মাষ্টারমশাই

 
শিক্ষক সমাজের মেরুদন্ড।সেই মেরুদন্ডটা সোজা রাখতে গেলে বুঝি সুচারুশরণ বাগচির মত ই মূল্য দিতে হয়-- 
 
মানুষটির জন্ম অবিভক্ত বাংলায়।অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলার আকুরটাকুরে কোন সালে , কত তারিখে তাঁর জন্ম - সে খবর রাখি নি। মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ' পদ্মানদীর মাঝি' তে এই আকুরটাকুর গাঁয়ের কথা লিখেছিলেন।গৌতম ঘোষের ফিল্মে মাইজো কর্তার সংলাপে গাঁটির কথা ছিল।পূর্ববঙ্গীয় কথ্যরীতিতে গোরা সর্বাধিকারী এই মাইজকর্তা চরিত্রটি অসামান্য ভাবে ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
বসিরহাটের কাছে ধলতিতা গ্রামটির প্রতি সমরেশ বসুর যেমন একটা ভীষণ ভালোলাগা ছিল , তেমনটা হয়তো আকুরটাকুর ঘিরে মানিকের ছিল না।গঙ্গা থেকে যুগ যুগ জীয়ে , এমন কি গোগোলের কাহিনীতেও এই ধলতিতার কথা সমরেশ লিখেছিলেন।আকুরটাকুর ঘিরে পদ্মানদীর মাঝির বাইরে সম্ভবত মানিক কিছু লেখেন নি।
মানুষটির জন্মস্থান এখন আর ময়মনসিংহ জেলায় নেই।জেলার সাব ডিভিশন টাঙ্গাইলের নামে এখন আকুরটাকুর টাঙ্গাইল জেলায়।কেবল ওই জেলাতেই নয়, টাঙ্গাইল শহর গায়ে গতরে এন এতটাই বড়ো যে, আকুরটাকুর এখন সেই শহরের ই একটা অংশ। তবে শহরের অংশ হলে কি হবে, মানুষটা যখন ভূমিষ্ট হয়েছিলেন বা মানিকের উপন্যাসের মাইজকর্তা যখন সেই জায়গাটি থেকে এসেছিলেন, তখন তার নাম ছিল , কেবল ই ' আকুরটাকুর' ।এখন কিন্তু টাঙ্গাইল শহরের গহীনে থাকা সেই এলাকার নাম হয়েছে, ' আকুরটাকুর পাড়া' ।এই ' পাড়া' শব্দটা কবে , কি ভাবে যুক্ত হয়েছে- তা খুঁজে পাই নি।অবিভক্ত ময়মনসিংহ জেলা গেজেটিয়ারে কিন্তু কেবল আকুরটাকুর ই দেখেছি।
আকুরটাকুরের সেই মানুষটি পড়াশুনা করেছিলেন ইতিহাস নিয়ে।সুশোভন সরকারের খুব প্রিয় ছাত্র ছিলেন।আবার রবীন্দ্রনাথ তোষামোদি পছন্দ করতেন, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে খুব খুশি হতেন-- সুশোভন সরকার অমনটা লেখবার পর( প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ- সুশোভন সরকার, আনন্দ) , সেই মানুষটিই ' দেশ' পত্রিকার পাতায় নিজের শিক্ষকের এই ধারণার তীব্র বিরোধিতা করতে পিছ পা হন নি।
বস্তুবাদী দর্শনের প্রতি ছিল তাঁর গভীর আস্থা।সেই আস্থাই তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল মার্কসীয় দর্শনের প্রতি।সেই চেতনা থেকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন শিক্ষকতাকে।যুক্তবঙ্গে শুরু তাঁর শিক্ষকতার জীবন। সেকালের পূর্ববঙ্গে শিক্ষক জীবনের যে বোধ কে বিকশিত করতে শুরু করেছিলেন , সেই বোধের পরিপূর্ণ পরিস্ফুটন ঘটে ছিল খন্ডিত বাংলায়।
নিজের রাজনৈতিক বোধে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত স্থিত ছিলেন।তাঁর সেই রাজনৈতিক বোধ কে একটা সময়ে সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ অভিহিত করেছিল , শ্রেণী সহযোগিতার বোধ।কারন , ডাঙ্গের মতের সমর্থকদের অনেকেই ছয়ের দশক থেকে কমিউনিস্ট বলতে নারাজ ছিলেন। আজকের দিনের রাজনৈতিক পরিবেশ , পরিস্থিতি যদি সেদিনের মানুষেরা দেখতে পেতেন, আকুরটাকুরের সেই মানুষটা দেখতে পেতেন-- কি ভাবতেন, কি বলতেন-- এটা জানতে খুব ইচ্ছে করে।
মানুষটি যেহেতু সরকারি কমিউনিস্ট ছিলেন না, তাই ভঙ্গবঙ্গে যে ইস্কুলে শিক্ষকতা করতেন, সেখানকার সরকারি কমিউনিস্ট হেড মাষ্টারমশাইয়ের কাছে যেভাবে নির্যাতিত হয়েছেন- সেই করুণ কাহিনী ঘিরে আস্ত একটা উপন্যাস লেখা যায়। যেহেতু তিনি সরকারি কমিউনিস্ট নন, সেহেতু সরকারি কমিউনিস্ট পরিচয় দিয়ে নিজের আখের গোছানো সেই হেডমাষ্টার , তাঁর ধামা না ধরা সহকর্মীর সার্ভিস বুক নষ্ট করে দিয়েছিলেন।সহকর্মীটি যাতে অবসরকালীন কোনো সুযোগ সুবিধা না পান, এমন কি পেনশনটুকু ও তাঁর না জোটে , সেজন্যে সেই হেড মাষ্টারের আন্তরিক প্রয়াসে প্রয়াসী হয়েছিলেন , হেড মাষ্টারের ই সহকর্মী নামক কিছু ভৃত্য।
আকুরটাকুরের মানুষটি ইতিহাস পড়াতেন।তা বলে সেকালের পড়াশুনার ধাঁচ অনুযায়ী ইংরেজি বা ভূগোল ই শুধু নয়, অঙ্ক শাস্ত্র কেও গুলে খেয়েছিলেন।ইস্কুলে সে সব বিষয়ে কখনো কখনো ক্লাস ও নিতেন।তবে ছাত্রদের সঙ্গে ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বড় নরম মনের মানুষ। ফলে অনেকেই তাঁর পড়া খুব একটা মন দিয়ে শুনত না।আর যেহেতু স্বয়ং স্কুলের হেডমাষ্টার , তাঁর এই সহকর্মীটি সম্পর্কে ছাত্রদের কাছে অবজ্ঞা সূচক কথা বলতেন, তাই বেশিরভাগ ছাত্র ই সেই ঋষি তুল্য শিক্ষকটিকে পরোয়া করতো না।তবে তাঁর বিরুদ্ধে হেডমাষ্টার যত ই ছাত্রদের উসকে দেওয়ার চেষ্টা করুণ পা কেন, আকুটাকুরের সেই মানুষটির শান্ত, আটপৌরে অথচ ঋজু , দৃঢ় ব্যক্তিত্বে এমন একটা কিছু ছিল যে, হেডস্যারের শত উস্কানি স্বত্তেও ছাত্রদের মধ্যে কেউ কখনো সেই শিক্ষককে এতটুকু অসম্মান করে নি।অমর্যাদা করে নি।ক্লাসে দুষ্টুমি করেছে।ক্লাসে অমনোযোগী থেকেছে।তা বলে ধুতি - পাঞ্জাবী পরিহিত, ফর্সা টকটকে গায়ের রঙ।একটু রেগে গেলে, ফর্সা মুখটা একদম লাল টকটকে হয়ে যেত।
                          সরকারি বাম পরিচয় খাটিয়ে হেডমাষ্টার ' তাসের দেশ' কায়েম করলেন ইস্কুলে। প্রেয়ার লাইন শুরু হওয়ার আগে , ঘন্টা বাজলেই গেট বন্ধ হয়ে যাবে। ছাত্র - শিক্ষক কেউ ই আর ঢুকতে পারবে না আইনত।কিন্তু হেডস্যারের পছন্দের তালিকায় থাকা ছাত্র, যাদের মায়েরা মাঝে মাঝেই হেডস্যারের ঘরে ঘিরে রাজনীতি, সমাজনীতি নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা করেন, সেই সব মায়েদের সন্তানেরা বা প্রধান শিক্ষকের পছন্দের তালিকায় থাকা সহ শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এই নিয়মের ব্যতিক্রম ছিল অবশ্য ই ভালোরকম ভাবে।
আকুরটাকুরের সেই মানুষ টি প্রায় তিন কিলোমিটার হেঁটে , রেল লাইন পার হয়ে ইস্কুলে আসতেন।কদাচিৎ তাঁকে রিক্সা চাপতে দেখা গেছে। অটোর চল তো তখন হয় ই নি।সেকালের মানুষেরা কেবলমাত্র সাশ্রয়ের জন্যে হাঁটতেন না।হাঁটা টাকে তাঁরা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় শারীরিক ব্যায়াম বলে মনে করতেন।
মানুষটি কিন্তু নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই ইস্কুলে আসতেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন প্রেয়ার লাইন সবে শুরু হয়েছে।ছেলেরা লাইন দিয়ে দাঁড়াতে শুরু করেছে।হেডমাষ্টারের বশংবদ আঁকার শিক্ষক হারমোনিয়ামে সুর ধরবেন আর কী। হঠাৎ বজ্রকন্ঠ, বাঁশদেওওও।
গোটা প্রেয়ার লাইন নিস্তব্ধ। একদা আকুরটাকুর নিবাসী সেই ক্ষণজন্মা শিক্ষকের হুঙ্কারে।দারোয়ান নির্ধারিত সময়ের একটু আগেই স্কুল গেট বন্ধ করে দিয়েছে। 
হেড মাষ্টার একটু আগেই টিচার্সরুমে ঢুঁ মেরে দেখে এসেছিলেন, তাঁর শত্রু আসেন নি।হয়ত তাঁকে জব্দ করতেই ' বাঁশদেও' , ইস্কুলের দারোয়ান , ' মালিকে' র হুকুম তামিল করেছে মাত্র।
আকুরটাকুরের সেই মানুষটি অবসর নেওয়ার পর থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পেনশন পান নি সেই সরকারি বাম বলে দাবি করা হেডমাষ্টারের ব্যক্তি প্রতিহিংসার জন্যে।তাবলে ছাত্রদের প্রতি দায়িত্ববোধে আকুরটাকুরের মানুষটির কোনো খামতি ছিল না।সেই আটের দলকে তিনি ইতিহাস পড়তে আগ্রহী ছাত্রকে পরামর্শ দিয়েছিলেন পন্ডিত নেহরুর ' গ্লিমসেস অব ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি' পড়তে।যখন বামপন্থী শিবিরেও সর্বস্তরে আন্টনি গ্রামশি কে নিয়ে খুব একটা চর্চা শুরু হয় নি, সেইরকম সময়ে উৎসাহী ছাত্রদের তিনি গ্রামশ চিনিয়েছিলেন। ই এম এস নাম্বুদ্রিপাদের লেখা ' মহাত্মা অ্যান্ড হিজ ইজম' পড়তে পরামর্শ দিতেন ছাত্রদের।রাউল ফক্সের সঙ্গে পরিচিত করেছিলেন ছাত্রদের।আবার সেই কালেই পি এন ওক নামক এই ভুঁইফোড়ের তাজমহল নিয়ে হিন্দুত্ববাদী তত্ত্ব সম্পর্কে সচেতন করেছিলেন।ছাত্রদের কাছে হরক্কা সভ্যতা বোঝাতে রমেশচন্দ্র মজুমদার নন, এ এল ব্যাসাম ছিলেন তাঁর আদর্শ।
                   জীবনের শেষ পর্বে রোগশয্যায় শুয়ে একটাই পরিতাপ করেছিলেন, কোনো আর্থিক নিরাপত্তা নেই। তাঁকে তাঁর ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা হেড মাষ্টার তখন সরকারি দলের অন্যতম জেলা নির্ধারক।জেলা কেন , প্রায় গোটা রাজ্যের অঘোষিত শিক্ষামন্ত্রী।
শিক্ষক দিবস অতিক্রান্ত। বড্ড মনে পড়ছে তাঁকে।সুচারুশরণ বাগচি। বাম আমল, যখন সরকারি বাম না হওয়ার জন্যে তিনি বাম হয়ে ওঠা হেডমাষ্টারমশাইয়ের চরম হেনস্থার শিকার, তখন কিন্তু তাঁর ছেড়ে আসা দলের বিধায়ক আপন সহোদর।সেই দল তখন শাসক শরিক।
একটিবারের জন্যেও নিজের সহোদরের কাছেও নিজের ব্যক্তি সমস্যার কথা বলেন নি সুচারুবাবু। ব্যক্তি সম্পর্ক আর আদর্শবোধ-- এই দুটোকে কখনো মেশান নি।তাই ই চরম আর্থিক কষ্টের ভিতরে শেষ জীবনটা কাটিয়েও মেরুদন্ডটা সোজা রেখেই মুক্তারপুর শ্মশানে পঞ্চভূতে তিনি মিশে গেছেন।যেখানে একদিন মিশেছিলেন তাঁর একদা কমরেড, সমরেশ বসু।
প্রণাম সুচারুশরণ বাগচি। আপনি, আপনারা ছিলেন বলেই আজ ও আমরা বেঁচে আছি।

  • সম্পাদকীয়