অপহরণ ও আলো

আজকেই রানিকে তুলে নেবে ভন্তা। ও যখন সাইকেল নিয়ে বেরোবে, তখনই পিছন পিছন যাবে। শম্ভুর মোড় থেকে ঠিক বাঁদিকে ঘুরলেই, যে ফাঁকা জায়গাটা আসে, সেখানে রানিকে আটকাবে। গাড়ি স্টার্ট করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবে ভন্তা। ওকে সাইকেল থেকে নামিয়ে গাড়িতে তুলতে হবে। রানি রোগা পাতলা কিন্তু লম্বা কম নয়, গড়পরতা বাঙালি মেয়ের থেকে বেশ কিছুটাই লম্বা। ভন্তা ওকে পাঁজাকোলা করে গাড়ির মধ্যে তুলে নেবে। বিশুদার গাড়িটা পুরো অটোমেটিক, গাড়ির কাচ একদম কালো। ড্রাইভার একবার ইলেকট্রনিক লক অন করে দিলে, পিছনে বসে কেউ খুলতে পারবে না। আর ভিতর থেকে চেঁচালেও কেউ শুনতে পাবে না। শুধু রানিকে তুলে ফেলতে হবে ঝট করে।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভন্তা ভাবছিল। সকালে চা নিয়ে ও ছাদে চলে আসে। নিচে এখন হাঁক ডাক করে রোজকার ঝগড়া চলছে। দাদা সকালেই বৌদিকে চড় মেরে দিয়েছে। আর একবার মারতে গিয়েছিল, বৌদি তার আগে উল্টে মেরেছে। দাদা’র রাতের মদের খোঁয়ার এখনও কাটেনি। রোগাপটকা চেহারায় বসে বসে ধুঁকছে। বৌদি ভারি চেহারাটা নিয়ে দপ দপ করে উঠোন, রান্না ঘর, বাথরুম যাওয়া আসা করছে। মোহন’কে কোলে করে নিয়ে দাদার পাশে বসিয়ে আবার কলতলায় গিয়ে চিৎকার করে বলেছে, - লাথি মেরে মুখ ভেঙ্গে দেব ..শয়তানের বাচ্চা….। 


তাই শুনে মোহন হাঁ করে তাকিয়ে আছে দাদার দিকে। মোহনকে দেখতে চাইনিজদের মতো, ছোট ছোট চোখ, গালগুলো ফোলা ফোলা। মুখ দিয়ে সব সময় লাল পরে। দশ বছর বয়স হয়ে গেছে, কিন্তু এখনও কিছুই বোঝে না। মোহন জন্ম থেকেই এমন। ডাক্তার আগেই বলেছিল কিছু হবে না, স্পেশাল চাইল্ড, সারা জীবন সামলে রাখতে হবে। সাধু বাবা, পীর বাবা, ঝাড়-ফুঁক আর যজ্ঞ পার করে দাদা বৌদি এখন নিজেদের মধ্যে লড়তে ব্যস্ত। মোহন এমন আধখ্যাঁচরা হয়ে জন্মানোর পর থেকেই দাদা বৌদির ভাব-ভালবাসা সব শেষ হয়ে গেছে। একসময় ছিল বিধবা মা’র গালাগাল আর অভিশাপ, মা মরে যাওয়ার পর এখন দাদার গালাগাল আর হাত-পা চালিয়ে মারামারি। বৌদিও কম যায় না। মার খেলে উল্টে মার দেয়। এইভাবেই চলছে।


ভন্তা এখন ছাদ থেকে রানিদের বাড়ির দিকে নজর রাখছে। রানির বাবাকে বাজার যেতে দেখেছে, একটু পরেই ফিরে আসবে। রিটায়ার করা বুড়োর রোজ বাজার যাওয়া চাই। ভন্তাকে দেখলেই ভুরু কুঁচকে তাকায়। সেই কবে একবার ওর গাড়িতে করে গিয়েছিল কলকাতায়। শ্রাদ্ধ বাড়ির নেমন্তন্ন ছিল। সেখানে রানিকে কোনও এক ফ্যামিলির দেখে পছন্দ হয়েছিল। ফেরার সময় রানি আর রানির মা তাই নিয়ে আকারে ইঙ্গিতে কথা বলছিল। রানি যদি রাজি হয়, তাহলেই….। ফ্যামিলিটা ভাল, ছেলেটাও ভাল চাকরি করে…। ড্রাইভারকে না বুঝতে দিয়ে আড়ালে ইঙ্গিতে যেমন বলে সবাই, ভন্তা এইসব বোঝে। এর মধ্যেই রানি হঠাৎ বলে উঠেছিল, - আমার ওইরকম মাকুন্দ ছেলে ভাল লাগে না, দাড়ি গজায়নি, গোঁফ থেকেও নেই - ছ্যা..।
শুনে ভন্তা ফ্যাক করে হেসে ফেলেছিল, রানির বাবা ভুরু কুঁচকে তাকাতেই সামলে নিয়েছিল। সেই থেকে ভন্তাকে দেখলেই রানির বাবা এড়িয়ে যায়। এরপরও ওরা কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে, বিয়েবাড়ি আর অন্যান্য কাজে গাড়ি নিয়ে গেছে। ওকে এড়িয়ে বিশুদাকে বলে অন্য ড্রাইভার নিয়েছে। অবশ্য শুধু ওটাই কারণ নয়। রানিরা এই পাড়ায় এসেছে বছর পাঁচেক। আগে ওরা রাঁচিতে থাকত। ওর বাবা ওখানে চাকরি করত। এই পাড়ায় রানিরা নতুন। ভন্তাদের বাড়িতে সারাদিন দাদা বৌদির নোংরা খিস্তি খেউর শুনে অনেকেই এখন ওদের এড়িয়ে যায়। রানির বাবা মাও কিছুদিন পাড়ায় থেকে সেটা বুঝে গেছে। শুধু রানি একমাত্র ভন্তাকে দেখলে রাস্তায় হেসে কথা বলে। পরিচিত কাউকে দেখলেই রানি হাসে - দাঁড়িয়ে কথা বলে- ও অমনই। লম্বা, বেতের মত টানটান শরীর রানির, ওর গায়ে নিশ্চই সুন্দর একটা গন্ধ আছে! 


ভন্তাদের বাড়িটা কেমন ঘুপচি, আলো ঢোকে না। খোলা নর্দমার পাঁক, বাথরুমের জল কম দেওয়া হিসির ঝাঁঝ, রান্নাঘরের না ধোওয়া আঁশটে গন্ধ পাক মারে সারাদিন। দাদা, বৌদি ওদের সব আলো নিভিয়ে দিয়ে সংসারের দমবন্ধ গাড়িটা চালিয়ে যাচ্ছে। পুরনো খাটারা গাড়ির মত এই সংসারের বহুদিন কোনও সার্ভিস নেই, ইঞ্জিন, টায়ার, গিয়ার সব ভোগে গিয়ে হিচকি মেরে চলছে।
এইখান থেকে ভেগে না পড়লে ভন্তা বাঁচবে না। গাড়ির মধ্যে কালো কাঁচ তুলে, এসি চালিয়ে ও পালিয়ে বেড়ায়, গাড়িতে থাকতেই ওর সবথেকে ভাল লাগে। কাঁচ তুলে, এসি চালিয়ে গড়িয়ে চলা। কোথাও থামলেও সিট হেলিয়ে শুয়ে থাকে। কিন্তু কাজ ফুরোলে আবার তো ফিরে আসতে হয়। ও চলে যাবে। কিন্তু একা নয়, ওর রানিকে লাগবে। ওই লম্বা শরীর, ওই ঝিকমিকিয়ে হাসি… রানিকে পেতেই হবে ওকে… কিন্তু উঠিয়ে না নিয়ে গেলে পাওয়ার আশা নেই। 


ওই যে রানির বাবা আসছে। একবার তাকিয়ে বাড়ির সামনে দাঁড় করানো বড় গাড়িটা দেখল। বিশুদার এই গাড়িটা সবাইকে চালাতে দেয় না। ভাল পার্টি না হলে এইসব গাড়িতে চাপবে কে? রেটে পোষাবে না। সকালের দিকে ডিউটি থাকলে বিশুদা অনেক সময় বলে গ্যারেজ থেকে গাড়ি নিয়ে চলে আসতে। আজ যেমন একটা এয়ারপোর্ট পার্টি পিক আপ আছে। ভন্তা সেই বুঝেই গাড়িটা নিয়ে এসেছে। ভেগে যাবে এই গাড়ি নিয়ে আজ। এই গাড়িতেই রানিকে তুলে নেবে… নেবেই। 

নিচে দাদা আবার চিৎকার করছে, - শালা, খেতে না দিয়ে কোথায় যাচ্ছিস…
-দেব না খেতে , মরে যা তুই জানোয়ার...। 


বৌদির তীক্ষ্ণ গলার স্বর ভন্তার কানে এসে বিঁধল। এই সময় রানি সাইকেল নিয়ে বেরোল। ভন্তা চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিয়েই দৌড় মারল। পিঠের ব্যাগটা রেডি ছিল। আজ ও সকাল থেকেই জিন্স আর টি-শার্ট পরে আছে। জুতোটা পায়ে গলিয়ে নিচে বারান্দায় বৌদির মুখোমুখি হল। মোহনকে বসিয়ে খাওয়াচ্ছে। ওকে দেখে শুনিয়ে শুনিয়ে বলল, আজ দুটোকেই বিষ খাওয়াব, তারপর নিজেও খাব। 
ভন্তা পাত্তা দিল না। এই বাড়িতে ও আর ফিরবে না। এখানে থাকলে ওকেও মরে যেতে হবে। গাড়িটা দেওয়াল ঘেঁষে রেখেছিল। ইলেকট্রনিক্স ডোর লক খোলার পিক পিক আওয়াজ শুনে দাদা ভেতর থেকে চেঁচিয়ে বলল, - ভন্তা দেখ, আমায় খেতে দিচ্ছে না শয়তান মেয়েছেলে… 
মোহন চিৎকার করে উঠল, জান্তব একটা শব্দ , ও যেটা করে, একমাত্র এইভাবেই মোহন ওর অস্তিত্বের জানান দিতে পারে, যেটার আসলে কোনও মানে নেই। ওই আওয়াজটা শুনতে খুব বিচ্ছিরি লাগে, বুকটা কেমন কেঁপে ওঠে। কাঁচ তুলে দিল ভন্তা, বাইরের রোদ আর গরম কমে গেল। কোনও চিৎকার আর নেই, যেন ঝপ করে জীবনের সব অসহ্য শব্দ আর গন্ধের সুইচ বন্ধ করে দিল ও। এই গাড়িটার কালো কাঁচের ভেতর পুরো অন্য একটা পৃথিবী, এটা নিয়েই ভন্তা ভেগে যাবে! গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ভন্তা পালিয়ে গেল বড় রাস্তার দিকে। 

 

শম্ভুর মোড় পার করে একপাশে ভন্তা গাড়িটা স্টার্ট রেখে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সকালের অফিস যাত্রীরা কেউ কেউ এই রাস্তা দিয়ে যায়। টুকটাক কিছু বাইক আর সাইকেল যাচ্ছে। রানি সাইকেল করে এসে পড়বে এক্ষুনি। বুকটা কেমন একটু করছে। নাহ্, ভয় নয়! কীসের ভয়? কিছু পেতে গেলে রিস্ক নিতেই হবে। 
-কি রে ভন্তা এখানে? 
বাইক থামিয়ে সানি অবাক হয়ে দেখছে ওকে। ভন্তার অস্বস্তি হল। সানির এক কানে দুল, চুল কাটে অনেক খরচা করে। ভাড়ায় গাড়ি চালায় আবার নিজের গাড়িও আছে। একটু হিরো মার্কা হাবভাব। 
-পার্টিকে আনতে যাব এয়ারপোর্ট থেকে।
- বিশুদা তোকে নতুন গাড়িটা চালাতে দিয়েছে! দামি গাড়িটার দিকে অবাক হয়ে দেখছে সানি।
- হুম। ওকে আর পাত্তা না দিয়ে ভন্তা মোবাইল নিয়ে টেপাটিপি করতে লাগল। 
তখনই মোড়ের মাথা থেকে রানি সাইকেল নিয়ে চলে এল। ভন্তার বুকের মধ্যে হঠাৎ করে ধকপক শুরু হয়ে গেল।
সানি থাকলে হবে না, ওকে ভাগাতে হবে। 
- তোর কোথায় ডিউটি? 
- ডাক্তারবাবুর জামাইকে কলকাতা ছাড়তে যাব। সানি কথা বলতে বলতে দূর থেকে আসা সাইকেলটার দিকে তাকাল। লম্বা চেহারার রানি এগিয়ে আসছে। 
 - দেখিস, সাবধানে চালাস, বহুত পিক আপ…। সানি বাইক নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে ইঙ্গিতপূর্ণ তাকাল। 
ভন্তা মনে মনে বলল, -শালা। কিছু আন্দাজ করেছে নাকি! করলেও কী, ও তো আর ফিরছে না, এক্ষুনি ভাগবে…। 
সাইকেল চাপা রানির লম্বা শরীরটা গড়িয়ে আসছে ভন্তার দিকে। ওকে জাপটে ধরে গাড়িতে তুলবে। তুলবেই এখন…।
-    সোমনাথদা! …
ভন্তা থমকে অবাক হয়ে তাকাল। রানি সাইকেল থেকে নেমে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। 
 -সাইকেলের চেনটা খালি পড়ে যাচ্ছে... সোমনাথদা...

সোমনাথদা... সোমনাথ দা...! 
রানির গলায় নিজের হারিয়ে যাওয়া নাম শুনে হাতড়ে বেড়াচ্ছিল ভন্তা…
 -আপনার নাম কী দাদা? ফোন নাম্বারটা সেভ করে রাখি। 
 -ভন… ইয়ে সোমনাথ...। নাম্বারটা লেখো, মানে লিখুন... নাইন নাইন ফাইভ…
ভন্তা আঙুল দেখেছিল, লম্বা, সরু সরু আঙুল। পাতলা নখ, হালকা হয়ে আসা নেল পালিশ.. ভন্তার নাম্বার সেভ হচ্ছে।
-    পাড়ার মধ্যে, কখন গাড়ি লাগে, তাই নিয়ে রাখলাম…।

 

-    কী মুশকিলে পড়লাম বলুন তো! আমায় সাড়ে নটার ট্রেন ধরতেই হবে। না হলে আজকে অফিস কামাই। 

অফিস! বর্ধমানের বড় একটা শপিংমলে সারাদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খদ্দেরদের জামাকাপড় দেখায় রানি। ট্রেনে করে যায় বলে ওটা অফিস হয়ে গেল! কত টাকা মাইনে দেয়? ওই শপিংমলে সারাদিন দাঁত বার করেই হাসতে হয় ওকে, ছেলে খদ্দেরগুলো শার্ট-প্যান্ট দেখার ফাঁকে নিশ্চয়ই রানিকেও দেখে...!
- গাড়িতে ওঠো। পৌঁছে দিচ্ছি।
ভন্তার কথা শুনে রানির দাঁত ঝিকমিক করে উঠল, - সত্যি? কিন্তু এই সাইকেলটা কোথায় রাখব….?
-    ফেলে দাও…. ভন্তা বলতে চাইল। বলল, - রাস্তার ধারে তালা মেরে এখানেই রাখ। তোমাকে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে আমি বাড়ি দিয়ে আসব। 
রানির চোখ আরও ঝিকমিক করে উঠল। ওকে পাশে বসিয়ে ভন্তা গাড়ি ছেড়ে দিল। কাঁচ তোলা, এসির মধ্যে মৃদু শব্দে গান বাজছে, সুন্দর একটা গন্ধ কিন্তু এটা তো গাড়ির সেন্ট! ভন্তা রানিকে পাঁজাকোলা করে তুলবে ভেবেছিল, কিন্তু ও নিজেই হেঁটে উঠে পড়ল, ওর গায়ের গন্ধ পেল না ভন্তা। 

-চুপ করে বসে থাক। একটু চিল্লিয়েছিস কি গলা টিপে দেব…। জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে নিলে এটাই বলত ভন্তা। রানি নিশ্চয়ই চেষ্টা করত জানলা খুলে চিৎকার করার। ভন্তা সেই সুযোগ দিত না, ও সব কিছু লক করে দিয়ে হাই পিকআপে গাড়ি চালাত, এই গাড়ির সব সিস্টেম ওর জানা, রানির চিৎকার চাপা দেওয়ার জন্য গান চালিয়ে দিত জোরে….। 

-কী সুন্দর গাড়িটা। আমি মাঝে মাঝে দেখি এই গাড়িটা নিয়ে আপনি আসেন। বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায় না কিন্তু ভিতরটা এত সুন্দর…। 

ভন্তা অল্প হাসল। বিশুদা’র এই গাড়িটা ওই সব থেকে বেশি চালায়, বলা যায় এটা এখন ওর নিজের গাড়ি। স্টেশনের কাছে এসে গেছে ওরা, রানি বলল, - ইসস এসে গেলাম! নামতেই ইচ্ছে করছে না গাড়ি থেকে…। আচ্ছা, এই গাড়ি করেও তো বর্ধমান চলে যাওয়া যায়! ট্রেনের আগেই পৌঁছে দিতে পারবেন?
-হ্যাঁ পারব...যাবে?
- সত্যি! এ মা আমি এমনি বলছিলাম…। 
- চলো, নিয়ে যাচ্ছি…। ভন্তা অল্প হেসে গাড়ির স্পিড বাড়াল। রেললাইনের তলা দিয়ে ওর গাড়ি ছুটল। স্টেশনের একটু পরেই কী সুন্দর রাস্তা। দু’পাশে আমবাগান। ঘন ঠাসের পাতা, ডালপালা নিয়ে ঝুঁকে আছে রাস্তার ওপর। দিনের বেলাতেও আলো আঁধারি রাস্তায়। মাখনের মত চলছে ভন্তার গাড়ি। আমবাগান পেরিয়ে গেলে ধানক্ষেত, কলাবাগান, পাটক্ষেত, কালো রাস্তার দু’পাশে খালি পাল্টে যাচ্ছে সবুজের পরতগুলো। ছোট রাস্তা পার করে একসময় হাইওয়েতে উঠে পড়ল ভন্তা। এই রাস্তাই চলে গেছে বর্ধমান, দুর্গাপুর, ধানবাদ, বেনারস, দিল্লি পার করে কোথায় না কোথায়! এই গাড়ি করে রানিকে নিয়ে ভন্তা চলে যাবে... যাবেই অনেক দূরে। যেখানে ও কোনও রাস্তা চিনবে না, কোনও লোক ওকে জানবে না। খিদে পেলে ধাবাতে গাড়ি দাঁড় করিয়ে, রানিকে শাসিয়ে বলবে,  গাড়ি থেকে নেমেছিস তো মেরে পা ভেঙ্গে দেব। 

-    আমার এই ধানক্ষেত দেখতে খুব ভাল লাগে…। রাঁচিতে কোয়ার্টার থেকে সাইকেল নিয়ে একা একাই চলে যেতাম ঘুরতে, ….। 
রানির উচ্ছ্বাস ভরা গলায় ভন্তা চমকে তাকাল। রানির চোখ মুখ ঝকমক করছে। ঠোঁটের পাশে একটা ছোট্ট তিল, ভন্তা এই প্রথম দেখল এত কাছ থেকে। 
-এত সুন্দর লং ড্রাইভ আমি কোনওদিন করিনি। 
সত্যি বলছে? ভন্তা আড়চোখে রানিকে দেখল। এত হাসি এত খুশী কী করে থাকে ও? ঝপ করে গাড়িতে উঠে পড়ল এক কথায়! ন্যাকামি করছে না তো?
-আহা সূর্যমুখী...একটু দাঁড় করান না…। 
হাইওয়ের ধারে সূর্যমুখী ফুল ফুটে আছে অনেক। সবুজের মাঝে হলুদ ফুলগুলো আলো হয়ে আছে। ভন্তা গাড়িটা এক পাশ করে দাঁড় করাল। রানি তাকিয়ে আছে ফুলগুলোর দিকে। ওর চুলগুলো ঘাড়ের কাছে এলিয়ে আছে, ওর গালে রোদ পড়েছে, নাকটা কী টিকালো! ভন্তা কখনও ওকে চড় মারতে পারবে! চুলের মুঠি ধরে কাছে টেনে বলতে পারবে… 
- এত হাসি কিসের? সবার সঙ্গে এত ঢলানি কিসের…? 

-এখানে খুব সুন্দর ছবি উঠবে...। রানি বলল।
-নামবে? 
রানি মাথা নাড়ল। ওর চোখটা আনন্দে মেখে আছে। ডোর লক খুলে দিল ভন্তা।


কালো রাস্তার পাশে সবুজ ঘাসের কার্পেট, তার মাঝে হলুদ সূর্যমুখী অনেক আলো ছড়াচ্ছে। সাদা চুড়িদার পরা রানি ওঁর লম্বা দেহটা নিয়ে পায়ে পায়ে ওই আলোর মধ্যে হাঁটতে গেল। স্টিয়ারিং ধরে ভন্তা দেখছিল। রানি একবার পিছন ফিরে তাকাল। ওর ঝিকমিক হাসি ভন্তার চোখ ঝলসে দিল। বাইরে অনেক আলো, গাড়ির ভিতরের কালো কাঁচ ঢাকা আঁধার থেকে ভন্তা বাইরে যাবে কিনা বুঝতে পারছিল না। 
                                             --------------

  • অয়ন ভট্টাচার্য
img
আগের পাতা
মাগরিবের ছায়া