চেতনা জাগরণের দীপশিখা

শিল্পীর চেতনা তৈরি করে জীবনবোধ।আর সেই জীবনবোধ পৌঁছে দেয় যেনএক অনির্চনীয় আনন্দে। তখনই ডেকে যায় আনন্দের সাগর থেকে বান—


‘চেতনায় রামানন্দ’– ছোট একটা বই।কিন্তু বই যে আমাদের হাতিয়ার।আমাদের মেধা- মননের দুনিয়াকে প্রসারিত করবার সব থেকে বড় অস্ত্র এই ছোট্ট বইটা পড়ারপর বারবার সেই কথাটাই মনে পড়ে যাচ্ছিল। আমাদের চেতনাকে জাগরিত করবার এক উজ্জ্বল দীপশিখা কেন সুজয় বাগচীর লেখা এই গ্রন্থটি।

দর্শনশাস্ত্রের প্রায়োগিক এবং ফলিত দিকটি কীভাবেআমাদের মানব সমাজের কল্যাণে নিয়োজিত হতে পারে,এত অল্প কথার মধ্যে দিয়ে শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের যাপন চিত্রের খণ্ডখণ্ডমুহূর্তের মধ্যে দিয়ে তা এই গ্রন্থে ধরা হয়েছে। 


গ্রন্থটি পড়লে আমাদের শুধুমাত্র আনন্দই হয় না। মনকেও এক শান্ত সমাহিত অবস্থার মধ্যে নিয়ে যায় বইটা।যেন পড়া শেষ হয়ে গিয়েও শেষ হয়ে যায় না বইটির রেশ। আমাদের চেতনার তন্তুকে বারবার যেন সে সেতারের তারের মতো ঝংকৃত করতে থাকে। আমরা ডুবে যাই রামানন্দ চেতনার এক অনির্বচনীয় আনন্দ সমুদ্রে।
বইটির শুরুতেই ভূমিকায় প্রখ্যাত শিল্পী গণেশ হালুই লিখছেন, রামানন্দবাবুর কথায়;– কুঁড়ি বলছে, আমি ওই ফুলটার মত ফুটছি না কেন? কুঁড়ি যে ফুল হতে চায় তার জন্য তো সময় লাগবে, তোমরা আজ যারা ছাত্র, তোমরা এখন কাজকে ভালোবেসে কাজের সঙ্গে থাকো।দেখবে তোমরা একদিন ফুলের মতো ফুটবে এবং তোমাদের সুবাস ছড়িয়ে পড়বে দেশ-দেশান্তরে।...” 

দর্শনের কত গভীর, মর্মস্পর্শী কথা।অথচ কত সহজ ভাবে, সুন্দর ভাবে বলা। গণেশ হালুইয়ের কলমে আঁকা শিল্পী রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই এক টুকরো ছবি যেন ভারতের যুগ যুগান্তব্যাপী গুরু–শিষ্য পরম্পরার এক অনবদ্য ছবি চলমান ছবি ফুটিয়ে তুলেছে।

‘কাজে’-র সঙ্গে থাকার উপদেশ বা পরামর্শ, এই ছোট্ট বাক্যটির ভিতর দিয়ে জীবন দর্শনের এমন এক শিক্ষায় শিল্পী রামানন্দ কেবল তাঁর নিজের ছাত্রদেরই উদ্বুদ্ধ করছেন না।দেশ-কাল–সময় নির্বিশেষে সমকালের–ভাবীকালের ছাত্রদের জন্যে অফুরন্ত কর্মদিশা দিয়ে যাচ্ছেন—এ প্রাপ্তির কোনও আলাদা বিশেষণ সহযোগে তুলনা হয় না।

কুঁড়ির উপমার মধ্যে দিয়ে ফুল ফোটার নিত্য আয়োজনের যে সুসংবদ্ধ ধারাবাহিকতার কথা শিল্পী রামানন্দ বলছেন আর সেই কথাটা যখন অন্য অনেক কথার মধ্যেও একটা বিশেষ ব্যঞ্জনা নিয়ে শিল্পী গণেশ হালুইয়ের কলমে উঠে আসছে—তখনই যেন আমাদের মনে হয়, দুই স্রষ্ঠার চিন্তার সখ্যতা কীভাবে শিল্প এবং শিল্পীর আঙিনাকে ভবিষৎতের শিল্প আর শিল্পীর মননলোকের উদ্ভাষণ ঘটাতে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে থাকে।

সুজয় লিখছেন রামানন্দের জবানীতে তাঁর গুরু রামকিঙ্করের কথা; কিঙ্করদা,’কাউকেকখনও বলতেন না তোমার হবে না।‘(পৃ-১১) এ সত্যবচন যেন আবার আমাদের চোখের সামনে জীবন্ত করে তোলে রামকিঙ্করকে। বস্তুত ছোট এই বইটিতে দু-চারটে পঙক্তির ভিতর দিয়ে রামানন্দ উবাচে লেখক সুজয় যেভাবে রামকিঙ্করকে তুলে ধরেছেন, রামকিঙ্করকে ঘিরে ভবিষৎতের গবেষকদের কাছে তা অচিরেই আকর বিশেষ হয়ে উঠবে।
                 
‘না’ বিষয়টা রামকিঙ্করের শিল্পী চরিত্রের সঙ্গে কখনও খাপ খেত না।কোনওছাত্রকে একটিবারের জন্যেও রামকিঙ্কর কখনও নিরুৎসাহিত করেননি। পুঁথিগত শিক্ষার ধার না ধরা এই জন্মশিল্পী শিক্ষা মনস্তত্ত্বকে কীভাবে অন্তর থেকে আত্মস্থ করেছিলেন, তাকে রামানন্দের জবানীতে একটা অপরূপ ক্যনভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন বইটির লেখক সুজয়।

রামানন্দের কথা লিখছেন সুজয়;’কিঙ্করদা কাজ নিয়ে তন্ময় থাকতেন।তাঁর সেই তন্ময়তাকেই অনেকে নানা ভাবে নেশার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছেন।‘(পৃ-২৯) 

এই পঙক্তিটি পড়বার পর মনে হয়, রামকিঙ্করের মতো ক্ষণজন্মা শিল্পী সম্পর্কে এর থেকে ভালো মূল্যায়ন বুঝি আর কিছু হয় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, কিছু নতুন আলোচক,সাম্প্রতিক অতীতে খুব মেতে উঠেছেন রামকিঙ্করকে ঘিরে আলোচনায়।আর রামকিঙ্করকে নিয়ে আলোচনার সময় তারা সব থেকে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন রামকিঙ্করকে ঘিরে নানা ধরনের নেশাজনিত স্বকল্পিত গল্প কাহিনীতে।    
              
নেশা আর রামকিঙ্করকে একাত্ম করে দিয়ে রামকিঙ্করের শিল্পসত্ত্বা,শিল্পীসত্ত্বা
দুটোকেই ধারাবাহিকভাবে অপমান করে যাওয়া হচ্ছে।সেই জায়গায়মাত্র এক-দুটো বাক্যের ভিতর দিয়ে শিল্পী রামানন্দ বন্দোপাধ্যায় তাঁর অন্যতম শিল্পগুরু রামকিঙ্কর বেইজ সম্পর্কে যে অনবদ্য মূল্যায়ন করেছেন সেটি রামকিঙ্কর সম্পর্কে অন্যতম সেরা মূল্যায়ন।
            
রামকিঙ্করকে একটু হলেও দেখবার অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে তাঁরাই জানেন, নিজের সৃষ্টির জগত ঘিরে তন্ময় হয়ে থাকাটা কোন জায়গায় রামকিঙ্করকে নিয়ে যেত। রামকিঙ্করকেনা দেখলে,না জানলে, তাঁর শিল্পসৃষ্টির সমকালীন তন্ময়তা ঘিরে সাধারণ মানুষের পক্ষে ধারণা করাটা সত্যিই মুশকিল। 

পরবর্তীকালে সমরেশ বসু তাঁর  ‘দেখি নাই ফিরে’  বা প্রকাশ দাসের মত রামকিঙ্করের যথার্থ অনুরাগীরা, তাঁর সেই তন্ময়তার কিছু কিছু খন্ড চিত্র পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তুলে ধরেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল,এমনভাবে রামকিঙ্করকে ঘিরে আলোচনার একটা রেওয়াজ আমাদের শিল্পসাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে চলে এসেছে যে, শিল্পীর সেই তন্ময়তাকে আমরা অনুধাবন করতে পারি না ঠিকভাবে। 

আমাদের কাছে শিল্পীর তন্ময়তাকে তুলে ধরা হয় তাঁর কিছু ব্যক্তিজীবনের খন্ড চিত্রের মধ্যে দিয়ে।রামকিঙ্করের ব্যক্তিজীবনের সামগ্রিকতাটা কিন্তু কখনোই তাঁর শিল্পীসত্ত্বার সামগ্রিকতা নয় –এই বিষয়টা রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় যে দৃঢ়তার সঙ্গে সুজয় বাবুকে বলেছেন এবং যে সততার সঙ্গে সেটিকে সুজয় বাবু আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন,  সেটি কেবল রামানন্দ বন্দোপাধ্যায়কে ঘিরে চর্চার ক্ষেত্রেই নয়। আগামী দিনে যাঁরা নিরপেক্ষ রামকিঙ্কর চর্চা করবেন,তাঁদেরকাছে বিশেষ মূল্যবান সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হবে। 
এখানে আরেকটা বিষয় বিশেষ করে উল্লেখ করতে হয়,গোটা বইটিতেই পটশিল্পকে ঘিরে রামানন্দ বন্দোপাধ্যায়ের যে প্রবল ভালোবাসা, নিষ্ঠা,আকর্ষণ- তা ছত্রছত্রে উঠে এসেছে।আমরা সাধারণ শিল্পরসিক মানুষজন এই পটশিল্প ঘিরে রামকিঙ্করের ভালোলাগা,ভালোবাসা এবং আকর্ষণ সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানিনা।সেটিকেও এখানে খুব স্বল্পকথায় রামানন্দবাবুর বয়ানে, লেখক সুজয়বাবু তুলে ধরেছেন। আর সেই তুলে ধরার মধ্যে দিয়ে রামকিঙ্কর পরিচালিত রক্তকরবী নাটকের খন্ড স্মৃতি আমাদের কেমন যেন উদাসীন করে দেয়। 

শিল্পের প্রতি ভালোবাসা কিভাবে শিল্পীর প্রতি এক গভীর দায়িত্ববোধে রূপান্তরিত হয়, রামকিঙ্করের জীবনের একটি ক্ষুদ্র অথচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্যে দিয়ে এখানে সুজয়বাবু তুলে ধরেছেন রামানন্দবাবুর স্মৃতি হাতরে।

চর্চা থেকে বোধের জাগরণের যে উপদেশ রামানন্দবাবু তাঁর ছাত্র সুজয়কে দিচ্ছেন(পৃ-১৫), সুজয় সেই শিক্ষাকে আমাদের সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরে একটি গুরুতর সামাজিক দায়িত্ববোধের পরিচয় রেখেছেন। বোধের জাগরণ না ঘটলে শিল্পীসত্ত্বা তো দূরের কথা,মানবিক সত্ত্বারই উন্মীলন হওয়া সম্ভবপর নয়।

 

সুজয়বাবুর লেখা গোটা বইটি পড়লে মনে হয়,কেবলমাত্র বোধের উন্মেলনের জন্য রামানন্দবাবু তাঁর ছাত্রকে উসকে দিচ্ছেনতাই-ই নয়। তিনি যেন তাঁর ছাত্র সুজয়বাবুর মধ্যে দিয়ে গোটা বাঙালি সমাজকে তথা গোটা মানব সমাজকে একটা বোধের দিকে উসকে দিচ্ছেন।যে বোধের কথা বারবার জীবনানন্দ তাঁর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে বলে গিয়েছেন। সেই বোধকেই যেন জাগরিত করবার লক্ষ্যে এই একুশ শতকের প্রায় মধ্যভাগে শিল্পী রামানন্দ বন্দোপাধ্যায় এক নতুন ঋত্বিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।
 সেই বোধের উর্মিলনে তিনি তাঁর চেতনার আরোহীনিতে স্থাপন করছেন উপনিষদকে।উপনিষদের সেইচরৈবতি মন্ত্রকেই তিনি বোধেরউন্মেলনেরসবথেকে বড় স্থাপয়িতা বলে মনে করছেন। আর তাই যেন তিনি বলছেন;’বিনয়শক্তির আর এক নাম।এই বিনয়ের শক্তিই শিল্পীর দৃষ্টির উন্মোচন ঘটায়।‘(পৃ-২৫)।
শিল্প-শিল্পীর পথনির্দেশিকায় এ যেন এক অমোঘ দিকচিহ্ন। এই দিকচিহ্নের সুলুক সন্ধান আমাদের সামনে তুলে ধরে বইটির লেখক সুজয় বাগচী,গোটা বাঙালি পাঠক সমাজের কাছে এক সোনার খনির সন্ধান এনে দিয়েছেন। লেখককে আমাদের সশ্রদ্ধ অভিবাদন।

 

 

চেতনা রামানন্দ
সুজয় বাগচী
সায়ন্তন পাবলিকেশন
১৯০ টাকা

  • গৌতম রায়