ভোলা মিঞার এন্তেকালের পর থেকে নদিয়া মিলের সঙ্গে সম্পর্কের সুতোটাও ছিঁড়ে গিয়েছে তারামনের।বুড়োর পি এফ , গ্রাচুইটির টাকা পয়সার জন্যে কিছুদিন এই লোক, সেই লোক ঘোরাঘুরি করেছিল তারা।শেষে শোনে সান্তার নাকি টাকাটা তুলে নিয়ে গেছে ভোলা মিঞার জমা টাকাগুলো।
সতীনপো সান্তারের কথাগুলো ও ভালো করে বোঝে না তারামণ।হিন্দিজবান কোনো কালে বলতে শিখেছিল নাকি সে? হঠাৎ করে ভোলা মিঞার সাথে নিকার পর বরের হিন্দি বুলি গুলো ঠিক মতো ঠাওর ই করে উঠতে পারতো না নোতুন বৌ।আর সেজন্যে বরের কাছে মুখঝামটাও কম খায় নি তারামণ।
ছোট্ট গাঁ ছেরামপুর।প্রমিত উচ্চারণ টাই এই গাঁয়ের চলতি উচ্চারণে পরিণত হয়েছিল।কেতাবী নাম, দলিল পর্চার নাম ' শ্রীরামপুর' কয়জনাই বা আজ ও জানে? সেই ছেরামপুর গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে একটা তির তিরে খাল।গাঁয়ের মুরুব্বিরা বলে মুক্তোপুরের নদী।কামিল পাশ দেওয়া ইব্রাহিম আলি বলেছিল; ধুস ওটা আবার নদী নাকি? ওটা তো খাল।ওদিকে চলি গেছে বিদ্যেধরী নদী ধররে সোজা বাংলাদেশ টাক।আর ই দিকে সেই চটকলের মধ্যি দে মিশেচে গঙ্গার থনে।
সেই মুক্তোপুর খালকে বুকে জড়ানো নদিয়া মিল ই যে তারামণের পেটের ভাত জোটানো, না জোটানোর মালিক হয়ে উঠবে, সেইকালে কি আর সেটা বুঝেছিল তারামণ? বিয়ের আগে , সেই কিশোরীবেলায় গাঁয়ের এককোন দিয়ে তির তির করে বয়ে যাওয়া খালটা যে বিয়ের পরেও তার সঙ্গ ছাড়ে নি- এটা মনে করে তারামণের বেশ ভালো ই লেগেছিল।খালে জল তেমন থাকতো না তার গাঁ ছেরামপুরে।ছাগল চড়াতে গিয়ে একদঙ্গল মেয়ে চলে আসতো গাঁয়ের একদম শেষপ্রান্তে এই খালটার ধারে।শ্বশুরঘরের দেশে এসে খালের মুক্তোপুর নাম শুনলেও তারামণদের গ্রামে তার পরিচিতি ছিল বিদ্যেধরী বলেই।
বিয়ের পর প্রথম রাসমেলার মাঠের ধারে সেই খাল দেখার অবাক হওয়া নিয়ে যখন গাঁয়ের ইব্রাহিমকে বকবক করছিল তারামণ, ইব্রাহিম ই তখন বলে , এই খাল এককালে খাল ছিলো না।প্রায় নদীর পারাই ছিল।যশোর, খুলনা থেকে বিদ্যেধরী নদী বেয়ে কতো বড়ো বড়ো নৌকো এই খাল বেয়ে এসে পড়তো গঙ্গায়।তারপর সোজা দোখলে কলকাতার দিকে পাল তুলে তরতর করে বয়ে চলে যেত সেইসব হরেক কিসিমের নৌকো।
মুক্তোপুর শ্মশান আর তার প্রায় লাগোয়া কবরস্থানের পাশ দিয়ে যেতে গিয়ে অনেক নৌকো ই নাকি শেষ পর্যন্ত জায়গা মতো পৌঁছে উঠতে পারতো না। শ্মশানযাত্রীদের ভিতরে ডাকাবুকো লোকজন থাকলে নানারকম ভয় দেখিয়ে নৌকো তে লুঠপাট চালাতো।গোর দিতে আসা লোকজন ও যে সব সময় হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতো তা নয়।বড়ো নৌকো, অনেক জিনিষপত্রে বোঝাই এমন টা হলে পাশে কুমোরের চাক চালাতে চালাতে পালেদের ষন্ডাগুন্ডা মার্কারাও আসতো উঠে।হাত লাগাতো লুঠের কাজে।
চটকল তৈরি হওয়ার আগে এইসব লুঠপাটের কাজে নাকি আশেপাশের দুচার ঘর বর্ধিষ্ণু মানুষ জনেরাও চুপচাপ সায় দিতো।ইব্রাহিমের কাছে শুনেছিল তারামণ, মুক্তোপুর খাল এখন দুনিয়ার আবর্জনা নিয়ে যে রাসমেলার মাঠের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে, এককালে যে খালের জোয়ার ভাটার দাপটে এই মাঠ পানিতে ভরে যেতো, পাশ দিয়ে রেললাইন তখন সবে হবো হবো করছে, নদিয়া মিল তখন কোথায়? এই মাঠ , মিলের জমির মালিক মুখুজ্জেরা নাকি পোষা লেঠেলদের শ্মাশানযাত্রী সাজিয়ে নৌকো লুঠ করাতো।আর লুঠ করতে গিয়ে একটা আধটা খুন জখম হয়ে গেলে নিমতলা গোরস্থানে গোর দিতে আসা মানুষজনের গায়ের উপরে সেইসব লাশ ফেলে চম্পট দিতো।
কুমোরপাড়ার ভিতরে এই নিমতলা মাঠ লাগোয়া কয়েকঘর মুসলমানের বসতি।তবে তারা বেশ বর্ধিষ্ণু।বাড়ির লাগোয়া বেশ বড়ো পুকুর আছে।মাছ কিলবিল করে পুকুরের পানিতে সবসময়। পুকুরঘেরা বড়ো বাড়ির মানুষেরাই পাশের ছোট বাংলা মসজিদের ইমাম সাহেব কে একখন্ড জমি দিয়েছেন।গোরখাদেম কেও খানিকটা জমি দিয়েছেন সেই বড়ো বাড়ির মুরুব্বিরা।
এই কুমোরপাড়ার কুমোরদের ভাটপাড়ার ভটচাযযি বামুনেরা পাড়া ঘরে 'মোছলমান বেড়ে যাচ্ছে' বলে উসকে দেয় মাঝে মাঝে।পন পোড়ানো, চাক চালানো বুদ্ধি নিয়ে এই পাড়ার কুমোর আর মালো রা মাঝে মাঝেই হাঙ্গামা বাধাবার চেষ্টা করে ।বড় মুরুব্বির পুকুরের মাছ টা , গাছের পল পাকুর চুরি করে।আসলে ছেলেপিলেরা চুরি করে দুটো চারটে মাছ খাক কি পিয়ারা চিবোক বা বাতাবি নেবু খাক, তা নিয়ে মুরুব্বিদের তেমন কোনো আপত্তি নেই।
অতোশতো তত্ত্বতালাশ বোঝে না তারামন।তার ভাবতে অবাক লাগে এককালে এই রেল লাইন ছিল না।রেলের পেট চিড়ে লাইনটা ঢুকে যায় নি নদিয়া জুট মিলের ভিতরে।আর ঢুকবেই না কি করে? নদিয়া জুট মিল ও তো তখন ছিল না।ধু ধু মাঠ।
তারামণ ভাবে কি কি গাছ ছিলো ওই অত্তো বড়ো মাঠে? খেজুর গাছ ছিল? জিরেনের রস ভরতে ওসমান চাচা আসতো? বিচ্ছু গুলো সেই রস চুইয়ে পড়া পাতার ছুলুই কোকাকোলা খাওয়ার স্ট্র দিয়ে ছ্যাঁদা করে রস খেয়ে নিতো? শেষে রসের হাড়ি নামিয়ে প্রায় ফাঁকা কলসী দেখে নছিবকে দায়ী করে ওসমানচাচা অমন করে কপাল চাপড়াতো?
কেবল তালেব বে পড়া বিদ্যেতে তারামণের পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব নয় আজ থেকে প্রায় শ দুয়েক বছর আগে, সেই রেল লাইন যখন পাতা হয় নি,ইংলন্ডের শিল্প বিপ্লবের জেরে এই গঙ্গানদীর দুই তীর ধরে ছোট বড়ো চট কল আর নানা কারখানা যখন তৈরি হয় নি, তখন কোকাকোলার ও জন্ম হয় নি।তখন ইংরেজদের কাছে স্ট্র বলতে ছিল একমাত্র গরু খাওয়ার খড়।তারামণ যে নরম পানীয় টানার ' ইসট্র র ' কথা বলছে, সেই কাগজের সরু সরু নলের আবিস্কার ই তখনো হয় নি।
আষশেওড়ার ঝোপের ভিতর থেকে একদল ভাম নিজেদের ভিতরে মারামারি করতে করতে চলে গেল জলের দিকে।গঙ্গায় তখন জোয়ারের জল।মুক্তারপুর খাল বেয়ে হু হু করে জল ঢুকছে। উজান স্রোতে বেয়ে বেয়ে একটা গালুই নৌকো আসছে নদীর পানে।এক দঙ্গল ভামের হুটোপুটিতে নৌকোর মাঝিরা প্রথমটায় একটু চমকেই গিয়েছিল। খালের মোহানার কাছে এই শ্মশানের ধারে ভূতপ্রতের কথা শুনে মাঝিরা অভ্যস্থ। কিন্তু সেই ভূত প্রেতের আড়ালে যে এই এলাকার ফুটো পয়সার জমিদার শীতল মুখুজ্জে একদঙ্গল লেঠেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে তা গালুই নৌকোর প্রধান মাঝি হেসো সরদার ভাবতেই পারে নি।
হেসো সর্দারের প্রধান শাগরিদ রমাই মাঝি বেশ খানিকটা দূর থেকে মশালগুলো দেখেছিল।রমাইয়ের ধারণা হয়েছিল , চিতার আগুন।মুক্তোপুর শ্মশানের বেশ নাম ডাক আছে। বসিরহাট থেকেও পুন্নির লোভে মরা আসে এই শ্মশানে ।শ্মশান ভৈরবের কাছে চোত সংক্রান্তি তে বুড়ো শিবের কাছে সন্নেস নেওয়া মূল সন্ন্যাসীর নীল ষষ্ঠীর দিন ভরে পড়ার নামডাক বসিরহাট পেড়িয়ে , ইছামতীর টান কাটিয়ে খুলনার সেনহাটি পর্যন্ত পৌঁচেছে।
খুলনার দিঘলে সেনহাটির কেষ্ট মজুমদারের বাড়ির এক বৌয়ের বাচ্চাকাচ্চা হয় না। ছেলের বিয়ের তাই তোরজোর পড়েছে। ছেলের মা আর চায় না বাঁজা বৌ।তা সেই বৌ কোথা থেকে শুনলে ভাটপাড়ার মুক্তোপুর শ্মশানে নীল ষষ্ঠীর দিনে খাজনের সন্নেসীদের ওসুধ দেওয়ার কথা। স্বামী সোহাগী সেই বৌ , বর কে রাজি করে বজরা নিয়ে এসেছিল এই মুক্তোপুর শ্মশানে।রমাই ছিল সেই বজরার পিছ সারেঙ।
শ্মশানে সেই সন্ন্যাসীর কাছ থেকে ছাওয়াল হবার ওসুধপত্র নিয়ে কেষ্ট মজুমদারের বাড়ির রাখহরি মজুমদার দলবল নিয়ে গিয়েছিল কাঁঠালপাড়ায় শীতল মুখুজ্জের বাড়িতে।রমাই যে কেবল রাখহরির বজরার পিছ সারেঙ ছিল তাই নয়, রাখহরির দেহরক্ষীর দায়িত্ব ও তাকে পালন করতে হতো দিঘলে সেনহাটির মেজতরফের কত্তা মাঠাকুরণের হুকুমে।
রাখহরি সদলবলে পৌঁছবার পরে শীতল মুখুজ্জের বাড়িতে যেন মোচ্ছব পড়ে গিয়েছিল।শীতল যে কি ভাবে পূবদেশের আত্মীয়ের দেখভাল করবে তা যেন ঠিক ঠাওর করে উঠতে পারছিল না। শীতলের মা তো প্রথমে শ্মশান ফেরত লোকজনদের দালান কোঠায় উঠতেই দিতে চায় নি।সবশুদ্ধু গঙ্গা নেয়ে তারপর রাখহরি সপরিবারে পা দেয় শীতল মুখুজ্জের দালান কোটায়।
রাতের এলাহি পানভোজনে রাখহরি তো চিতপাত।কোঠাবাড়ির ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই রমাইয়ের।ওদিকে কত্তামায়ের হুকুম রাখহরি যেন একমুহূর্তের জন্যে ও রমাইয়ের চোখের আড়াল না হয়। মাঝিমাল্লাদের জন্যেও ধেনোর ভালো আয়োজন করেছিল শীতল।দেশগাঁয়ে থাকলে পরে এতোটা বজরা বয়ে আনার পরিশ্রমের পর দুভাঁড় ধেনো, হাতের নক্ষ্মী পায়ে ঠেলতো না রমাই।কিন্তু এই ভিন দেশে নেশাভাঙ করতে গেলে যদি কত্তার কোনো ক্ষেতি হয়ে যায়? সেই ভয়েই খানিকটা সাত্তিক ভাবেই রাত টুকু কাটাবে বলে ভেবেছিল রমাই।যেমন ভাবা কাজটাও তেমন ই করেছিল সে।তবে নিশুত রাতে সেই বাড়ির সদর দারোয়ান ধেনোর টানে যখন বেঁহুশ, তখন ধীর পায়ে , খুব সজাগ হয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে যায় রমাই।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই পাশের একটা ঘর থেকে রাখহরির গিন্নির গলা পায় রমাই।গিন্নিমার অসংলগ্ন অথচ কামার্ত গলা শুনে প্রথমটায় খুব ঘাবড়েই গিয়েছিল সে।একটা থামের আড়াল হয়ে পাশের জানলায় চোখ রাখতেই তো রমাইয়ের চক্ষু চড়ক গাছ।আর তার একটু পরেই দরজা খুলে বেড়িয়ে গেল শীতল মুখুজ্জে।
আজ এই মুক্তোপুর খাল বেয়ে গঙ্গার উজানে ঢোকার মুখে একটু এগুতেই ভুল ভাঙল রমাইয়ের।শ্মশানযাত্রীর মতোই খাটো ধুতি আর ঘাড়ে গামছা নিয়ে মশাল হাতে একদল লোকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে , এটা তো সেই শীতল মুখুজ্জেই? সেবার ফেরার পথে আপন মনেই রাখহরি মজুমদার বলেছিল; সাকুল্যে ছত্তিশ বিঘে জমি , তায় নাকি জমিদার! ছোঃ!
সময় ঘুরতেই রাখহরির গিন্নি একখান সোনার চাঁদ পুত্তুরের জন্ম দিয়েছিল। দিঘলে সেনহাটির মজুমদার ভিটেতে ভাটপাড়ার মুক্তোপুর শ্মশানের শ্মশান ভৈরবের জয়জয়কার পড়লেও মুক্খুসুক্খু মানুষ রমাই ধেনো মদে চুমুক দিতে দিতে খুব হেসেছিল সেদিন।( ক্রমশঃ)