শিশুশিক্ষা ঘিরে ভাবনা চিন্তা , চলছে–চলবে। শিশুর মনের বিকাশ, শিশুশিক্ষার সবথেকে বড়পর্যায়। সেই বিকাশের দিকটি কি সঠিকভাবে দেখবার চেষ্টা হচ্ছে এই প্রতিযোগিতার দুনিয়াতে---
এই কিছুদিন আগেও একটা সময় ছিল যখন বাৎসরিক পরীক্ষার পর পড়ুয়ারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচত, "যাক বাবা এখন আর পড়া নেই যতদিন না রেজাল্ট বেরচ্ছে"। এখন পরীক্ষা শেষ হতে যত দেরি, তারপর দিনই পিঠে ব্যাগ নিয়ে পরের ক্লাসের টিউশন চালু। এই মুহূর্তে যাঁরা স্কুলপড়ুয়াদের অভিভাবক, তাঁদের যদি আবার সেই ছোট বয়সটা ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাঁরা এই দু’রকমের মধ্যে কোন ব্যবস্থাটা চাইবেন? সত্যিটা মনে হয় একমাত্র গোপন ব্যালটেই বেরোবে। এখন কিন্তু একজন স্কুলপড়ুয়ার বছরের বেশিরভাগ সময়টাই কাটে নম্বরের পেছনে দৌড়ে। সেই অনাবিল আনন্দের ছুটির সংস্কৃতি আর নেই। প্রচলিত ধারণা, "বুঝলে হে, এ হল কম্পিটিশন| যা জনসংখ্যা আমাদের, কী আর করা যাবে, ভাল চাকরি পেতে হবে তো"| কিন্তু এই কম্পিটিশনটা কী নিয়ে? নম্বরের নাকি মেধার? আচ্ছা, ভেবে দেখুন তো, চারপাশে যাদের দেখছেন, এমনকি নিজের জীবনেও, ভালো থাকার সঙ্গে নম্বর পাওয়ার সম্পর্ক (অঙ্কের ভাষায় কোরিলেশন) কতটা? হয়তো এর সঙ্গে পছন্দের কেরিয়ার হওয়া বা না হওয়ার সম্পর্ক থেকে যায় কিন্তু জীবনে আনন্দে থাকার, একটি সফল জীবন পাওয়ার ক্ষেত্রে, সত্যিই “নম্বর” কতটা বাধা হয়ে থাকে? জীবন একমুখী নয়, একটা equation দিয়ে সবার জীবন একরকমভাবে চলে না। তাহলে সবাই একরকমভাবে দৌড়নোর লড়াইতে নেমে কী লাভ হচ্ছে? Successful হওয়ার জন্য?
Sucess বা সাফল্যেরর যে ধারণা থেকে নম্বরের পিছনে এই দৌড় তার সবটাই পেশা, অর্থ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার, যার কোনও প্রাকৃতিক প্রয়োজন জীব হিসেবে মানুষের কিন্তু নেই। একটা জনপ্রিয় ধারণা আছে যে ইন্সেন্টিভের হাতছানি না থাকলে মানুষ নাকি নতুন কিছু করবে না, আধুনিক যুগে উৎসাহ দিতে পেটেন্ট, প্রমোশন, টাকা ইত্যাদির ব্যবস্থা।
কিন্তু আলতামিরা গুহায় বসে বাইসন আঁকার সময় কোনও হাততালি পাওয়ার তাড়া তো ছিল না, মেডেলও নয়, বিবর্তনেও ওটা শর্ত ছিল না, তাহলে কিসের তাগিদ ছিল? প্রাকৃতিকভাবে যেটা সত্যি তা হল জীবজগতে মানুষই একমাত্র ক্রিয়েটিভ বা সৃষ্টিশীল| সে সৃষ্টিশীলতা তার বুদ্ধিও শ্রমের মধ্যে দিয়ে কাজে পরিণত করে সাফল্যেরর আনন্দ পায়, এই সাফল্যের সামাজিক প্রতিষ্ঠা বা স্বীকৃতি অর্থে নয়, বরং এক তাগিদ যেটা মানুষের প্রাকৃতিক। পাখি হাজার হাজার বছর ধরে একইভাবে বাসা বোনে, মাকড়শা একইভাবে জাল বোনে, মৌমাছি নিখুঁত চাক বাঁধে| কিন্তু মানুষ কয়েক দশক আগেও যেভাবে জীবনযাপন করত আজ তার থেকে আলাদা কিছু করে। এ এক বিখ্যাত ব্যক্তির কথা| লক্ষ বা হাজার হাজার বছরের টাইম স্কেল – এ মুঠোয় পাথর থেকে মোবাইলফোন- মানুষের অগ্রগতিতে এই কথা যেমন প্রযোজ্য তেমনি আবার প্রতিটি মানুষের ক্ষুদ্র জীবনেও কিন্তু সত্যি| বাস্তবজীবনে মার্কশিট দেখিয়ে লড়া যায়নি, লড়াইয়ের মূল অস্ত্র ক্রিয়েটিভিটি। ক্রিয়েটিভিটি আর বুদ্ধি, একটির সঙ্গে আরেকটি সংযুক্ত, কিন্তু এক নয়। বুদ্ধি বেশি হলে ইংরিজি ভাষা দ্রুত শিখবে আর শুনে মুগ্ধ হওয়ার মতো ইংরিজি বলতে পারাটা ক্রিয়েটিভিটি, আর্ট। গাভাসকর, সচিন, মেসি, মারাদোনার খেলার কায়দা বইতে বা ট্রেনিংয়ে পাওয়া যাবে না ওটা তাদের উদ্ভাবন, আর্ট। বিজ্ঞানে ফুল মার্কস পেলেও গবেষণায় সাফল্য ক্রিয়েটিভ বুদ্ধিটা সহায়ক। কারণ মাথায় আপেল পড়ে। গাছের আপেল শেষ হয়ে গেলেও ক্রিয়েটিভ মন ছাড়া নতুন চিন্তার উদয় হয় না, শুধু যুক্তিবাদী ও বুদ্ধিমান মস্তিস্ক এ কাজ পারে না।
সাফল্যেরর প্রয়োজন প্রাকৃতিকভাবে না থাকলেও মানুষের তৈরি করা সমাজ এই প্রয়োজন সৃষ্টি করেছে। মানুষ তার সমাজ ও কর্মজীবনে প্রতিদিন পরীক্ষার মুখোমুখি, ব্যক্তিগত জীবনে, পরিবারে, পাড়ায়, কর্মস্থলে, ইন্টারভিউতে, ভিড় বাসে ট্রেনে, সর্বত্র| বইয়ের উদাহরণের অংক মিলিয়ে সেসব সমস্যা হাজির হয় না। আমরা নিজের জীবনধারণের সব জিনিস নিজেই সৃষ্টি করি না বলেই সমাজের ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখার একটা পথ বাছতে হয়, যাকে আমরা এক কথায় পেশা বলি। যার মাধ্যমে সমাজকে কিছু দিই বদলে সেখান থেকে পাই, দেওয়া নেওয়ার ভারসাম্যের অভাব আরেকটি ভিন্ন বিতর্ক।
আসল হল কে কীভাবে চারপাশের ঠেলাঠেলির ভিড়ে নিজস্বতাকে কাজে লাগিয়ে সমাজের এই সাপ্লাই নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে আর সেখানেই দরকার ক্রিয়েটিভিটি। পছন্দের পেশায় যাওয়ার রাস্তায় এন্ট্রি পেতে নম্বর সাহায্য করতে পারে কিন্তু তারপর? আজ থেকে ৫০-৬০ বছর আগে কোনও চাকুরে প্রায় একইধরণের কাজ করে সারাজীবন কাটিয়েছেন। আজ প্রতিবছর সেই কাজ বদলে যাচ্ছে। ব্যবসা করতে গেলে ধরণ পাল্টাচ্ছে রোজ।
কিন্তু যার ক্রিয়েটিভিটি আছে সে নতুন ছক বের করে ফেলছে। AI এর সঙ্গে মানুষের জীবিকায় টিকে থাকার লড়াই এখন পরিষ্কার, অর্থাৎ কম্পিটিশন কিন্তু ক্রিয়েটিভিটির, শুধুই মার্কশিট কাজে লাগবে না।
পেশা ও সমাজ থেকে বিযুক্ত হয়ে পড়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়াটা যেখানে প্রাথমিক শর্ত সেখানে সামাজিক মানুষ হয়ে ওঠা একটি অত্যন্ত দরকারি বিষয়। আজকাল একটি অত্যন্ত আত্মকেন্দ্র্রিক প্রজন্ম তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, নম্বরের দৌড়ের একটা বড়ো ভূমিকা এতেও আছে। মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যোগাযোগ গড়লেও তার আশপাশের বাস্তবে যারা রয়েছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগে বড় একটা আগ্রহী নয়, কীভাবে তা গড়ে সেটার ধারণাটা সে পায়নি। নিজেকে বুঝতে ও অপরকে বুঝতে, পারিবারিক, সামাজিক ও কর্মক্ষেত্রে নিজেকে স্বছন্দে মিলিয়ে রাখতে IQ ছাড়াও 'ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স' বা 'ইমোশনালকোশেন্ট' (EQ) এর বড় প্রয়োজন| সমাজে পরস্পরকে বোঝার স্তর যত উন্নত হবে ততো বেশি বাসযোগ্য হয়ে উঠবে। অনেকেই অভিযোগ করেন তাঁকে কেউ বোঝে না, আসলে উল্টোও হতে পারে, তিনিও বোঝেন না কেমনভাবে তার অসুবিধে বা সুবিধে অন্যকে বোঝালে কোনও কিছু এগোতে পারে। এ এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার।
অতএব, পরীক্ষায় নম্বর তো লাগবেই, কিন্তু নম্বর বাড়ানোর দৌড়ে থাকার সঙ্গে সঙ্গে কিভাবে ক্রিয়েটিভিটিতে শান দেওয়ার পরিবেশ চাই, বাড়িতে, স্কুলে, সমাজে| কিন্তু কীভাবে? অনাবিল আনন্দের মধ্যে অবসর কাটানোর সুযোগ ছাড়া কল্পনাশক্তির বিকাশ ঘটে না| ফ্ল্যাটে থাকা শৈশব ধানক্ষেতের আলের ওপর দিয়ে হাঁটে না| কেউ আর বলে না "পাড়ায় কোনও খেলার মাঠ নেই", আসলে সবাই পড়তে ব্যস্ত! আজকাল দরকারে খেলার স্কুলে নাম লেখাতে হবে। পুকুরে সাঁতার নেই, আছে সুইমিং ক্লাস। যোগাসনের বদলে "ইয়োগা"। অর্থাৎ নিজের ইচ্ছেয় যেমন খুশি খেলব, দু’চারজনে বল পায়ে নিয়ে দৌড়ব অথবা বর্ষায় কাদামাটিতে ফুটবল, এসব ইচ্ছে থাকলেও কোনও সুযোগই নেই। এতে নম্বর বাড়ছে কিনা বলা কঠিন কিন্তু সৃষ্টিশীলতা বনসাই হয়ে যাচ্ছে| এই অন্ধকূপ থেকে বেরোতেই হবে। ছোটদের ক্রিয়েটিভ হতে দিন| IQ এর সঙ্গে তাদের EQ যাতে সমান গুরুত্বের সঙ্গে বৃদ্ধি পায় তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এককথায়, মস্তিস্ককে বৈচিত্রময় পুষ্টি দিতে হবে| এই খানেই আর্টের (সঙ্গীত, পেইন্টিংইত্যাদি) চর্চা, কাব্যের-সাহিত্যের চর্চা, স্পোর্টস বড় প্রয়োজন। আর্টের ট্রেনিংমানুষের বুদ্ধি ও ইমোশনকে পুষ্টি যোগায়, ব্যক্তিত্বকে গড়ে তোলে। শুধু অঙ্কে একশো পেয়ে যতটা লাভ তার চেয়ে অঙ্কে কয়েক নম্বর কম পেয়ে তার সঙ্গে একটু সরোদ বাজাতে শেখা অথবা জলরং ও তুলির ব্যবহার দিয়ে নিজের মনকে প্রকাশ করতে শেখা জীবনের বড় ক্যানভাসে অনেক বেশি প্রয়োজনীয়। এতে অঙ্ক, ইতিহাস ইত্যাদির ক্ষতি তো হবেই না বরং উন্নতি হতে পারে। গবেষণা বলছে যে কোনও একটি বাদ্যযন্ত্র বাজানোর চর্চা করে এমন কারওর মানসিক বিকাশ ও বিভিন্ন বিষয়ে ক্ষমতা থাকার সম্ভাবনা অন্যান্যদের থেকে অনেক বেশি। অর্থাৎ বৈচিত্র্যের চর্চা আসলে মেধাকে বাড়িয়েই তুলবে|
এই চর্চা নিয়মরক্ষার নয়, একেবারে স্কুল পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। স্কুলে সঙ্গীত, পেইন্টিং এবং স্পোর্টস ইত্যাদির ক্লাসের গুরুত্ব অঙ্কের ক্লাসের সমান গুরুত্ব পাক। কবিতা লেখায় কারও সম্ভাবনা প্রকাশ পেলে তাকে উৎসাহ দেওয়ার পরিবেশ তৈরি হোক। স্কুলজীবন একটি দীর্ঘসময়। এই সময়ে সবাই সারাবছর শুধুই একরকম নম্বরমুখী দৌড় লাগালে সমাজের ইকোসিস্টেমটাই নষ্ট হয়ে যাবে। বরং সময় বলে দিক কে কোন ক্ষেত্রে ভালো দৌড়োবে, কে অঙ্কে আর কে রং-তুলিতে|