এক : ছয় দশক ও বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
কবি, কথাসাহিত্যিক ও চলচিত্র নির্মাতা বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত (১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪ – ১০ জুন ২০২১)কথাসমগ্র ১-এর মুখবন্ধ ‘অসহায় আকুলতা’-য় সংবেদনশীল মানুষের যাপনের সঙ্কটের ভাষ্য তৈরি করেছেন –
কথা যে কখন শুরু হয় আর কখনইবা শেষ হয় তা বলা মুশকিল, কখনও কখনও কথা শেষই হয় না। এই শুরু হওয়া আর শেষ হওয়ার মাঝখানে লুকিয়ে থাকে আমাদের আসল কথা। ‘ফেরা’ ছবিতে যে লোকটি গাছে চড়ে বসে থাকে আর নামতেই চায় না সে তার মালিককে বলেছিল, ‘আপনার সঙ্গে আমার আসল কথা হয় নাই।’ মালিক বলে, ‘আসল কথা কী? আসল কথা মানে কী?’... অথচ তারা একসঙ্গে থেকেছে কতকাল। এইভাবে একসঙ্গে থাকাথাকির পরেও বা না থাকাথাকির আগেও আমাদের অনেকেরই আসল কথা আর বলা হয় না। নানা সময়ে নানান ভাবে কথা বলতে গিয়ে আসলে বারবার সেই আসল কথাটাই আমি বলতে চেয়েছি।১
কবি মণীন্দ্র গুপ্ত ‘ষাট দশকের কবিতা’ প্রবন্ধে লিখেছেন – রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য তিনের দশকের কবিরা সমবেত হয়েছিলেন, সমাজবাদী সাহিত্যাদর্শের বিশ্বাস বা ফ্যাশন চারের দশকের কবিদের একত্রিত করেছিল। পাঁচের দশকের কবিদের সেরকম উত্তুঙ্গ প্রতিবন্ধক বা বিশেষ সাহিত্যাদর্শে বিশ্বাস না থাকলেও তাঁরা কেবল বন্ধুত্বের টানে একত্রিত হয়েছিলেন, হয়তো সাধারণের মধ্যে হারিয়ে না যাওয়ার প্রতিষেধক হিসেবে এই পথচয়ন করেছিলেন। ছয় দশকে এসব কিছুই ছিল না। তাঁদের সামনে না ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, না ছিল কম্যুনিস্ট ভাবাদর্শের জোয়ার, বা না কোনও গাঢ় বন্ধুত্বের আহ্বান। স্বাভাবিক, ঘরোয়া, মধ্যপন্থী মানুষদেরই সমবায় এই ছয়ের দশকের সাধারণ চিত্র, ব্যতিক্রম যে নেই তা অবশ্য নয়। দলবদ্ধ হওয়ার জন্য পূর্ববর্তী দশকগুলোর মতো ছয়ের দশক কোনও আনুকূল্য পায়নি, বরং আরও কিছু সূক্ষ্ম প্রতিকূলতা ছিল। অনেকসময় কোনও বড়ো মাপের প্রতিষ্ঠান বা প্রতিপত্তিশালীর অনুগ্রহও সৃষ্টিশীলদের এক-ছত্রছায়ায় আশ্রয় দেয়। পাঁচের তুলনায় ছয়, এসব আনুকূল্যের কিছুই পায়নি। দিলীপকুমার গুপ্তের মতো ‘উদার সহায়ক’ তার ছিল না, ছিল না বুদ্ধদেব বসুর মতো ‘বৎসল অনুগ্রাহক’, সর্বোপরি আনন্দবাজার প্রতিষ্ঠানের মতো ‘পরিপালক ও দুর্গ’। অনেকে প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষণ অস্বীকার করেছেন। যোগ্যতা অনুযায়ী প্রাপ্য প্রচারও তাঁরা পাননি।পাঁচ যেন সম্পূর্ণ সমকালীন সমস্ত ‘কামধেনুগুলি’ নিঃশেষিত করে রেখেছিল। ‘প্রতিভা’, ‘শেষ নিয়ামক’ হলেও পরিস্থিতির সঙ্কোচনও অনেকদিন ধরে অনেক কিছু ম্লান করে রাখতে পারে। কার্যত ‘পরিস্থিতি বা সুযোগ বা নিজস্ব মেজাজ’ কিছুই ছয় দশকের কবিদের একত্রিত হওয়ার অনুকূলে ছিল না। একমাত্র সময়সীমার চারপাশ ছাড়া তাঁদের একসঙ্গে চিহ্নিত করার আর কোনও ভূমি নেই। কিন্তু এই সময়সীমানার মাপও সবসময় গ্রাহ্যের সীমায় আসেনি। পাঁচের দশকে আত্মপ্রকাশকারী কয়েকজন কবি স্বেচ্ছানির্বাচনের পথে ছয়ের দশককে বেছে নিয়েছেন, তেমনি ছয়ে লিখতে শুরু করেও কেউ কেউ নিজেদেরকে প্রয়োজনবোধে সাতের কূলে ভিড়িয়েছেন। তাছাড়া ছয় দশকের কবিদের বয়ঃসীমার ফারাক অল্প নয়। যেমন –কবিরুল ইসলাম বা সত্য গুহর সঙ্গে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বা ভাস্কর চক্রবর্তীর পুরো এক দশকের ব্যবধান। এ সকল বৈশিষ্ট্য ছয় দশকের সামগ্রিক কাব্যচরিত্র এবং রুচিতে বিস্তৃতির সঙ্গে একটা অসামঞ্জস্য এনেছে। ছয়ের কবিগোষ্ঠী কার্যত ‘দলহীনদের একটা দল’। তাঁদের চরিত্রের কোনও সামগ্রিক রূপ বা কবিতার কোনও মূল সুরের অনুসন্ধান কার্যত সম্ভবপর নয়। তবে এটাও লক্ষণীয় যে ছয় দশকের কবিদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে তাত্ত্বিকতার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তাঁরা অনেকেই মননশীল সুধীন্দ্রনাথের দ্যুতিকঠিন বৈদগ্ধ্যে উপাসকের মতো আকৃষ্ট হয়েও জীবনানন্দের মানবতার বোধে আবিষ্ট হয়েছিলেন। মুখ্যত এই ‘দুরূহতাকামী কবিরা’ পাঁচের ‘স্মার্ট সাংবাদিক তরলতায় বিরক্ত’ হলেও নতুন কোনও গভীর সৃষ্টির সামর্থ্য না থাকায় শুধুই ‘প্রতিক্রিয়াবশত’ তাঁরা তিন ধাপ পিছিয়ে গিয়ে সমকালীন উপস্থিতিকে অস্বীকার করে তিনের দশকের ‘মননশীল ধ্রুপদীয়ানা’র অনুরাগী হলেন। এই গ্রহণ-বর্জনের ক্ষেত্রে ‘ব্যক্তিগত রুচি, বিপ্রকর্ষণ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষাও’ অবশ্যই কার্যকরী হয়েছিল।২
ছয় দশকের প্রধান কবিরা হলেন – পবিত্র মুখোপাধ্যায়, মঞ্জুষ দাশগুপ্ত, তুষার রায়, কালীকৃষ্ণ গুহ, দেবারতি মিত্র, ভাস্কর চক্রবর্তী, সামসুল হক, শামসের আনোয়ার, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, বিজয়া মুখোপাধ্যায়, বিনোদ বেরা, মণিভূষণ ভট্টাচার্য, রত্নেশ্বর হাজরা, শম্ভু রক্ষিত, মলয় রায়চৌধুরী, পুষ্কর দাশগুপ্ত, পরেশ মণ্ডল, সমীর রায়চৌধুরী, গীতা চট্টোপাধ্যায়, সমীর রায়, জিয়াদ আলি, প্রণব চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণা বসু, রাণা চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ ঘোষ হাজরা, অরুনেশ ঘোষ, সমীর চট্টোপাধ্যায়, কমলেশ সেন, রবীন সুর, অনন্ত দাশ, অর্ধেন্দু চক্রবর্তী, মৃণাল বসু চৌধুরী প্রমুখ। প্রতি সময় পরিধির তাৎপর্যপূর্ণ কবিদের সেই সময়ের একটি ‘চরিত্র’ তৈরি করে দেওয়ার ক্ষমতা থাকে। ছয় দশকের কবিরা যোগ্যতা বা দক্ষতায় পিছিয়ে না থাকলেও পরাক্রান্ত পাঁচ দশকের কবিদের পরেছয় দশকে তাঁদের সেই ‘চরিত্র’ হয়ে ওঠার প্রবণতা যথেষ্ট দেখা যায়নি। শুধু সৎ প্রচেষ্টার কর্ম নয়, কবিতায় অসামান্য হয়ে ওঠার পিছনে যে আরও অতিরিক্ত রসায়ন কার্যকরী তা হয়তো অনেক লেখালেখির মূল্যে, সময় থেকে দূরবর্তী হয়ে তাঁরা কেউ কেউ বুঝছিলেন।৩
দেশকালের সংক্ষুব্ধ দিনযাপন অথবা মৃত্তিকালগ্ন শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম ও শান্তিপ্রবাহ নিয়ে ছয় দশকের গুটিকয়েক কবিই লিখেছেন, ‘চিন্তাস্পৃষ্ট এবং আত্মনিবিষ্ট কবিতা’ রচনায় এই দশকের কবির মূল আগ্রহ ছিল। চল্লিশের সাম্যবাদী ভাবপ্রবাহ ততদিনে স্তিমিত, প্রাচীনদের স্বাদেশিকতায়ও উদ্বুদ্ধ হওয়ার সময় তখন নয়। ছয় দশকের কবিদের পঞ্চাশের আত্মপ্রাধান্যময় কবিতার আবহাওয়া ঘিরে ছিল। ইতিহাসের অনেক বঞ্চনার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের মুক্তিসংগ্রামগুলির প্রতি ছয় দশকের কবিদের ‘অবিশ্বাস ও অনীহা’, ‘বৈরাগ্য ও সন্দেহ’ অযৌক্তিক ছিল না। দেশবিভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, উদ্বাস্তু সমস্যা ইত্যাদি ঘটনার চাপ পাঁচ দশকের কবিদের উপর অবশ্যই বেশি থাকলেও তাদের মনে একটি স্মৃতির বিচরণভূমি ছিল। ছয় দশকের উদ্বাস্তুদের তো সেটুকুও ছিল না। ছয় দশক উত্তরাধিকাররূপে পেয়েছে ‘পূর্বপুরুষের বিচ্যুতি’, ‘রাজনৈতিক শঠতা’, ‘ধূসর ভবিষ্যৎ’। ‘দূরবিসর্পী শূন্যতা, কেবল শূন্যতার’ মধ্যে ছয় দশকের কবিদের বেড়ে ওঠার চিহ্ন কবিতাগুলিতে লগ্ন। কাজেই এই অবস্থার চাপে কবিতা ‘পাংশু, নিরালম্ব ও অশক্তমুষ্টি’ হতে বাধ্য হলেও তাকে দোষ দেওয়া এক অর্থে অবিচার করা।৪
এই ভয়ঙ্কর চাপ তরুণদের ক্ষেত্রেও অন্তিম নিয়ামক হবে কি না সে সম্পর্কে কবি মণীন্দ্র গুপ্ত প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি উত্তর অনুসন্ধান করে লিছেছেন –
ষাট-সত্তরের সেই সন্ত্রাস – সেই প্রচণ্ড দিনরাত – সেই বীর্যবান, অসহিষ্ণু, মূর্খ প্রাণগুলির ক্রোধ এবং দুঃখ – সমবয়সী হওয়া সত্ত্বেও ‘ষাটে’র কবিরা কী করে এদের সংক্রমণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারলেন নিজেদের! ইতিহাসচেতনা, সময়চেতনা এ সব কি তা হলে কথার কথা মাত্র? এই ক্লৈব্য, হৃদয়হীনতা ও মনুষ্যত্বের অপস্মার থেকে ‘ষাটে’র কবিতাকে বাঁচিয়েছেন মণিভূষণ ভট্টাচার্য, অনেকখানি দেবদাস আচার্য ও বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, এবং কিছুটা রবীন সুর ও শম্ভু রক্ষিত।৫
ছয় ও সাত দশকের বিশ্ব ও বাংলার প্রেক্ষিতে কয়েকটি প্রাসঙ্গিক সাল ও ঘটনা আমরা উল্লেখ করতে পারি। ১৯৬১ -এর জানুয়ারিতে বুদ্ধদেব বসুর অনূদিত ও সম্পাদিতশার্ল বোদলেয়ার : তাঁর কবিতা, ফেব্রুয়ারিতে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের হে প্রেম হে নৈঃশব্দ, সেপ্টেম্বরে রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরীর কাব্যগ্রন্থ ‘আরশিনগর’, ডিসেম্বরে মলয় রায়চৌধুরীর ‘হাংরি জেনারেশনের ইস্তাহার’ প্রকাশিত হয়। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে মার্টিন হাইডেগারের Being and Time (Sein und Zeit১৯২৭) অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়। ১৯৬৩ জানুয়ারিতে বিষ্ণু দে সম্পাদিত একালের কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হয়। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ মে নকশালবাড়ির সহিংস আন্দোলন সূচিত হয়। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১ মে কমিউনিস্ট পার্টি এম এল গঠিত হয়। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব বাংলায় (পাকিস্তান) ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান ও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভের পরে স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ গুরুত্বময় ঘটনা। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চ স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতীয় কবিতা পর্যায়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত বাংলা কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়। ১৯৭৫ -এর ২৬ জুন সারা ভারতে জরুরি অবস্থা জারি হয়। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজীবের হত্যাকাণ্ড একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের পালাবদলের ইতিহাসকে ধারণ করে রয়েছে।৬
সাতের দশক বাংলা আধুনিক কবিতার ইতিহাসে ‘একটি গুরুত্বপূর্ণ কালখণ্ড’, ‘স্বতন্ত্র ইতিহাস’! এই ইতিহাস একসঙ্গে শৌর্য ও সচেতন রাজনৈতিক আদর্শবাদ ও চোরগোপ্তা ভ্রাতৃঘাতীনগ্ন নিন্দনীয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের। এটি একসঙ্গে স্বপ্ন-সততা-বিশ্বাস ও অন্তর্ঘাত-আদর্শচ্যুতি-গুমখুন-থার্ডডিগ্রির। এই ইতিহাস অবিস্মরণীয় আবেগ ও বিপ্লবের নামে ভয়াবহ অতিরেকের। যেন ঘরে-বাইরে মুক্তিযুদ্ধ। পূর্ব-পাকিস্তান থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্ম আসন্ন। পরস্পরবিরোধী বর্ণময় ও বিচিত্র এই সময়ের কবিতাও স্বভাবত ‘বর্ণিল আর বৈচিত্র্যমণ্ডিত’। সামাজিক, আর্থ-রাজনৈতিক স্তরের পরিবর্তনের ধাক্কায় সাহিত্যের স্থিতাবস্থা নষ্ট হয়। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে এই সময়নির্মাণ ও সৃষ্টির স্পষ্ট বাঁক, প্রচণ্ড চাপের মধ্যে কবিতার নতুন কণ্ঠস্বর শোনা যায়। কবিতার মতো রোমাণ্টিক বিপ্লবের অমলিন স্বপ্নে পশ্চিমবঙ্গে বিপ্লবের এই দশকে কবিতার মধ্যেও ‘বিষয় ও প্রকরণের প্রকাশ্য বিপ্লব’ দেখা যায়।৭
দুই : হিমযুগ কাব্যগ্রন্থ ও পৃথিবীর কথা
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের প্রথম কাব্যগ্রন্থ গভীর এরিয়েল-এ (১৯৬৩) কিছু কিছু কবিতা সমরেন্দ্র সেনগুপ্তর কবিতার দ্বারা ঈষৎ প্রভাবিত ছিল। তখনও বুদ্ধদেব তাঁর স্বকীয় কণ্ঠস্বর আবিষ্কার করে উঠতে না পারলেও তার কিছুদিন পরে কবি নিজস্ব স্বরগ্রাম খুঁজে পান। তখন থেকে তিনি যে কবিতা রচনা করেছেন তা বিশিষ্ট স্বকীয়তামণ্ডিত। কবি বুদ্ধদেবের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ কফিন কিংবা সুটকেস-এ তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনদর্শন বহুলাংশে প্রতিষ্ঠিত পেয়েছিল। তাঁর তৃতীয় কবিতার বই হিমযুগ-এ (১৯৭৭)এই দৃষ্টিভঙ্গির আরও অনেক স্বচ্ছতা ও বলিষ্ঠতা প্রকাশ পেয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থের সমালোচনা করে পত্রিকা সম্পাদক কবি-অধ্যাপক প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত ‘হিমযুগ: বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত’ প্রবন্ধে(অলিন্দ, গ্রীষ্ম সংকলন, ১৩৮৫) ছয় দশকের কবিদের মধ্যে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তকে একটি বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী, ‘একজন প্রধান কবি’ রূপে স্বীকৃতি দিয়েছেন।৮
পাঁচ দশকের প্রতিষ্ঠিত ও উল্লেখযোগ্য কবিদের একজনের সঙ্গে অন্যজনের কবিতার স্বাতন্ত্র্য থাকলেও ‘পরোক্ষ এবং প্রচ্ছন্ন রোমান্টিকতা’র সূত্র তাঁদের প্রত্যেকের কবিতার মধ্যেই আভাসিত হয়েছিল। পাঁচ দশকের কবিতা থেকে বুদ্ধদেবের কবিতার গুণগত পার্থক্য হল তাঁর কবিতা ‘প্রায় সর্বাংশেই অ-রোমান্টিক’। বুদ্ধদেব দীর্ঘদিন আগে থেকেই সচেতনভাবে এই ঘরানাকে পরিহারের সঙ্গে সঙ্গেই বিকল্প একটি কাব্যধারণাকে পাঠকের কাছে উপস্থিত করেছেন। জীবন ও পৃথিবী সম্পর্কে বুদ্ধদেবের কোনও বিভ্রম বা মায়াহীন(illusion)ধারণাকেই কবি প্রণবেন্দু ‘অ-রোমান্টিক’ বলে উল্লেখ করেছেন। কবি বুদ্ধদেব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জীবনকে বিশ্লেষণ করতে শিখেছেনযেন কোনও অবস্থাতেই তিনি মোহগ্রস্ত হতে প্রস্তুত নন।৯
সাধারণত সৃষ্টিপর্বের সূচনায়কবির কাব্যে রোম্যান্টিক কল্পনার স্বপ্নাঞ্জন, নিসর্গ-সৌন্দর্যের মায়াপ্রভাববিস্তার করে থাকে তা কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায়। গভীর এরিয়েল-এর ‘ব্যক্তিগত লেখা’ রোম্যান্টিক, গীতল, মায়াময়, স্বরাবিষ্ট। দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ কফিন কিংবা সুটকেশ থেকে তাঁর কবিতায় প্রসঙ্গ ও প্রকরণ বা ভাব ও রূপে এক মৌল পরিবর্তন ঘটে যায়। তাঁর কবিতায় কখনও প্রত্যক্ষ বর্ণনায় ও বিবৃতিতে, কখনও পরোক্ষ কৌশলে, রূপক বা ফ্যান্টাসির আধারে সমীপ দেশকালের অভিজ্ঞান গভীরভাবে মুদ্রিত হয়। রোম্যান্টিক স্বপ্নকল্পনার ক্রমক্ষীয়মান প্রবণতার সঙ্গে কবি প্রায়শই বাস্তবাতীতের সঙ্গে মিলিয়ে, ফ্যান্টাসির আপাত-অসম্ভবের ঘুরপথে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাজাত বাস্তবকে ধরতে চেয়েছেন, যাতে বাস্তবের বাইরের চেহারার মধ্যে অন্তঃসত্যকে চিনে নেওয়া যায়। মধ্যবিত্ত জীবনে বেঁচে থাকার অর্থহীনতা, পারিপার্শ্বিক জগতের অসঙ্গতি, বিভ্রান্তি, বিচ্ছিন্নতা, যন্ত্রাশ্রয়ী মসৃণ দিনযাপনের নিষ্প্রাণতা, দিনানুদৈনিকের কৃত্রিমতা ও অভ্যাসজীর্ণ একঘেঁয়েমি, প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির সামনে নিরুপায়তার মধ্যেইকবির আন্তরিক সংবেদনা ও গভীর জীবন সংসক্তি লক্ষ করা যায়। তাই তাঁর রচনায় বারে বারে উঠে আসে সত্তরের দশকের নতুন জগৎ ও জীবনের স্বপ্নমুগ্ধ কৈশোর ও তারুণ্যের সংগ্রাম, দ্রোহ ও আত্মাহুতি প্রচ্ছন্ন, অর্ধপ্রচ্ছন্ন বা প্রকটভাব। একটু ছড়ানো-ছিটোনো, পরস্পর-বিচ্ছিন্ন বর্ণনা বা চিত্রের ঈষৎ-আল্গা ধরন কফিন কিংবা সুটকেশ (১৯৭২) কাব্যগ্রন্থে প্রকাশ পেয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থে বুদ্ধদেব ক্যাজুয়াল কথালাপের ভঙ্গিটিকে প্রায়শই আশ্রয় করেছেন। হিমযুগ-এ বুদ্ধদেবের উপস্থাপন সংহত, আঁটো, অনেকাংশে একাগ্রহয়ে প্রায়শই তা রূপকের দ্ব্যর্থকতায় ভর করেছে। কবি মানুষকে মনুষ্যেতর প্রাণীর চেহারায় বা অংশকে সমগ্রের প্রতিভূ হিসেবে ধারণা বা কল্পনা করে কখনও দেখেন, মানুষের অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গগুলিকে বা মানুষের ব্যবহৃত নানা বস্তুসামগ্রীকে অতিশয়িতরূপে একটা স্বাধীন, স্বয়ংবশ সত্তায় মানুষের অসঙ্গত, দিগ্ভ্রষ্ট আচরণের সূচকরূপে উপস্থিত করেন। এই রূপকাশ্রয়ে প্রায়শই একটা ছক যেন উঠে এল।১০