কেনো সুনীলদা কবির রক্ত নিলেন না

 
এক আপনভোলা বাউল। ভেকধারী নন। যথার্থ বাউল। তাইই বোধহয়, তাঁর জন্মদিনে তুলসীদাসের দোঁহাই বলা যেতে পারে-- দুনিয়া লোক সব বাওরা হো কর ঘর ঘর বাঘিনী পালে--
 
সেসব অনেক কাল আগের কথা। তখন পৃথিবীকে এতো বিবর্ণ রঙে দেখিনি। দুর্গাপুজোর দশমী-র পরপর পিনাকীদা, মানে আমার প্রিয় কবি পিনাকী ঠাকুর ফোন করলেন- দাদাকে প্রণাম করতে যাবে না? যাব তো। দাদা এখন কোথায় আছেন? পিনাকীদা বললেন- শান্তিনিকেতন। অনেকেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শান্তিনিকেতনের 'একা এবং কয়েকজন' এই নামের বাড়িতে গেছেন। সুনীলদার এই বাড়িতে আমরাও বেশ কয়েকবার যাবার সুযোগ হয়েছে। বেশ লাগত আমার বাড়িটি।  ছোট একটা পুকুর; সামনেটা বাগান, হাঁস সব মিলিয়ে বেশ মনোরম পরিবেশ। আর এসব কিছু দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন দীনবন্ধুদা। সরল- আত্মভোলা দীনবন্ধুদার সঙ্গে আমার ভাল বন্ধুত্ব ও হয়ে গিয়েছিল প্রথম দেখাতে। ক‍্যানেলটা ছেড়ে একটুখানি হাঁটলেই সুনীলদাদের পাড়া। অর্ঘ‍্য সেনের বিখ্যাত কালো বাড়ি ও ওখানে। দাদা চলে যাবার পর শান্তিনিকেতনে গেলেও ওই পাড়াতে ইচ্ছা করেই যাই না। তাই জানি না। আগে যখন ওই পাড়া দিয়ে হেঁটে যেতাম, কী অদ্ভুত প্রশান্তি যে মনের মধ‍্যে নেমে আসতো, যেন পৃথিবীটা সত‍্যিই  এতো নিরালা-নিঝুম। হেঁটে গেলে নিজের পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। তাছাড়া বড়-বড় বাড়িগুলি তালাবন্ধ। এ পৃথিবী যেন নির্মল, কখনও কোনও মলিনতা যেন এই অঞ্চলে আসিনি। পিনাকী ঠাকুরের লোভনীয় প্রস্তাবে রাজি হয়ে, দাদা আর ভাই মিলে ব‍্যান্ডেল থেকে ট্রেন ধরে পৌঁছালাম প্রান্তিক। উন্নয়নের জোয়ার তখনও শান্তিনিকেতনকে এতো বিপর্যস্ত  করেনি। স্বাতীদি সেবার পুজোর ছুটিতে বোনদের সঙ্গে কোথায় যেন বেড়াতে গেছেন। একা আছেন দাদা। দাদাকে দেব বলে এক প‍্যাকেট গোল্ড ফ্লেক কিং সাইজ কিনে, পিনাকীদার সঙ্গে পৌঁছালাম 'একা এবং কয়েকজন' এ। দীনবন্ধুদা বললেন, দাদা ওপরে লিখছেন। লেখার সময় বিরক্ত করব? ভাবতে-ভাবতে দাদার ঘরের সামনে গিয়ে উঁকি দিলাম। দাদা দরজার দিকে তাকিয়ে বললেন, আরে তোমরা? এসো। এসো। আমরা বললাম- না, মানে আপনাকে প্রণাম করতে এসেছিলাম। প্রণাম পর্ব হয়ে গেলে, কম্পিত হস্তে দাদার দিকে এগিয়ে দিলাম সিগারেট। দাদা বললেন- আরে, বিষ কাউকে কেউ উপহার দেয় না কি? তারপর বললেন- এদিকে কি কোনও কাজে এসেছিলে? আমরা বললাম- না। না। আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। পরের ট্রেনে চলে যাব। দাদা বললেন- জরুরি কিছু কাজ আছে নাকি? দুপুরে খেয়ে গেলে পারতে। কাঠ বেকার কাজ আবার কি? দোতালায় ওঠার সময় দুটো খবর পেয়েছি, এক- ইলিশ মাছ রান্না হয়েছে। দুই- দরজার কোণে এমনকিছু পানীয়ের শিশি-বোতল দেখেছি, যা কোনোদিন কিনে খেতে পারলেও; ভীষণ পছন্দের। তাই যাওয়ার ইচ্ছে মোটেও নেই। তবে সামনে কি বলা যায়, যে থাকার ইচ্ছা নিয়ে এসেছি। তাই বললাম - না। মানে, আপনি তো ব‍্যস্ত; লেখা আছে। দাদা বললেন- লেখাতো সবসময়ই আছে। দুপুরে খেয়ে যাও, গল্প-টল্প করা যাবে। দাদা ও বৌদিকে সেসময় দেখাশুনা ও সহযোগিতা করার জন‍্য ধনঞ্জয়দা-উৎপলদা-দীনবন্ধুদা সবাইকে আজও শ্রদ্ধা করি ও ভালবাসি, কারণ সেসময় আমরা যারা দাদার কাছে যেতাম, সবার সম্পর্কে সচেতন ছিলেন ওঁরা। পিনাকীদা যে মাছ খান না, তার জন‍্য দীনবন্ধুদা ডিম রান্না করেছেন। যথাসময়ে খেতে বসলাম, পিনাকীদার পাতে মাছ নেই দেখে সুনীলদা বললেন- তুমি ইলিশ মাছও খাও না? তুমি তো মহা র্দুবৃত্ত। সবাই মিলে-মিলে হাসি মজা করে খাওয়ার শেষে, দাদা আমেজ করে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন- তাহলে তোমরা কটার ট্রেন ধরবে। আর রাখঢাক না করে বললাম-দাদা,চলে যাব ভেবেছিলাম, কিন্তু দরজার কোণে যা শিশি-বোতল দেখলাম! হা-হা করে হেসে উঠলেন সুনীলদা, বললেন- ঠিক আছে। ঠিক আছে। আজ রাতটা থেকেই যাও তাহলে। সেই সন্ধে ও রাতের কথা যতদিন বেঁচে থাকব, মনে থাকবে। সন্ধেবেলা দাদার বাড়ির বারান্দায় আমরা চারজন, মানে সুনীলদা-পিনাকীদা আমি ও সেই লোভনীয় শিশি বসা হল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'স্মৃতির শহর' কাব‍্যগ্রন্থটি আমার বড্ড প্রিয়। তাছাড়া আরও সব উপন‍্যাস ও প্রবন্ধ সম্পর্কে মনের মধ‍্যে হাজার প্রশ্ন তখন ঘুরপাক খায়, সামনেই বসে আছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। লোকজন কম। এ সুযোগ তো বড় একটা পাওয়া যায় না। একের পর এক বিষয় জানতে চাইলাম ওঁর কাছে। একটি কবিতা চরণ ছিল সম্ভবত এরকম-গান্ধী মৃত্যুর টেলিগ্রাম যখন আসে, তখন আমি পাশের বস্তির ছেলেদের সঙ্গে ছিপি খেলছিলাম। দাদার কাছে জেনে নিলাম - ছিপি টা কীরকম খেলা। এরকম কত কী যে। সব কিছু তো লেখা যায় না। আমেরিকার অনেক গল্প বললেন। আইওয়া শহরের রাইর্টাস ওয়ার্কশপ, মার্গারিট অনেক প্রসঙ্গ। ছেলে-বৌমা, বিশেষত নাতির অনেক গল্প বললেন। বললেন- জান তো, আমার নাতি খুব একটা রূপকথার গল্প পড়ে না। তা আমরা সপরিবারে গেছি একজায়গায় বেড়াতে। অনেকটা অঞ্চল জুড়ে বনাঞ্চল সেখানে। যে বড়-বড় গাছগুলি মারা গেছে কিংবা নষ্ট হয়ে গেছে, আমেরিকানরা এগুলি কেটে ফেলে দেননি। বরং শিল্পীরা সে গাছগুলি কেটে নানারকম আকৃতি দেবার চেষ্টা করেছেন। একটি গাছের সামনে দাঁড়িয়ে আমার নাতিবাবু বলল- শি ইজ প্রিন্সেস! আমি জানতে চায়লাম, কি করে বুঝলে যে- প্রিন্সেস? নাতি বলল- অ‍্যাই ইউজ মাই ইমাজিনেশন। বুঝলে কল্পনাকে আটকে রাখা যায় না। এটি একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। সেই সন্ধে থেকে গড়িয়ে যাওয়া শান্তিনিকেতনের রাত আমি জীবনে ভুলব না। নবপর্যায় কৃত্তিবাস পত্রিকার শেষের দিকে, প্রাণ উজাড় করে পরিশ্রম করেছি। কী পাব কী পাব না, হিসাব করেনি একফোঁটা। পিনাকী ঠাকুর সহযোগি সম্পাদনার কাজ করেছেন। আমি ছিলাম একশো গ্রাম কলগেটের সঙ্গে দশগ্রাম ফ্রি সুদীপ। কৃত্তিবাস পত্রিকার জন‍্য কাজ করতে আমার ভাললাগত। শুধু আমার কেনো, আমাদের শান্তিপুরের পুরো বন্ধুদের দল অঞ্জন,তাতাই, ভুট্টো, সাম‍্য, প্রহ্লাদ, অভিজিৎ, জয়, জিৎ,রবি, সবাই হাতে হাত মিলিয়ে দুদিনের আই সি সি আর- এ অনুষ্ঠান হোক বা কৃত্তিবাসের আড্ডা, পোস্টার মেরে বেড়িয়েছি যাদবপুর থেকে কলেজস্ট্রিট। পরির্বতে পেয়েছি অকৃত্রিম ভালবাসা। যে ভালবাসা-র জন্ম কিংবা মৃত্যু নেই। আর একটি ছোট্ট ঘটনার কথা লিখে আজকের লেখা শেষ করি। শেষ করি লিখলেও দাদাকে নিয়ে লিখতে গেলে তা যেন কিছুতেই শেষ হতে চায় না। সুনীলদার হাঁটু অপারেশন হবে পিয়ারলেস হসপিটালে। রক্ত লাগবে। এটি এমন কিছু বড় ব‍্যাপার নয়। সুনীলদার রক্ত লাগবে বললে হাজার জন প্রস্তুত। তবুও আমাকে ফোন করলেন ধনঞ্জয়দা, জানালেন - দাদাবাবুর রক্ত লাগবে কিন্তু কোনও কবি হলে হবে না। আমাদের শান্তিপুর থেকে আমাদের বন্ধু অভি ও পাপ্পুদা গিয়ে রক্ত দিয়ে এলো। পরে চিন্তা করেছি কেনো সুনীলদা কোনো কবির রক্ত নিলেন না। উত্তরটা আমার মনে-মনেই জানা থাক। আপনারা ও চিন্তা করুন দেখি। শুভ জন্মদিন সুনীলদা।

  • সুদীপ চক্রবর্তী