌকাতেই থাকবে। ওআমাকে একটু কালীঘাটে ছেড়ে দিয়ে আসুক।
কালীঘাটের মন্দিরের আগে জেলেদের বাস। চেতলা এলাকাতে মাছের জাল কেনা বেচার বড় কারবার ও রয়েছে।
জটাকেশের আপাতগন্তব্য সেই কৈবর্ত্যপাড়া।
যুধিষ্ঠির এবং কানাই  ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে। নিশি বাসরের পাড়া  হবার কারণে
তখনো গমগম করছে পল্লী।
গলির মুখে মুখে টাটকা কুচো মাছ ভাজার সঙ্গে দেদার তাড়ি বিক্রি হচ্ছে।
মেয়েদের বারান্দায় বারান্দায় রেডির তেলের প্রদীপ জ্বলছে।
কোন কোন মেয়ে প্রদীপ হাতে রাস্তার উপর এসে দাঁড়িয়েছে।
একটা তাড়ির  ঠেকের কাছাকাছি এসে  কানাই যুধিষ্ঠিরকে বলে,
দাদা চলো দুপাত্তর  হয়ে যাক।
যুধিষ্ঠির খুব একটা ঘোরতর সুরা পায়ী এরকম নয়। তবু কানাইয়ের আহ্বানে সম্মত হয়।
  সুরা পান শেষ হলে দুজনে উঠে দাঁড়ায়। একটু এগোতে কানাইয়ের চোখ আটকে যায় বারান্দায় মোড়ার উপর বসে থাকা এক যুবতীর দিকে।
যুবতীর ঘরের দিকে এগোতে শ্যামাঙ্গী সেই বারাঙ্গনা সম্মোহক হাসিতে কানাই কে বলে,এসো।
যুধিষ্ঠির কানাই কে বলে, তুমি ওর সাথে যাও। আমি অন্য ঘর দেখে নিচ্ছি।
কানাই কে ঘরে ঢুকিয়ে সেই মায়াবী যুবতী ঘরের দরজা বন্ধ করে।
কানাই এর মস্তিষ্কের তন্ত্রীতে তখন সুরার  ক্রিয়া ধীরে ধীরে শুরু হচ্ছে। কানাইয়ের চোখে ক্রমশ ঘোর লাগতে শুরু করে।
মেয়েটি  বাগদি ঘরের মেয়ে। বিভিন্ন ভাগ্য বিপর্যয়ে আজ এই পাড়ায়। তবে চেহারার সঙ্গে একটা আশ্চর্য তেজ জড়িয়ে রয়েছে।
দরজা বন্ধ করে কানাইকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করে,
বলিও ভালো মানুষের পো,
পহা কড়ি কিছু আছে তো ট্যাঁকে?
কানাইয়ের চোখে তখন ঘোর।
কিঞ্চিত স্থলিত কন্ঠে বলে, তোমায় কিনতে পারে এমন কড়ি কই!
শ্যামাঙ্গিনী ঝরঝর করে হেসে ওঠে। বলে বাপরে নাগরের রস তো প্রচুর।
তারপর দ্রুত পরনের যাবতীয় পরিধেয় বিসর্জন দিয়ে পূর্ণ নগ্ন বিভঙ্গে কানাই কে বলে, এসো।
কুলঙ্গীতে রাখার রেড়ির তেলের প্রদীপ আশ্চর্য মায়াবী কোণ সৃষ্টি করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে উলঙ্গ শ্যামাঙ্গীর দেহবল্লরী তে।
নেশাতুর কানাইয়ের দৃষ্টিতে অলৌকিক বিভ্রম যোগ হয়।
তার আচমকা মনে হয় স্বয়ং মা দক্ষিণা কালী তার সামনে!

  • সুমিত চৌধুরী
  • সপ্তম পর্ব