পরহিতব্রতী 

কিছু মানুষের জন্মই হয় পরহিতের জন্যে। নিজেকে শুধু নয়, অন্যের জন্যেও ভাবেন তাঁরা। সেই যে খুব ছোটবেলায় পড়েছিলাম, “আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে, সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। “ (কামিনী রায়)

আজও ভুলিনি কবিতার এই কথাগুলো। যা একদা পড়েছি বারবার, পড়তে পড়তে মুখস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু এর মর্মকথা কি বুঝেছি? বোধহয় না। বইয়ের ভাল ভাল কথাগুলো জীবনে প্রয়োগ না করতে পারলে সে তো কেবল কথাই রয়ে যায়! তবে নিজের জীবন দিয়ে সেইভাবে আত্মস্থ করতে না পারলেও আমি আমার এই ছোট্ট জীবনে অসংখ্য না হলেও কিছু মানুষকে তো অন্তত দেখেছি প্রচারের আড়ালে থেকে মানুষের সেবা করে যেতে। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে জানতে পারি কোথায় কোন ডাক্তার এক টাকার ফি নিয়ে রোগী দেখে গিয়েছেন সারাজীবন। একজনকে দেখেছি একা হাতে একটা পুকুর খনন করতে। পরার্থে নিবেদিত এমন সব মানুষের মতো আরও অনেকে আছেন, যাঁদের খবর আমরা তেমন করে পাই না। আজ একটা তথ্যচিত্র দেখে প্রচারের আড়ালে থাকাতে আরেকজনকে জানলাম। তাঁর নাম রাজীব দাস। তথ্যচিত্রটি (বিন্দুর পাঠশালা) তৈরি করেছেন শান্তনু সাহা। 

বিন্দু আসলে রাজীবের ডাকনাম। মূলত পরিচালকের আমন্ত্রণেই এই ছবিটা দেখতে গিয়েছিলাম। ৩৫ মিনিটের এই ছবিতে শান্তনু তুলে ধরেছেন একজন অসামান্য মানুষকে, যিনি সাতাশ বছর বয়সে (২০০৮) স্কুলের চাকরি নিয়ে ঝাড়্গ্রামের এক অখ্যাত গ্রাম বাঁশতলায় গিয়েছিলেন। মনে রাখা দরকার জায়গাটা ছিল পুরোপুরি মাওবাদী অধ্যুসিত, যেখানে তার কিছুদিন আগে একটি ট্রেন পুড়িয়ে দিয়েছিল দুষ্কৃতিকারীরা। এমনই একটি জায়গায় চাকরি করতে গিয়েছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার পালপাড়ার এই যুবক। ওখানে গিয়ে তিনি পেয়েছিলেন একটি ভগ্নপ্রায় স্কুলবাড়ি, ছাত্র ছিল বটে, কিন্তু সেও না থাকার মতো। ওই গ্রামটির মূল বাসিন্দা হল লোধা ও শবর শ্রেণিভুক্ত আদিবাসী। এতশত দেখেও তিনি কিন্তু পালিয়ে আসেননি, মাটি কামড়ে ওখানে পড়ে থেকে ওখানকার গ্রামবাসীদের প্রকৃত শিক্ষা দিতে বদ্ধপরিকর হয়েছিলেন। এমন একটি চ্যালেঞ্জ নেওয়ার দুঃসাহস তিনিই নিতে পারেন যাঁর চিত্ত পুরোপুরি ভয়শূন্য। যিনি আপন গরিমায় চলতে পারেন মাথা উঁচু করে। মনের জোর ও আপন কর্মদক্ষতায় প্রকৃতপক্ষে ওই ঊষর মরুভূমিতে তিনি ফুল ফুটিয়েছিলেন। শুধুমাত্র ছোটদের নয়, বড়দেরকেও তিনি স্বাক্ষর করে তুলতে পেরেছিলেন। 

বিশেষভাবে উল্লেখ্য গৃহকর্ম সেরে যেসব বয়স্ক নিরক্ষর মানুষদের তিনি স্বাক্ষর করে তুলেছিলেন তাঁদের মধ্যে একজনের বয়েস ছিল ৭২। এছাড়া অন্য ছেলেমেয়েদের রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাদর্শে পাঠ্যবই বহির্ভূত কিছু শিখিয়ে প্রকৃত মানুষ করে তুলতে উদ্যমী হয়েছিলেন। শিখিয়েছিলেন নাচগান আর নাটকের মধ্য দিয়ে ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’র কবিতার মর্মার্থ। তাঁর সাদর আহ্বানে সাড়া দিয়ে পরবর্তী সময়ে কলকাতা থেকে তাঁর পরিচিত সেবাব্রতী কয়েকজন ওখানে গিয়ে তাঁদের স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে ওইসমস্ত মানুষদের আলোকিত করে এসেছেন। পরিচালক শান্তনু সাহা মানুষটির খবর পেয়ে ওখানে গিয়ে অসীম ধৈর্য্য তাঁর কর্মকাণ্ডকে ক্যামেরায় ধরে রাখেন। 

ইতিমধ্যে আসে কোভিড পর্ব। শান্তনুর কাজও থেমে যায়। পরম দুর্ভাগ্যের ব্যাপার ২০২১ সালের একুশে এপ্রিল ওই পরহীতব্রতী জীবদাসের অকালমৃত্যু ঘটে। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে ওই মানুষটির প্রয়াণে শান্তনুর ছবি তৈরির অভিমুখ বদলে যায়। 

অচিরেই তিনি আবার সেই গ্রামে যান এবং গ্রামবাসীদের সঙ্গে নানাভাবে কথা বলে জানতে পারেন কী অপরিসীম দরদ ও নিষ্ঠা দিয়ে রাজীব দাস ওই অখ্যাত গ্রামের মানুষদের মধ্যে শিক্ষা তথা সংস্কৃতির আলো পৌঁছে দিয়েছিলেন। 
     
আসলে রাজীব শুধুমাত্র কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যায় শিক্ষিত ছিলেন না। তাঁর মধ্যে ছিল একধরনের সেবাব্রতী মনোভাব এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তাঁর ভিতরকার নাট্যসত্ত্বা। তাই শুধু বইয়ের বিদ্যা নয়, ওইসব হতশ্রী মূঢ় ম্লান মুখে তিনি যোগান দিতে পেরেছিলেন আত্মোপলব্ধির ভাষা। তাঁরা নাটক করেছিল, নাচ ও গান শিখে, ব্রতচারীদের আদলে রপ্ত করেছিল বিবিধ শারীরিক কসরত। কয়েক বছরের অক্লান্ত চেষ্টায় নিবেদনে রাজীব ওই গ্রামে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করে এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত তৈরি করেন।

পরম দুর্ভাগ্যের কথা, মাত্র চল্লিশ বছর বয়সেই রাজীবের জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। অন্যদের সেবা করতে গিয়ে নিজের দিকে তাকান নিজে! তাঁর অকালমৃত্যুতে ওই গ্রামে নেমে আসে এক শোকের ছায়া। সমস্ত গ্রামবাসী অশৌচ পালন করেন। রাজীবের কথা বলতে গিয়ে ক্যামেরার সামনে যখন ওই গ্রামের মানুষের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে, তখন আমার চোখের পাতাও ভিজে আসে। বিন্দুর পাঠশালা মানুষের ভিতরকার মনুষ্যত্বকে এইভাবেই জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। 

আসলে রাজীবের মতো অনেক রাজীবকে যে আমি দেখেছি। আমি আমার মধ্যেও একজন রাজীবের উপস্থিতি টের পাই। ১৯৯৪ সালে মে মাসে আমরা হৃদয়পুরে আসি। আমরা বলতে আমি, অরুণিমা এবং আমাদের একমাত্র কন্যা রাকা। এখানে এসে দেখি আমাদের চারপাশের মানুষজন সেই অর্থে অনেকটাই পিছিয়ে পড়া।
 
তারপর কী ভেবে যেন আশপাশের কয়েকজন শিশুকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে এসে গান শেখাতে শুরু করি। গান থেকে নাটক, নাচ, ছবি আঁকা এবং আরও কত কী! টানা এগারো বছর চালিয়েছিলাম আমার সেই সাধের প্রতিষ্ঠান ‘আনন্দধারা’। নিজের কথা আর নয়। আমার আজকের উদ্দিষ্ট রাজীব দাস।

তাঁকে নিয়ে ছবিটা দেখতে দেখতে কেন জানি না বড্ড বেশি স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়েছিলাম। মানুষের সেবা করতে গিয়ে নিজের দিকে সেইভাবে না তাকিয়ে যে মানুষটা সেই অর্থে আত্মাহুতি দিলেন, তাঁর সেই মৃত্যুহীন প্রাণ যা তিনি তাঁর মরণের মধ্যে দিয়ে ওই গ্রামের সাধারণ মানুষের জন্যে দান করে গিয়েছেন, তার প্রতি আর কিছু পারি বা না পারি একটি ব্যর্থ নমস্কার তো জানাতেই পারি!

  • সুশীল সাহা